আবু মকসুদ
·
হঠাৎ করে আমার মাঝে রাজনৈতিক পরিপক্কতা চলে আসায় আমি বিস্মিত হচ্ছি। জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ না করেও আমি রাজনীতি সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, তা আমাকে আনন্দিত করছে। সম্প্রতি আমি রাজনীতি নিয়ে অন্যদের জ্ঞান দিচ্ছি। শুনতাম, তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান গোপনে রাজনৈতিক পরামর্শ দিতেন; অপরিপক্ব ও মূর্খদের কৌশল বাতলে দিতেন। এমনকি বিশ্ব বেহায়া এরশাদও নাকি তার কাছ থেকে গোপনে পরামর্শ নিতেন।
সিরাজুল আলম খানকে ‘কাপালিক’ বলা হতো, যা তন্ত্রমন্ত্র ও বশীকরণের সঙ্গে যুক্ত। কাপালিকরা সাধারণত শৈব সম্প্রদায়ের এবং কালী বা শিবের পূজা করেন। তারা মরা খুলি ব্যবহার করে বিভিন্ন সাধনা করেন। সিরাজুল আলম খান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং ‘দাদাভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠক ছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনি বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেন। রাজনীতির পেছনে থেকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্যই তাকে ‘কাপালিক’ বলা হতো।
সিরাজুল আলম খানের কর্মকাণ্ড সবকিছু গোপনে হতো। প্রকাশ্যে তন্ত্রমন্ত্র সাধনা করা হয় না; আধার ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন না হলে ষড়যন্ত্র জমে না। সিরাজুল আলম খান প্রথম জীবনের অর্জন শেষ জীবনে ষড়যন্ত্রে ব্যয় করেছেন। গৌরবের অবস্থান থেকে পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন শুধুমাত্র ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতার কারণে। তার এই অন্ধকার কৌশলগুলি আমাদের রাজনৈতিক জগতে একটি রহস্যময় মেঘের মতো ভাসছে, যা কখনও সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয়নি।
আমার অনেক দিন থেকেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির চোরাগলিতে হাঁটার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সিরাজুল আলম খানের মতো সক্ষমতা আমার মধ্যে নেই। তাছাড়া গাঁজার গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরে বসে কাউকে পরামর্শ দেওয়ার চিন্তাও আমার জন্য ভীতিকর। আমার পক্ষে গোপন রাজনীতির কুশলী পরিকল্পনাকারী হওয়া সম্ভব নয়। আমি নিজের বিদ্যাবুদ্ধিতে যতটুকু বুঝি, ততটুকু বলি। নিজস্ব এন্টিনার বাইরে কোনো কিছু বলে বিদ্যাগজ হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। আমি জানি, আমি লাফ দিলে কত ফুট উঠতে পারব। আড়াই ফুটের বেশি লাফালে খন্দে পড়ে যাব না এমন নিশ্চয়তা আমি নিজেকে দিই না।
রাজনীতি পর্যবেক্ষণের বিষয় বলে আমি মনে করি। গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ রাজনীতির অলিগলি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। রাজনীতি কোনো রকেট সায়েন্স নয়, উচ্চতর গণিতও নয়। মানুষের জীবনের সাথে সম্পর্কিত যে বিষয় তাকে মানুষের জীবন দিয়েই বুঝতে হয়, সেটা বোঝা অসম্ভব নয়। একটি বিষয়কে শুধু শখ হিসেবে না দেখে, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝতে পারলে তা অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে।
গত দুই-আড়াই মাস ধরে আমি রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ ও কলাম লিখেছি। সবগুলো কলাম আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত। কোনো আরোপিত বিষয় আমি বলতে যাইনি। কোনো লেখাতেই আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিনি। আমার লেখায় সরাসরি কিছু কথা থাকে, আড়াল বা ধোঁয়া রেখে রাজনীতির কথা বলা সম্ভব নয়। পেটে অর্ধেক রেখে মুখে অর্ধেক নিয়ে আসা আমার দ্বারা সম্ভব নয় বলে অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলে। সরাসরি কথা অনেকেরই পছন্দ নয়। আমি প্রায় সব লেখাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করি, তবে কোনো লেখাতেই তিন-চারটির বেশি লাইক আসে না। কিন্তু অবাক করার বিষয়, ফেসবুকের পোস্টে যখন ইনসাইট দেখি, পোস্ট রিচ বা এঙ্গেজমেন্ট দেখি, তখন লাইক-এর হিসাবে গরমিল হয়ে যায়। একটি পোস্টে পাঁচশো এঙ্গেজমেন্ট দেখালেও লাইক মাত্র আড়াইটা। এই হিসাব মিলাতে পারি না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার লেখা বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে কলাম হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব কলাম পড়ে ইনবক্সে বেশ কিছু মন্তব্য পাচ্ছি। রাজনীতির চিন্তকরা, যাদের কাছে রাজনীতি নিয়ে শিক্ষার অনেক কিছু আছে, তারাও দু-একজন আমার কলাম নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আজ এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সাহিত্যিক, যার লেখার আমি একজন গণমুগ্ধ পাঠক, ইনবক্সে লিখলেন: “মকসুদ ভাই, আদাব। প্রকাশ্যে আপনার যুক্তিপূর্ণ লেখা প্রতি সমর্থন জানানো বা মনের কথা বলতে পারছি না। তাই ক্ষমাপ্রার্থী। বিবেক জ্বলছে। ভালো থাকবেন।” তার মাপের পাঠক আমার এলেবেলে লেখা পড়ছেন, এটাই আমাকে আপ্লুত করেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে সমর্থন প্রকাশ করতে না পারায় আমিও দুঃখিত। এইতো গতকালকেই আমাদের প্রধান ফেরেশতা বললেন, যা ইচ্ছা তাই সমালোচনা করা যাবে, তারপরও প্রকাশ্যে আমার এলেবেলে লেখাকে সমর্থন জানাতে ভয় পাচ্ছেন কেন? দেশের স্বাধীনতার পরেও মানুষ কেন ভয়ে আছে? তাহলে এই স্বাধীনতা কী? দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা কি শুধু কথার কথা? আমরা কি এক স্বৈরাচারী থেকে অন্য মহা স্বৈরাচারীর ফাঁদে পড়ছি।
জানি না, কাপালিক থাকলে তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতাম। তিনি মরা খুলি সামনে রেখে কালীর সাধনা করে আমাদের ভবিষ্যতের খবর এনে দিতে পারতেন। আফসোস, তিনিও মরা খুলি নিয়ে কবরে ঘুমিয়ে আছেন। রাজনীতির এই অন্ধকার পথের মেঘ কাটিয়ে কোনো একদিন হয়তো আমরা সত্যিকার অর্থে মুক্তি পাবো, এমনটাই আশায় বুক বাঁধি।
সংবাদটি শেয়ার করুন