টাইমস নিউজ
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে হিংস্র জনরোষের নাম মব জাস্টিস ।
দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী আচরণ, দুর্নীতি আর অবর্ণনীয় দমন-পীড়নে অতিষ্ট হয়ে উঠে দেশের মানুষ। যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ৫ আগস্ট। পতন ঘটে দেড় দশকের রেজিমের । ওই দুপুরেই জনরোষ থেকে বাঁচতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে যান প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তার পরেই পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা।
পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে যারা পালাতে পারেননি তারা পড়েছেন তীব্র জনরোষে। যার ফলশ্রুতিতে অনেকেই গণপিটুনির স্বীকার হয়। এমন সব ঘটনাগুলোকে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’।
মূলত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশজুড়ে বড় আকারে ‘মব জাস্টিস’ শুরু হয়। তবে বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে সেটা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা।
কিন্তু এবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারপিট করে তাড়িয়ে দেওয়া, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা, কোথাও কোথাও পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনা সামনে যত আসছে ততই জোড়ালোভাবে উঠে আসছে ‘মব জাস্টিস’ নামে একটি শব্দযুগল। তবে অনেক মানুষই আছেন যারা হয়ত এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত না। চলুন জেনে নেই মব জাস্টিস কী, কেনই বা হয়,
মব (mob) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (Justice) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। ‘মব জাস্টিস’ অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। মব জাস্টিস অনুৎসাহিত করতে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে ‘আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না।’
মব জাস্টিস বলতে সাধারণভাবে বোঝায় জনতা আইন বা আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো বিচার নিজ হাতে যখন তুলে নেন, তাই মব জাস্টিস। এ ধরনের ঘটনায় যদি কেউ মারা যায় বা জনতার গনপিটুনিতে কেউ মারা গেলে তাকে লিঞ্চিং (lynching) বলে। এর অর্থ বিচার বহির্ভূত হত্যা।
এছাড়া জানতা দ্বারা বাড়িঘর পোড়ানো, কাউকে আহত করা, ভাঙচুর সবকিছুই মব জাস্টিসের অংশ।
আমাদের দেশে মব জাস্টিস এবং লিঞ্চিং প্রায়ই দেখে থাকি। ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে ‘ডাকাত’ সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছিল ৬ ছাত্রকে। ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মা’কে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল। সম্প্রতি এমন আরও একটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর যার আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরও প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।
মব জাস্টিস ঘটার কারণ কী?
একটা দেশ বা সমাজে মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চিং বিভিন্ন কারণে দেখা দেয়। তবে আইনের শাসন না থাকা, দুর্বল আইন, বিচারের প্রতি জনতার অনস্থা সৃষ্টি হলে মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চং বেশি দেখা যায়। এছাড়া মানুষ যখন ক্রমাগত অন্যায় আর বিচারহীনতায় অতিষ্ট হয়ে উঠে তখনই ‘মব জাস্টিসে’র নামে ‘লিঞ্চিং মবে’র প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এ ধরনের বিচারে অনেক সময় সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মব জাস্টিস সংগঠিত হওয়ার পেছনে মোটাদাগে ১০টি কারণ উল্লেখ করা যায়। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে..
আইনপ্রণয়নের অভাব
যদি জনগণ মনে করে যে আইন প্রণয়ন বা তার প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না, তখন তারা নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
অব্যবস্থাপনা
প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা যদি দুর্বল বা অকার্যকর হয়, তখন মানুষ নিজের হাতে ব্যবস্থা নিতে পারে।
অসন্তোষ ও ক্ষোভ
যদি জনগণ নির্দিষ্ট একটি ঘটনায় গভীর ক্ষোভ বা অসন্তোষ অনুভব করে, তারা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মব জাস্টিসের আশ্রয় নিতে পারে।
সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনা
কখনও কখনও সামাজিক বা রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে জনগণ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে এবং নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে পারে।
স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া
কিছু ক্ষেত্রে, অসন্তোষ বা ক্ষোভের কারণেই লোকেরা তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং মব জাস্টিসের দিকে চলে যায়।
রাজনৈতিক প্রভাব
রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, নিজেদের বা তাদের সমর্থকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য।
অর্থনৈতিক প্রভাব
ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই বিচার ব্যবস্থাকে কিনে নিতে পারে, নিজেদের অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে।
সামাজিক বৈষম্য
নিম্নবর্গের মানুষের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়া অনেক কঠিন হতে পারে, কারণ তাদের কাছে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করার মতো সামর্থ্য নাও থাকতে পারে।
বিচার বিভাগের দুর্বলতা
যদি বিচার বিভাগ দুর্বল হয়, তাহলে তা সহজেই রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপে নতি স্বীকার করতে পারে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতা
যদি পুলিশ বা অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দুর্বল হয়, তাহলে তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না এবং মিথ্যা মামলা চালু করতে পারে।
দার্শনিক উইলিয়াম গডউইন বলেছেন, ‘আইনি বিচার সকল নৈতিক কর্তব্যের সমষ্টি।’ বলা হয়, ‘আইনের নিয়মে পাওয়া ন্যায়বিচার সভ্য সমাজের স্থায়ী নীতি।’ বস্তুত, প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই নিজস্ব আইন রয়েছে। সে অনুযায়ী সব বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়। আর এটার ব্যত্যয় ঘটলে বিচারকার্য বিঘ্নিত হয়, সৃষ্টি হয় অপ্রত্যাশিত বিশৃঙ্খলা বা মব জাস্টিস।
মব জাস্টিস বন্ধ করতে করণীয়
মব জাস্টিস প্রতিরোধ করার জন্য আমাদেরকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো শক্তিশালী করতে হবে এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণকে সচেতন হতে হবে তাদের অধিকার সম্পর্কে এবং মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।
সংবাদটি শেয়ার করুন