সৌমিত্র দেব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনের সামনে গেলেই মনটা কেমন করে ওঠে অধ্যাপক শাহিদা ইসলামের । প্রতিদিনের মতো আজো দেখলেন অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের সামনে তরুণদের ছবি তোলার হিড়িক । ইতিহাস বিমুখ এই জাতি কি কোনদিন বুঝবে না এই ভাস্কর্য কিসের প্রতীক ! এটা যে ধারণ করে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । আমরা বুঝি বা না বুঝি , আমাদের প্রতিপক্ষ খুব ভালো করে এটা বোঝে । তাই তো ওরা এটা ভেঙ্গে ফেলার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা করে আসছে । অবশ্য এই সেলফিবাজেরা সবাই যে এখানকার ছাত্র , তা নয় । বেশীর ভাগ বহিরাগত । তরুণদের মধ্যে একজন সাজুগুজু করা নারীকেও দেখা যাচ্ছে । মেজাজ খারাপ করে গাড়ি থেকে নামলেন শাহিদা। কষে একটা ধমক লাগাতে গিয়ে দেখলেন , মহিলাকে খুব চেনা চেনা লাগছে । মহিলাও তাকে দেখে চমকে উঠলো । আরে , শাহিদা আপা আপনি ? এবারে শাহিদা চিনতে পারলেন । রাগটা কোন রকমে গোপন করে বললেন, কেমন আছো প্রিয়াংকা ? এতোদিন পর কোথা থেকে ?
প্রিয়াংকার সঙ্গে অনেক স্মৃতি আছে শাহিদার । কয়েক বছরের জুনিয়র হলেও প্রিয়াংকা ছিল তার রুম মেট । বলল , অনেকদিন দেশে ছিলাম না আপা। এবার সুযোগ পেয়েই তাই ঘুরতে এসেছি পুরনো ক্যাম্পাস । অপরাজেয় বাংলা আমার কাছে শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় , জীবনের ও প্রতীক । তবে এতোদিন পরে একটা বিষয় খেয়াল করলাম আপা ।
শাহিদা জানতে চাইলে সে বলল , ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালেদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা । তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি , তিনি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা থেকে বের হতে পারেন নি । তিনি এখানে নারী সমাজের একজন প্রতিনিধু এনেছেন দুই জন পুরুষ প্রতিনিধির সঙ্গে । পুরুষ দুজন সশস্ত্র , কিন্তু নারী নিরস্ত্র । তিনি কি বোঝাতে চাইছেন , পুরুষেরাই শুধু সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, নারীরা নয় ? নারীরা শুধু সেবা করেছে ? না আপা , ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। সশস্ত্র যুদ্ধ করে অন্তত দুই জন নারী বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন । ইতিহাসের ক্লাশে আপনারা কি নারীদের এই বীরত্ব কখনো আলোচনা করেছেন ?
বিব্রত হলেন শাহিদা । আমাদের ইতিহাসে নারীরা উপেক্ষিত । নিম্নবর্গের মানুষ উপেক্ষিত । সরকার পরিবর্তন হলেই এ দেশে ইতিহাস পরিবর্তন হয় । তবে প্রকৃত ইতিহাস কখনো চাপা থাকে না । তিনি প্রিয়াংকাকে থামিয়ে দিয়ে ওকে ডিপার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকে টিচার্স লাউঞ্জে ।
শাহিদা বলেন , প্রিয়াংকা , তোমার কি লুবনা আপার সঙ্গে পরিচয় আছে । লুবনা মারিয়াম ।
প্রিয়াংকা বলল , তাঁর নাম আমি অনেক শুনেছি । কিন্তু পরিচিত হবার মতো সুযোগ পাই নি । শুনেছি সাধনা নামে তার একটি নাচের দল আছে ।
শাহিদা বলেন, তাহলে তাঁর সম্পর্কে তুমি অনেক কম জানো । তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । তাঁর বাবা সেক্টর কম্যান্ডার কাজী নুরুজ্জামান । তিনি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস , ঐতিহ্য নিয়ে অনেক কাজ করেছেন । আমাদের বিলুপ্তপ্রায় সমর নৈপুণ্য ও নৃত্যকলাকে তিনি নতুন ভাবে তুলে ধরেছেন। একদিন তোমাকে আমি রায়বেঁশে নৃত্য দেখাতে নিয়ে যাবো । এখন বলো , বিলাতে গিয়ে তুমি করছো ?
প্রিয়াংকা জানালো সে বিয়ে করেছে । সেখানে একটা বাংলা স্কুল করেছে । স্বামীর সঙ্গে লন্ডনেই পরিচয় । তবে ওদের দেশের বাড়ি বাংলাদেশে । রাজনগর ।
রাজনগর ? চমকে উঠলেন শাহিদা । ওটা কোথায় ? প্রিয়াংকা বলল , মৌলভীবাজার জেলায় ।
দুই
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য খুব সহজে প্রতিষ্ঠা পায় নি । শুরুতেই তাকে পড়তে হয়েছিল পাঠান ও রাজপুতদের প্রতিরোধের মুখে। এ ছাড়া মুঘলদের গতি রোধ করেছিল বাংলার বারো ভুঁইয়ারা । রাজপুতদের সঙ্গে আত্মীয়তা করে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছিলেন সম্রাট আকবর । কিন্তু পাঠানরা কিছুতেই লাইনে আসেনি । উত্তর ভারত থেকে মার খেতে খেতে শেষ পরযন্ত বালাদেশেই মিলেছিল তাদের আশ্রয় । এই বিষয়ের ওপরে গবেষণা করেই অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন ডক্টর শাহিদা ইসলাম । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের এই শিক্ষক এখনো মনে করেন তাঁর এই অভিসন্দর্ভ সম্পূর্ণ হয় নি। তিনি ডিগ্রি পেয়েছেন।কিন্তু অনেক গবেষণা বাকি রয়ে গেছে ।
গবেষণার নেশায় তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত । যশোর , ময়মন সিং হ , কুমিল্লা , গাজীপুর সব ঘুরে তিনি চলে এসেছেন মৌলভীবাজার জেলায় । এখানে একটি উপজেলার নাম রাজনগর । তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছে এই রাজনগরেই তিনি পেয়ে যাবেন তাঁর সকল প্রশ্নের উত্তর । তাঁর সঙ্গে আছেন পারিবারিক বন্ধুও এ দেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী রফিকুর রহমান এবং প্রিয় ছাত্রী অনন্যা রহমান। রফিক সাহেব এই পাঠানদের শাসনামল নিয়ে প্রামান্য চিত্র বানাবেন । আর অনন্যা নিজে থেকেই চায় তাঁর গবেষণা সহযোগী হয়ে কাজ করতে ।
চার দিনের ছুটি নিয়ে এই সফরে এসেছেন । চলাচলের সুবিধার জন্য নিজের গাড়ি বাদ দিয়ে একটা নোয়া গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন । যাতে করে সব রকম দুর্গম রাস্তায় চলাচল করা যায় । ড্রাইভার শরিফ মিয়া নিজেকে খুব অভিজ্ঞ হিসেবে দাবি করেছে । সব চেয়ে বড় কথা সিলেটে সে বহুবার সফর করেছে । তাই পথ ঘাট সব তার চেনা । কিন্তু সিলেটের সীমানায় ঢোকার পর শায়েস্তাগঞ্জ পার হতেই শাহিদা বুঝতে পারলেন শরিফ মিয়ার প্রথম কথা ঠিক থাকলেও দ্বিতীয় কথা পুরোপুরি সত্য নয় । সে অভিজ্ঞ চালক এতে সন্দেহ নেই। সিলেট সে বহুবার গেছে, এটাও সত্য । কিন্তু সে সিলেটের অনেক জায়গাই চেনে না। শায়েস্তাগঞ্জ এসে যখন শাহিদা বললেন লশকরপুর হাবেলি যাবেন , সেটা খুঁজে বের করতেই শরিফ মিয়ার ঘাম ঝরে গেল । অথচ এটা একটা কমন জায়গা।
একদিকে গুগল ম্যাপ দেখিয়ে শরিফ মিয়াকে গাইড করছেন শাহিদা আর অন্যদিকে অনন্যার জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করছেন । সামনের আসনে বসে রফিক সাহেব আছেন ফুর্তির মেজাজে । জানালার পাশে ক্যামেরাকে তাক করে রেখেছেন দক্ষ তীরন্দাজের মতো । এক্সক্লুসিভ কোন দৃশয় মিস করতে চান না তিনি ।
মুগ্ধতা বালিকার মৌলিক প্রতিভা । অনন্যাও এ ব্যাপারে প্রতিভাময়ী । এর আগে সিলেট এলাকায় তার কখনো যাওয়া হয় নি । যা দেখছে, তাই ভালো লাগছে । আবার এর মধ্যে পেয়ে গেছে গল্পের আমেজ। মুঘল পাঠানের এই ইতিহাস খুঁজতে এসে সে অনেক থ্রিল পাচ্ছে । ম্যাডামের কাছে জেনে নিতে পারছে অনেক অজানা কাহিনী ।
জানা বিষয় নতুন করে জানতে চায় ম্যাডামের কাছে । ১৫২৬ সালে পানি পথের প্রথম যুদ্ধে মুঘল্রা কিভাবে পরাজিত করলো পাঠান সুলতানকে ? সে বহুবার পড়েছে ,পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদির বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। তারা চাগতাই খান ও তৈমুরের মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৫৫৬ সালে আকবরের ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্রূপদী যুগ শুরু হয়। আকবর ও তার ছেলে জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদূর অগ্রসর হয়। আকবর অনেক হিন্দু রাজপুত রাজ্যের সাথে মিত্রতা করেন। কিছু রাজপুত রাজ্য উত্তর পশ্চিম ভারতে মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জারি রাখে কিন্তু আকবর তাদের বশীভূত করতে সক্ষম হন। কিন্তু সে গোড়া থেকে জানতে চায়।
শাহিদা বিরক্ত হন। তবু মুরশিদের মতো প্রিয় ছাত্রীকে আবার নতুন করে পড়াতে শুরু করেন।
মুঘলা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ভারতবর্ষে গেছেন মধ্য এশিয়ার সমরখন্দ থেকে । সমরখন্দ বর্তমান উজবেকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত । তিনি যাদের পরাজিত করেন সেই লোদিরাও কিন্তু ঠিক ভারতীয় নয় ।
লোদি রাজবংশ ছিল পশতু রাজবংশ। । ১৪৫১ থেকে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত উত্তর ভারত ও পাঞ্জাবের অংশবিশেষ ও বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে লোদি রাজবংশের শাসন ছিল। বাহলুল খান লোদি এই রাজবংশের সূচনা করেন।
ইবরাহিম লোদির আমলে লোদি রাজবংশের পতন ঘটে। তিনি মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের (রানা সাঙ্গা) র কাছ থেকে বেশ কিছু আক্রমণের সম্মুখীন হন। রানা সাঙ্গা লোদিদেরকে কয়েকবার পরাজিত করে । ফলে রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপরেও পানিপথের প্রান্তরে লোদি বাহিনীর সৈন্য ও অস্ত্র ছিল মুঘলদের চেয়ে অনেক বেশী । কিন্তু বাবর ভারত আক্রমণের আগে পারস্যের সম্রাটের কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্র গোলাবারুদ পেয়েছিলেন। বিশেষ করে কামান সম্পর্কে লোদি বাহিনীর কোন ধারণাই ছিল না । লোদি বাহিনী হাতি ও ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করতে এসেছিল। কামানের গোলায় একদিকে তারা ধরাশায়ী হয়েছিল । অন্যদিকে কামানের আওয়াজে হাতি ঘোড়া গুলো দিশেহারা হয়ে ছুটে পালায় । এভাবেই বিজয়ী হয় মুঘলেরা । ইব্রাহিম লোদির লাশের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হয় মুঘল সাম্রাজ্য ।
তিন
অনন্যা জানতে চাইলো, লোদিরা কি পাঠান ছিলেন?
শাহিদা তখনো গুগল ম্যাপ দেখছেন। বললেন , হাঁ । তারা ছিল পশতু ভাষী । বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে ছিল তাদের রাজ্য । তারা আদি ভারতীয় না হলেও ভারতের নিকটবর্তী ছিল। তাদের পরবর্তী বংশধরেরা নিজেদেরকে ভারতীয়ই মনে করতো । বাবর ত্তাদের রাজ্য কেড়ে নেয়ায় তারা মুঘলদেরকে বিদেশী মনে করেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলো । এক পর্যায়ে বাবরের পুত্র হুমায়ুনের হাত থেকে রাজ্য কেড়ে নিলো শের
শাহ সুরি ।
তিনি ছিলেন মধ্যযুগীয় দিল্লির একজন শক্তিশালী আফগান বিজয়ী। একজন সাধারণ সেনাকর্মচারী হয়ে নিজের কর্মজীবন শুরু করে পরবর্তীকালে তিনি মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীর সেনানায়কের পদে উত্তীর্ণ হন। শেষপর্যন্ত তাকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ১৫৩৭ সালে নতুন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন যখন অন্যত্র অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় শের শাহ সুরি বাংলা জয় করে সুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করেন।””
কথার মাঝখানে আবার প্রশ্ন করল অনন্যা । শের শাহ কি তবে বাংলার পাঠান সম্রাট ছিলেন ?
বিরক্ত হলেন শাহিদা।
” আরে না না। বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করলেন। এখান থেকেই শুরু হল তাঁর বিজয়ের অগ্রযাত্রা ।
শের শাহ সুরি কেবলমাত্র একজন মেধাবী রণকৌশলবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক ও যোগ্য সেনানায়ক। তার সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের মধ্যেই পরবর্তীকালের (বিশেষত হুমায়ুন-পুত্র আকবরের) মুঘল সাম্রাজ্যের মূলভিত্তিটি নিহিত ছিল।১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তার পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন রাজত্বে তিনি নাগরিক ও সামরিক প্রশাসনের এক নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি প্রথম রুপিয়া নামক মুদ্রার প্রচলন করেন, যা বিংশ শতাব্দী অবধি চালু ছিল। তিনি মোহর নামে ১৬৯ গ্রেইন ওজনের স্বর্ণমুদ্রা ও দাম নামে তাম্রমুদ্রাও চালু করেন।
তাছাড়া তিনি ডাক ব্যবস্থারও আমূল সংস্কার করেন। তিনি হুমায়ুনের দিনা-পানাহ শহরের উন্নতি ঘটান এবং এর নতুন নামকরণ করেন শেরগড়। আবার খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে পতনোন্মুখ পাটনা শহরেরও পুনরায় সংস্কার করেন তিনি। শের মাএ হল বাঘ । কথিত আছে, তিনি কোনো এক ভারতীয় জঙ্গলে একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘকে সম্পূর্ণ খালি হাতে হত্যা করেছিলেন।
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড (সড়ক-এ-আজম) শের শাহ সুরির অমর কীর্তি। বিগত চার শতাব্দী ধরে এই সড়ক “বিশ্বে অদ্বিতীয় এক জীবননদীর মতো” দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আজও ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে এই সড়ক অন্যতম প্রধান রাস্তা। এর ভারতীয় অংশটি বর্তমানে স্বর্ণ চতুর্ভূজ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১৫৪৫ সালে চান্দেল রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কালিঞ্জর দুর্গে বারুদের বিস্ফোরণে শের শাহ সুরির মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ সুরি নাম গ্রহণ করে সুরি সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। সাসারামে একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে তার ১২২ ফুট উঁচু নয়নাভিরাম সমাধিসৌধটি আজও বিদ্যমান।
তার মৃত্যুর পর হুমায়ুনের নেতৃত্বে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আকবরের রাজত্বকালে ১৫৮০ সালে আব্বাস খান সারওয়ানি নামে মুঘল সম্রাটের এক ওয়াকিয়া-নবিশ তারিখ-ই-শের শাহি নামক গ্রন্থে শের শাহ সুরির রাজত্বকালের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন।
এবার সামনের আসন থেকে ঘাড় ঘোরালেন রফিকুর রহমান । গাড়ি কিন্তু শ্রীমঙ্গল পার হয়ে গেছে । শের শাহের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আপনি কিছুই বলেন নাই।
একটু হেসে বলা শুরু করলেন শাহিদা ।
শের শাহের পিতামহ ইব্রাহিম খান সুর, যিনি একজন ঘোড়া ব্যবসায়ী হিসাবে শুরু করেছিলেন, বর্তমান হরিয়ানা প্রদেশের নারনাউল এলাকায় একজন জমিদার (জায়গিরদার) হয়েছিলেন, ।
তার পৃষ্ঠপোষক জামাল খান লোদি সারাংখানির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যিনি তাকে হিসারের কয়েকটি গ্রাম বরাদ্দ করেছিলেন। সিকান্দার লোদি সারাংখানিকে নিযুক্ত করেন, যিনি সিংহাসনে সিকান্দার সংগ্রামকে সমর্থন করেছিলেন, জয়ের পর জৌনপুর এলাকার (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। জামালের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী খান-ই-আজম আহমেদ খান সারাংখানি, ২০,০০০ সাওয়ারের পদমর্যাদার সাথে, ইব্রাহিম সুরের পুত্র হাসান, আফগান দুর্ধর্ষ নেতা, সাসারাম এবং খাওয়াসপুর-থান্ডার ইকতাতে ৫০০ সাওয়ারের পদে নিযুক্ত করেন।
সুলতান বাহলোলের এই অনুগ্রহের সময়েই শের শাহের পিতামহ, যার নাম ইব্রাহিম খান সুরি,*[সুররা নিজেদেরকে মহম্মদ সূরির বংশধর হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন, যে ঘুর সাম্রাজ্যের বাড়ির রাজকুমারদের একজন, যিনি চলে গিয়েছিলেন। তার জন্মভূমি, এবং রোহের আফগান প্রধানদের একজনের কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন।] তার ছেলে হাসান খানের সাথে, শের শাহের পিতা, আফগানিস্তান থেকে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন, এমন একটি জায়গা থেকে যাকে আফগান ভাষায় বলা হয় “শরগারি”। “* কিন্তু মুলতানের ভাষায় “রোহরি” (তহসিল কুলাচি)। এটি একটি শৈলশিরা, সুলাইমান পর্বতমালার একটি স্ফুর, প্রায় ছয় বা সাত ক্রোশ দৈর্ঘ্য, গোমল নদীর তীরে অবস্থিত। তারা মুহাব্বত খান সুর, দাউদ সাহু-খাইল, যাদেরকে সুলতান বাহলোল পাঞ্জাবের হরিয়ানা এবং বাহকলা প্রভৃতি পরগনা জাগিরে দিয়েছিলেন, এর চাকরিতে প্রবেশ করেন এবং তারা বাজওয়ারার পরগণায় বসতি স্থাপন করেন।
রফিকের মনে হল আলোচনা টা বোরিং হয়ে যাচ্ছে । তিনি বাদশা নামদার হুমায়ুন সম্পর্কে জানতে চান । মনে হল মুঘল হলেও হুমায়ুনের প্রতি শাহিদার ও কিছুটা সহানুভুতি আছে। শের শাহের হাতে সাম্রাজ্য হারালেন । আবার শের শাহের মৃত্যুর পর সেটা পুনরুদ্ধার ও করলেন মুঘল সাম্রাজ্যের এই দ্বিতীয় সম্রাট ।
তিনি ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই দফায় আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। তিনি এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের পুত্র ছিলেন। তিনি তার পিতার মতই তার রাজত্ব হারিয়েছিলেন, কিন্তু পারস্য সাম্রাজ্যের সহায়তায় পরিনামস্বরূপ আরও বড় রাজ্য পেয়েছিলেন।
১৫৩০-এর ডিসেম্বরে, হুমায়ুন ভারতীয় উপমহাদেশের মুঘল ভূখণ্ডের শাসক হিসেবে দিল্লির সিংহাসনে তার পিতার উত্তরাধিকারী হন। হুমায়ূন যখন ২২ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি একজন অনভিজ্ঞ শাসক ছিলেন। তার সৎ ভাই, কামরান মির্জা তাদের পিতার সাম্রাজ্যের উত্তরতম অংশ কাবুল এবং কান্দাহার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। পরে মির্জা হুমায়ূনের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে।
হুমায়ুন শেরশাহ সুরির কাছে পরাজিত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন, কিন্তু সাফাভি রাজবংশর সহায়তায় ১৫ বছর পরে তা পুনরুদ্ধার করেন। এরপর, হুমায়ুন খুব অল্পদিনের মধ্যে সাম্রাজ্যের সীমা বৃদ্ধি করেন।
চার
কথা বলতে বলতে তাদের গাড়ি মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ রেস্ট হাউসে পৌঁছে যায় । শাহিদা তার এক অতিরিক্ত সচিব বান্ধবীর মাধ্যমে সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন । কিন্তু গতকাল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এনডিসি বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন আপাতত সার্কিট হাউসে কোন কক্ষ খালি না থাকায় তাদের জন্য জেলা পরিষদে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে । সেখানে দুটো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বরাদ্দ হয়েছে । একটাতে রফিক সাহেব ও অন্যটাতে শাহিদা আর অনন্যা ।
ড্রাইভার শরিফের জন্য আর কক্ষ পাওয়া গেল না । তার জন্য পাশের একটা হোটেলে ব্যবস্থা করে দিল রেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার ।
শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ স্নান করলেন শাহিদা ইসলাম । প্রকৌশলী স্বামী কানাডায় অভিবাসী । ছেলে মেয়েরাও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । তিনি একাই আছেন বাংলাদেশে । বছরে একবার কানাডায় ঘুরতে যান। অথবা ওরা আসে তার কাছে। এটাই উত্তর উপনিবেশিক বাস্তবতা । একা থাকলেও তিনি নিঃসঙ্গ নন। বরং নির্জনতা উপভোগ করেন নিজের মতো ।
শের শাহ সুরি বংশের কাছ থেকে মুঘলরা আবার কি করে সাম্রাজ্য ফিরে পেল , জানতে চায় অনন্যা । উদাস হয়ে যান শাহিদা। ভেবেছিলেন শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু ঘুম আর আসছে না ।
শের শাহ সুরির দুর্বল উত্তরাধিকারী আফগান শাসক আদিল শাহ সুরির প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্য সেনাপতি ছিলেন হেম রাজ ওরফে হেমু । তিনি ভারতীয় ইতিহাসের এমন এক সময়ে ছিলেন যখন মুঘল এবং আফগানরা উত্তর ভারত জুড়ে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা করছিল। তিনি পাঞ্জাব থেকে বাংলা পর্যন্ত উত্তর ভারত জুড়ে লড়াই করেন এবং আগ্রা ও দিল্লিতে হুমায়ুন ও আকবরের মুঘল বাহিনীর বিপক্ষে ২২টি যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
১৫৫৬ সালের ৭ অক্টোবর দিল্লির যুদ্ধে আকবরের মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করার পর হেমু রাজকীয় মর্যাদা দাবি করেন এবং বিক্রমাদিত্যের প্রাচীন উপাধি গ্রহণ করেন যা অতীতে অনেক হিন্দু রাজা গ্রহণ করেছিলেন। এক মাস পরেই মুঘলদের সঙ্গে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় চোখে তীরবিদ্ধ হন । অজ্ঞান অবস্থায় যুদ্ধবন্দী হন। আকবরের অভিভাবক বইরাম খান তার শিরশ্ছেদ করেন।[
এর পরে সম্রাট হন জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর । তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, যিনি ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ অব্দি রাজত্ব করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ইনি মহান শাসকদের অন্যতম হিসেবে মহামতি আকবর নামেও পরিচিত। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে তিনি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৫৬০ সালে বৈরাম খাঁকে সরিয়ে আকবর নিজে সকল ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু আকবর ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে তার সাম্রাজ্য বিস্তার চালিয়ে যান। ১৬০৫ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত তার সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।
কিন্তু পিতা হুমায়ুন বাংলা বিজয় করতে গিয়ে দিল্লির মসনদ হারিয়েছিলেন । তাই আকবর বঙ্গ বিজয়ে আগ্রহী হলেও নিজে কখনো সশরীরে বংলাদেশ সফরের সাহস করেন নি। তিনি সারা ভারতবর্ষ থেকে আফগান ও পাঠানদের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছেন। আর সে কারণেই পাঠানদের শেষ আশ্রয় হয়েছিল বাংলাদেশ ।
অনেক রাতে ঘুমালেও খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে যায় শাহিদার । পাশের বেডে তাকিয়ে দেখেন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে তার প্রিয় ছাত্রী অনন্যা রহমান । আস্তে করে দরজা খুলে তিনি বের হন।
ভোরের স্নিগ্ধ আলো । ঝিরি ঝিরি বাতাস। জেলা পরিষদের বিশাল এই ক্যাম্পাসে একটা পুকুর আছে । আছে একটা পাবলিক লাইব্রেরিও । সেখানে একা হাঁটতে গিয়েও তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন না। শাহিদা জানেন , প্রবাসী অর্থায়নের কারণে দেশের অন্যতম ধনী জেলা শহর এই মৌলভীবাজার । ছবির মতন সুন্দর । খুক করে একটা কাশির শব্দে চমকে পেছনে তাকালেন শাহিদা। দেখলেন মাত্র ১০ গজ দূরে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী রফিকুর রহমান। মুখে তার ফেরেশতার মতো নিষ্পাপ হাসি । রফিক বললেন, আমাদের ফাঁকি দিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়ানো কি ঠিক হচ্ছে ?
হাসলেন শাহিদাও ।অনন্যাকে দেখলাম অঘোরে ঘুমাচ্ছে । ভাবলাম আপনিও ঘুমাবেন । যাক এসেই যখন পড়েছেন , কয়েকটা ছবি তুলেন
সে আর বলতে। এখন তো আর ক্যমেরার জন্য আলাদা করে ফিল্ম কিনতে হয় না ।
পাঁচ
রেস্ট হাউসে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নেই । কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে ঝটপট নাস্তা সেরে নিলেন তারা । রোদ চড়া হবার আগেই ছুটলেন খোজার মসজিদ দেখতে। বেশী কষ্ট করতে হলো না। আলসে অনন্যাকে একটু তাড়া দিতে হলো মাত্র ।
মৌলভীবাজার শহরের অতি নিকটবর্তী ইউনিয়ন মোস্তফাপুর ।আর সেই মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের শাসনামলে ১৪৭৬ সালে একটি ছোট পাহাড়ের উপরে এটি নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তীতে আফগান নেতা ও মুগলদের প্রতিপক্ষ খাজা উসমানের নামে নামকরণ করা হয়। খজার মসজিদ থেকে খোজার মসজিদ ।
অবাক হয়ে দেখলেন শাহিদা, মসজিদটি অনেকখানি সংস্কার করা হয়েছে । প্রাচীনত্ব ঘুচিয়ে দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন উন্নয়নকারীরা । মসজিদের ভেতরে ঢুকতে যেতেই বাধা দিল কয়েকজন গ্রামবাসী ।
তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল , মসজিদে নারীদের প্রবেশ নিষেধ । ক্ষেপে গেলেন রফিক সাহেব । গ্রামবাসীর সঙ্গে তাঁর রীতিমতো ঝগড়া বেঁধে গেল । তাকে থামিয়ে দিলেন শাহিদা । তিনি জানেন এদের কিভাবে ফেস করতে হয় ।
হাত দুটো ওপরে তুলে ইশারায় সবাইকে থামতে বললেন । তারপর ওদেরকে জানালেন তারা সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় হতে এসেছেন। মসজিদ ভালোকরে ভিসিট করে সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হবে । এবার দেখা গেল গ্রামবাসীর মধ্যে প্রবল আগ্রহ। ঢুকতে বাধা তো দিলই না। প্রটোকল দেবার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবকে ফোন করতে চাইলো ।
তাদের অতি উৎসাহে বাধা দিলেন শাহিদা । ভেতরে ঘুরে দেখলেন । ৫০০ বছর আগে এখানে ছিল গভীর জঙ্গল । বিদ্রোহী পাঠানদের আত্মগোপনের জন্য আদর্শ জায়গা । এই মসজিদটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের জন্য সংরক্ষিত করা দরকার ।
গ্রাম বাসীরাও জানালেন এক সময় এই এলাকায় খুব বাঘের উৎপাত ছিল । আজ পর্যন্ত, মসজিদের ভিতর পূর্ব স্তম্ভে বাঘের পায়ের তিনটি চিহ্ন বিদ্যমান। শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের শাসনামলে মুসা ইবনে হাজী আমীর ও স্থানীয় মন্ত্রী (সম্ভবত ফৌজদার) মজলিস আলম ১৪৭৬ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মুঘল বাংলার সুবাহদার, মানসিংহের বিরুদ্ধে আফগান বিদ্রোহের পরে খাজা উসমান নামে এক আফগান গাজি এই মসজিদে আশ্রয় নেয়।
এই মসজিদ বহুবার সংস্কার করা হয়েছে ।
১৯৩০ দশকের শেষের দিকে আজম শাহ নামের একজন পণ্ডিত মসজিদের কাছে বাস করেছিলেন। ১৯৪০ সালে মূল গম্বুজটি পৃথক হয়ে পড়ে এবং আজম শাহ নতুন গম্বুজ নির্মাণের জন্য অর্থোপার্জন করেন, এবং তিনি বানিয়াচং এর ইসমাইল মিস্ত্রির সাথে সফলভাবে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৬০ সালে মসজিদটি আবার নতুন করে সংস্কার করা হয়। আজম শাহের প্রস্থান করার পর, এটি আবার ভেঙ্গে পড়ে এবং গাছ-লতাপাতায় ছেয়ে যায়।
দু চোখ ভরে মসজিদের স্থাপত্য দেখলেন তারা। মসজিদের গম্বুজটি সাদা টাইলের এবং ১৮ ফুট লম্বা। ৩টি বড় দরজা পাশাপাশি ৬টি ছোট দরজা আছে। ভবনের অভ্যন্তরের পূর্ব স্তম্ভে বাঘের পায়ের চিহ্ন রয়েছে। ছাদের কাছাকাছি, একটি ফুলের নকশাসহ একটি আরবি শিলালিপি আছে ।
ফিরে আসার সময় অনন্যাকে বললেন শাহিদা । বুঝলে অনন্যা , খাজা ওসমানের নামেই এই মসজিদের নাম হয়েছে খোজার মসজিদ । চোখ বড় বড় করে বলল অনন্যা , এই খাজা ওসমান আবার কে ?
রহস্যময় হাসি হেসে বললেন শাহিদা , আমার নায়ক । ওকে খুঁজতেই আমরা এখানে এসেছি ।
পূর্ব পুরুষ আফগানিস্তান থেকে এলেও নিজেকে বাঙালি দাবি করতেন খাজা ওসমান খান লোহানি । খাজা ওসমান নামেই সমধিক পরিচিত, ছিলেন উত্তর-পূর্ব বাংলার একজন পাঠান সর্দার এবং যোদ্ধা। বারো ভূঁইয়াদের একজন হিসেবে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ সিলেটে জমিদারি করেন।
খাজা ওসমান সম্পর্কে বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে,
খাজা উসমান ছিলেন বাংলায় মুগল আগ্রাসনের মোকাবেলায় আফগানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রাণপুরুষ এবং বাংলায় মুগলদের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ছিলেন খাজা ঈসার (ঈসা খান মিয়া খেল) পুত্র এবং উত্তর উড়িষ্যার অধিপতি কুতলু খান লোহানীর ভ্রাতুষ্পুত্র। কুতলু খান লোহানীর মৃত্যুর (১৫৯০) পর তাঁর ভাই ও মন্ত্রী ঈসা খান লোহানী কুতলু খানের নাবালক পুত্র নাসির লোহানীকে উড়িষ্যার মসনদে অধিষ্ঠিত করে মুগল সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু ঈসা খান লোহানীর মৃত্যুর পর উড়িষ্যার আফগানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। উড়িষ্যার মুঘল সুবাদার রাজা মানসিংহ কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন (১৫৯৩)। আফগান দলপতিদের বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে মানসিংহ বিশিষ্ট আফগান নেতাদের উড়িষ্যার বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে জায়গির প্রদান করেন। খাজা উসমানকে বাংলার ফতেহাবাদ পরগণায় (বর্তমান ফরিদপুর অঞ্চল) জায়গির বন্দোবস্ত দেয়া হয়।
খাজা উসমান তাঁর ভাই খাজা সুলায়মান, খাজা ওয়ালী, খাজা মালহী ও খাজা ইবরাহিমসহ বাংলা অভিমুখে রওনা হন। কিন্তু উসমান তাঁর জায়গির এলাকায় পৌঁছবার আগেই মানসিংহ জায়গির সনদ বাতিল করেন। সম্ভবত মানসিংহ বাংলায় অপরাপর আফগান নেতাদের এতোটা কাছাকাছি উসমানকে পুনর্বাসন করা সমীচিন মনে করেন নি। মানসিংহের এই হঠকারিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উসমান প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর ভাটি অঞ্চলের অধিপতি ঈসা খান মসনদ-ই-আলার সঙ্গে যোগ দেন। পরে উসমান ময়মনসিংহ জেলায় ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব তীরবর্তী এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বোকাইনগরে গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য নগর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। তিনি ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরবর্তী হাসানপুর ও এগারসিন্ধুতে গড়ে তোলেন দুটি দুর্ভেদ্য সামরিক ঘাটি। ব্রহ্মপুত্র নদই তখন ছিল উসমানের রাজ্য ও মুগল অধিকৃত অঞ্চলের মধ্যকার বিভাজন রেখা।
খাজা উসমান ভাটির অধিপতি ঈসা খানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কয়েকবারই রাজা মানসিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কোনদিনই তিনি মুগলের আধিপত্য মেনে নেন নি। তিনি ঈসা খানের পুত্র মুসা খানের সঙ্গেও মিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখেন। মুসা খানের বিরুদ্ধে মুগল বাহিনীর অভিযানকালে তিনি বরাবরই মুগলদের আক্রমণ করার জন্য আগ্রহী ছিলেন। উসমান সিলেটের আফগান দলপতি বায়েজীদ কররানী এবং বানিয়াচঙ্গের জমিদার আনোয়ার খান এর সঙ্গে কুটনৈতিক সখ্যতা স্থাপন করেন।
মুসা খানের পতনের পর উসমানের পতন ঘটানোই ছিল মুগল সুবাদার ইসলাম খানের প্রধান লক্ষ্য। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের শুরুতে ইসলাম খান উসমানের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য ব্যাপক সমর প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। মুগল পদাতিক বাহিনী শেখ কামাল ও শেখ আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে হাসানপুরে (বোকাইনগরের ২৫ মাইল উত্তরে) গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে শেখ কামাল ও আব্দুল ওয়াহিদ বোকাইনগরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। মুগল বাহিনী সারাপথে চতুষ্পার্শ্বে পরিখা বেষ্টিত ছোট ছোট প্রতিরক্ষা দুর্গ নির্মাণ করে ওই দুর্গের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছত্রছায়ায় সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। ছোট ছোট দুর্গের সহায়তায় অগ্রসরমান মুগল বাহিনীকে পদে পদেই উসমানের সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের মোকাবিলা করতে হয়। উভয় পক্ষে খন্ডযুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
মুগল বাহিনীর বীরদৃপ্ত অগ্রগতি, তাদের সংখ্যাধিক্য এবং বিপুল রণসম্ভার অচিরেই আফগান প্রতিরোধের ভিতকে দুর্বল করে দেয় এবং তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে সংশয়। উসমানের সেনাপতিদের মধ্যকার ঐক্যেও ফাটল ধরে। তাজপুরের দুই আফগান দলপতি নাসির খান ও দরিয়া খান তখন উসমানের পক্ষ ত্যাগ করে মুগলদের সঙ্গে যোগ দেন। দুই সেনাপতির দলত্যাগ এবং অনুরূপ আরও দলত্যাগের সম্ভাবনায় উৎকণ্ঠিত হয়ে খাজা উসমান বোকাইনগর ত্যাগ করে সিলেটে বায়েজিদ কররানির রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। উসমান তখন নাসির খান ও দরিয়া খানের ২৫০ জন আফগান সৈন্যকে বন্দী করেন এবং শেষ পর্যন্ত সিলেট অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করেন। মুগল বাহিনী উসমান কর্তৃক পরিত্যক্ত বোকাইনগর দুর্গ অধিকার করে (৭ ডিসেম্বর ১৬১১)।
উসমান সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় নতুনভাবে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। উহরে গড়ে তোলেন তাঁর সুরক্ষিত রাজধানী শহর। এই উহর বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার হাইল হাওরের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ১৬ মাইল পূর্বে অবস্থিত পতন উশারের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। উসমান তাঁর পুত্র খাজা মুমরিজ ও ভাই খাজা মালহীকে নিকটবর্তী তরফ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মুগল সুবাদার ইসলাম খান এরপর খাজা উসমানের বিরুদ্ধে অভিযানের ব্যাপক প্রস্ত্ততি নেন। বাংলার বাইরে থেকে কতিপয় সেনানায়ককে এনে এই অভিযানে সম্পৃক্ত করেন। দাক্ষিণাত্য থেকে সুজাত খানকে এনে অভিযানের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। শান্তিপূর্ণভাবে উসমানকে আয়ত্তে আনার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট এক জরুরি বার্তা প্রেরণ করা হয়। উসমানকে অনুরোধ জানানো হয় যেন তিনি যুদ্ধবিগ্রহ পরিহার করে আত্মসমর্পণ করেন। জবাবে উসমান জানান যে, অদৃষ্টের বহু ঘাতপ্রতিঘাতের পর সমগ্র দেশ মুগলের কর্তৃত্বে ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশের এক নিভৃত কোণে আশ্রয় নিয়েছেন যেখানে তিনি শান্তিতে বসবাস করতে চান। আর এখন যদি তারা তাকে সেখান থেকেও বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে তাহলে তাঁর জন্য আর একবার রণক্ষেত্রে তাঁর ভাগ্যের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।
সুজাত খানের অধীনে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীতে ছিল ইসলাম খানের ৫০০ বাছাই করা অশ্বারোহী, ৪০০০ বন্দুকধারী, বিপুল সংখ্যক হাতী, ইহতিমাম খানের অধীনে পুরো মুগল নৌবহর এবং সরাইলের জমিদার সোনাগাজীর নৌবহর। স্থলবাহিনী মেঘনার তীর পথে উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে তরফ দুর্গের নিকটে পৌঁছে। খাজা মুমরিজ ও খাজা মালহী দুর্গ থেকে শত্রু বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু স্বল্পকালীন প্রতিরোধের পরই তারা দুর্গ ত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করেন এবং উহরে খাজা উসমানের সঙ্গে মিলিত হন। সুজাত খান তখন তাঁর বাহিনীসহ দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে একসময় পুটিয়া গিরিপথে উসমানের দুর্গের নিকটে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। খাজা উসমানের ভাই খাজা ওয়ালী দুটি দুর্গ থেকে গিরিপথ প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গিরিপথে শত্রুবাহিনীর গতিরোধ করার ক্ষেত্রে এ দুটি দুর্গের অবস্থান ছিল খুবই সুবিধাজনক। একটি দুর্গ ছিল পাহাড়ের পাদদেশে এবং অপরটি পাহাড়ের উপর। খাজা ওয়ালী দুর্গ দুটি পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। এভাবে দুর্গ দুটি ত্যাগ করে খাজা উসমানের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেন খাজা ওয়ালী। সুজাত খান দুটি দুর্গ দখল করে (১৪ ফেব্রুয়ারি ১৬১২) তাঁর বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন।
উহর অভিমুখে সুজাত খানের অগ্রযাত্রার সংবাদ পেয়ে খাজা উসমান তাঁর মোকাবেলার জন্য অগ্রসর হন। খাজা উসমান নিজে তাঁর বাহিনীর মধ্যবর্তী অংশের দায়িত্ব নেন। এ অংশে ছিল ২০০০ অশ্বারোহী, ৫০০০ পদাতিক ও ৪০টি হাতী। ১০০০ অশ্বারোহী, ২০০০ পদাতিক সৈন্য এবং ৩০টি হাতীসহ বাহিনীর বাম অংশের দায়িত্ব দেয়া হয় খাজা ওয়ালীকে। উসমানের বিশ্বস্ত অনুচর শেরে ময়দানকে দায়িত্ব দেয়া হয় বাহিনীর ডান অংশের। এতে ছিল ৭০০ অশ্বারোহী, ১০০০ পদাতিক সৈন্য ও ২০টি হাতী। ১৫০০ অশ্বারোহী, ২০০০ পদাতিক সৈন্য ও ৫০টি হাতী সমন্বয়ে গঠিত অগ্রগামী বাহিনীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর ভাই খাজা ওয়ালী ও খাজা ইবরাহিম এবং ভ্রাতুষ্পুত্র খাজা দাউদের উপর। খাজা উসমান তাঁর বাহিনী নিয়ে রাজধানী উহর থেকে পূর্বদিকে প্রায় ১২ মাইল অগ্রসর হয়ে দৌলম্বপুর গ্রামে পৌছেন। দৌলম্বপুর গ্রামটি বর্তমান মৌলভীবাজারের প্রায় পাঁচ মাইল দক্ষিণে হাইল হাওরের মাইল খানেক উত্তরে অবস্থিত। দৌলম্বপুরে পৌঁছে খাজা উসমান কর্দমাক্ত ও খানাখন্দ ভরা বিশাল এক জলাভূমির পাশে পরিখা খনন করে অবস্থান নেন। এই জলাভূমির পার্শ্বে ছিল বিশাল ও ঘন সুপারি বন। এই সুপারিগাছের সঙ্গে উঁচুতে তক্তা বেঁধে মাচান তৈরি করা হয় এবং সেই মাচানের উপর বসানো হয় কামান। এ ভাবেই উসমান জলাভূমির প্রান্তে শত্রুর মোকাবেলার জন্য এমন দুর্ভেদ্য অবস্থান বেছে নেন যাতে তাঁর প্রতিপক্ষের পক্ষে যুদ্ধ করা ছিল খুবই দুরূহ। মুগল সেনাপতি তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে জলাভূমির নিকটে উসমানের অবস্থান থেকে দেড় মাইল দূরে পরিখা তৈরি করে অবস্থান নেন।
১৬১২ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ রবিবার প্রত্যুষে মুগল বাহিনী উসমানের বাহিনীর ডান অংশের উপর প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই মুগল সৈন্যদের মধ্যে সংশয় ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বাহিনীর ডান ও বাম অংশ শোচনীয় পরাজয় বরণ করে, বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং উভয় অংশের সেনাপতি শেখ আচ্ছা ও ইফতিখার খান নিহত হন। প্রবল আক্রমণের মুখে অবশিষ্ট সৈন্যরা তাড়া খেয়ে মূল পরিখায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আফগানরা মুগল বাহিনীর মধ্যবর্তী অংশে প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর রক্ষাব্যুহ ভেঙে দেয়। মুগল সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রধান সেনাপতি সুজাত খান তাঁর বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কোনরকমে তিনি বন্দীত্ব এড়াতে সক্ষম হন।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধে মুগল বাহিনী যখন সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত এবং আফগানদের বিজয় অবধারিত, ঠিক তখনই একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। অকস্মাৎ এক মুগল অশ্বারোহীর তীরের আঘাতে খাজা উসমান মারাত্মক আহত হন। এই মুগল অশ্বারোহী শেখ আব্দুল জলিল ছিলেন সেনাপতি ইফতিখার খানের এক বিশ্বস্ত অনুচর। যুদ্ধে ইফতিখার খানের মৃত্যুর বদলা নেয়ার উদ্দেশ্যে শেখ আব্দুল জলিল যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে উসমানের দিকে ছুটে যান এবং এতোটা কাছে থেকে তাঁর প্রতি তীর ছোড়েন যে তীরটি তাঁর বাম চোখ ভেদ করে মাথার মগজে ঢুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে উসমান তাঁর ঘাতককে বর্শায় গেঁথে ফেলেন এবং চোখে বিদ্ধ তীরটি টেনে বের করেন। কিন্তু তীরটি বের করতে গিয়ে তাঁর ডান চোখটিও তীরের ফলার সঙ্গে বের হয়ে আসে। তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। এতে এতটুকু বিচলিত না হয়ে এই দুর্ধর্ষ আফগান যোদ্ধা একটি রুমাল দিয়ে বা হাতে নিজের চোখ বেঁধে ফেলেন যাতে তাঁর অনুসারীরা তাঁর এ মারাত্মক জখম দেখতে না পায়। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডান হাতে তাঁর হাতীর মাহুতকে ইশারা করেন সুজাত খানের দিকে অগ্রসর হওয়ার। কিন্তু দ্রুত তাঁর বাকশক্তি রহিত হতে থাকে এবং তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
খাজা উসমানের মৃত্যুসংবাদ সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখা হয়। তাঁর পুত্র খাজা মুমরিজ হাতীর পিঠে করে দ্রুত উসমানের মৃতদেহ শিবিরে নিয়ে যান এবং নিজে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসেন। নেতাকে হারিয়ে আফগানরা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায় এবং রাতের অন্ধকারে উহরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মধ্যরাতের পরে চুপিসাড়ে শিবির ছেড়ে উহারের উদ্দেশে রওনা হন। উসমানের মৃতদেহ উহরে নিয়ে গিয়ে দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলে গোপনে সমাহিত করা হয়। তাঁর প্রাসাদ অঙ্গনে তৈরি করা হয় একটি মেকি সমাধি।
উসমান সম্ভবত ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব। উড়িষ্যা থেকে বিতাড়িত হয়ে উসমান মুগল আগ্রাসনের মোকাবেলা করে বাংলায় স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ অঞ্চলে আফগান শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটান। উসমান অমর হয়ে আছেন তাঁর ব্যক্তিগত শৌর্য, অকুতোভয় উদ্যম ও কর্মশক্তি, তেজস্বিতা, উদ্দেশ্য সাধনে নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি তাঁর স্বাধীনতা প্রিয়তার জন্য। এসব গুণাবলিই তাঁকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছে ক্রমবর্ধমান মুগল শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিরোধ যুদ্ধে। মুগলের আধিপত্য কোনদিন তিনি মেনে নেন নি, বরং স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার সংগ্রামে রণক্ষেত্রেই তিনি প্রাণ দিয়েছেন।
আর উইকি পিডিয়ায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন মানসিংহ এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বাংলার সর্বশেষ পাঠান শাসক। তার পরাজয়ের ফলে বাকী সকল পাঠানকে আত্মসমর্পণ করতে হয় এবং সিলেট অঞ্চলটি সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাহারিস্তান-ই-গায়বী, তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী এবং আকবরনামার মতো বিখ্যাত গ্রন্থে তার জীবনী রয়েছে।
উসমানের পিতার নাম খাজা ঈসা খান মিয়াখেল। তার অপর চার ভাই: সুলায়মান, ওয়ালি, মালহি ও ইব্রাহিম। উসমানের চাচা কুতলু খান লোহানী ছিলেন বাংলার সুলতান সুলায়মান খান কররানী কর্তৃক নিয়োজিত পুরীর গভর্নর। তৎকালীন পূর্ব ভারতে বসবাসকারী পাঠানদের সম্প্রদায়টি ছোট হলেও দিল্লী সালতানাত ও শাহী বাংলায় তারা বেশ প্রভাবশালী ছিল। বেশিরভাগ পাঠান মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং সুলতানাতের পতনেল পর তারা বারো ভূঁইয়াদের সমর্থন করতে শুরু করেন।]১৫৯০ সালে কুতলু খাঁ’র মৃত্যুর পরে নাসির খান লোহানী মুঘলদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় এই অঞ্চলেল পাঠানদের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল।
নাসির দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মাথায় মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে বিহারের তৎকালীন গভর্নর মানসিংহ তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এতে নাসির পরাজিত হন। পরবর্তীতে, মানসিংহ বাংলা সুবাহর সুবাহদার হিসেবে দায়িত্ব পান এবং পাঠানদের প্রভাব দুর্বল করার চেষ্টা শুরু করেন।[১০] এদিকে, খাজা সুলায়মান ওড়িশায় সিং-দের হাতে নিহত হলে উসমান আফগানদের নেতা হিসাবে অধিষ্ঠিত হন। এরপর মানসিংহ ও উসমানের মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাতে, উসমান উড়িষ্যা ছেড়ে চলে গেলে তাকে বাংলার ফতেহাবাদে জায়গীর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।[১১] প্রথমদিকে, মানসিংহ তাতে রাজি হয়েছিলেন। যার ফলে উসমান, তার চার ভাই এবং অন্যান্য পাঠানরা বাংলায় পাড়ি জমাতে শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মানসিংহ যখন বুঝতে পারলেন যে, ঈসা খানের মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে বাংলায় বিদ্রোহীদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান; তখনই তিনি পাঠানদের বাংলায় গমন ঠেকাতে জায়গীর বাতিলের নির্দেশ দেন। মানসিংহের এই হঠকারিতায় উসমান বেশ রাগান্বিত হন এবং দক্ষিণবঙ্গ আক্রমণ করেন ও সাতগাঁও দুর্গ দখল করেন। তারপর, ১৫৯৩ সালে উসমান পূর্ব দিকে অভিযান চালিয়ে ভুশনা পর্যন্ত চলে যান যেখানে তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি চাঁদ ইবনে কেদার রায়কে পরাজিত করেন। এখানে, তিনি ভাটি অঞ্চলের শাসক ঈসা খানের সাথে একটি জোট গঠন করেন, যার নেতৃবৃন্দ পরবর্তীতে বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিতি পায়।[৭] কথিত আছে, মানসিংহ হতে লুকিয়ে থাকতে উসমান একবার দক্ষিণ সিলেটের গয়ঘর মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন।[১২]
ঈসা খাঁর সাথে কাজ করে, উসমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জয় করেন। তিনি তার রাজধানী গৌরীপুরে বোকাইনগর দুর্গ শহরটি তৈরি করতে সক্ষম হন এবং এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব বাংলার উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।[১৩] অল্প সময়ের জন্য পাঠানরা উত্তর ওড়িশায় ফিরে আসে। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পরে, ১৫৯৯ সালে উসমান বোকাইনগর দুর্গ পুনর্নির্মাণ করে একে ২০,০০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করতে সক্ষম হন।[১৪] উসমান হাসানপুর এবং এগারোসিন্দুরে আরও দুটি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্রহ্মপুত্র নদী ছিল পশ্চিমের মুঘল অঞ্চল এবং উসমানের অঞ্চলের মাঝে সীমারেখা।[৭]
১৫৯৬ সালে উসমান শ্রীপুরের চাঁদ রায়কে পরাজিত করেন।[৩] তারপর, ১৬০২ সালে উসমান ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে ও মুঘল থানাদার আলাপসিংহ, সজওয়াল খান ও বাজ বাহাদুর কালমাকদেরকে হারিয়ে দেন। পরাজিত মুঘল থানাদাররা ভাওয়ালের দিকে পালিয়ে যায়।[১৫] মানসিংহ এই খবরটি পাওয়া মাত্রই উসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীরনগর থেকে বানার নদী অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলেন।[১৬] বানার নদীর তীরে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে উসমানের অনেক অস্ত্র ও সংস্থান লুট করা হয়েছিল এবং পাশাপাশি অনেক পাঠানের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিল।[১৭] ঈসা খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ চালিয়ে ভাটি অঞ্চলের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা।[১৮]
১৬০৬ সালে মুসা খান বাংলার সুবাহদার ইসলাম খাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করলে উসমান তৎক্ষণাত সাম্রাজ্যের পরবর্তী লক্ষ্য হয়ে ওঠেন। একই বছরের অক্টোবরে, ইসলাম খাঁ আবদুল ওয়াহিদ এবং শেখ কামাল বায়েজিদকে জাহাঙ্গীরনগর থেকে হাসানপুর পর্যন্ত একটি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পদযাত্রা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাসানপুর ছিল উসমানের রাজধানী বোকাইনগরের ঠিক উত্তরেই। হাসানপুরে থেকে মোগল সেনাবাহিনী বোকাইনগরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সাথে সাথে খন্দক এবং দুর্গ তৈরি করেছিল। যুদ্ধে উসমানের সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং পাশ্ববর্তী তাজপুরে তার পাঠান মিত্র নাসির এবং দরিয়া খান ইসলাম খাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাদের অধীনস্থ অনেক পাঠান যোদ্ধা এসে উসমানের দলে যোগ দিলেও অনেক পাঠান তাদের নেতাদের অনুসরণ করে মুঘলদের সমর্থন জানায়। কিন্তু, এভাবে মিত্রদের পাশে না পাওয়ায় উসমানের শক্তি যথেষ্ট হ্রাস পায়। তাই তিনি ২০০ জনেরও বেশি পাঠানকে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সিলেট অঞ্চল ছিল বাংলায় আফগানদের সবচেয়ে শক্ত ঘাটি। উসমান সেখানে অনেক আফগান নেতাদের সঙ্গে জোট গঠন করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বানিয়াচংয়ের আনোয়ার খান, সিলেটের দ্বিতীয় বায়েজীদ কররানী এবং মাহমুদ খান।[১৯] ১৬১১ সালের ৭ ডিসেম্বর বোকাইনগর মুঘল সাম্রাজ্যের দখলে আসে।[৬] তবে মুসা খানের মৃত্যুর পর পরই বানিয়াচংয়ের আনোয়ার খান জাহাঙ্গীরনগরে মুঘলদের সাথে দেখা করে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তখন তিনি তাদের তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি যতদিন বানিয়াচংয়ে কর্তৃত্ব করতে পারবেন, ততদিন তিনি উসমানের বিরুদ্ধে মুঘলদের সহায়তা করবেন।
উসমান তরফ পৌঁছেছিলেন যেখানে তিনি তার পুত্র মুমরিজ এবং ভাই মালহীকে তরফএ অবস্থান করার জন্য নিযুক্ত করেন। আর উসমানের ভাই খাজা ওয়ালি দায়িত্ব পান বাহুবলের গিরিপালের পাদদেশে পুটিয়া (পুটিজুরি) নামক একটি পাহাড়ী দুর্গের। এরপরে উসমান তার অভিযান অব্যাহত রাখেন এবং ইটা রাজ্যে পৌঁছে তিনি সেখানকার রাজা সুবিদ নারায়ণেকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপরে তিনি কমলগঞ্জের উহারে তার নতুন রাজধানী স্থাপন করেন এবং দক্ষিণ সিলেটের নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে সক্ষম হন।[২০] তার রাজ্যটি উসমানগড় (উহার) নামে পরিচিত ছিল ও তরফ (হবিগঞ্জ) জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বলা হয়ে থাকে, মণিপুর আক্রমণ করার জন্য তরফ থেকে একটি বাহিনী কাছাড়ে প্রেরণ করা হয়েছিল।[২১]
ইসলাম খাঁ উসমানকে পরাজিত করার অভিযানের জন্য একটি বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সমগ্র উপমহাদেশ থেকে সৈন্য ও অফিসার সরবরাহ করেছিলেন এবং দাক্ষিণাত্যের সুজাত খান চিশতিকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন।[২২] যুদ্ধ শুরুর আগে সুজাত উসমানকে মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। উসমান এই বার্তার জবাবে বলেছিলেন যে, অদৃষ্টের বহু ঘাতপ্রতিঘাতের পর সমগ্র দেশ মুগলের কর্তৃত্বে ছেড়ে দিয়ে তিনি দেশের এক নিভৃত কোণে আশ্রয় নিয়েছেন যেখানে তিনি শান্তিতে বসবাস করতে চান। আর এখন যদি তারা তাকে সেখান থেকেও বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে তাহলে তাঁর জন্য আর একবার রণক্ষেত্রে তাঁর ভাগ্যের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।[৬]
সুবাদার ইসলাম খাঁ বানিয়াচংয়ের আনোয়ার খানকে উসমানের বিরুদ্ধে একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বিশ্বস্ত মনে করেননি। তাই তার পরিবর্তে তিনি ইসলাম কুলি খানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এতে আনোয়ার রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর থেকে এগারোসিন্দুরে রওনা হন। তিনি হাসানপুরে উসমানের সমর্থনে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মুসা খাঁর ভাই মাহমুদ খান এবং ভাওয়ালের বাহাদুর গাজীর সাথে নতুন পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু, তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল এবং সকল বিদ্রোহী নেতাকে কারাবন্দি করা হয়েছিল।[২৩]
তবে, ইসলাম খাঁ বাংলায় আফগান শক্তির ইতি টানতে আগ্রহী ছিলেন এবং তাই তিনি যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি তার নিজের ৫০০ অশ্বারোহী, ৪,০০০ বন্দুকধারী এবং বিপুল সংখ্যক ঘোড়া এবং হাতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।[২৪] সরাইলের জমিদার সোনাগাজী যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করেছিলেন এবং ইহতিমাম খান একটি রাজকীয় বাহিনী সরবরাহ করেছিলেন। শেখ আচ্ছা এবং ইফতিখার খান তুর্কমেনকে ডান ও বাম অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৬১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মোঘল সেনাবাহিনী মালহী (উসমানের ভাই) এবং মুমরিজ (উসমানের পুত্র) দ্বারা শাসিত তরফের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পরেই উহারের দিকে পিছিয়ে যান। আর, খাজা ওয়ালী আগত সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার আগেই তার পার্বত্য দুর্গ ত্যাগ করেছিলেন।[৬]
মালি, মুমরিজ ও ওয়ালীর আগমনের পরে উসমানও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। তিনি তার ২০০০ অশ্বারোহী, ৫,০০০ পদাতিক এবং ৪০টি হাতি প্রস্তুত করেছিলেন। উসমান তার টিউপ-ও-টুফাং স্টাইল আর্টিলারিটির জন্য বিখ্যাত ছিলেন।[২৫] তিনি ওয়ালীকে ১০০০ জন অশ্বারোহী, ২০০০ জন পদাতিক এবং ৩০টি যুদ্ধ-হাতি দিয়ে বাম দিকের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। আর শেরে ময়দানকে ৭০০ জন অশ্বারোহী, ১০০০ জন পদাতিক এবং ২০টি হাতি নিয়ে ডানদিকের দায়ভার অর্পণ করেছিলেন।[৭]
১৬১২ সালের মার্চ মাসে উভয় সেনাবাহিনী নিকটবর্তী দৌলম্বপুর গ্রামে মিলিত হয়। সেখানে একটি জলাভূমির তীরে যুদ্ধ শুরু হয়।[২৬] যুদ্ধের শুরুতেই মুঘল বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ইফতিখার খান তুর্কমেন এবং শেখ আচ্ছা উভয়কেই হত্যা করা হয়েছিল এবং তাদের বাহিনীকে প্রচণ্ড পরাজিত করা হয়েছিল। সুজাত খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় বাহিনীও পরাজিত হয়েছিল। তবে সুজাত পালিয়ে বন্দিত্ব এড়াতে সক্ষম হন।[৬]
মুঘলদের পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত, ঠিক তখনই ইফতিখার খানের অনুগত সৈনিক শেখ আবদুল জলিল তার ঘোড়ায় চড়ে উসমানের দিকে যাত্রা করেছিলেন। আবদুল জলিল উসমানের দিকে লক্ষ্য করে তীর ছোড়েন। তীরটি তীরটি তার বাম চোখ ভেদ করে মাথার মগজে ঢুকে যায়। উসমান তীরটি বের করতে গিয়ে তার ডান চোখটিও বের হয়ে আসে। অন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনে এক হস্তী-আরোহীকে সুজাত খানকে খুঁজে বের করে আক্রমণ করার জন্য ইশারা করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উসমান বাকশক্তি হারান এবং তারপর পর মারা যান।[৭]
উসমানকে পাঠানরা উহারে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং দুটি পাহাড়ের মাঝখানে অজ্ঞাত স্থানে তাকে দাফন করা হয়। তবে, উসমানের প্রাসাদের বাইরেও একটি ভুয়া সমাধি তৈরি করা হয়েছিল।[২৭]
আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারতে আফগানরা ৪৯টি হাতি এবং রত্নালঙ্কার মুঘল সম্রাটকে উপহার দেয়।[২৮] মুঘলরাও উসমানের আত্মীয়-স্বজন এবং আত্মসমর্পণকারী আফগানদের সম্মানিত করে। এছাড়াও, এ বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে একটি ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল।[২৯]
১৯৮৫ সাল থেকে স্থানীয়রা উসমানের স্মরণে মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলার নাম উসমানগড় রাখার প্রস্তাব করে আসছে। এই উপজেলার জন্য প্রস্তাব বর্তমানে উহারের উসমানের দুর্গটি দুটি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে: শ্রীসূর্য এবং উসমানগড়। দুপি স্থানই কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার ইউনিয়নে অবস্থিত।[৫] দাবিটি বাস্তবায়িত হলে উসমানগড় উপজেলাটি ৬টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত হবে ।
অনন্যাকে বললেন শাহিদা এই দুই পিডিয়ার তথ্য পেয়েও আমার মনে হয়েছে খাজা ওসমান সম্পর্কে অনেক তথ্য এখনো বাকি রয়ে গেছে ।
ছয়
গয়ঘর থেকে ফিরে তারা গেলেন মৌলভীবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌমোহনায় । সেখানে পানসী রেস্টুরেন্টে ভর্তা ভাজি দিয়ে ভুড়ি ভোজন করলেন । আগে থেকেই প্ল্যান ছিল শাহিদার, বিকেলের দিকে ইকোপার্ক যাবেন । সেই অনুযায়ী রওনা দিলেন তারা । সরকারি কলেজের পাশ দিয়ে সোনাপুর হয়ে কালেঙ্গা রোডে এই ইকো পার্ক । সবুজ বন, টিলা পাহাড় সবকিছু মিলিয়ে এক অপূর্ব সৃষ্টি এই ইকোপার্ক । দুরন্ত শিশুর মতো ছুটোছুটি শুরু করলো অনন্যা । একটু পরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল , ম্যাডাম এতো সুন্দর ইকোপার্কে এখনো কোন বন্য প্রাণীর দেখা পেলাম না ।
ছবি তুলতে তুলতে রফিক সাহেব বললেন, ইকোপার্কের নামে আমরা বন্য প্রাণীর জীবন যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি । বাধ্য হয়ে ওরা আরো গভীর কোন বনে চলে গেছে ।
কিন্তু বন্য প্রাণী না হলেও অচিরেই বন্য মানুষের দেখা মিলে গেল । একটা সি এন জি চালিত অটোতে করে এলো মোট ৬ জন তরুণ। মনে হলো ওরা আগে থেকেই তাদেরকে অনুসরণ করে আসছে । ওদের চোখে মুখে বন্য প্রাণীর হিংস্রতা । ওদের প্রত্যেকের হাতেই ধারালো ছুরি । শাহিদাদের তিনন কে ৬ জন মিলে ঘিরে দাড়ালো ওরা। তারপর ২ ভাগ হয়ে তিনজন মিলে অনন্যাকে টেনে হিচড়ে অটোর দিকে নিয়ে যেতে লাগলো । রফিক সাহেব খালি হাতেই ওদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করলেন । তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । চিৎকার শুরু করেছে অনন্যা ।
এমনি সময় শোনা গেল গাড়ির আওয়াজ । দেখা গেল একটা জিপ গাড়ি । নাম্লেন ৬ ফুট দীর্ঘ এক যুবক । তাকে দেখে যেন আঁতকে উঠলো বখাটে তরুণেরা । অনন্যাকে এক ঝটকায় ফেলে অটোতে করে চোখের নিমেষে পালিয়ে গেল ওরা ।
ভদ্রলোক কাছে এসে অনন্যাকে বললেন , ব্যাথা পান নি তো। তারপর রফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন , আমার নাম সুবীর রায় চৌধুরী । কাছেই কালেঙ্গা রোডে আমার একটা রিসোর্ট আছে । এই বখাটেগুলো স্থানীয় নয় । ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রিসোর্টে একটু রেস্ট নেবেন । এর মধ্যে হয় তো এই ম্যাডামের ট্রমা কেটে যাবে ।
সুবীর রায়ের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যে শাহিদা আর কথা বাড়ালেন না । তিনি শরিফ মিয়াকে বললেন জিপ গাড়িটি অনুসরণের জন্য ।
টিলার ওপরে ছবির মতো সুন্দর রিসোর্ট করেছেন সুবীর । রাতের অন্ধকারে রঙিন বাতি এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রচনা করেছে । আছে তার কাছে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ । ইতিহাস নির্ভর বইগুলির পাতা ওল্টাতে লাগলেন শাহিদা। রফিক সাহেব ছবি তুলছেন। আর চেয়ারে বসে ধাতস্থ হবার চেস্টা করছে অনন্যা । নিজের হাতে তাদের জন্য কবি বানিয়ে আনলেন সুবীর ।
এতোক্ষণে তার সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করলেন শাহিদা । সুবীরদা , আপনার বাড়ি কি এখানেই । সুবীর জানালেন, না না। আমার বাড়ি পাশের উপজেলায় । রাজনগরে ।
– তাই!। রাজগর নামটা কিভাবে হলো ?
শাহিদার প্রশ্ন শুনে সুবীর বলেন, এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করে। আসলে প্রাচীন ইটা রাজ্যের নামে এই রাজ নগর । ১১দশ শতকের শেষ দিকে এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন নিধিপতি শর্মা । তার দশম উত্তর পুরুষ সুবিদ নারায়ণ ছিলেন এই বংশের শেষ রাজা ।
বাহ । ভালো জানেন দেখছি । আপনি কি ইতিহাসের ছাত্র ? শাহিদার প্রশ্ন শুনে সুবীর বলেন, নাহ। ইতিহাস সবাইকেই জানতে হয়। আমি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র ।
মৃদু হেসে শাহিদা বলেন , বঙ্কিমের দুর্গেশ নন্দিনী পড়েছেন ।বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস । সুবীর বলেন, উপন্যাস হিসেবে খুব ভালো । যদিও এই উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো উপন্যাসের ছায়া দেখা যায় । ২৬ বছরের তরুণের রচনা হিসেবে এটা ভালোই । কিন্তু ইতিহাস সেখানে আরোপিত মনে হয়েছে । কাকে নায়ক করতে হবে আর কাকে ভিলেন, সেটা বুঝতে পারেন নি লেখক ।
দিল্লীশ্বরের প্রধান সেনাপতি অম্বররাজ মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎসিংহ বিষ্ণুপুর থেকে মান্দারণ যাত্রাকালে ঝড়ের কবলে পড়ে শৈলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে আশ্রয় নেন। সেখানে ঘটনাচক্রে মান্দারণ দুর্গাধিপতি জয়ধর সিংহের একমাত্র পুত্র মহারাজ বীরেন্দ্র সিংহের স্ত্রী বিমলা ও তাঁর কন্যা দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পরস্পর পরস্পরের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখলেও জগৎসিংহ ও তিলোত্তমা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে পাঠান সেনাপতি ওসমান খাঁ সুকৌশলে মান্দারণ দুর্গ অধিকার করে ও বীরেন্দ্র সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী বিমলা ও কন্যা তিলোত্তমাকে বন্দী করে। কুমার জগৎসিংহও বন্দী হন। যদিও পাঠান নবাব কতলু খাঁর প্রহসনের ন্যায় বিচারে বীরেন্দ্র সিংহকে হত্যা করা হয়। নিহত বীরেন্দ্র সিংহের স্ত্রী বিমলা পাঠান নবাব কতলু খাঁকে হত্যা করে পতি হত্যার প্রতিশোধ নেয়। পাঠানেরা কুমার জগৎসিংহের মাধ্যমে অম্বররাজ মানসিংহ তথা দিল্লীশ্বরের সঙ্গে সন্ধি করেন। অন্যদিকে কতলু খাঁর কন্যা নবাবজাদী আয়েষা জগৎসিংহের প্রেমে পড়েন। আয়েষার প্রণয়ী পাঠান সেনাপতি ওসমান একথা জানার পর ক্রোধে কুমার জগৎ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে মান্দারণ পুনরায় স্বাধীন হয় ও দিল্লীশ্বরের প্রধান সেনাপতি অম্বররাজ মানসিংহের মাধ্যমে মহারাণী বিমলার হস্তে রাজ্যপাঠ হস্তান্তরিত হয় এবং মহাধুমধামের সাথে কুমার জগৎ সিংহ ও দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমার মিলন ঘটে। লেখক এখানে পাঠান বীর ওসমানের প্রতি অবিচার করেছেন ।
বিস্মিত শাহিদা জিগ্যেস করেন খাজা ওসমানের প্রতি আপনার এতো দুর্বলতা কেন ?
তাকে আরো চমকে দিয়ে সুবীর বলেন , খাজার কাছে ধর্ম ও জাতীয় পরিচয়ের চাইতে মানুষ পরিচয় ছিল বড়। তিনি রাজা সুবিদ নারায়ণের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুঘলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে । কিন্তু সুবিদ রাজি না হওয়ায় তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । পরাজিত হয়ে সুবিদ তার চার ছেলেকে ধর্মান্তরিত করেন । কিন্তু খাজা ওসমান তো সেটা চান নি । তিনি চেয়েছেন বাংলার আকাশ মুঘল মুক্ত রাখতে। তাই তিনি যখন মুঘলের সঙ্গে যুদ্ধে চরম আহত হলেন তার এক শিশু পুত্রকে এক হিন্দু পরিবারের কাছে দিয়ে যান , যাতে হিন্দু পরিচয় নিয়ে বড় হয়ে সে মুঘলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে । সেই থেকে ওই পরিবার মুঘলের বিরুদ্ধে , ব্রিটিশের বিরুদ্ধে , পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে ।
খাজা ওসমানের উত্তর পুরুষেরা গোটা রাজনগরে বিভিন্ন পরিচয়ে ছড়িয়ে আছে ।
সুবীরের সঙ্গে কথা বলে সাহিদা তার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলেন ।
সংবাদটি শেয়ার করুন