এসবিএন ডেস্ক: শীতের হিমেল হাওয়ায় জড়সড় প্রকৃতি। তারপরও আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে শীতের এক একটি রঙিন ফুল। কুয়াশার সাদা চাদর ভেদ করে মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় তাদের সৌন্দর্যের উপস্থিতি।
আমাদের দেশে জন্মালেও শীতের অধিকাংশ ফুলের জন্মস্থান এদেশে নয়। মূলত শীতপ্রধান দেশ থেকে এনে এদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া হয়েছে। এসব ফুলের মধ্যে অন্যতম হল- ডালিয়া, ক্রিসেন্থেমাম, বাটন, কারনেশন, জিনিয়া, কসমস, পিটুনিয়া, হলিহক, এস্টার, সুইটপি, ফ্লকস্, পর্টুলেখা, ভার্বেনা... সবই অন্য দেশের ফুল। কবে কোন পুষ্পপ্রেমিকের চোখে পড়ে ফুলগুলো এদেশে এসেছে তা আজ অনেকটাই অজানা। তবে বিদেশী ফুলগুলো এদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে বলে আমাদের বড় সমাদরের ধন হয়ে উঠেছে। এদেশে জন্মাতে জন্মাতে এরা যেন এদেশের শীত মৌসুমের ফুল হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো ফুলেরতো চমৎকার বাংলা নামই রয়েছে। যেমন ক্রিসেন্থেমামের নাম দেয়া হয়েছে ‘চন্দ্রমল্লিকা’, বাটনকে বলা হয় ‘বোতাম’ ফুল। আর ডালিয়া, কসমস, ক্যালেন্ডুলা, পিটুনিয়া নিজ নিজ নামে জন্ম-জন্মান্তরের চেনা। শীত মৌসুমে এদেশের দু-চারটি নিজস্ব ফুলও রয়েছে। কৃষ্ণকলি, গাঁদা, দশবাইচণ্ডী... ইত্যাদি। শীতকালের ফুলের মধ্যে কয়েকটি ফুল এদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে গাঁদা, ডালিয়া, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, সালভিয়া উল্লেখযোগ্য।
এদেশে জন্মানো ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গাঁদা ফুল। বিভিন্ন রঙ ও প্রজাতির গাঁদা ফুল রয়েছে। কোনোটা ঝলমলে হলুদ, কোনোটা হলদে কমলায় মেশানো, কোনোটা দেখতে একেবারে কমলা রঙের, আবার হলুদ পাপড়ির থোকার মধ্যে খয়েরি রঙের পাপড়িও কিছু রয়েছে। লাল গাঁদাও চোখে পড়ে কখনও কখনও। ফুলের আকার আকৃতির পার্থক্যও একেবারে কম নয়। কোনোটা ছোট তো কোনোটা বেশ বড়। হাইব্রিড গাঁদার গাছগুলো মাঝারি আকৃতির, আঁটোসাঁটো এদের গড়ন। ফুল বেশ বড় বড় এবং জীবনকালও অন্য গাঁদার চেয়ে বেশি।
শীতের আরেক বৈচিত্র্যময় ও নজরকাড়া ফুল ডালিয়া। বিভিন্ন প্রজাতির ডালিয়া রয়েছে। এদের পাপড়ির সৌন্দর্য আর চমৎকার বিন্যাস সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। ফুলের মঞ্জুরির আকার আকৃতি ভেদে ডালিয়ার কমপক্ষে দশটি শ্রেণী রয়েছে। বাংলাদেশে ডেকোরেটিভ, ক্যাকটাস আর পম্পন শ্রেণীর ডালিয়ার চাহিদা বেশি। এদের প্রতিটি শ্রেণীতে রয়েছে অজস্র প্রজাতি। ডালিয়া ফুলের বৈচিত্র্য সে কারণেই বহুমাত্রিক। সবুজ আর নীল রঙ ছাড়া অন্য সব রঙেরই ডালিয়া ফুল রয়েছে। প্রজাতি ভেদে ডালিয়া গাছের উচ্চতার পার্থক্য দেখা যায়। বড়-মাঝারি-ছোট সব রকম প্রজাতি রয়েছে। সে কারণেই বৃত্তাকার নকশায় ছোট থেকে কেন্দ্রের দিকে বড় আকৃতির ডালিয়া বাগানে লাগালে; তাতে ফুল ফুটলে আশ্চর্য এক নান্দনিক শোভার সৃষ্টি হয় চারপাশে। মূলত ডালিয়ার মাংসল মূল দিয়ে নতুন চারা তৈরি করা হয়।
ক্রিসেন্থেমামের বাংলা নাম চন্দ্রমল্লিকা। নাম শুনেই বোঝা যায়, এদেশে মানুষের মনে এ ফুল কতটা জায়গা করে নিয়েছে। শতাধিক প্রজাতির চন্দ্রমল্লিকা রয়েছে। আর এমন কোনো রঙ নেই যা চন্দ্রমল্লিকার প্রজাতিতে নেই। রঙের দিক থেকে এরা অতুলনীয়। টবে ভালো জন্মে। বীজ, কলম বা কন্দ সবভাবেই এদের বংশবিস্তার করা যায়। যদিও সরস ফুলের জন্য অঙ্গজ উপায়ই শ্রেষ্ঠ।
শীত মৌসুমের আরেক ফুল কসমস। আদিনিবাস মেক্সিকোতে। তিন-চার ফুট লম্বা সুদৃশ্য চিকন সরু সরু ফালিযুক্ত পাতা বিশিষ্ট এ ফুল গাছটিতে ধরে এক একটি একক ফুল। প্রজাতি ভেদে এদেরও রঙে রয়েছে ভিন্নতা।
গ্যাজানিয়া সাম্প্রতিক সময়ে শীত মৌসুমের জনপ্রিয় ফুল। ফুলটি বহুবর্ষজীবী বীরুৎ হলেও আমাদের দেশে এটি বর্ষজীবী বীরুৎ হিসেবে জনপ্রিয়। গাছ ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। লতানো। পাতা সরু, লোমযুক্ত। ফুল অনেকটা সূর্যমুখীর মতো। সাদা, লাল, কমলা, হলুদ রঙের ফুল হয়। পাহাড়ি এলাকায় এরা ভালো জন্মে। আদিনিবাস দক্ষিণ আফ্রিকা। টবে লাগানো যায়।
সালভিয়া, মেক্সিকোর আরেক ফুল। ভালোই মানিয়ে নিয়েছে এদেশের প্রকৃতির সঙ্গে। এক একটি লম্বা দণ্ডের ওপর এক একটি ফুল। প্রজাতি ভেদে ফুলের রঙও ভিন্ন। কসমসের যেমন লাল রঙের ফুল রয়েছে তেমনি রয়েছে গোলাপি রঙের ফুলও। আবার নীল রঙের ফুল যেমন আছে, তেমনি আছে সাদা রঙের ফুল। শীতের ফ্যাকাশে ভাবকে রঙে রঙে রঙিন করে তোলে সালভিয়া নামের এ বিদেশী ফুল।
ক্যালেন্ডুলা শীত মৌসুমি ফুল। গাছ ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। পাতা লম্বা, রোমশ ও অমসৃণ। ফুল হয় কমলা রঙের। তবে লাল ও হলুদ রঙের হয়ে থাকে। লম্বা ডাঁটার মাথায় ফুল ফোটে। ফুলের আকার প্রায় ১০ সেন্টিমিটার। ক্যালেন্ডুলা টবেও লাগানো যায়। রোপণের এক মাস পর গাছের আগা ভেঙে দিলে ভালো ফুল হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার সুগন্ধী ফুল পিটুনিয়া। ঘণ্টাকৃতির এক একটি ফুল ফোটে গাছের ডালে ডালে। সাদা, বেগুনি, গোলাপি এমনি সব নানা রঙের ফুল ফোটে এদের জাতভেদে। শীত মৌসুমের আরেক ফুল এস্টার। বিভিন্ন প্রজাতির সঙ্গে রয়েছে বাহারি রঙের মুগ্ধতা।
কৃষ্ণকলি হল বাংলাদেশের শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল। হাত দেড়েক উঁচু গাছে ছোট ছোট ফুল ফোটে। কোনোটির রঙ সাদা আবার কোনোটির রঙ গোলাপি। ফুলটির নাম কেন কৃষ্ণকলি হল সে এক গবেষণার বিষয়।
বাংলার নিজস্ব প্রজাতির আরেক ফুল হল দশবাইচণ্ডী। নামটা বিদঘুটে হলেও ফুলটি দেখতে খুবই সুন্দর। ছোট ছোট গাছের দেহজুড়ে প্রজাপতির মতো দেখতে এক একটি ফুল ফোটে। ফুলের রঙ সাধারণত নীল। তবে হলুদ ও গোলাপি রঙের ফুলও দেখা যায়।
বাংলাদেশের শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল কম হলেও বিভিন্ন দেশের ফুল চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে এদেশের পরিবেশের সঙ্গে। পরিকল্পিতভাবে ফুলের গাছ লাগাতে পারলে কনকনে শীত মৌসুমেও হেসে উঠবে বাগান, আনন্দে উৎফুল্ল হবে মন। চারদিক তখন বাহারি রঙের ফুটন্ত ফুলের আভায় হয়ে উঠবে রঙিন। ফুল যে স্বর্গীয় নান্দনিক সৌন্দর্যের আধার তখন তা স্পষ্ট ও সত্য হয়ে উঠবে।
লেখক : ফসল উন্নয়ন গবেষক, উদ্ভাবক ও লেখক
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com