কামরুল হাসান
‘বেজে ওঠে সাইরেন’ লায়লা অাফরোজের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। পেশায় ব্যাংকার লায়লা অাফরোজকে সবাই আবৃত্তিশিল্পী হিসেবেই চেনেন। জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে তার ভেতর কথাসাহিত্যের ফুল ফুটলো এবংতা চমৎকারভাবেই। কবিতা পড়তে পড়তে তার ভেতর তৈরি হয়েছে কবিতাসংলগ্ন এক গদ্য।পরণকথা কথাসাহিত্যের এক সমাবেশ, প্রতিমাসে একটি করে অাসর বসে এর, হয় কাঁঠালবাগানে এর প্রধান অায়োজক কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমানের বাসায়, নয় হাতির পুলের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে। ফেব্রুয়ারির অাসরটি বসলো নতুন একটি জায়গায়, ছায়ানট ভবনের ছাদে। এটি পরণকথার ৩০তম অাসর।
ছায়ানটের ছাদে বসন্তের মনোলোভা সন্ধ্যায় অামন্ত্রিত অতিথি ও পরণকথার সদস্যরা এক এক করে জড়ো হতে লাগলো। কিঞ্চিৎ ফ্যাকাশে সবুজের ম্যাট পেতে অাসন গেঁড়ে বসার ব্যবস্থা, যাদের হাঁটুতে সমস্যা তাদের জন্য নিচু চেয়ার। ছাদের একপাশে কাঠের একটি নিচু মঞ্চ, দু’পাশে দুটি মাইক্রোফোন বক্তার জন্য তৈরি। গুটিয়ে রাখা যায় এমনি চিকন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো পর্দা দুপাশ থেকে নামিয়ে দিতেই তৈরি হলো দেয়াল। তাতে বসন্তের প্রাণজুড়ানো হাওয়া কাটা পড়লেও মাথার উপর লাগানো টেবিল ফ্যানগুলো পুষিয়ে দিল শীতলতার প্রয়োজন। দূরে একটি ভবনে অনেকগুলো রেস্তোরাঁর অতিউজ্জ্বল নিয়ন সাইন বলে দিচ্ছে বদলে গেছে ধানমন্ডি, বদলে গেছে আমাদের চেনা শহরটি।
‘বেজে ওঠে সাইরেন’ এক বোনের দৃষ্টিতে দেখা ভাইয়ের কাহিনী, যে ভাই পিতৃসম। সেসময় বাবারা অল্পবয়সে টুপটাপ মারা যেতেন, বিপুল সংসারের ভার এসে পড়তো বড় ছেলের উপর। লায়লা অাফরোজের এই ভাই কেবল বয়সের ব্যবধানে নয়, দায়িত্বশীলতার বিচারেও পিতৃসম। এটি একটি উপন্যাস, কেননা এখানে একজন নায়ক আছেন, অার এই নায়ক লেখিকার বড় ভাই এটিএম শামসুদ্দীন। কমিউনিস্ট অান্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আজীবন বামপন্থী মানুষটি ছিলেন অকৃতদার। তিনি রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে বাঙালিদের মাঝে সবচেয়ে উঁচু পদে চাকরি করতেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন দৈনিক সংবাদ-এ, অতঃপর কমরেড মণি সিংহের সরাসরি প্রভাবে ঢাকাস্থ রাশিয়ান দূতাবাসে। সেসময়ে বুদ্ধিজীবিদের বেশিরভাগই ছিলেন বামপন্থী, মেহনতি মানুষের মুক্তির যোদ্ধাদেরও জীবিকার জন্য কিছু করতে হয়। দৈনিক সংবাদ, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার এমন কিছু প্রতিষ্ঠানে তারা কাজ পেতেন।
বইটির দুটি পর্ব, প্রথম পর্ব ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১; দ্বিতীয় পর্ব ১৯৭১ থেকে ২০০৯, যে বছর লেখিকার বিপ্লবী ভাই মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সাইরেন বেজে উঠেছিল, দ্বিতীয় সাইরেন বেজে ওঠে ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। বইটির মনোজ্ঞ অালোচনায় একথা বল্লেন অধ্যাপক এম এম আকাশ। তাঁর ও প্রখ্যাত ছড়াকার আকতার হুসাইনের অালোচনার মধ্য দিয়ে উঠে এল ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য। এরা সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, কমরেড। ১৯৭১ সালে লায়লা অাফরোজের বয়স বারো। বারো বছরের একজন বালিকা কীভাবে ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সত্তরের নির্বাচন, ৭ই মার্চ, ২৫শে মার্চ প্রভৃতি দেখছে, তা স্মৃতি থেকে তুলে এনে লেখা এই বই।
এম এম আকাশের আলোচনাটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ অালোচনা, যেখানে বইটির রাজনৈতিক গুরুত্ব, সাহিত্যিক মূল্য সবই উঠে এলো।আকতার হুসাইন স্মরণ করলেন কী করে তাঁর বাবার অকাল মৃত্যুর পর তাকেও এটিএম শামসুদ্দীনেরর মতো বিরাট পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। জীবিকার সন্ধানে তিনিও সংবাদে সাংবাদিকতার কাজ নিয়েছিলেন, ১১ ভাই-বোন ও মায়ের বিরাট পরিবারকে সেময়কার ১৫০ টাকা বেতনে, সে বেতনও ছিল অনিয়মিত, তিনি হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, তার পরিবারকে লিটারালি উদ্ধার করেন এটিএম শামসুদ্দীন, রাশান দূতাবাসে চাকরি পাইয়ে দিয়ে, বেতন একলাফে বেড়ে হয় ৭৫০ টাকা। কৃতজ্ঞচিত্তে এসব স্মরণ করলেন উদীচির প্রতিষ্ঠাতা।
মুক্তিযুদ্ধে দু’ধরণের যোদ্ধা ছিল, কেউ লড়াই করেছে বন্ধুক হাতে প্রত্যক্ষভাবে, কেউ লড়াই করেছে অপ্রত্যক্ষভাবে। এটিএম শামসুদ্দীন এমনি এক অপ্রত্যক্ষ যোদ্ধা যিনি দিল্লী থেকে ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে অাসা মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল গোপনে পৌঁছে দিতেন সঠিক জায়গায়। তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন অারও কয়েকজন যার ভেতরে ছিলেন সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ড. লিয়াকত হোসেন, অধ্যাপক ড. গীতি অারা চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী জিনাত রেহানা, মুক্তিযুদ্ধের জীবন্তভাষ্য সংগ্রাহক হাসান মাহমুদ, দেওয়ান সাঈদুল হাসান প্রমুখ।
পরণকথার ব্যানার ভুলে ফেলে এসেছিলেন, গাড়ি ঘুরিয়ে সেটা অানতে গিয়ে সোয়া ঘণ্টা দেরি হলো সঞ্চালক ও পরণকথার প্রাণ কথাশিল্পী ঝর্না রহমানের। সময় সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন সানুষটি এজন্য অনুতাপ প্রকাশ করলেন। তার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করছিলেন কথাশিল্পী ফরিদুর রহমান।
একটি মনোজ্ঞ অালোচনার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সমৃদ্ধ হলাম। বইটির গুরুত্ব অনুধাবন করে এটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। জিনাত রেহানার খালি কণ্ঠে গান ও অাপায়নের মধ্য দিয়ে শেষ হলো জমজমাট এক অনুষ্ঠান সঙ্গীতালয়ের ছাদে সাইরেন বাজিয়ে।
সংবাদটি শেয়ার করুন