ফরিদ কবির
আত্মজীবনীমূলক বই 'আমার গল্প' বেরোনোর পর নানাজন নানা মন্তব্য করেছেন। অনেকে উৎসাহী হয়ে বইটি পড়েছেন। অনেকে তো বইটি বেরোনোর পর তাদের মতামত জানিয়ে ফেসবুকে পোস্টও করেছেন।
তবে কেউ কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, এতো কম বয়সে(?) আমি কেন আত্মজীবনী লিখতে গেলাম! কঠিন প্রশ্ন হলেও এর উত্তর সোজা।
মানুষের বয়স বাড়লে দুটো জিনিশ হয়। এক, তার সাহস কমে যায়।দুই, তার জীবনের কালো অধ্যায়গুলো ভুলে যেতে চায়।রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ও পরিবারের ভয়ে অনেক কিছু খোলামেলা বলাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
আমি মনে করি, অর্ধসত্য লেখার চাইতে আত্মজীবনী না লেখাই ভালো।
'আমার গল্প'র কিছু কপি এখনো অবশিষ্ট আছে। বন্ধুরা চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন।বইটি প্রকাশ করেছে 'আগামী প্রকাশনী'।
...............................................................
'আমার গল্প' থেকে এক টুকরা।
(আগে যারা এটি পড়েছেন, তাদের আর পড়ার দরকার নেই)
সারাজীবনই নিজে থেকে কখনো কিছু করতে পারিনি! আমার ধারণা, কখনো কোনো ঘটনা ঘটানোর সাধ্য আমার নাই!
আমি সব সময়ে অন্য ঘটনার মধ্যেই বেশিরভাগ সময় ঢুকে পড়েছি! তারপর সে ঘটনার অন্যতম সাক্ষী হয়ে উঠেছি!
আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ বা আমাদের সময়ে আমি মোটামুটি সিনিয়র পদে কাজ করলেও এ কাগজগুলোর শুরুতে আমার কোনো ভূমিকাই ছিলো না! আজকের কাগজে আমি যুক্ত হই খুবই আকস্মিকভাবে! ভোরের কাগজ-এর উদ্যোগ যখন নেয়া হয়, তখন তো আমি ঝর্নাকে নিয়ে কলকাতায়। ফিরে এসে আমি যোগ দেই। সহকারী সম্পাদক হিসেবেই।
আজকের কাগজ ও ভোরের কাগজের গল্পের চাইতে উত্তেজনাময় গল্প নব্বইয়ের দশকে আর ঘটেনি! এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন, এরশাদের পতন ও বিএনপির ক্ষমতাগ্রহণের পর এ দুটি দৈনিকের উত্থান ও পতনের ঘটনাই সবচাইতে অালোচিত বিষয় ছিলো বলে আমার ধারণা।
পঁচাত্তরে সপরিবার বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যেমন আকস্মিকভাবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন, মতিউর রহমানের ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই ঘটেছিলো!
তিনি অাজকের কাগজে একজন পার্টটাইম সাংবাদিক ছিলেন। মাঝেমধ্যে আজকের কাগজে এসে রাজনীতি বিষয়ে একটা দুটো প্রতিবেদন লিখে দিয়ে যেতেন! তার কোনো নির্ধারিত চেয়ার-টেবিলও ছিলো না!
কাজী শাহেদ আহমেদ ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন ও দৈনিকের পূর্বনির্ধারিত শেয়ার দিতে রাজি না হওয়ায় আজকের কাগজের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে!
২৯ জানুয়ারি রাতে নাঈমের নেতৃত্বে প্রায় সবাই আজকের কাগজ থেকে বেরিয়ে আসে। নতুনধারার এক দৈনিকের অপমৃত্যু ঘটে সেদিনই।
ঘটনার দিন সকালেই আমি কলকাতা রওনা হই। আমরা সবাই জানতাম, জানুয়ারি থেকেই আজকের কাগজে ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করা হবে! ফেব্রুয়ারির এক তারিখে নতুন স্কেলে বেতন হবে, সেটা নিয়ে সবাই বেশ প্রফুল্লই ছিলো।
আমার আর ঝর্নার কলকাতা যাওয়ার জন্য নাঈম হাজার দশেক টাকাও দিলো।
নাঈমের হাতে তখন যাদুই কাঠি ছিলো। ওর কাছে অসম্ভব বলতে কিছুই ছিলো না! এতোটাই যে ২৯ জানুয়ারি আজকের কাগজ ভেঙে যাওয়ার আটদিনের মাথায় ও ভোরের কাগজের ডিক্লারেশন বের করে ফেললো। পনেরো ফেব্রুয়ারি থেকেই ভোরের কাগজ বাজারে যেতে শুরু করলো!
ফেব্রুয়ারির আট তারিখে আমি ঢাকা ফিরতেই শরিফ জানালো, ভাইয়া, নাঈম ভাই আপনারে আজই দেখা করতে বলছে!
বললাম, কেন?
আপনি তো জানেন না, আজকের কাগজে তো আমরা কেউ নাই!
আমি বললাম, সেটা জানি। কলকাতা বইমেলায় এখলাস ভাইয়ের (শিশুসাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমেদ) সাথে আমার দেখা হইসিলো। উনার কাছেই শুনছি, আজকের কাগজে তরা নাই!
আমরা তো সবাই রিজাইন করসি। আপনি এখন কী করবেন? শরিফ জানতে চাইলো।
বললাম, আমিও রিজাইনই করবো। নাঈম কী করবে এখন?
শরিফ বললো, পিজির পেছনে তো নাঈম ভাই নতুন অফিস নিসে! ভোরের কাগজ নামে নতুন দৈনিক বের হবে।
সেদিনই আমি ভোরের কাগজ অফিসে গিয়ে ঢুকলাম! নাঈমের রুমে অনেকেই বসে ছিলো। আমাকে দেখেই নাঈম হাসতে হাসতে বললো, কী মিয়া, আজকের কাগজ এইভাবে ভাইঙ্গা দিয়া কলকাতায় ভাগলা?
আমি বললাম, হুম। কী করুম। কলকাতায় গিয়া শাহেদ ভাইরে কইলাম, এইবার যা খুশি করেন!
ভোরের কাগজে আমাদের নতুন করে যাত্রা শুরু হলো। পনেরো তারিখেই ভোরের কাগজ বাজারে গেলো। সেদিন বিভিন্ন পত্রিকায় ভোরের কাগজের চমৎকার একটা বিজ্ঞাপনও ছাপা হলো। আমরা যে আজকের কাগজেরই সেই তরুণ তুর্কি তার প্রচ্ছন্ন আভাষ পাওয়া গেলো বিজ্ঞাপনের ভাষায়ও। বিজ্ঞাপনটি তৈরি করে দিলেন আফজাল ভাই (শিল্পী ও অভিনেতা আফজাল হোসেন)।
বিজ্ঞাপনটি ছিলো এরকম-
'আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি
অা জ কে র কা গ জ-
ভোরের কাগজ!'
ভোরের কাগজও কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের পাঠকদের ভালবাসা আদায় করে নিলো।
কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ভোরের কাগজেও ভাঙনের সুর বেজে উঠলো!
তবে, সেই সুর আমাদের কারোর কানে তখনো পৌঁছায়নি! সেই সুর প্রথম আমার কানে তুলে দিলেন মতি ভাই, মানে মতিউর রহমান!
এরপরই দ্রুত একের পর এক ঘটনা ঘটতে শুরু করলো! মুঘল সাম্রাজ্যের মতোই এখানেও হদিস পাওয়া গেলো প্রাসাদ(!) ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস আর দলাদলির! আমি ছিলাম এসব ঘটনার বাইরের একটা চরিত্র! এক সময় লক্ষ করলাম, সেই ঘটনায় আমিও ঢুকে গেছি! নিজেরই অজান্তে!
ভোরের কাগজে মতি ভাই নিয়মিত এলেও তেমন কারোর সঙ্গেই তার তখনো ঠিক ঘনিষ্টতা হয়নি! আমার সঙ্গে এক-দুবার কুশল বিনিময় অবশ্য হয়েছে! তিনি আসলে ছিলেন এ কাগজে একেবারেই বেমানান। কারণ এখানে সবাই ছিলো এক অর্থে তরুণ। মতি ভাই-ই কিছুটা বয়স্ক! হয়তো সে কারণেই তাকে সবাই কিছুটা এড়িয়েই চলতো!
একদিন দেখি, মতি ভাইয়ের দু চোখ টকটকে লাল! তাকে খুবই বিষণ্ন ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিলো। আমি উপেক্ষা করলেই হতো!
কিন্তু আমার স্বভাব মন্দ! কাউকে বিধ্বস্ত দেখলে এগিয়ে যাওয়া আমার একটা বদঅভ্যাস!
আমি এগিয়ে গেলাম।
না গেলেই আজ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো!
সেই এগিয়ে যাওয়াই আমার কাল হলো!
নাঈমেরও!
আমার চরিত্রেরও বদল ঘটলো। আমি ছিলাম নাঈমের ঘনিষ্ট সহচর। কিন্তু দাঁড়ালাম নাঈমেরই বিরুদ্ধে! আমার অন্তত তখন মনে হয়েছিলো, ন্যায়ের পক্ষেই দাঁড়িয়েছি আমি!
এখন বুঝি, যে সত্য আমরা জানি, তা আসলে অর্ধসত্য। পুরো সত্য বলতে আসলে কিছুই নাই।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com