হাছন রাজার কথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসে গানের কথা। গান ছাড়া হাছন রাজার অস্তিত্ব কল্পনা করা কঠিন। প্রচুর গান লিখেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলোর খুব কম সংখ্যকই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার একমাত্র গানের বই ‘হাছন উদাস’। তখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। এতে বোঝা যায় বই প্রকাশের দিকে তার ঝোঁক ছিল না। বরং তিনি গানকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে গাওয়ার মধ্যেই স্বার্থকতা পেয়েছেন। এজন্য তার নাম পড়ে গিয়েছিল গানের রাজা হাছন রাজা। কিন্তু তিনি মামুলি একজন গীতিকার মাত্র ছিলেন না। তার গানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলে বোঝা যায় তিনি কি অসাধারণ কবিত্ব শক্তির অধিকারী ছিলেন। আর তার কবিত্ব শক্তি ও জীবনী শক্তির ভেতরে লুকানো ছিল এক গভীর দর্শন। জীবন ও জগতকে আলাদা করে দেখার এক স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি। সে কারণে তাকে বলা হয মরমী ধারার কবি।বাংলা সাহিত্যে মরমী ধারা যুগ যুগ ধরে বহমান থাকলেও এ ধারার উজ্জ্বল কবির সংখ্যা খুব বেশি নয়। সাধারণভাবে মরমী বলতে বোঝানো হয় বিশ্বপ্রকৃতির মর্মে যিনি প্রবিষ্ট। তিনিই মরমী। তবে আভিধানিক ভাবে দেখেতে গেলে দেখা যায় ইংরেজী গুংঃরপ শব্দের বাংলা অনুবাদ ‘মরমী’। আবার এই গুংঃরপ শব্দটি এসেছে গ্রীক ভাষার গঁরবহ থেকে। এই গঁরবহ শব্দের অর্থ হলো নয়ন মুদ্রিত করা, ভাব অন্তরের মহলের দিকে ফিরিয়ে দেয়া। ভারতীয় উপনিষদেও এর প্রতিধ্বনি আছে। একজন কবি বা শিল্পীর প্রধান দায়বদ্ধতা থাকে তার শিল্পের প্রতি। কিন্তু এখানেই তিনি সীমাবদ্ধ নন। তিনি জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতিও দায়বদ্ধ। মরমী কবির সেই দায়টা থাকে একটু অন্যভাবে। তাকে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ভাবতে হয়। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন নিয়েও ভাবতে হয়। সেই মিলনের আকাক্সক্ষা একের ভেতরে দুই আবার দুইয়ের ভেতরে এক নিয়ে আসে। সাস্প্রতিককালেও কবিদের মধ্যে কারও কারও কবিতায় এই মরমী সত্তার দ্যুতি দেখা যায়। যেমন নির্মলেন্দু গুণের ‘যাত্রাভঙ্গ’ কবিতার দেখা যায় ‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই, দুইকে আমি এক করিনা ,এককে করি দুই।…’ এভাবে সৃষ্টি ও ¯্রষ্টা অথবা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে একীভূত করার একটা প্রয়াস দেখাযায় মরমী কবিদের কাজে। তাদের প্রেমিকদৃষ্টি ¯্রষ্টার নূরের বদন বা আলোর মুখও দর্শন করে অনায়াসে। হাছন রাজা লিখেছেন-
‘কিবা শোভা ঝলমল করে বাঁকা তার নয়নে রে কালা না হয় ধলা না হয় নূরেরই চটক রে। ভৈসালের বৎসরে বন্ধে দরশন দিল রে দয়া করিয়া আমার সঙ্গে কথাবার্তা কইলো রে। তুমি আমার, আমি তোমার বন্ধে যে বলিল রে, আমার দুঃখের কথা শুনিয়া বন্ধের দয়া হইল রে। নূরের বদন হাছন রাজা দিলের চক্ষে দেখল রে, আমারে করিয়া ফানা অন্তরে ছাপাইল রে। এই দেখিলাম, এই নাই, কি করি উপায় রে প্রেমের মাতাল হইয়া হাছন রাজা গান গায় রে।
এই যে ‘প্রেমের মাতাল’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা-এর মধ্যেই আছে আত্মোপলব্ধির এক মরমী পর্যায়। আর এর ভেতরেই আমরা খুঁজে পাই দার্শনিক হাছন রাজাকে।সৃষ্টিকর্মই প্রকাশ করে দেয় একজন শিল্পীর আত্মজীবনীর অংশ। খুব ছেলেবেলায় হাছন রাজা সিলেটে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছিলেন।সন, তারিখ চিহ্নিত করতে তিনি ওই বছরটিকেই নির্দেশ করেছেন। যেমন এখনও আমাদের লোকজীবনে দেখা যায় সাধারণ মানুষ ১৯৭১ সাল না বলে বলেন সংগ্রামের বছর বা যুদ্ধের বছর।হাছন রাজার কাছে তেমনি ওই ভূমিকম্পের বছর ভৈসালের বৎসর। সিলেট আঞ্চলিক ভাষায় ভূমিকম্পকে ভৈসাল বলা হয়। সম্ভবত: কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে স¤্রাট অশোকের যেমন বোধোদয় হয়েছিল, ছেলেবেলার সেই ভূমিকম্প হাছন রাজার চিন্তারও মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার কাছে মনে হয়েছে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। জগৎ নশ্বর। কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ দুঃখকে জয় করার জন্য এ রকম পরিস্থিতিতে ঘর ছেড়েছিলেন। বৌদ্ধ দর্শনে এর নাম মহাভিনিষ্ক্রমণ। বহু বছরের সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। হাছন রাজা সে পথে যাননি। তার দার্শনিক ভাবনার ভেতর দিয়ে ঘরে থেকেই পেয়ে গেছেন তার অন্তর্লোকের বন্ধুকে। যার কাছে পেয়ে গেলেন সব প্রশ্নের জবাব। নূরের বদনকে দিলের চক্ষে দেখলেন। জন্ম হলো এক নতুন হাছন রাজার। তিনি তখন শুধু হুরমৎ জাহান বিবির আদরের পুত্র নন। শুধু জমিদার নন। তিনি তখন থেকে মরমী কবি। যার রয়েছে এক সুস্পষ্ট জীবন দর্শন।
হাছন রাজা রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন। তারা ছিলেন এক হিন্দু রাজবংশের উত্তরাধিকারী। সিলেটের রামপাশা ও সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী মিলে বিস্তৃত ছিল তার রাজত্ব। কিন্তু অন্য রাজাদের থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। তার ভেতরে ছিল মরমী চেতনা। রাজকীয় আড়ম্বরে চলাফেরা তার খুব অপছন্দ ছিল। তিনি প্রাচীন ঋষিদের মতো শব্দ নিয়ে খেলা করতেন। সে কারণে তাকে রাজর্ষি বলা যায়। তবে ঋষিদের শব্দব্রহ্ম ছিল মূলত: ঈশ্বর ও অতীন্দ্রিয় জগৎ নিয়ে। হাছন রাজারও সে রকম ভাবনা ছিল। পাশাপাশি তার ভাবনা ছিল মানুষ, জীবন ও জগৎ নিয়ে। আর সেখানেই রয়েছে তার দার্শনিক পটভূমি।র্ জর্ষি হাছনকে সেখানে দার্শনিক হ্ছন রাজা হিসেবেও বিচার করা যায়। তার গান বা কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে এই দর্শন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দর্শনকে উপলব্ধি করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি হাছন রাজার এই দর্শনের কথা তুলে ধরেছেন।
গ্রাম্য কবির এই দার্শনিক চিন্তাকে তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সেখানে। হাছনরাজার দর্শন সুফীবাদ প্রভাবিত ছিল। তিনি যখন বলেন, ‘মম আঁখি হইতে পয়দা হইলো আসমান জমিন।’ সেটা স্মরণ করিয়ে দেয় সুফী দার্শনিকের ‘আইনাল হক।’ অর্থাৎ- আমিই আল্লাহ। কথিত আছে তিনি চিশতিয়া তরিকার এক আধ্যাত্মিক গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। হয়তো জীবন যাপনেও প্রভাবিত ছিলেন হাছন। রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে বহু গান রচনা করেছেন তিনি। শ্রী চৈতন্যের পিতৃভূমি ছিল সিলেটের ঢাকা-দক্ষিণ। সিলেট বিভাগের জল হাওয়ায় এমনিতেই তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তার ওপর সারা বাংলার ভাব আন্দোলনেই প্রাণপুরুষ হিসেবে বিবেচিত হন শ্রী চৈতন্য মধ্যযুগে বৈষ্ণব কবিতা ও গান বাংলা সাহিত্যকে প্রেমধর্মের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। হাছন রাজার প্রেমিক সত্তায়ও কৃষ্ণের অনুভূতি ছিল প্রবল। এছাড়াও তিনি আকৃষ্ট ছিলেন বাংলার বাউল দারায়।
তিনি নিজেই তার গানে বলেছেন, ‘বাউলা কে বানাইলো রে’ হাছন রাজারে, বাউলা কে বানাইলো রে’।
হাছন রাজার জীবনযাত্রা মোটেও বাউলদের মতো ছিল না। তিনি গৃহী ছিলেন। সংসারী ছিলেন। বৈষয়িক জ্ঞানও যে তার খুব কম ছিল সেটা বলা যাবে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন বাউল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর চলাফেরায় তিনি বাউলদের নৈকট্য অনুভব করতেন। সামন্তবাদী পারিবারিক বাউলদের জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। হাছন রাজার দৌহিত্র দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন, বাউল ভাবনা থাকলেও হাছন রাজা বাউল ছিলেন না । কিন্তু বাউল দর্শন যে তাকে প্রভাবিত করেছিল সেটা তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তিনি অস্বীকার করেছিলেন। মোল্লা-মুনশীর বিপক্ষে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন। তিনি কোন মাধ্যম ধরতে চাননি। সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সুফীবাদী চিন্তা লালন করেছেন। বলেছেন ‘আমি যাইমু আল্লাহরও সঙ্গে। বলেছেন আল্লাহ রূপ ও আল্লাহ রঙের কথা। একথাগুলো শরীয়তের সঙ্গে খাপ খায় না। মারিফতি তত্ত্বের সঙ্গে মেলে। তবে এসব তত্ত্বই ভাববাদী দর্শন। এর মধ্যে ফুটে উঠেছে অসার সংসার, ক্ষণস্থায়ী জীবন ও জগতের নিষ্ফল আনন্দ। তিনি জীবনের প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করেছেন। সেসব নিয়ে আত্মসমালোচনা করতেও ছাড়েননি। বলেছেন, ‘আর করবায়নি হাছন রাজা দেশও দেশও বিয়া’। তবে তার এই কাবতা ও গানগুলোকে বস্তুবাদী দর্শন দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। এর মধ্যদিয়ে তিনি জীবনের নিরর্থকতা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি সেই নিরর্থকতাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন। হাছন রাজার গীতি কবিতায় একটি বড় জায়গা নিয়ে আছে মৃত্যুচিন্তা। মৃত্যুর অমোঘতা নিয়ে তিনি লিখেছেনÑ
‘একদিন তোর হইবোরে মরণ রে হাছন রাজা একদিন তোর হইবেরে মরণ। মায়াজালে বেড়িয়া মরণ, না হইলো স্মরণ রে হাছন রাজা একদিন তোর হইবে রে মরণ। যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়ি টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরী রে। সে সময় কোথায় রইবো (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী কোথায় রইবো রামপাশা, কোথায় লক্ষণছিরিরে ॥ করবায়নি রে হাছন রাজা রামপাশার জমিদারী করবায়নি রে কাপনা নদীর পাড়ে ঘুরাঘুরি রে ॥ আর যাইবায়নি হাছন রাজা রাজাগঞ্জ দিয়া করবায়নি রে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া ॥…
মরমী কবি হাছন রাজা-২
এই গানের মধ্য দিয়ে হাছন রাজা বুঝিয়ে দিয়েছেন এই সংসারে সুন্দরী নারী, বাড়ি অথবা জমিদারি সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী। আর তখনই তিনি বলেন,
‘ছাড় ছাড় হাছন রাজা, এ ভবের আশা, প্রাণবন্ধের চরণতলে, কর গিয়া বাসা রে’। আবার এই হাছন রাজাই স্পর্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন তার দর্শনের আরেকটি রূপ। তিনি বলেন, আমিই মূল নাগর রে আসিয়াছি খেইড় খেলিতে ভবসাগর রে । আমি রাধা, আমি কানু, আমি শিব শঙ্করি অধর চাঁদ হই আমি গৌর হরি। আমি মূল আমি কুল আমি সর্ব ঠাঁই, আামি বিনে এ সংসারে অন্য কিছু নাই।’
হাছন রাজার দর্শনকে বুঝতে হলে তিনি যে জল হাওয়ায় জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন সেই পারিপার্শ্বিতাকে বুঝতে হবে। সিলেটের নাম ছিল তখন শ্রীহট্ট। সেটা ছিল দর্শন চর্চার একটি মোক্ষম স্থান। শামসুজ্জামান খান তার ‘হাসন রাজার মানস- ভুবনের পটভূমি’ প্রবন্ধে বলেছেন-শ্রীহট্ট হিন্দু-মুসলমান ধর্ম ও মর্ম-ষাধনার তীর্থস্থান স্বরূপ । শ্রীচৈতন্যদেব ও তদীয় প্রধান পার্ষদ, প্রথমে জ্ঞানবাদী ও পরে চৈতন্য-প্রভাবে ভক্তিবাদী সাধক অদ্বৈত আচার্যের (১৪৫৪-১৫৫০) পিতৃভূমি এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান সুফি-সাধক হজরত শাহ্জালাল (র.) (মৃত্যু ১৩৪৬ খ্রি.)-এর সাধানকেন্দ্র হিসাবে সিলেটের এক বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভুর পিতৃভূমি সিলেট হলেও তাঁর জন্ম ও সাধনক্ষেত্র নবদ্বীপ । অঞ্চলে ; তবে তাঁর অতুলনীয় প্রভাব সারা বঙ্গদেশ এবং তার বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এত বিপুল মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আর কোনও বঙ্গসন্তান পাননি। দেশের মানুষের ভালোবাসার এই প্রবল জোয়ার এবং নব্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের প্রবল চাপে তিনি পিতৃভূমি সিলেট আসতে পারছিলেন না কিন্তু এ ব্যাপারে পিতামহীর প্রবল আগ্রহকে সম্মান জানিয়ে অবশেষে সন্ন্যাস গ্রহণের পর শ্রীহট্টের অন্তঃপাতি ঢাকা-দক্ষিণে আগমন করেন। ঢাকা -দক্ষিণ শ্রীহট্টের মধ্যে প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান বলে পরিগণিত ও গুপ্তবৃন্দাবন নামে খ্যাত।
অতএব বৈষ্ণব প্রেমÑধর্ম ও ভক্তিবাদী সাধনার ধারা যে করে হিন্দু-মুসলমান ভাবুক-চিন্তক-মানব-প্রেমিক-মরমিয়া সাধকদের আপ্লুত করেছিল তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটি মহৎ ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই প্রতীক। এখানে ধর্মে নানা ভেদ-বিভেদ নেই। ফলে সিলেটে এক উদার ও সমন্বয়বাদী ধর্ম-সংস্কৃতির ধারা গড়ে ওঠে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধানার বিখ্যাত কেন্দ্র সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সঙ্গীদের প্রভাবে ইসলামের সুফিবাদের হৃদয়ের রংয়েরও ছোপ লাগে। বস্তুতপক্ষে বর্তমান বৃহত্তর সিলেটে মধ্যযুগ থেকে একাল পর্যন্ত গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মুসলমান এবং সুফি সাধক বাবা শাহ্জালালের প্রতি-আপ্লুত হিন্দুর সংখ্যাও বেশুমার। অন্যদিকে প্রখ্যাত পীর-মুর্শিদ, দরবেশ-সাধু-সন্ত এবং লৌকিক ধারার অগণন বুজর্গ সাধক, লোকগায়ক, কবি ও মরমিয়া ভাবুকের সাধন-ভজন ও ভাবপ্রকাশের স্থান হিসেবেও সিলেটের খ্যাতি অনন্য। এই সাংস্কৃতিক আবহের ফলে (শব্দটি একানে খুবই সুপ্রযুক্ত মনে করি)-তে গোটা সিলেট অঞ্চলে যে সাংস্কৃতিক ভাবজগৎ গড়ে ওঠে তা বিশেষ তাৎপযপূর্ণ। এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে ধর্মমতের ভিন্নতা কোনও বাধা বা বিরোধের সৃষ্টি করেনি। পলে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব-ভাব-আন্দোলনের মর্মবাণী জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপক হিসেবে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কবিতার প্রবলতা একালে আমাদের বিস্মিত করে। শুধু হিন্দু লেখকদের লেখার নয়, মুসলমান পরি, হাজী, কারি, লেখকদের রচনায়ও এর বহু পরিচয় বিধৃত। কিছু উদাহরণঃ ১ আবের পাতন ঘরে খাকের বদন তার মাঝে খেলা করে শ্যামনিরঞ্জন ॥
গোলাম হোসেন (১৪৬৮-১৫৫৬ খ্রি.) ২
তন রাধা মন কানু শাহনূরে বলে রাধাকানুর মিলন হইল আড়াই হাতের তলে ॥ অথবা
শাহ আবদুল ওহাব (১৭৬৩-১৮৮৮ খ্রি ৪ কদমতলে বাঁশি বাজাও শুনিতে মধুর বিরহিনী হইয়া ঝুরি শুনি যে সে সুর শীতালং শাহ ওরফে মোহাম্মদ ছলিমউল্লাহ (১৮০০-১৮৮৯ খ্রি. ৫ কারে লইয়া কারে লইয়া বসতি কর মনারে রাধার মন্দিরে। পীর নছিম আলী (১৮১৩-১৯২০ খ্রি.) ৬ সখি গো আইত যদি কালাচান্দ বসাইতাম সামনে এগো কৈতাম মনের দুঃখ মুই ধরিয়া চরণে।
শেখ ক্বারী আবদুল ওয়াহিদ (১৮৬৮-১৯৫৩ খ্রি.) ৭ সুবল যারে বৃন্দাবন দেখে আসগে রাধারানী আছে রে কেমন ॥ মথুরাতে আছি আমি পাগল আমার মন রাধার জন্য সদা আমার প্রাণ উচাটন ॥ রাধার পদে ধরে সুবল করিস নিবেদন দিবানিশি রাধা প্যারী আছে রে স্মরণ ॥ রাধার প্রেমে আছি বান্দা জন্মের মতন শীঘ্র গিয়ে দেখবো আমি ঐ রাঙ্গা চরণ ॥ মথুরাতে আছি আমি হইয়ে রাজন রাজার খেদে ত্যাজ্য করব রাজসিংহাসন ॥ ছহিফায় বলে শুন ভুবনমোহন কুজায় কুবুদ্ধিয়ে তুমি হয়েছে বন্ধন ॥
ছহিফা বানু (১৮৫৮-১৯০৭ খ্রি.) হাছন রাজার বৈমাত্রেয় বোন। ইনি ‘হাজী বিবি’ নামেও পরিচিতি ছিলেন ।
৮. ক. ভ্রমর কইও গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া ॥ ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া আমি রাধা মরিয়া যামু কৃষ্ণহার হইয়া ॥ খ. কি দিয়ে শুধতাম ফ্রেমঋণ গো রাই আমার সে ধনও নাই। লাদাপ্রেমে ধরণী হইল মোহিনী ॥ (রাধারমণ)
৯
একজন সোনার মানুষ গো সই, সোনার মানুষ একজন সোনার মানুষ রূপের চান্দ আমার আসিয়াছিল নদীয়ায়। তার বিরহে অগ্নিবান লাগছে কলিজায় ॥ সখিগো তার রূপেরই কিরণ, সূর্যের বরণ মুখের আলো ঝলমল, অপূর্ব গঠন… খি গো যে দেখলে তারে সে কিগো পারে লাজকুল মান জ্ঞাতি গো জাতি রক্ষা করিবারে ॥ হাজী মো. ইয়াছিন (১৯৪৯-১৯৩৪ খ্রি.)
মরমী সাহিত্যের ব্যাখ্যায় সিলেটের একালের বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল বলেনÑ ‘মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (র.)-র বুশনা বা বঁশীমুরলী নাম ধরে ঠাঁই নিল শ্রীকৃষ্ণের করকমলে। মাওলানা রুমীর (রা.) মসনবী শরীফের ফারসি বয়েতঃ
বুশঁনা আযনার চুঁ মীকুনাদ অ-আযুদায়ী হা হেকায়েত মীকুনাদৎ অর্থাৎ, বাঁশি যখন বাজে তখন শোনো দিয়া মন, প্রাণবন্ধুয়ার লাগি বাঁশি করিছে ক্রন্দন। মাওলানা রুমী (র.)-র ভাব ও ভাষায় বাংলায় প্রতিধ্বনি তুললেন বৈষ্ণব পদকর্তা বড়– চ-ীদাসসহ অনেক পদকর্তা পদাবলীর সুরেঃ কে-না বাঁশী বা এ বড়ায়ি কালিন্দি নৈকূলে কে-না বাঁশী বায়ে বড়ায়ি ও গোঠ গোকুলে।
একইভাবে মুসলিম পদকর্তা আলী রেজাও গাইলেন: বাঁশী বাজান জান না- অসময়ে বাজাও বাঁশী পরাণ মানে না আমি যখন বইসা থাকি গুরুজনের মাঝে তুমি নাম ধরিয়া বাজাও বাঁশী আমি মরি লাজে।
অন্যদিকে গুরুসদয় দত্ত কর্তৃক সংগৃহীত ‘শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত’ গ্রন্থে সম্পাদকের ভূমিকায় ড. নির্মেলেন্দু ভৌমিক বলেছেন ঃ বৈষ্ণবধর্ম ও ইসলাম-সুফিধর্মের প্রভাবে শ্রীহট্ট একদা বাউল-ভাটিয়ালি-মারফতী গান রচনার একটি বিশেষ কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। মুসলমান সাধক ও ফকিরেরাই সেই সাংস্কৃতিক মিশ্রণের সুরবাণী রূপকে তাঁহাদের রচিত গীত-গুচ্ছের মধ্যে ধরিয়া রাখিয়াছিলেন। যে সমস্ত সাধক-ফকির এই বৈষ্ণব-ইসলাম সুফিধর্মকে তাঁহাদের গানে রূপ দিয়েছিলেন, তাঁহারা প্রত্যেকেই মরমী সাধক…’ (ভূমিকা , পৃ. ২৫, ১৯৬৬: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ।
সিলেটের লোককবি ও সাধকের তাই বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, সুফি, বাউল প্রভৃতি চিন্তা-চেতনার পন্থাকে মিলিয়ে মিশিয়ে গ্রহণ করেছেন। সুফিপন্থার মারিফত বা মরমী ভাবধারার মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রভাবিত বাউলধর্ম এক নতুনতর প্রকাশ পথ খুঁজে পেয়েছে। ফলে তত্ত্বজ্ঞানমূলক সুফিবাদের সঙ্গে যোগক্রিয়ামূলক বাউলধর্মেরও মিশ্রণ ঘটে গেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৌদ্ধ নাথ পন্থীদের দেহাত্মবাদী তান্ত্রিক সাধনার ধারা। এই ধরনের মিলন যে সম্ভবতা আমরা মধ্যযুগের মুসলমান রচিত বাংলাকাব্যে এবং ওই সময়ের লোক সাহিত্যে বিস্তর পরিমাণে পাই। সেই ধারা পরবর্তীকালেও বহমান থেকেছে। সিলেটের বিখ্যাত মারিফত পন্থী বাউল কবি সৈয়দ শাহ্ নূর (মৃত্যু ১৮৫৫ খ্রি.) তাঁর নছিয়ত’ কাব্যে বলেছেনঃ
শরীয়ত দেখ ভাই আকলের উপরে তরীকত কহি ভাই গোসত বোলইন যারে। হকীকত শুন ভাই হাড় বোলইন যারে। মারিফত হাড়ের গোদা সকলের ভিতরে।
এই কবিতার শরীয়ত নয় মারিফতকেই সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়েছে। সিলেটের লোক কবিতায় এ ধারার অন্য এক বিশিষ্ট কবি আকবর আলী ছাবাল শাহ জালালবাদী সম্পর্কে ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৫০ সংখ্যায় মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনে লিখেছেন, ‘তাঁর তিনখানা বইয়ের নাম : ‘এস্কে দেওয়ানা’ , ফানায়ে জান’ এবং ‘যৌবন বাহার’।’
বলা হয়েছে আকবর আলীর ‘এস্কে দেওয়ানা’ বা প্রেমপাগল বইটি আধ্যাত্মিক তত্ত্বপূর্ণ গানের পুস্তক। অন্যান্য গ্রন্থে কবির বিভিন্ন পদেরসহিত রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পদ আছে (শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত, পৃ. ৩৮)। অর্থাৎ মারিফতী গান ও বৈষ্ণবভাব –সাধনার গানাি এই কবির অন্বিষ্ট।
শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, রাধারমণ প্রমুখ খ্যাতিমান সাধক কাবও তত্ত্বজ্ঞান ও অতীন্দ্রিয় প্রেমমূলক কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তাঁরা একালেও খ্যাতিমান। রাধারমণ রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কবিতা রচনা করলেও নিজেকে ‘বাউল’ বলেও উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ শাহনূর, হাসন রাজা প্রমুখও নিজেকে ‘বাউল’ বা বাউলা বা পাগল/পাগলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। সিলেটের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যে ওপর আলোকপাত করে ড. সুকুমার সেন তাঁর ‘ইসলাম বাঙলা সাহিত্যে’ লিখেছেন : … শ্রীহট্টের অন্য সাহিত্য ধারার মধ্যে রয়েছে ইসলাম পুরাণকাব্য ও রোমান্টিক প্রণয়গাথা। ইসলাম পুরাণ কাব্যগুলি হিন্দুদের পুরাণ পাঁচালীর দেখাদেখি রচিত হয়েছিল ।… এই ইসলামী পুরাণ পাঁচালীর ধারা নিঃসৃত হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে চাটগাঁয়ে ও সিলেটে।…সিলেটের মুসলমানেরা উত্তর-পশ্চিমের হিন্দিভাষী মুসলমানদের সঙ্গে বরাবর যোগ রেখে চলেছিল বলে এরা পুরোপুরি বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি অনেক দিন অবধি।… সিলেট ও চাটগাঁর মুসলমানদের মধ্যে হিন্দিমূলক আখ্যায়িকার প্রচলন খুবই ছিল।
তবে হাসন রাজা এক আশ্চর্য সম্মুখমুখী দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন বলেই মনে হয়। তাঁরই কবিতায় মধ্যযুগে লোকজ কবিতার ভাববস্তু অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তাঁর চেতনা ছিল প্রখর এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। তাই নিজেকে তিনি ‘বাঙালী’ বলে উল্লেখ করেছেন ঃ
হাছন রাজা বাঙালী হয়ে কাঙালী প্রেমানলে জ্বালিয়ে যায় প্রাণ আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা। আমি তোমার কাঙ্গালী গো। তোমার লাগিয়া কান্দিয়া ফিরে হাছন রাজা বাঙালী গো ॥ হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি খোদা। রাধা বলিয়া ডাকিলে মুল্লা-মুসল্লিয়ে দেয় বাধা।
হাছন রাজার দর্শন নিয়ে প্রথম লেখালেখি করেন- প্রভাতকুমার শর্মা। তিনি ‘মরমি কবি হাছন রাজা’ প্রবন্ধে লিখেছেন –তুমি সর্বব্যাপী , বিশ্বব্যাপী, আমিও সর্বব্যাপী, বিশ্বব্যাপী, তবে তুমি আমি তো এক! তাই বলিতেছেন : তুমি কে আর আমি কে তাহাই তো বুঝিতেছি না। আমি তো এক ভিন্ন দুই দেখি না। তুমি এই বিশ্বের কর্তা, তুমি এই বিশ্বব্যাপী, আমি শব্দটিই যে মিথ্যা, তুমি যে সকল , তোমার যে কোন অংশীদার নাই। যাহারা আমি আমি বলিয়ে পাগল, তাহারা তো কিছুই বোঝে না; সংসারের আবর্তে পাড়য়া তাহারা স্বরূপ ভুলিয়া গিয়াছে, তাহারা বুঝিতেছে না যে তুমি আমি এক দেহ, এক মন , এক আত্মা, তাহারা মূখতায় অন্ধ! মিছামিছি আমি বলিয়া সর্বব্যাপী তোমাকে ভুলিয়া যায়। হে অন্তর্যামী, তুমি ভিন্ন কিছুই নাই। তুমি আমাকে একটি নাম দিয়াছ। সেই নামের আড়ালে নিজেকে ছাপাইয়া রাখিয়া সকল কাজ করিতেছ। কিন্তু হায়! লোকে যে সকল দোষ আমার ঘাড়ে চাপাইয়া দেয়, তুমি তো দেখিতেছি তুমি ছাড়া আমি কিছুই নই। যাহাকে আমি বলিতেছি সেও যে ওই তুমি! তাই তুমি কে আর আমি কে, আমি তো তাহাই বুঝিতেছি না। মরমি এইভাবে পাগল হইয়াছেন, তাই বলিতেছেন :
আমি আমার পরিচয় করিয়াছি সবই তুমি , আমিত্ব ছাড়িয়া দিয়েছি আমি তো কিছুই নহি, কিছুই নহে তুমি বহি তুমি বিনে কিছু নয় এই বুঝিয়েছি! আমি আমি একটি নাম দিয়া খেলা খেল ভবে আসিয়া কত রং ঢং কর দেখি তোমার নাচানাচি। তুমি ঘরে ,তুমি বাইরে তুমিই সবার অন্তরে- কে বুঝিতে পারে প্রভু তোমারই যে পেছাপেছি। হাছন রাজার এই উক্তি সকলেই তুমি মা শক্তি তুমি আমি ভিন্ন নহি একই হৈয়েছি। আমি আমার পরিচয় পাইয়াছি, আমি বুঝিয়াছি তুমি ভিন্ন আমি কিছু নহি, তুমি ‘আমি’ বলিয়া একটি নাম দিয়া ভবের খেলা খেলাইতেছে। তুমি ঘরে তুমি বাহিরে, তুমি সকলের অন্তরে বিরাজমান। প্রভু তোমার কৌশল কে বুঝিতে পারে? তুমিই যে সকলের শক্তি, আমি তুমি ভিন্ন নহি-সোহহং, সোহহং, তুমি আমি এক হইয়া গিয়াছি, এক হইয়া রহিয়াছি। আবার বলিতেছেন ঃ হাছন রাজায় কয় আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয় অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময় প্রেমেরি বাজারে হাছন রাজা হইয়াছে লয় তুমি বিনে হাছন রাজা কিছু না দেখয় প্রেম-জ্বালায় জ্বলি মইলাম আর নাহি সয় যদিকে ফিরিয়া চাই দেখি বন্ধুময় আমি তুমি, তুমি আমি, ছাড়িয়াছি ভয়ে উন্মাদ হইয়া হাছন রাজা নাচন করয়ে। দয়াময়, আমি তো কিছুই নহি , তুমি ভিন্ন আমি তো কিছুই দেখিতেছি না। কবীর বলিয়াছিলেন- ‘যদি আমি বলি যে তিনি ভিতরে আছেন, তা’ হলে বাইরের বিশ্ব-জগৎ লজ্জায় মরে যাবে।’ কবি তেমনি বলিতেছেন- হে দয়াময়, তুমি অন্তরে বাহিরে, যেদিকে ফিরিয়া চাই, কেবল তোমাময় দেখিতেছি। তুমিই আমি, আমিই তুমি। এই আনন্দে আমি আজ উন্মাদ হইয়া নাচিতেছি- তুমিময়- এ বিশ্ব কেবল তুমিময়!
এইভাবে কবি পাগল হইয়াছেন, উন্মাদ হইয়াছেন, আউলাঝউলা হইয়াছেন, কবি চলিয়াছেন এই বিশ্বের পুষ্পোদ্যানের ভিতর দিয়া –গন্ধে আকুল হইয়া! ক্ষণে কাঁদিতেছেন, ক্ষণে হাসিতেছেন, নিজেকে দেখিতেছেন, অতীন্দ্রিয়লোকে তাঁহার যে প্রেমের পাত্র তাঁহাকে দেখিতেছেন, হারাইতেছেন, আবার তাঁহার সঙ্গে মিশিয়াও যাইতেছেন। দাদু বলিয়াছিলেন- ‘সেবা দ্বারা তাঁহাকে পাইব’। কবীরের মতো আমাদের মরমী কহিতেছেন-প্রেমের দ্বারা তাহাকে জয় করিব।
‘খোদা মিলে প্রেমিক হইলে পাবে না পাবে না খোদা নমাজ-রুজা কইলে (করিলে)।’ বলিতেছেন- হে অন্তর্যামী, আমি তোমার প্রেমিক। প্রেমিকে প্রেমিকে পরিচয় হইয়াছে, তাই :
‘তুমি আমি, আমি তুমি।’ ‘হে ফকির, আমার প্রাণে তোমার প্রাণ লাগালে। Ñকবীর
আর :
হাছন রাজায় প্রভুরে কয় হস্তের মধ্যে ধরি তোমার আমার এমনি বন্ধন ছাড়াইতে না পরি। এর মধ্যে কৃত্রিমতা নাই, পুঁথিগত বিদ্যা নাই, ভাষার বাহাদুরী নাই, আছে শুধু খাঁটি অনুভূতি- নিজস্ব জিনিস। তারপর একদিন: হাছন রাজারে ব্যগ্র দেখিয়া দয়া লাগে কানাইর বুকে আইস ত্বরিয়ে- কানাই ডাকে তোমায় নিয়ে যাই।
একদিন ডাক আসিল। কানাইর দয়া হইল, একদিন ডাক পড়িল। মরমী সে ডাক শুনিলেন এবং সাড়া দিলেন। চিরদিনের যে বাড়ী, চিরকালের যে বাড়ী, অনন্ত মিলনের সঙ্গীতে যাহা মুখরিত, সেখানে তাঁহার স্থান হইল- দেহে দেহে, প্রাণে প্রাণে,মনে মনে,আত্মায় আত্মায় চিরপ্রেমাস্পদের সঙ্গে কবি মিশিয়া গেলেন। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২২ অগ্রহায়ণ হঠাৎ সকালে দেখিল, কবির চিরদিনের বাসনা সফল হইয়াছে :
আমি যাইমু রে যাইমু আল্লহি সঙ্গে। আমি তাঁহার সঙ্গে যাইব। – কবি তাঁহার সঙ্গে চলিয়া গিয়াছেন। হাছন রাজা খাঁটি মরমী ও কবি ছিলেন। একটা কিছু তাঁহার সম্মুখে ছিল, যাহা তিনি ধরিয়া ও ধরিতে পারিতেন না। সেই অনুভূতির ব্যথায় তিনি অস্থির হইয়া কাঁদিতেন, আবার ক্ষণিকের জন্য পাইয়া আনন্দে নাচিতেন। তাঁহার এই হাসি-কান্নার কাহিনী নীল আকাশের মতো গভীর, দূর দিগন্তরেখার মত ঝাপ্সা, সন্ধ্যার অন্ধকারের মত রহস্যময়। এইখানেই তাঁহার কবিত্ব, ভাবুকতা, এইখানেই তিনি মরমী। হাছন রাজার চরিত্রের যে একটি বৈশিষ্ট্য তাঁহার কবিতার ভেতর দিয়ে ফুটিয়া উঠিতেছে তাহার উল্লেখ করিয়া আমার প্রবন্ধ শেষ করিব। দেশের বর্তমান অবস্থার সম্মুখে ইহা একটি আদর্শের মত। হাসন রাজা হিন্দু ও মুসলমান উভয়কেই ভালবাসিতেন, হিন্দুদের দেবতা ও মুসলমানদের দেবতা বলিয়া তাঁহার কোন সংর্কীণতা ছিল না।তাঁহার বহু গানে কানাই, কালাচান্দ ঠাকুর, রাধা প্রভৃতি উল্লেখ আছে। তিনি কোন কোন স্থানে হিন্দু দেবমন্দিরাদি স্থাপনের জন্য নিষ্কর ভূমি দান করিয়াছিলেন। তাঁহার চরিত্রের এই একটি গৌরবের বস্তু। তাঁহার মাতার শ্রাদ্ধে প্রজারা প্রায় ১২০টি গরু দান করিয়াছিল। তিনি তাহাদের একটিও বধ করিতে দেন নাই, মহিষ দ্বারাই কার্ষ্য সম্পাদন করিয়াছিলেন। কবিত বাস্তব জগতেও আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। হাছন রাজার মেয়ের ঘরের নাতি ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনি দেওয়ান হাছন রাজা প্রবন্ধে লিখেছেন- হাসন রাজার মরমী ও দার্শনিক প্রতিভার বিকাশের ধারা অনুসরণ করে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি। সম্প্রতি ‘হাছন রাজা ও সর্বেশ্বরবাদ’- শীর্ষক একটা প্রবন্ধে তাঁর দার্শনিক প্রতিভার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। বদিউজ্জামান সাহেবের প্রবন্ধে অভিযোগ রয়েছে-হাছন রাজাকে প্রভাতকুমার শর্মা হিন্দুভাবাপন্ন ও আমি মুসলিমভাবাপন্ন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি। এ মন্তব্য কতকটা সত্য, হাছন রাজা সম্বন্ধে প্রথম প্রবন্ধকার যে তাঁকে হিন্দুভাবাপন্ন করার চেষ্টা করেছেন- তার প্রমাণ রয়েছে তাঁর মন্তব্যে। তিনি লিখেছেন, ‘হাছন রাজা তাঁর আম্মার ফাতিহাতে গো-বধ হতে দেন নি। এ ঘটনা ঘটে ১৩১১ বাংলা সনে অর্থাৎ আমার জন্মের দু’বছর আগে। এ সম্বন্ধে আমি আমার আম্মা বা অন্যান্য লোকের নিকট থেকে প্রভাত শর্মার মন্তব্যের পক্ষে কোন কথা শুনিনি। কাজেই এতে কোন বিচার সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে হাছন রাজা যে অত্যন্ত উদার মতাবলম্বী ছিলেন সে সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত। আমি প্রাচীন বিশ্বস্তলোকের বাচনিক জানতে পেরেছি-কালীপুর মৌজা পত্তনের পূর্বে হাসন রাজা ভবিষ্যৎ বসতকারীদের দ্বারা কালীপূজা করেছিলেন এবং এ পূজা উপলক্ষে সাতশত টাকা প্রজাদের দান করেছিলে। এরূপ বহু দৃষ্টান্ত দ্বারা হাছন রাজার পরমত সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
তবে পরমতসহিষ্ণুতা বা তার চরম পরিণতি উদারতা ও নিজস্ব মতবাদের পোষকতা একার্থবাচক কথা নয়।আমি তাঁর কাব্যসাহিত্যের আলোচনা করে দেখিয়েছি-তিনি প্রথমে শরীয়তের আইন-কানুন বাস্তবজীবনে রূপায়ণের জন্য মুমিন মুসলমানদের আহ্বান করেছেন। পরবর্তী স্তরে তিনি প্রেমের মাধ্যমে তাঁর প্রিয়তমকে লাভ করার চেষ্টা করেছেন। সর্বশেষ স্তরে তিনি দার্শনিকরূপে তাঁর নিজের মধ্যেই সে প্রিয়তমের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তবে তাঁর মানসবিকাশের এ পর্যায়গুলো বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি াুসলামী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ইসলামী সংস্কুতির গোড়ার কথা- ‘মান আরাফা নফসাহু ফাকদ্ আরাফা রব্বাহু’- যে আপনাকে জেনেছে সে তার রবকেও জেনেছে। এ উক্তি কার এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারও কারও ধারণা এটি একটি হাদিস।
তবে অধিকসংখ্যক আলিমের ধারণা- এটি হযরত আলী (রা)-এর উক্তি। তবে সর্বাবস্থায়ই ইসলামী সংস্কৃতি এ উক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ উক্তিকে কেন্দ্র করেই হোসেন বিন মনসুর বলেছেন-‘আনাল হক’ (আমিই সত্য)। বায়েজিদ বলেছেন-‘সুরহানী’ (আমিই পবিত্র)অ ইবনুল ফরীদ বলেছেন- আনা হিয়া (আমিই সেই অনিন্দ্য সুন্দরী নারী,-যাকে সুফীরা আল্লারই প্রতীক বলে কামনা করে)। এ উক্তির ভিত্তিতেই মওলানা জালালউদ্দিন রুমী বলেছেন-‘আমার সত্তাই প্রস্তর ও মৃত্তিকার সাথে মিশে রয়েছিল। তারপর একদিন তাতে প্রাণের সাড়া দেখা দিল এবং আমি প্রথমে বৃক্ষাদিরূপে দেখা দিলাম। তারপর আমার প্রকাশ হল হামাগুড়ি দিয়ে চলা জানোয়াররূপে- আকাশের বুকে বিচরণশীল পাখিরূপে- জলে সঞ্চরমান প্রাণীরূপে এবং সর্বশেষ মানুষরূপে দেখা দিয়ে আমি এখন আপনার রূপই অবলোকন করছি’।
হিন্দু-সংস্কৃতিতেও রয়েছে ‘আত্মানাম বিদ্ধি’। তবে সেখানে সর্বপ্রধান বক্তব্য হচ্ছে-ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা-জীবে পরাপর। বেদান্তের সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে একমাত্র সত্য- মানবাত্ম পরমাত্মার অংশ হিসাবে সত্য। কাজেই তাকে যদি বিষয়মুখী (ঙনলবপঃরাব) সংস্কৃতি বলা যায় তাহলে ইসলাম সংস্কৃতিকে বলা যায় আত্মমুখী (ঝঁনলবপঃরাব)। হাছন রাজা যে আত্মমুখী সংস্কুতির সর্বশেষ পর্যায়ে আরোহন করেই বলেছিলেন-‘মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন’; কাজেই আমার মন্তব্য খেয়ালীর কল্পনা-প্রসূত মন্তব্য নয়। আমার পক্ষে একথা এত জোর দিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। বিশ্ব ভারতী থেকে প্রকাশিত হিন্দি মাসিকে প্রায় ২৪/২৫ বছর আগে বাউলদের বর্ণনা প্রসঙ্গে সুবিখ্যাত প-িত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী লিখেছেন-‘হাছন রাজা আউর ইনকা বেটা একলিমুর রাজা বাউল থা’। সে প্রবন্ধ পাঠ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এটি যে কত বড় মিথ্যে তা বাউলদের সম্পর্কে যাঁরা অনুসন্ধান করছেন- তাঁরা সকলেই অবগত আছেন। বাউলদের পক্ষে প্রচলিত শরীয়তের বিধান ও সংহিতার আদেশ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেই সে সম্প্রদাংভুক্ত হতে হয়। একজন মুসলমানকে বাউল হতে হলে সাতটি শুক্তবারে জুম’আর নামাজের পূর্বে মসজিদে গিয়ে হয়- ‘আমি শরীয়ত মানি নে’। তেমনি কোন হিন্দুকে বাউল হতে হলে- সাতটি সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বলতে হয়-‘আমি সংহিতা মানি নে’। তার ওপর বাউলদের আবার আধ্যাত্মিক বংশলতিকা রয়েছে। বাউলদের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। কবীরপন্থী, জগন্মোহিনী সম্প্রদায় প্রভৃতি নানা শাখা রয়েছে। …হাছন রাজা সাত জুম’আয় কেন, এক জুম’আয়ও শরীয়ত অস্বীকার করেন নি। তিনি কোনদিন বাউল বলে তাঁকে প্রচারও করেন নি। বরং উল্টোদিকে তিনি চিশতিয়া তরীকার সৈয়দ মাহমুদ আলী বলে পাঞ্জাব থেকে আগত এক পীর সাহেবের কাছে মুরীদ হয়েছিলেন এবং আজীবন তাঁর দীনাতিদীন ভক্তরূপে তাঁর চরণ-সেবা করেছেন। সিলেটের অনতিদূরে রনকেলি নামক স্থানে সে পীর সাহেবের আস্তানা ছিল। হাছন রাজা বৎসরে একবার তাঁর দরবারে হাজির হয়ে তাঁর সেবা করা অবশ্য কর্তব্য বলেই গণ্য করেছেন। কাজেই তিনি চিশতিয়া তরীকার লোক ছিলেন একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
তবে একথা সত্য- তাঁর মাঝে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হোসেন ইবনে মনসুর, বায়েজিদ, ইবনুল ফরীদবা রুমী থেকে যে তাঁর দার্শনিক মতবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। কাজেই হাছন রাজা ইসলামী ভাবাপন্ন ছিলেন এবং রাধাকুষ্ণ, কালী, দূগা প্রভৃতি দেব-দেবীকে তার প্রত্যয় প্রকাশের মাধ্যমে হিসাবে রূপকের আকারে ব্যবহার করেছেন। আমি তাঁর বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করিনে। তবে তিনি হিন্দু সংস্কৃতির বা মুসলিম সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে একটি অভিনব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছেন সে কথা অস্বীকার করতে পারিনে।…”
তার মানে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ স্বীকার করে নিচ্ছেন হাছন রাজা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান হলেও তার দশৃন প্রথাগত মুসলমানদের মতো নয়। আর এই দর্শনের প্রভাবেই তিনি হিন্দু সংস্কৃতির বা মুসলিম সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে একটি অভিনব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ ব্যাপারে লোক বিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, “হাছন রাজা বাউল ছিলেন কিনা এ নিয়ে গবেষকগণ অনন্তকাল পর্যন্ত তর্কচালিয়ে যেতে পারেন্ কিন্তু এতে হাছন রাজার কাব্য বিশ্লেষণের কোন অগ্রগতি সাধিত হবে না।” ভাব জগতের মানুষেরা নিজেদের অস্বাভাবিকত্ব সম্পর্কে সচেতন। ত্ই তারা নিজেদের ‘আউলা’ ভাবেন। পাগল বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। নিজেকে বাউল ঘোষণারও তাদের দ্বিধা নেই কিন্তু ভাবের ঘোরে বাউল হলেও বাস্তবে হওয়া খুব সহজ নয়। কারণ বাউল দর্শন গভীর একটি দর্শন। এর সঙ্গে সুফীবাদ ও বৈষ্ণববাদের একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে। তবে ওই সব পরিচয়ের বাইরেও হাছন রাজা কেন নিজে বাঙালী বলে পরিচয় দিলেন সেটা ভেবে দেখতে হবে। তিনি তার ক্রন্দসী প্রেমিক সত্তাকে বাঙালী বলে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাঙালীকে এভাবে একটু নেতিবাচক করে কখনও কখনও দেখিয়েছেন। যেমন- ‘হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।’ অর্থাৎ বাঙালীরা যেন মানুষ নয়। কবিগুরুর এই রসিকতার পেছনেও রয়েছে গভীর দর্শন। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন- “কবিগুরু তোমার কথা আজ মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।” কবিগুরুর এই দর্শনের মধ্যদিয়ে বাঙালীর সীমাবদ্ধতাকে বোঝা যায়। তাঁর ধারণা ছিল বাঙালী স্বাধীন হতে পারলেই তার মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারবে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যেন সেই জবাবটি দিয়েছেন। অবশ্য এই রবীন্দ্র দর্শনের বিকল্প হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সতীর্থ সিলেটের আরেক কৃতিসন্তান গুরুসদয় দত্তের একটি গানের কথা আলোচনা করা যায়। তিনি বলেছেন- “মানুষ হ মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালী হ।” অর্থাৎ, কেউ যদি কায়মনে প্রকৃত বাঙালী হতে পারে তাহলে তার পক্ষে বিশ্বমানব হওয়া সম্ভব। এই গানের কথায় তিনি বাঙালীর সকল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে গেছেন। সেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদের আঘাতে জর্জরিত হয়ে নাথপন্থী সহজিয়া কবি ভুসুকু বলেছিলেন- “আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভইলি” অর্থাৎ, আজ ভুসুকু বাঙালী হইল। হাছন রাজার সুরে সেই বিদ্রোহী ভাব নেই। তিনি বাঙালির প্রেমিক পরিচয়টিকেই বড় করে তুলেছেন। হাছন রাজার গানে ও জীবন দর্শনে যে সব কথা বলা হয়েছে এগুলো নিয়েই বিকশিত হয়েছে আমাদের জাতীয় চেতনা। হাছন রাজা ¯্রষ্টাকে নিয়ে ভেবেছেন। সৃষ্টিকে নিয়ে ভেবেছেন। বিদ্যালয়ে বেশিদূর পড়াশোনা করেননি। ১৮৫৪ সালে তার জন্ম। জন্মের তিন বছর পরেই উপমহাদেশব্যাপী সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। কার্লমার্কস যাকে বলেছেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এর ঢেউ সুনামগঞ্জকেও স্পর্শ করেছিল। কিন্তু হাওরের বিশালতায় সেই ঢেউ মিলিয়ে গেছে। ভৈসালের বৎসর তার মনে যে রেখাপাত করেছিল সিপাহী বিদ্রোহ তা করেনি। এখানে শ্রেণী অবস্থানও একটা বড় ব্যাপার। জমিদার পরিবারগুলো তখন ইংরেজদের সহযোগিতাই করেছে। সে কারণে হয়তো হাছনর্ জার কবিতা ও গানে রাজনৈতিক উত্তাপ পাওয়া যায় না। তার ওপরে হাছন ছিলেন প্রভৃতি প্রেমিক। তবে তার প্রকৃতি চিন্তার সঙ্গে দার্শনিক লেখক অক্ষয় কুমার দত্তের প্রকৃতি চিন্তার কিছু পার্থক্য আছে। উচ্চশিক্ষিত অক্ষয় কুমার দত্ত পাশ্চাত্য মানবতাবাদী চিন্তার সঙ্গে পরিচিতি ছিলেন। তার মতে এই বিশ্বজগৎ প্রকৃতির নিয়মের অধীন। বিশ্বজগৎ কোন বিশ্বাতীত ঈশ্বরের নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত নয়। তার কাছে প্রকৃতির নিয়মই ঈশ্বরের নিয়ম। প্রার্থনার পরিবর্তে প্রাকৃতিক নিয়ম পালন করলেই মানুষ সুখী হতে পারে। মানবকূলের হিত সাধন করাই পরমেশ্বরের যথার্থ উপাসনা। এই ছিল তার মত। হাছন রাজার দর্শন শেষোক্ত চিন্তার কাছাকাছি ছিল। তবে তিনি প্রার্থনাকে একেবারে বাদ দেননি। নামাজ পড়ার সপক্ষে গান রচনা করেছেন। আবার মোল্লা-মুনশীর আরোপিত চিন্তাকেও সমালোচনা করেছেন। তার প্রকৃতি ও জীবপ্রেমের উদাহরণ দেয়া যায় ‘সৌখিন বাহার’ বই থেকে। এই বইটি যেন হাছন রাজার প্রকৃতি অভিজ্ঞতার এক নির্যাস। ৪২ পৃষ্ঠার ছোট এই বইতে তিনি কোড়া, দোয়েল, ঘোড়া, হাতি এসব নিয়ে লিখেছেন। পড়লে মনে হবে তিনি ছিলেন একজন পাখি বিশেষজ্ঞ। মরমী কবি হাছন রাজা-৩
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাছন রাজার গানের দার্শনিক পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে দর্শন কংগ্রেসের সভায় ও পরবর্তীতে লন্ডনে হিবার্ট বক্তৃতায় তিনি হাছন রাজার দু’টি গানের উল্লেখ করে বলেন, পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। সেটি এই যে, ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাইলেন, ‘মম আঁখি হইতে পয়দা হইছে আসমান জমিন, শরীর করিল পয়দা শক্ত আর নরম আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম। এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাহার নয়ন পথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিরাও এমনিভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাহার মধ্যে তিনিই আদিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত। মরমী কবি এই গানটিতে ‘আমি’র পরিচয় দিয়েছেন এভাবে আমি হতে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। আুম হতে এই ত্রিজগৎ। আমি হতে সৃষ্টি হয়েছে ধ্বনি। আমি সুন্দর, আমি ধ্বংস, আমি ভিতর ও বাহির, চিন্তা ও বাক্য, আমি প্রকাশ ও অপ্রকাশ। আমার দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ ও পৃথিবী-এই দৃশ্যমান জগৎ। এইরূপ আমার কর্ণ হইতে সৃষ্টি হয়েছে এই শব্দ, এই ধ্বনি। আমার শরীর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শক্ত ও নরম, ঠান্ডা ও গরম। আমি নাসিকা দ্বারা সৃষ্টি করেছি গন্ধ, আমি জিহ্বা দ্বারা করেছি এই রস মিষ্ট ও তিক্ত। আমার তো আদি অন্ত নেইঅ জীবনের তো শেষ নেই। সে তো চিরকালই জীবিত। আমি আপনাকে চিনেছি জেনেছি- আপনাকে চিনলে তাকে চেনা যায়।’ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চূণী উঠলো রাঙা হয়ে…। কাজী নজরুল ইসলামও তার বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন’ সে কারণে হাছন রাজার দর্শন, আমাদের জাতীয় দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উৎসব মানুষে মানুষে মিলনের কথা বলে। কায়মনে বাঙালী হাছন রাজাও সারাজীবন তার গানে ও দর্শনে সেই মিলনের কথা বলেছেন।
হাছন রাজা ও আমাদের লোকসাহিত্য
সুনামগঞ্জ শহর। সুরমা নদীর পাড়ে মানুষের ভিড়। কোলাহল। সবকিছু ছাপিয়ে আমার কানে এলো এক মধুর গান- ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকা দু’নয়নে নেশা লাগিল রে’ দেখলাম এক আদিবাসী বালক পওাণ খুলে এই গান গাইছে। তার হাতে বাঁশি। গলায় ক্রুশ। ছেলেটির সঙ্গে কথা বললাম। ওর নাম সাংমা। জাতে গারো। লেখাপড়া করেনি বেশিদূর। গানও শেখেনি কোন প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে এই গান তার মুখস্ত হয়ে গেছে। সুরও চলে এসেছে আয়ত¦।
একই অবস্থা সুনামগঞ্জের বর্ষিয়ান শিল্পী আবদুল লতিফেরও। তিনি ৮০ বছরেরও বেশিসময় ধরে হাছন রাজার গান করছেন। হাছন রাজার গানের কথা ও সুর নিয়ন্ত্রণ বা সংরক্ষণের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তবু তিনি ওই গানের অবিকৃত সুর ধরে রেখেছেন তার কণ্ঠে। এভাবেই হাছন রাজার গান ও কবিতা আমাদের লোক সাহিত্যে অবদান রেখে চলেছে। লোকসাহিত্য মানে জনগণের সাহিত্য। সেটা শুধুমাত্র প-িত ও শিক্ষিতজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তবে অশিক্ষিত জনগণের ভেতরেও দর্শন ছিল। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন,একদিকে সিদ্ধাদের চর্যাপদ, অন্যদিকে মরমিয়া বাউল ও বৈষ্ণব সঙ্গীত-সুফীদের প্রভাবেযে বিপ্লব সাধিত হলো তার থেকে কেউই রেহাই পেল না। পরবর্তী অজস্র মারফতী দেহতত্ত্বে তারই লোকায়ত ধারা নানা তরঙ্গ ভঙ্গে প্রবাহিত। [[জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, ভল্যুম ১৪ (১৯৪৮)] সে কারণে হাছন রাজা যেমন গানের রাজা তেমনি লোক সাহিত্যেরও রাজা। লোকসাহিত্যের শক্তি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন-কৃষিভিত্তিক ও গ্রামীণ পূর্ব বাংলায় সামাজিক অগ্রগতির ¯্রথ ধারা এবং শহরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিচ্ছিন্নতা ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, তাই শাসককূল বা রাজশক্তি তাদের ওপর সরকারী সংস্কৃতি বা আদর্শ চাপিয়ে দিতে পারেন। বরং প্রধান শাস্ত্রীয় ধর্ম গণমানুষের প্রচলিত জীবন চেতনার চাপে লৌকিক রূপ নিয়েছে। বাংলায় বিশেষ করে পূর্ব-বাংলায় জীবনবাদী সংস্কৃতি গঠনে সুফিদের প্রভাবজাত লৌকিক ইসলাম ও চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের জন সংশ্রবের বিপুলতা বড় রকমের ভূমিকা পালন করে- বিশেষ করে বৈষ্ণব ভাব আন্দালন এমন পর্যায় পৌঁছে যে তাতে বলা হয় বঙ্গদেশে, কানু ছাড়া তীত নাই। এর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের যোগতন্ত্রসহ প্রবহমান অন্যান্য আদান তো ছিলই, ফলে আমার এক শক্তিশালী মানবিক, বহুত্ববাদী (চধৎধষরংঃরপ) ও সমন্বিত লৌকিক সংস্কৃতি ধারার বিকাশ প্রত্যক্ষ করি, এমনকি মধ্য যুগের শিক্ষিত অভিজাত মুসলমান কবিরাও মাতৃভাষার কাব্য রচনা করতে গিয়ে এদেশের মানুষের বিশেষ করে নব্য মুসলমানের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ও মানস প্রবনতা অনুযায়ী কাব্য রচনা করেছেন। প্রখ্যাত কবি সৈয়দ সুলতান তার মহাকাব্যিক ‘নবী বংশে’ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর,হরি বা কৃষ্ণকে অবতার বা নবীরূপে চিত্রিত বলেছিলেন অন্যদিকে তার জ্ঞান চৌতিশা ও জ্ঞান প্রদীপ যোগ কলন্দর জাতীয় গ্রন্থ। এতে সুফি সাধন-তত্ত্ব ও সন্যাসীর যোগ সাধন পন্থার মিলন ঘটেছে বলে ড: মুহাম্মদ এনামুল হক তার মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৬৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে মারফতী গানে তিনি ‘তত্ত্বজ্ঞান’ প্রচার করেছেন, কারণ কবির মতে, যাহা তত্ত্বজ্ঞান তাহাই মারফতী। শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষ বিজয়’ ও এই লৌকিক সমন্বয়বাদী ধারারই কাব্য। ড: আহম্মদ শরীফ এদের মূল্যায়ণ করতে গিয়ে বলেন, শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত উজির বাহরাম খানদের ধর্মের আরাধানার কথা শেখ ফয়জুল্লাহ পীর, মীর সৈয়দ সুলতান, হাজী মোহাম্মদ, শেখ চাঁদ, আলী রাজা প্রভৃতি আধ্যাত্ম সাধনার নামে বৌদ্ধ বজ্র সহযান স্বীকার করেন। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘…সঙ্গী উকিল তারাই পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ও মানস প্রভাবে ‘সুফী’ নামের দেশী যোগতন্ত্র ভিত্তিক কায়া সাধনে ও দেহাত্মবাদে আশ্বস্তবোধ করে। এদের রচনায় লোকায়ত বিশ্বাস ও লোক সংস্কৃতির প্রভাব গভীর ও ব্যাপক (ড: আহম্মদ শরীফ বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য পৃ: ৩৩১) হাছন রাজা কত গান রচনা করেছিলেন তার সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না। তবে তা প্রায় চার-পাঁচশ হবে বলেই অনুমান। অনেক গান সিলেট- সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে কিছু হারিয়েও গেছে। হাসন রাজার দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল-‘হাছন উদাস’ (১৯০৭) ও ‘সৌখিন বাহার’। দুটি গ্রন্থই এখন দুষ্প্রাপ্য। প্রথম মুদ্রণের পর ‘হাছন রাজা’ নামে কয়েকটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। সিলেটের ‘আল-ইসলাহ’ পত্রিকায় হাছন রাজার অনেক গান প্রকাশিত হয়েছিল। হাছনসহ সিলেট অঞ্চলের অন্যান্য মরমী কবির জীবনী ও গান সংগ্রহ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে এই পত্রিকার ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘হাছন উদাস’-এ বেশ কিছু গান সংকলিত হয়। এই গ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে প্রভাত কুমার শর্মার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। বোধকরি হাছন রাজা সম্পর্কে এটিই প্রথম রচনা। হাছনের গান তত্ত্বমূলক, সকলেই যে এর রস গ্রহণে সক্ষম তা তিনি ভাবেননি।একটি গানে হাছন জানাচ্ছেন: আমি করি রে মানা, অপ্রেমিক গান আমার শুনবে না কিরা দেই কছম দেই আমার বই হাতে নিবে না। হাসনের অপর গ্রন্থ, ‘সৌখিন বাহার’ সম্পর্কে সৈয়দ মুর্তজা আলী বলেছেন, ‘বইখানির আলোচ্য বিষয় স্ত্রীলোক, গোড়া ও ‘কুড়া’ পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। বইখানি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা গ্রাম্যতা ও যৌনাচার রসে জারিত বলে অনেকের ধারণা। হাছনের গান নিয়ে লোক সাহিত্য গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, “হাছনের গানে ঈশ্বরানুরক্তি, নশ্বর পৃথিবী, অনিত্যতার সংসার ও সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তি-এই বিষয়গুলোই প্রধান। তার প্রধান সিলেটের আঞ্চলিক শব্দ ও ক্রিয়াপদের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে এই গানের সুর ও ভাবের আন্তরিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততায় ভিন্ন অঞ্চলবাসীর রস গ্রহণে বাঁধার সৃষ্টি হয় না। হাছনের গানে ভণিতা- ব্যবহারে দুটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। একই গানে একাধিকবার ভণিতা-প্রয়োগ এবং বহু গানের প্রথম চরণেই ভণিতা-ব্যবহার। অন্যান্য মরমী কবির বেলায় সাধারণত দেখা যায় ভণিতা একবারই ব্যকহার করা হয় এবং তা প্রায়শই গানের শেষ চরণে। এটাই তাকে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। হাছনের গানে তার জীবন-দর্শন ও মানস পরিচয় প্রতিফলিত্ তার গানে তিনি কখনও ‘বাউল’ কখনও ‘পাগল’ বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সাধন-ভজনের দিক দিয়ে আনুষ্ঠানিক বাউল না হলেও ধ্যান-ধারণায় বাউলদের সমানধর্মী ছিলেন। জীবন ও জগতের মরমী রূপকার হিসেবে তিনি লালন সাঁইয়ের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন। কি জীবন কি শিল্পে তিনি ছিলেন সর্বমানবিক আদর্শের প্রতিপোষক, সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে ছিল তার স্থান। তার পরধর্ম-সহিষ্ণুতার কথা সিলেট-সুনামগঞ্জের লোক এখনও স্মরণ করে থাকেন। তিনি বেশ কিছু রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদও রচনা করেন। হাছন ছিলেন সন্ন্যাসী-রাজা, রাজর্ষি। যৌবনে উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করলেও উত্তরকালে তিনি সংযমী হয়েছিলেন। বিলাস-বসন ত্যাগ করে অতি সাধারণ জীবনা যাপন করতেন। তার ঘরবাড়ি, আসবাবপত্রের অবস্থাও ছিল অত্যন্ত দীন। এই বিষয়ে কেউ অনুযোগ করলে তিনি গাইতেন তার এই বিখ্যাত গানটি। লোকে বলে রে ঘরবাড়ি ভাল না আমার। কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার।। ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকবো আর। আয়না নিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার।। এই ভাবিয়া হাছন রাজায় ঘর-দুয়ার না বান্ধে। কোথায় নিয়া রাখবো আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে।। হাছন রাজার গান আধুনিককালের কবিদেরও উদ্বুদ্ধ করেছে,প্রাণিত করেছে কবিতা রচনায়। সেই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তার হাছন রাজার বাড়ী কবিতায় বলেছেন: কও তো হাছন রাজা, কি বৃত্তান্তে বানাইলে গে মনোহর বাড়ী? শিয়রে সমন, তুমি ছয় ঘরে বসাইলে জানালা- চৌখুপপি বাগানে এত বাঞ্ছাকল্পতরু কেয়ারি দুনিয়া আন্ধার তবু তোমার নিবাসে কত পিদ্দিমের মালা! এই অনিত্যতার সংসারে, হাছনজ্ঞানে, জীবন দু’দিনের ; এই আছে এই নেই। তবু তো মন রঙ্গরসে দিন কাটাতে চায়, পরের ভাবনা ভাবে না। কিন্তু- যখন মরিয়া যাইবা মাটিত হইব বাসা তখন কোথায় রইবো রঙ্গের রামপাশা।
চিরকাল তো কিছুই থাকে না। মৃত্যুর পর কোন স্বত্বই আর বহাল থাকে না। এই ভবসংসারে মায়ায় মত্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার করণীয় কাজ কিছুই করা হলো না মূঢ় মানুষের চোখে পরানো থাকে সংসার-রঙ্গের ঠুলি। আত্মগ্লানি হাছনকে বিহ্বল করে তোলে। আশয়-বিষয় পাইয়া হাছন তুমি কর জমিদারী চিরদিন থাকবেনি হাছন রাজা লক্ষ্মণছিরি।
জীবন-সায়াহ্নে এসে হাছনের আক্ষেপ জাগে মনে, পরম পুরুষের সাধন-ভজন যে কিছুই হলো না। শোচনাদগ্ধ হাছন বলেন:
দিন গেলে হেলে-দুলে রাত্রি গেল নিন্দে, ফজরে উঠিয়া হাছন হায় হায় করি কান্দে।
এর সঙ্গে তুলনীয় রবীন্দ্রনাথের একটি পঙক্তি। সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো
হেসে খেলে দিন চলে গেল,সাঁঝবেলাতে পাথরঘাটায় বসে আছে হাছন। তার দুর্দশার জন্যে তার ছ’জন গৃহশক্রই কি কম দায়ী! হাছন কেমন করে ‘সোনা বন্ধে’র নাম নেবে, সময় কোথায়? কেননা- স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল কেমনে করিবা হাছন বন্ধের সনে মিল।
হাছনের আর দোষ কি, সে তো ‘মৌলার হাতে ডুরি’ তাকে যেমন ফেরায় তেমন সে ফেরে। অদৃশ্য এক পুতুল নাচের কারিগর সদাই ‘খেইড় খেলায়’ হাসন রাজার দিয়ে।
প্রথম জীবনে হাছন রাজার চরিত্রদোষ দেখা দিয়েছিল। নারী সম্পর্কে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তবে বয়োবৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্রের এইসব স্খলন-পতন ক্রমশঃ দূর হয়ে যায়। হাছন রাজা ছিলেন খুব সৌখিন। ঘোড়া কেনা ও পাখি পোষা ছিল তার প্রধান শখ। তিনি ছিলেন খেয়ালি মানুষ। একবার এক ইংরেজ সাহেবকে তার জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার নিয়োগ করেছিলেন। এজন্য তাকে বেশ কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। পোশাক-পরিচ্ছদে হাসনের সৌখিন স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যেত। সৈয়দ মুর্তজা আলীর বর্ণনায়, ‘হাছন রাজা কখনও কখনও জমকালো পোশাক পরতে ভালবাসতেন। ভ্রমণকালে মখমলের পাজামা, জরিখচিত রঙ্গিন চৌগা, চাপকান ও পাগড়ি ব্যবহার করতেন। হাছন রাজা কখনও কখনও মানুষের কাঁধে চড়ে চলাফেরা করতেন বলেও জানা যায়। সকল মরমী গানের মধ্যেই একটি অভিন্ন সুর ধ্বনিত হয়। পথ যাই হোক, লক্ষ্য এক, চেতনাও তাই একসূত্রে বাঁধা। লালনের ‘অচিন পাখি’-ই হাছনের ‘মুনিয়া পাখি’। এই রূপকের আড়ালে সাধনার গূঢ় তত্ত্বই প্রকাশ পেয়েছে। লালন বলেছেন:
মাটির পিঞ্জিয়ার মাঝে বন্দী হইয়া রে কান্দে হাছন রাজার মন-মনিয়ায়রে রে ॥” আমাদের লোকসাহিত্যে ও লোক দর্শনে হাছন রাজার এই গানের অবদান অপরিসীম। কালজয়ী এই গানের কথা যতদিন যাচ্ছে ততই নতুন মাত্রা নিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে।
গানের রাজা হাছন রাজা। তার বেশিরভাগ গানেই আছে দর্শন। এখানে তার বেশ কিছু দার্শনিক গান তুলে ধরা হলো।
১ বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি। সোনা মামি। সোনা মামি গো। আমারে করিলায় বদনামি ॥ আমি হইতে আল্লা রছুল, আমি হইতে কুল। পাগলা হাছন রাজা বলে তাতে নাই ভুল ॥ আমা হইতে আসমান জমিন আমি হইতেই সব। আমি হইতে ত্রিজগৎ, আমি হইতে রব ॥ আমি আউয়াল, আমি আখের জাহের বাতিন। না বুঝিয়া দেশের লোকে ভাবে মোরে ভিন ॥ আমা হইতে পয়দা হইছে, এই ত্রিজগৎ। গউর করি চাইয়া দেখ হে, আমার ও মন ॥ আক্কল হইতে পয়দা হইল মাবুদ আল্লার। বিশ্বাসে করিল পয়দা, রছুল উল্লার ॥ মম আঁখি হইতে পয়দা, আসমান জমিন। কর্ণ হইতে পয়দা হইছে, মুসলমানী দিন ॥ আর পয়দা করিল যে, শুনিবারে যত। সবদ, সাবদ, আওয়াজ ইত্যাদি যে কত। শরীরে করিল পয়দা, শক্ত আর নরম। আর পয়দা করিয়াছে, ঠান্ডা আর গরম ॥ নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় আর বদবয় ॥ আমি হইতে সব উৎপত্তি হাছন রাজা কয় ॥ মরণ জিয়ন নাইরে আমার ভাবিয়া দেখ ভাই। ঘর ভাঙ্গিয়া ঘর বানানি এই দেখিতে পাই ॥ পাগল হইয়া হাছন রাজা কিসেতে কি কয়। মরব মরব দেশের লোক মোর কথা যদি রয় ॥ জিহ্বায় বানাইয়ি আছে মিঠা আর তিতা। জীবনের মরণ নাইরে দেখ সর্বদাই জিতা ॥ আপন চিনিলে দেখ খোদা চিনা যায়। হাছন রাজায় আপন চিনিয়ে এই গান গায় ॥
২ হাছন রাজায় বলে ও আল্লা ঠেকাইলায় ভবের জঞ্জালে। বেভুলে মজাইলায় মোরে এই ভবের খেলে ॥ বন্ধের সনে প্রেম করিবার বড় ছিল আশা। ভবের জঞ্জালে ফেলে করিলে দুর্দশা ॥ স্ত্রী হইল পায়ের বেড়ি পুত্র হইল খিল। কেমনে করিবায় হাছন বন্ধের সনে মিল ॥ স্ত্রীপুত্রের মায়ায় রইলায় ভবেতে মজিয়া। মরণ পরে স্ত্রী-পুত্র না পাইবায় খুঁজিয়া ॥ (আর) বাপ মইলা, ভাই মইলা আর মইলা মাও। এর কিনা বুঝলায় হাছন এ সংসারের ভাও। (আর) দিন গেল হেলে দুলে রাত্রি গেল নিন্দে ॥ ফজরে উঠিয়া হাছন হায় হায় করি কান্দে ॥ (আর) কান্দিয়া হাছন রাজায় কয় আরপীন নগর বইয়া। দিবা নিশি আছি কেবল বন্ধের চরণ চাইয়া।
৩ মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে। কান্দে হাছন রাজার মন মনিয়া রে ॥ মায়ে বাপে বন্দী কইলা, খুশী র মাঝারে। লালে ধলায় বন্দী হইলাম, পিঞ্জিরার মাঝারে ॥ উড়িয়া যায় রে ময়না পাখী, পিঞ্জিরায় হইল বন্দী। মায়ে বাপে লাগাইয়া, মায়া জালের আন্দি ॥ পিঞ্জিরায় সামাইয়া ময়নায় ছটফট করে। মজবুত পিঞ্জিরা ময়নায় ভাঙ্গিতে না পারে ॥ উড়িয়া যাইব শুয়া পক্ষী, পড়িয়া রইব কায়া। কিসের দেশ কিসের খেশ, কিসের মায়া দয়া ॥ ময়নাকে পালিতে আছি দুধ কলা দিয়া। যাইবার কালে নিষ্ঠুর ময়নায় না চাইব ফিরিয়া ॥ হাছন রাজায় ডাকব তখন ময়না আয়রে আয়। এমন নিষ্ঠুর ময়নায়, আর কি ফিরিয়া চায় ॥
৪ লোকে বলে, লোকে বলে রে, ঘর বাড়ী ভালা না আমার। কি ঘর বানাইব আমি শূন্যের মাঝার ॥ ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকব আর। আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার ॥ এই ভাবিয়া হাছন রাজায় ঘর দুয়ার না বান্ধে। কোথায় নিয়া রাখবো আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে ॥ হাছন রাজায় বুঝতো যদি, বাঁচব কত দিন। দালান কোঠা বানাইত করিয়া রঙ্গীন ॥
৫ আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে,। আরে দিলের চড়ে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে। কাজল কোঠা ঘরের মাঝে, বসিয়াছে কালিয়া। দেখিয়া প্রেমের আগুন উঠিল জ্বলিয়া ॥ কিবা শোভা ধরে (ওরে) রূপে দেখতে চমৎকার।ৎ (আর) বলা নাহি যায় বন্ধের রূপের বাহার ॥ ঝলমল ঝলমল করে (ওরে) রূপে বিজলীর আকার। মনুষ্যের কি শক্তি আছে, চক্ষু ধরিবার ॥ হাছন রাজায় রূপ দেখিয়া, হইয়া ফানা ফিল্লা। হু হু হু হু ইয়াহু ইয়াহু, বল আল্লা আল্লা।
৬ আমি যইমুরে যাইমু আল্লার সঙ্গে। ও আমি যাইমুরে যাইমু আল্লার সঙ্গে ॥ হাছন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে ॥ আল্লার রূপ দেখিয়ে হাছন রাজা, হইয়াছে ফানা। নাচিয়ে নাচিয়ে হাছন রাজায় গাইতেছে গানা ॥ আল্লার রূপ, আল্লর রঙ, আল্লারও ছবি। নুরের বদন আল্লার, কি কব তার খুবি ॥ হাছন রাজা দিলের চক্ষে আল্লাকে দেখিয়া। নাচে নাচে হাছন রাজা প্রেমে মাতয়াল হইয়া ॥ উন্মাদ হইয়া নাচে, দেখিয়া আল্লার ভঙ্গী। হুস-মুস কিছু নাই, হইছে আল্লার সঙ্গী ॥ আদম ছুরত আল্লার জানিয়ায় বেসক। খলকা আদমা আলা ছুরতেহি হক ॥ রূপের ভঙ্গী দেখিয়ে হাছন রাজা হইছে ফানা। শুনে নারে হাছন রাজায়, মুল্লা মুন্সীর মানা।
৭ রঙ্গিলা বাড়ৈ এই ঘর বানাইয়াছে কলে। রঙ্গে রঙ্গে ঘর বানাইয়া, বসি ঘরে খেলে ॥ মাটি দিয়া ঘর বানাইয়া, চামড়ার দিছে ছানি। পত্তন করিয়াছে ঘর মূলধন তার পানি ॥ (আর) মনির চেরাগ দিছে টুল্লির নীচে দিয়া। সর্ব কার্য করে সে যে, সেই রওশনী দেখিয়া ॥ কত কোঠা বানাইয়াছে, দেখতে মনোহর। সারি সারি কোঠা সব দেখিতে সুন্দর ॥ কোঠার মাঝে প্যাদা পাইক আছে সারি সারি। কোঠায় কোঠায় বসাইয়াছে কত যে প্রহরী ॥ মলকুতে, মেকাইল দিছে, ঘুরে আজরাইল। নাছুতে ইছরাফিল খাঁড়া, মুখে জিব্রাইল ॥ ঘরখানি বানাইয়া ঘরে বসিয়া রঙ্গ চায়। ছয়টি রিপু দিছে ঘরে কেমনে খেইড় খেলায় ॥ হাছন রাজায় বলে আমার, বাড়ৈর হাতে তালা। ঘরের মাঝে বসিয়া কত রঙ্গে করে খেলা ॥
৮ হাছন রাজায় কয়, আমি কিছু নয়রে, আমি কিছু নয়। অন্তরে বাহিরে দেখি, (কেবল) দয়াময় ॥ প্রেমেরি বাজারে হাছন রাজা, হইয়াছে লয়। তুমি বিনে হাছন রাজায়, কিছু না দেখয় ॥ প্রেম জ্বালায় জ্বলি মইলাম, আর নাহি সয়। যেদিকে ফিরিয়ে চাই, বন্ধু দেখি ময় ॥ তুমি আমি, আমি তুমি ছাড়িয়াছি ভয়। উন্মাদ হইয়া হাছন, নাচন করয় ॥
৯ একদিন তোর হইবে মরণ রে হাছন রাজা একদিন তোর হইবে রে মরণ। মায়াজালে বেড়িয়ে মরণ, না হইল স্মরণ রে,হাছন রাজা। একদিন তোর হইবে মরণ ॥ যমের দূতে আসিয়া তোমায়, হাতে দিবে দড়ি। টানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে, যমেরও পুরী রে ॥ সে সয়ম কোথায় রইব (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রী। কোথায় রইব রামপাশা, কোথায় লক্ষণছিরি রে ॥ করবায়নি রে হাছন রাজা রামপাশায় জমিদারী। করবায়নি রে কাপনা নদীর পারে ঘুরাঘুরি রে ॥ (আর) যাইবায়নি রে হাছন রাজা, রাজাগঞ্জ দিয়া। করবায়নি রে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া রে ॥ ছাড় ছাড় হাছন রাজা, এ ভবের আশা। প্রাণ বন্ধের চরণতলে, কর গিয়া বাসা রে ॥ গুরুর উপদেশ শুনিয়া, হাছন রাজায় কয়। সব তেয়াগিলাম আমি, দেও পদাশ্রয় রে ॥ হাছন রাজা, একদিন তোর হইবে মরণ। ১০ দেখা দেও দেখা দেও বন্ধুরে ভুবন মোহন। দেখা দিলে থাকে হাছন রাজার জীবন রে ॥ দেখা দেও দেখা দেও বন্ধুরে ॥ দেখা দেও দেখা দেও বন্ধু, হৃদয়ের চান। দেখা দিলে বাঁচে তোমার হাছনের প্রাণ রে ॥ প্রেমানলে জ্বলিয়া আমার তনু ঝর ঝর। এব নাকি প্রাণের বন্ধে ভাবে মোরে পর রে। কাকুতি করিয়ে ডাকি আইস বন্ধু কোলে। গাঁথিয়া রেখেছি হায় পরাইব তোর গলে রে। ঘরখানি সাজাইয়ে আছি কত রঙ দিয়া। পবিত্র করিয়াছি ঘর গোলাব ছিটাইয়া রে। হাছন রাজার মনের আশা পূরাও দেখা দিয়া। তোমায় লাগি হাছন রাজার প্রাণ যায় জ্বলিয়া রে ॥
১১ মরণ কালেরে কে যাইবে তোর সঙ্গে তুমি তো ভুলিয়া আছ, স্ত্রী পুত্রের রঙ্গে ॥ কিসে কি কররে মন আঙ্গে আর ডাঙ্গে। স্বামীর সেবা না করিলে, ধরাইবনি লাঙ্গে ॥ স্বামীর সেবা না করিলায়, দিন গেল গইয়া। বেভুলে মজিয়া রইলায়, কার দিকে চাইয়া ॥ আমার ভাসাইলায় গো আল্লা সুরমা নদী গাঙ্গে। ভাসিয়া ভাসিয়া হাছন রাজা, তোমার চরণ মাঙ্গে ॥
১২ কামাই কৈলে জামাই পাইবায় ভালো গো সুন্দরী নাতিন। কামাই কৈলে জামাই পাইবায় ভাল। সোনা জামাই বুচা দিব, তোমার রাঙ্গা গাল গো ॥ ভাল করিয়া কর কামাই, দিন আর রাইত। রাত্রির মাঝে বিছানায় না হইও কাইত।’ নিজ নাম ধরিয়া জামাইর, ডাকে দিলে জানে। অবশ্য আসিব জামাই, শুনিলে করণে। হাছন রাজায় বলে জামাই, আছে গো অন্তরে। একমনে না ডাকিলে, আইসে না মন্তরে। ডাক ডাক হাছন জান গো, এক মন হইয়া। এখনি তোর প্রাণের জামাই কোলে লইব আইয়া ॥
১৩ ছাড়িলাম হাছনের নাও রে। হাছন রাজার নাও রে ॥ চলো চলো পবন ঘোড়া। আরে বৈঠা ফালাইতে নারে ॥ হৈ হেঁইয়া-হেঁ-হেঁ-হেঁ- সুখের মায়ায় করছিল পীরিত নদীর কূলে বইয়া। এখন কেন ছাইড়া গেল সায়রে ভাসাইয়া রে ॥ হৈ হেঁইয়া-হেঁ- হেঁ- হেঁ। নায়ের থাইকা হাছন রাজা বলে যে ডাকিয়া। পীরিত না করিও রে ভাই মন না দেখিয়া রে ॥
১৪ সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল। দেওয়ানা বানাইল মোরে, পাগল করিল ॥ আরে না জানি কি মন্ত্র পড়িয়ে যাদু করিল। কিবা ক্ষণে হইল আমার, তার সঙ্গে দেখা অংশীদার নাইরে তার সে তো হয় একা ॥ রূপের ঝলক দেখিয়ে তার আমি হইলাম ফানা। সে অবধি লাগল আমার, শ্যামপীরিতের টানা ॥ হাছন রাজা হইল পাগল, লোকের হইল জানা। নাচে নাচে, ফালায় ফালায়, আর গায় গানা। মুখ চাইয়া হাসে আমার, যত আরি-পরি। দেখিয়াছি বন্ধের রূপ ভুলিতে না পারি। ভালো মন্দ যাই বল, তার লাগিয়া না ডরি। লাজলজ্জা ছাড়িয়া বন্দের থাকব চরণ ধরি ॥ দেওয়ানা হইয়া হাছন, কিসেতে কি বলে। মার কাট যাই কর থাকব চরণ তলে ॥
১৫ প্রেমের আগুন লাগল রে, হাছন রাজার অঙ্গে। নিভে না আগুন, ডুবলে সুরমা গাঙ্গে ॥ ধা ধা করি জ্বলছে আগুন, কিসে কি করেঙ্গে। আনিয়া দে গো প্রাণের বন্ধুরে গলেতে ধরেঙ্গে ॥ হাছন রাজা বন্ধু বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে। বন্ধুর আশায় নাচে হাছন, প্রেমেরই তরঙ্গে ॥ হাছন রাজায় বলে আমি, যাইমু বন্ধের সঙ্গে। আমিত্ব ছাড়িয়া দিয়া মিশব তার সঙ্গে ॥
১৬ কারে বন্ধে করিব পার মোল্লার ঝি কারে বন্ধে করিব পার। তোর বাপে করে নমাজ-রোজা আমি গোনাগার ॥ তোর বাপে দিনে-রাইতে নমাজ রোজা করে। লোক সমাজে বসিয়ে কেন, নিন্দা করে মোরে ॥ তোর বাপে সর্বদাই, করে এবাদত। মুই গুনাগারে লইয়া কট মোল্লার মত। নামাজ নামাজ কও মোল্লাজী জায়নামাজনি চিন। পিছ করটে আল্লা থৈয়া ঢুস দেও যে ময়দান ॥ খোদা খোদা কও মোল্লাজী খোদারেনি চিন। গাই বান্দ দুধ থৈয়া লেইজ ধরি টান ॥ হাছন রাজার আল্লারে মুল্লায় নাহি দেখে। আজলের আন্ধি লাগছে কট মোল্লাজীর চোখে। চউক থাকিতে দিনের কানার মত নাহি রই। সাক্ষাতে যে বন্ধু খাড়া মোল্লায় বলে কই ॥
১৭ বাড়ৈ, কই লুকাইলায় রে। ঘরখানি বানাইয়া রে বাড়ৈ, কই লুকাইলায় রে ॥ (আর) ঘরে বাইরে হাছন রাজায় তারে তুকাইল রে। বরুয়া বাশেঁর ঘরখানি বাখাল বাঁশের আড়া। ঢলুয়া বাঁশ দিয়া দিছে চতুর্দিকের বেড়া রে ॥ উলুছন দিয়া দিছে ঘরে এই না ছানি। মেঘ আসিলে চুয়ায় চুয়ায় পড়ে ঘরে পানি ॥ সকল ঘর বিচারিয়া দেখি। টুল্লিয়ে দুয়ার। সেইখানে বসিয়া আছে। বন্ধুয়া আমার ॥ (আর) বন্ধুয়ারে দেখিয়া আমার চিত্ত ব্যাকুল। হাছন রাজায় গান গায়। বাজাইয়া ঢোল ॥
১৮ প্রেমানলে হাছন রাজা জ্বলিল। জ্বলিয়া যাইতে হাছন রাজা এই বলিল ॥ আমি যে জ্বলিয়া মরি নাই মোর দুঃখ। জ্বলিয়া পুড়িয়া দেখিমু বন্ধের মুখ ॥ হাছন রাজা জ্বলিয়া মরতে নাচা কুদা করে। প্রেমের আগুন ধরিয়াছে সকল শরীরে ॥ নিভাইলে না নিভে আগুন ধাক ধাকিয়া উঠে। লুটন কবুতরের মত, হাছন রাজা লুটে ॥ ছটফট করে হাছন, চতুর্দিকে চায়। মম দুঃখ দেখিয়ানি মোর প্রাণবন্ধু আয় ॥
১৯ আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা, আমি তোমার কাঙ্গালী গো। তোমার লাগিয়া কান্দিয়া ফিরে, হাছন রাজা বাঙ্গালী গো ॥ তোমার প্রেমে হাছন রাজার মনে হুতাশন। একবার আমি হৃদ কমলে, করয়ে াাসন ॥ আইস আইস প্রাণপ্রেয়সী ধরি তোমার পায়। তোমায় না দেখিলে আমার জ্বলিয়ে প্রাণ যায় ॥ ছট্ ফট্ করে হাছন তোমার কারণ। ত্বরা করি না আসিলে হইব মরণ ॥ কান্দে কান্দে হাছন রাজা পড়ে আছাড়া খাইয়া। শীঘ্র করি প্রাণপ্রেয়সী, কোলে লও উঠাইয়া ॥ কোলে লইলে ঠা-া হইব, হাছন রাজার হিয়া। সব দুঃখ পাশরিব, চান্দ মুখ দেখিয়া ॥ হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা। রাধা বলিয়া ডাকিলে, মুল্লা মুন্সিয়ে দেয় বাধা ॥ হাছন রাজা বলে আমি, না রাখিব জুদা। মুল্লা মুন্সির কথা যত সকলই বেহুদা ॥
২০ বন্দে কেন আমায় ভালবাসে না। ছয় মাসে নয় একদিন আসে না ॥ আমি বলি আইস তারে,সে তো যায় গিয়া পরের ঘরে। কাকুতি মিনতি করি আমার ঘরে বসে না। কপালে মোর কি যে লেখা লেখিয়াছে প্রাণসখা। দিয়ে দেখা আয়না কাছে প্রাণ মোর বাঁচে না ॥ কি যে আমি কি করিব, কেমন করিয়ে মন ফিরাব। যত যতœ করি সে তো আমার হয় না। হাছন রাজা কান্দিয়া বলে আবার আসলে ধরব গলে। তুলিয়ে লইব প্রিয় কোলে, ছাড়িয়া দিব না ॥
২১ আগুন লাগাইয়া দিল কোনে, হাছন রাজার মনে। নিবে না দারুণ আগুন জ্বলে দিল জানে ॥ ধাক্ ধাক্ করিয়ে উঠিল আগুন ধৈল আমার প্রাণে। সুরমা নদীর জল দিয়ে নিবে না সে কেনে ॥ লাগাইল, লাগাইল আগুন আমার মনমোহনে। বাঁচি না গো বাঁচি না গো, প্রাণ বন্ধু বিহনে। জ্বলিয়া জ্বলিয়া যায় রে আগুন, কিসে নাই মানে। বুঝিয়া দেখরে হাছন রাজা ধরাইল না তোর ধনে ॥
২২ মরণ কথা স্মরণ হইল না হাছন রাজা তোর, মরণ কথা স্মরণ হইল না ॥ যখনে মরিয়া যাইবায়, মাটিতে হইব বাসা। তখনে কোথায় রইব লক্ষণছিরি রঙ্গের রামপাশা ॥ হাড় খাইব হাড়–য়া পোকে, মাড়ইল খাইব ঘুণে। পূণ্য পন্থা না চিনিলায় যৌবনের গুমানে ॥ না রহিব ঘর বাড়ী না রহিব সংসার। না রহিব লক্ষণছিরি নাম পরগণার ॥ কান্দিয়া হাছন রাজায় বলে, আল্লা কর সার। কি ভাবিয়া নাচ হাছন শূন্যের মাঝার।