খলিল জাহাঙ্গীর
বুঝার বয়স হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন ভোরে যার কোরান তেলাওত শোনে ঘুম ভাঙ্গত তিনি ছিলেন আমার বাবা। আজ দুই যুগ আর এই তেলাওত শোনাতে পাই না। কিন্তু প্রতিদিন ভোরে ঠিকই বাবার কথা মনে পড়ে। তাই আমার কাছে প্রতিদিনই বাবা দিবস।
মৌলভীবাজার জেলার শিক্ষিত সমাজের প্রবীনরা আজও যাদের নাম মনে রেখেছে তাদের মধ্যে মরহুম মাওলানা আতাউর রহমান (প্রাক্তন শিক্ষক মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) অন্যতম।
যিনি আমাদের বাবা।
তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। হাজারো ছাত্র ছাত্রীর শ্রদ্ধাভাজন ওস্তাদ । মৃত্যুর দুই যুগ পার হওয়ার পরও যার প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা তাকে নিয়ে স্মৃতি চারন করেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী আদর্শ মানুষ। পুরোটা জীবন শিক্ষকতা পেশায় অতিবাহিত করেছেন এই স্পষ্ট বাদি আলেমে দ্বীন।
কোরাণ সুন্নাহর সঠিক অনুসরনে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। বিতর্ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন সব সময়। পরিবারে ও সমাজে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছেন সারা জীবন ।
ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্বের সাথে উৎসাহ প্রদান করতেন।
মেধার মুল্যায়ন করা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যখনই কোন মেধাবী ছাত্র তাঁর নজরে পড়তো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে সাধ্যমত সাহায্য করার অব্যাহত চেষ্টা করতেন। নিজ এলাকার শিক্ষায় দিক্ষায় অনগ্রসর পরিবারের অনেক মেধাবী ছাত্র ছাত্রী তাঁর সান্নিধ্যে এসে জীবনে সাফলতা অর্জন করেছে।
আত্মীয় ও শুভাকাঙ্খীদের কাছে তিনি ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা। সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে সবাই তাঁর উপদেশের মুল্যায়ন করতো। তাঁর দিক নির্দেশনায় অনেকেরই উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথ সুগম হয়েছিল।
শিক্ষার্থীদের মেধা নির্ণয়ের মাধ্যমে শিক্ষার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারন। তার প্রিয় ছাত্র ছাত্রী ও সন্তানদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া তারই স্বাক্ষ্য বহন করে।
নিজ সন্তানদের ব্যপারে তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা । শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই তিনি
তাদের ব্যপারে যে ছক তৈরী করে রেখেছিলেন তা পূর্ণতা পেয়েছিল শত ভাগ । যা সাধারণত দেখা যায় না। সন্তানদের মধ্যে আলেমে দ্বীন’ শিক্ষক’ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ‘ও ডাক্তার’ বিদ্যমান। তারা আজ দেশ ও বিদেশে মর্যাদা পূর্ণ ও সম্মান জনক অবস্থানে সুপ্রতিষ্টিত।
তিনি পেশাগত দিক থেকে একজন শিক্ষক থাকলেও শিক্ষিত সমাজের সকল পেশার মানুষের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্ম কান্ডে তাঁর ভুমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। যার ফলশ্রুতিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মনে একটা স্থান দখল করে নিয়েছিলেন।
এই ক্ষনজন্মা পুরুষের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৬ সালে তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার কুলাউড়া থানার সন্জরপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ফুলবাড়ি” নামে তাঁর বাড়ির একক পরিচিতি রয়েছে। পরবর্তীতে চাকুরির সুবাদে ও সন্তানদের লেখা পড়ার কথা বিবেচনা করে মৌলভীবাজার শহরে দ্বিতীয় আবাস স্থল স্থাপন করেন।
পিতা মরহুম ছমর উদ্দিন আহমদ বৃটিশ শাসন আমলে হাইস্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। শিক্ষার প্রতি ছিল তার বিশেষ অনুরাগ। পিতার অনুপ্রেরণা ও নিজ প্রচেষ্টায় তাঁর শিক্ষা অর্জন ও পরবর্তী প্রজন্মের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়েছিল।
তিনি নিজ বাড়িতে থেকে স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন পরবর্তীতে চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস ও নোয়াখালী ইসলামীয়া আলীয়া মাদ্রাসা থেকে এফ এম ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত করে শিক্ষকতা শুরু করেন।
তাঁর কর্ম জীবন শুরু হয়েছিল কুলাউড়ার রাউৎগাও হাইস্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে । পরবর্তীতে কমলগন্জের কালীপ্রশাদ হাইস্কুল মৌলভীবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় , ব্রাহ্মমনবাড়িয়া সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সব শেষে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৯৫ ইং সনের ৬ই মে স্ত্রী চার পুত্র দুই কন্যা আত্মীয় স্বজন ও অগণিত গুণগ্রাহী রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মওলার ডাকে সাড়া দিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী মৌলভীবাজার শহরের শাহ মোস্তফার মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
দুই যুগ পার হয়ে গেছে তিনি পরলোকে চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু মৌলভীবাজারের গুনী জনদের মন থেকে মুছে যান নি। তাঁর আদর্শ অমর হয়ে আছে তার ছাত্রদের মাঝে তাঁর সন্তানদের মাঝে।
সংবাদটি শেয়ার করুন