মার্কিন মুলুকে নিখোঁজ পর্যটক

প্রকাশিত: ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২২, ২০২৩

মার্কিন মুলুকে  নিখোঁজ  পর্যটক

 

মাহমুদ হাফিজ

মার্কিন দেশ ভ্রমণে ইউজিন শহরটি একা একা এক্সপ্লোর করতে মন চাইলো। বৃষ্টিমুখর দুপুরে একা বেরিয়ে গেলাম দক্ষিণ ইউজিনের রেসিডেন্ট কমপ্লেক্স স্পেন্সার ভিউ থেকে।

একা একা বেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া কিংবা নগরী আবিস্কার আমার পুরনো অভ্যেস। শহর-নগরের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে এর প্রাণসূত্রটি আবিস্কারের জন্য জনযানে চড়ার বিকল্প নেই। এতে ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও বলার মতো কাহিনী জমে। নব্বুই সালে কলকাতা গিয়ে প্রথম হারিয়ে যাই। ভরবিকেল থেকে পথঘাট খুজে শেষাবধি রাত বারোটায় খুজে পাই নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন জাকারিয়া স্ট্রীটের হোটেল। এরপর যতো ভ্রমণ করেছি, কোন কোন না ভাবে হারিয়েছি ইচ্ছে অনিচ্ছেয় । আজ এ শহরে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলো বড়।
ইউজিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যের একটি ছোট শহর। নদী-খাল বিধৌত, গুচ্ছ পাহাড় (ক্যাসকেড) বেষ্টিত প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলের প্রকৃতিময় এক চমৎকার শহর ইউজিন। গুগলিং করে শহরের পথঘাট সম্পর্কে একটা আইডিয়া নিয়ে রেখেছি মস্তিস্কে। শহরের স্লোগান ‘সিটি অব আর্টস এ্যান্ড আউটডোরস’। আজ ঘর নয়, আউটডোরকে আরাধ্য মানলাম। কবি নজরুল বলেছেন, ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’ কিংবা ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবর জগৎটাকে কেমন করে ঘুরছে মানুষ…’।
রাস্তায় বের হয়ে বুঝলাম, শহরের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা নিতে জনযানবাহনে ভ্রমণের যে থামরুল নিজের জন্য তৈরি করে নিয়েছি, ইউজিনের ক্ষেত্রে তা খাটবে না। এ শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা জনযানের ব্যাপারটি পুরো ভিন্ন। নব্বুইভাগ মানুষ নিজস্ব গাড়িতে হুসহাস চলে ঢাউস রাস্তায়। আমার মতো ক্যাজুয়াল ভ্রামণিক, স্বল্পখরচে চলা শিক্ষার্থী আর গাড়ি কেনার সামর্থ নেই এমন স্থানীয়রা কেবল জনযাননির্ভর। গাড়িবিহীনদের জন্য আছে পর্যাপ্ত বাস, ট্যাক্সিসহ নানা যানবাহন। বৃহত্তর জনগোষ্ঠি এর বাইরে বলে জীবনযাত্রার প্রাণসূত্রও জনযান থেকে পাওয়া দুরুহ।
স্পেন্সার ভিউ’র বাসা থেকে বেরিয়ে এলটিডি-বা ‘লেন কাউন্টি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমস’ পরিচালিত বাস ছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছাউনিটি হিলিয়ার্ড স্ট্রীটের ২২ নম্বর এভিনিউয়ে। এ শহরের এভিনিউ ও স্ট্রিটগুলো একমুখী বলে হিলিয়ার্ড স্ট্রিট হয়ে সব গাড়িই যায় ইউজিন স্টেশনে। ইউজিন স্টেশন মূলত বাসস্ট্যান্ড-আমাদের গুলিস্তান। বিভিন্ন নম্বরের বাসগুলো এখান থেকে যাত্রীদের শহরের নানা প্রান্তে নিয়ে যায়।
হিলিয়ার্ডে দেখি আমার মতো আরেকজন মাত্র যাত্রী। সে চীনা, আমি বাঙালি। ২৭, ২৮ ও ৭৩ নম্বর বাস এখানে থামে। বাসের টিকেট চালকের কাছে পাওয়া যায়। দিনমানের টিকেটের দাম তিন ডলার ৭৫ সেন্ট। একমুখী যাত্রার টিকেট একডলার ৭৫ সেন্ট। আমাদের দেশের মতো কন্ডাক্টর সিস্টেম এখানে নেই। বাসে উঠে চালককে আগে থেকে কাটা পাস বা টিকেট দেখাতে হয়। সমপরিমাণ টাকা দিয়ে চালকের কাছ থেকেও টিকেট কাটা যায়। বেশিরভাগ চালকই মধ্যবয়স্কা নারী। আমি দিনমানের টিকেট বা ‘ডে পাস’ই কাটতে চাইলাম। এতে আনলিমিটেড ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া যায়। বাসে উঠে দশডলারের নোট দিয়ে চালকের কাছে ডে পাস চাইলাম। মহিলা চালক মুখে হাসি ধরে রেখে বললো-
সরি, আই ডন্ট হ্যাভ এ্যানি চেঞ্জ।
ভাবলাম, বেটি বলে কী! তাহলে যাবো কি করে?
বললাম-‘হাউ ক্যান আই গো টু মাই ডেস্টিনেশন’।
চালক আমার বাংলিশ ধরনের ইংলিশ উচ্চারণে বুঝলো আমি এ শহরর নতুন অভ্যাগত।
বললো, ‘আই উইল টেক ইউ এ্যাট ইউজিন স্টেশন উইদাউট চার্জ, দেন ইউ ক্যান কালেক্ট ইওর ডিজায়ার্ড টিকেট ফ্রম কাস্টমার সার্ভিস।‘
আমি ইউজিন স্টেশনেই যেতে চাচ্ছিলাম। কারণ সেখান থেকে কোন বাস শহরের কোন দিকে যাচ্ছে, তা জেনে বুঝে ‘ডে পাস’ কিনে ভ্রমণ শুরু করা যাবে। ইউজিন নেমে দেখলাম, ৬৬ নম্বর বাসে চড়লে শহরের ভ্যালি রিভার সেন্টারসহ ওক এলাকার গ্রোসারি শপ ‘মার্কেট অব চয়েজে’ যাওয়া যায়। যাওয়া আসার পথে ভিলামেট রিভার ও কবুর্জ ক্যাসেকডের গুচ্ছ পাহাড়সহ নানা দৃষ্টিনদন দৃশ্য চোখের আরাম দেয়। সে মতে, ডে পাস কিনে ৬৬ নম্বর বাসে ওঠে বসলাম।
শহরের আকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আরামদায়ক বাস হেলে দুলে চলতে শুরু করলো। হেলেদুলে বলছি এ জন্য যে, এই বাসগুলো আধুনিক ও নতুন। এতে ঝাঁকুনি লাগে না। বাস থামলে বা আঁকা, বাঁকা হলে একটা দুলুনি লাগে। বাসে বাইকারদের সাইকেল নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, হুইলচেয়ার ওঠানোর ব্যবস্থাসহ নানা এন্তেজাম আছে। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ভিলামেট নদীপারের ওক স্টপেজে। পাশেই ‘মার্কেট অব চয়েজ’। সদাইপাতিতে মন দিলাম। মার্কেট অব চয়েজে নানা জিনিস দেখে কিনতে আগ্রহ হলো, তবে চয়েজ করতে একটু দেরিই হয়ে গেল। ফিরতি পথেই ঘটলো অনিচ্ছেয় হারিয়ে যাওয়া আর বৃষ্টিবিড়ম্বনার দুর্ভোগ।
ওক থেকে প্রথম ফিরতে হবে ইউজিন স্টেশনে। তারপর বাস বদলে স্পেন্সারভিউমুখো প্যাটার্সন স্ট্রিট কিংবা হিলিয়ার্ড স্ট্রিটের ২২ নম্বর এভিনিউয়ে আসতে হবে। এখানকার বাসগুলো মিনিট মেপে চলে। দেখলাম, ইউজিন স্টেশনে পৌঁছার পর আমার বাস ট্রান্সফারটা খুব সময়ের সঙ্গে মিলছে না। হয় বহুক্ষণ বসে থাকতে হবে না হয় হিলিয়ার্ড-প্যাটার্সনে আমাদের ২২নম্বর এভিনিউয়ের আশপাশ দিয়ে চলে এমন বাসে উঠে পড়তে হবে। এমন একটি বাসের নম্বর ৭৬। এই বাস ইউনিভার্সিটি অব অরেগন ও ওয়ারেন পাহাড়ি এলাকার মধ্যে চলাচল করে ইউজিন স্টেশনের পাশ দিয়ে। ১১ নম্বর এভিনিউ’র অলিভ স্টপেজ থেকে এই বাসে উঠে পড়লাম। এটা হিলিয়ার্ড স্ট্রীট ছুঁয়ে যাবে। বাসটি ঢাউস রাস্তা,পার্ক,সবুজবেস্টিত পথ পেরিয়ে ওয়ারেন-উইলশায়ারের পাহাড়ি রাস্তায় গিয়ে উঠলো। শেষ স্টেশনে সবাই নেমে শ্রান্ত বিকেলে ঘরমুখো হলো। পথে কলহাস্যময় কতো যাত্রী উঠলো নামলো। কোথাও শিক্ষার্থী দল, কোথাও ঘরফেরতা অফিসকর্মী, কোথাও ঘর্মক্লান্ত অড জব কারী। আমার বুঝতে বাকি রইলো না আমি ফিরতি বাসে না উঠে এর আপ রুট বা ওয়ারেনমুখো বাসে চড়েছি। শেষ স্টেশনেও নামছি না দেখে ফাঁকা বাসে মহিলা চালক লুকিং গ্লাসে বার বার তাকাচ্ছে। তার ভাব এমন- ‘গুলিস্তান আইসা গেছে, নাইমা যান, নাইমা যান’। এককালের সুন্দরী মধ্যবয়স্কা চালকের জিজ্ঞাসুনেত্র দেখে আমিই মুখ খুললাম।
‘আই টুক রং ওয়ান, আই হ্যাভ টু গো ব্যাক উইথ ইউ’।
বাসের ভেতর রাখা রাইডার বুকে চোখ রাখলাম। দেখলাম, এই বাসই ফিরে ইউজিন স্টেশন হয়ে হিলিয়ার্ড স্ট্রিট হয়ে যাবে অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউজিন স্টেশনে নেমে আরেক বাসে হিলিয়ার্ড বা প্যাটার্সন স্ট্রিটে যেতে পারি, তবে সে বাস ছাড়ার সময় আরও অনেক পরে। হিলিয়ার্ড স্ট্রিট নেমেই হেঁটে বাসায় যেতে পারবো ভেবে এই বাসেই গাঁট হয়ে বসলাম। নিরিবিলি পাহাড়-টিলার রাস্তায় শুধু আমাকে নিয়েই মধ্যবয়স্কা চালক ধীরে ধীরে চলতো লাগলো। আমি বাসে বসেই শহরের নানা প্রান্ত বেশ উপভোগ করতে থাকি। বাস যখন টিলাময় রাস্তায় এগুতে থাকে, তখন নিচের চমৎকার বাড়িঘর চোখের দারুন আরাম দেয়।
ইউজিন স্টেশন থেকে ডাউনরুটে নতুন যাত্র্রী ওঠে। আমার নতুন টিকেট কাটার ঝামেলা নেই। জ্যাকেটের পকেটে থাকা ডে পাসটা আরেকবার স্পর্শ করে দেখি। ঠিকই আছে। এবার গাঁট হয়ে বসে থাকি। কয়েক স্টপেজ পরই হিলিয়ার্ড স্ট্রিটে এলেই বাস থেকে নেমে পড়ি। নামার পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, কনকনে ঠান্ডা। বৃষ্টির ছাঁটের মধ্যে ম্যারাথন দৌড় দিয়েই দ্রুত বাসায় পৌঁছানোর কথা ভাবতেই নিজেকে আরেক ভুলের মধ্যে আবিস্কার করি। আসলেই হারিয়েছি পথ। হিলিয়ার্ড স্ট্রিটে নেমেছি বটে, তবে তা ১৩ এভিনিউ বরাবর, আমার বাসা ২২ নম্বর এভিনিউয়ে । ১৩ থেকে ২২ এই ১০ এভিনিউ পাড়ি দিতে কতোটা পদক্ষেপ দিতে হবে তা মার্কিনীরা কিংবা মর্কিনপ্রবাসীরা ভালই জানে। ফাঁকা রাস্তায় ঝাঁপানো বৃষ্টির মধ্যে সে রাস্তায় হাঁটা বড় কষ্টকর। তারপর আছে বাসা খুঁজে পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপার।
কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টায় রুমাল পেঁচালাম। হাতে কাগজের ব্যাগে কেজি কয়েক বাজার। বৃষ্টিতে চোখের চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভিজে রুমাল,কাপড় চোপড় দিয়ে মুছে পরিস্কার করা যাচ্ছে না। গায়ে হুডির বদলে সাধারণ জ্যাকেট, পায়ে কাপড়ের জুতো। বাজার থেকে আনা কাগজের ব্যাগটার সুতোর হাতল ইতোমধ্যে ভিজে জবজবে হয়ে ছিঁড়ে গেছে। যে কোন সময় জিনিসপত্র পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বাঁ হাতের তালুতে রেখে ডানহাতে ধরে রেখেছি। রাস্তায় জমা আকসার বৃষ্টির পানি। পানির মধ্যেই জবজবে হয়ে হেঁটে চলেছি। এভিনিউয়ে হুসহাস ছুটে চলা গাড়ি থেকে ঝটকায় রাস্তার পানি এসে গায়ে ছিটে পড়ছে। তা এড়াতে বার বার দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে রাস্তার পাশে। ভরবৃষ্টির মধ্যে ইউজিন শহরের মানুষ রাস্তায় হাঁটে না। গাড়ি বা পর্যাপ্ত যানবাহন আছে বলে শপিং মল এলাকা ছাড়া ভুলেও কেউ রাস্তায় নামে না। গাড়িওলারা ছুটে চলার পথে এই বৃষ্টিবিঘ্নদিনে এমন নালায়েক পথচারিকে তাই অদ্ভুতচোখে একনজর দেখে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এদিকে আমি শহরের বৃষ্টিমুখর রাস্তায় নিজেকে এক হারিয়ে যাওয়া এক অদ্ভূত মানুষ হিসাবে আবিস্কার করে মজা পাচ্ছি। কনকনে ঠান্ডার কাঁপুনি সে মজা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। দাঁতে দাঁতে চেপে এগিয়ে চলেছি আমি-মাথায় রুমালজড়ানো বৃষ্টিভেজা এক মানুষ।
ওদিকে বাসায় শুরু হয়েছে কারবালার মাতম। বাসা থেকে বেরুনোর পর চার পাঁচ ঘন্টা কেটে গেছে। বলে গেছি আজ এ শহরে হারিয়ে যাওয়ার জন্য বেরুচ্ছি। ঘন্টার পর ঘন্টা পরও যখন ফিরছি না, তখন বাসার সবাই সে কথা সত্যজ্ঞান করতে শুরু করেছে। সৃষ্টি হয়েছে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির। গত কয়েকঘন্টায় ঘন ঘন বারান্দা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েও ফল না পেয়ে ‘পুরবাসীগণ’ এখন পুরো হতোদ্যম।
কিছুক্ষণ পর স্পেন্সার ভিউ’র স্যুট নম্বর তিনশ দুইয়ের দরজায় বেল। ঝট করে কপাটটি খুলতেই সামনে দেখি কনিষ্ঠপুত্র তুসু। পেছনে দাঁড়ানো বাসার অন্য সবাই। তারা চোখ ছানাবড়া করে দেখলো, মাথায় সাদা রুমাল পেঁচানো, দু’হাতে খয়েরি রঙের কাগজের ব্যাগ হাতেধরা জবজবেভেজা এক আগন্তক দরজায় দাঁড়িয়ে ঠায় । তিনি এ শহরে হারিয়ে যাওয়া এক অচেনা পর্যটক, এক অদ্ভূত মানুষ। #