রোকসানা লেইস
তারুণ্যের ঝকমকে দিন তখন। একা একা চলাফেরা রাজধানী ঢাকা শহরটাকে নিজের মতন চেনার সময়। শৈশব আবাস ছেড়ে এসে, মা বাবার নির্ভরতার কোল ছেড়ে নিজের মতন চলা শিখার শুরুর সময়।
নতুন জীবনের সাথে নতুন মানুষের সাথে নিত্য পরিচয়ের সাথে, চিরচেনা দৈনন্দিন অভ্যাশের পরিবর্তনের সাথে অনেক নতুন কিছু চেনা আবিষ্কারের নেশা আচ্ছন্ন করে রাখে। স্বপ্ন স্বপ্ন মুগ্ধ সময়। দূরন্ত সাহসে হাতের মুঠোয় জীবন ধরার তারুণ্য চকচকে সময়।
বদরুনেসা কলেজের হোস্টেলে নতুন সাথী বন্ধুদের সাথে জীবন যাপন। কলেজের সময় পেরিয়ে গেলে হোস্টেলে বান্ধবীদের সাথে বন্দিত্ব উপভোগ। নিজ বাড়িতে কখনো শাসন বারন নিষেধের বাঁধা ছিল না। যদিও সময়টা ছিল সত্তর দশকের শেষ দিকে। যখন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার শালিনতা আর রক্ষনশীল ছিল বড় বেশি। তবে আলৌকিক ভাবে আমি পেয়েছিলাম অপূর্ব মুক্তমনের পরিবার। যেখানে বাঁধা নিষেধের ততপরতা ছিল না বরং অবাধ শিল্প সাহিত্য চর্চার সুযোগ, স্বাধীন ভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ ছিল। কয়েকশ মাইল পথ পারি দিয়ে, ঢাকা আসতাম একা বা কখনো শহরের লোকজনের সাথে। বাবার একটাই ভয় ছিল রাত হয়ে গেলে যেন কেউ সাথে থাকে অন্তত বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার। সেই ব্যবস্থা করার জন্য সব রকম আয়োজন করতেন, কার্পণ্য না করে। সে সময়ে আমাদের রাস্তার করুণ দশা বর্তমান প্রজন্মের চিন্তা করতেও কষ্ট হবে।
বাংলাদেশের যে কোন জেলা বা মহকুমা থেকে ঢাকা আসতে সারাদিন বা দেড় দিনের মতন লেগে যেত। বাস বা ট্রেন লেইট হওয়া অতি সাধারন ঘটনা। রাস্তায় কয়েকটা ফেরি পার হতে হতো। পথে কয়েকবার বাসে নানা রকম যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিত। রেল ঠিক সময়ে আসলে সেটা ছিল সৌভাগ্যের দিন। সন্ধ্যায় ঢাকা পৌঁছানোর কথা থাকলেও প্রায় রাত বারোটার মতন সময় হয়ে যেত।
যোগাযোগের অসুবিধার মতন টেলিফোনের সুযোগও ছিল সৌভাগ্যের বরপুত্রের উপর নির্ভর করা। টিএনটি মর্জি হলে কখনো ঢাকায় লাইন লাগিয়ে দিত। গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে এবং কানের সকল ইন্দ্রেয় সচেতন রেখে, দু পক্ষকে সতর্ক ভাবে কথা শুনতে এবং বলতে হতো। কথা ছিল একটাই মেয়ে ঢাকা যাচ্ছে ঢাকার লোকজন যেন বাস বা ট্রেন স্টেশনে থাকে। অনেক বাসাতে আবার টেলিফোন ছিল না তাদের পাশের বাসা থেকে ডেকে আনা হতো টেলিফোন ধরার জন্য।
কখনো ক্যান্টনমেন্ট, কখনো ধানমণ্ডি, মহাম্মদপুর, র্ফামগেইট আগামাসি লেন। যখন যেমন সুবিধা হতো আত্মিয় স্বজন পরিচিতর বাড়িতে হানা দেয়া হতো। তারাও দ্বায়িত্ব নিয়ে অনেক অপেক্ষার কাল কাটিয়েছেন স্টেশনে বাস বা ট্রেন আসার অপেক্ষায় ধৈর্য্য নিয়ে। এমন ঝামেলা বাঁচাতে বাবা নতুন যাত্রা পথের সংযোগ করে দিলেন। কাউকে সাথে দিয়ে পাঠানো তার থাকা ফিরে যাওয়া যে খরচ সেরকম একই খরচে স্কুটার ভাড়া করে বিমান বন্দরে পৌঁছানো বিয়াল্লিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সেখান থেকে হুস করে পয়তাল্লিশ মিনিটে ঢাকা। পথে একটা স্টপেজ ও ছিল পনের মিনিট পর। আরামের যাত্রা সাথে বিমানের আতিথিয়তা, পূর্বানি হোটেলের কেক, পেস্ট্রি, স্যান্ডেউইচ আর চা কফি জুস ফল চকলেট ছিল বাড়তি আনন্দ। সাথে অনেকের অবাক চোখের তাকিয়ে দেখাও উপভোগ করতাম। এই বয়সে একা একা বিমানে চলাফেরা করে মেয়ে, কী সাংঘাতিক!
বিমান থেকে নেমে একাই রিকসা বা বেবী ডেকে বাসায় চলে যাওয়া, কাউকে অসুবিধা বা অপেক্ষায় না রেখে। কখনও সরাসরি হোস্টেলে চলে যেতাম। একা ঘোরার স্বাধীনতা শেষ হয়ে যেত যখনই কলেজের গেইট দিয়ে হোস্টেলে ঢুকতাম। আরোপিত নিয়ম মানার অসহিষ্ণুতা ,তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায় আমরা নানা রকম পরিকল্পনা করতাম এ খাঁচা ভেঙ্গে ফেলার। বন্দিত্ব, জেলখানা, বিদ্রোহ ভাবনা আর বন্ধুদের সাথে অনেক আলোচনার ঝড় উঠিয়ে শেষ পর্যন্ত অসুবিধা মেনে নিয়ে চলতাম ফোঁস ফোঁস করে।
যেখানে যে নিয়ম তার সাথে মানিয়ে নেয়ার শিক্ষাটাও পড়ালেখার সাথে শিখতে শুরু করলাম।
মাঝে মধ্যে সুযোগ এসে যেত হোস্টেলের বন্দীদশা থেকে বাইরে বেরুনোর সেদিন আমাদের আর পায়কে। আমরা ঘুরতে বেড়িয়ে পরতাম। নিউমার্কেট, গাউসিয়া মার্কেট বলাকা সিনেমা হল। কখনো রঙিন ছবি তোলার স্টুডিওতে।
সময়টা খুব কম থাকত। সব বন্ধুরা এক সাথে ঘুরে সবার প্রয়োজন মিটাতে গিয়ে কারোরই তেমন কিছু করা হতো না। ছুটাছুটিই সার হতো। তবে বেরিয়ে পরার আনন্দে আমরা আপ্লুত থাকতাম। আমাদের আবার হোস্টেল-জেলখানার গেইটের ভিতর ঢুকে পরতে হতো নির্ধারিত সময়ে। সবাই যখন জামা কাপড় কেনা কাটায় ব্যাস্ত। আমার খুব ইচ্ছে হতো বিকালে রোদ গায়ে মেখে রমনা বা রেসকোর্স ময়দানের সবুজ মেখে হেঁটে বেড়াই। কিন্তু ইচ্ছগুলো মনের মধ্যে রেখেই ফিরতে হতো।
এ ভাবে আমি এক সময় নিজের মতন ঘোরা ফেরার পথ করে নিলাম। যেদিন সপ্তাহর ছুটি আত্মিয়র বাড়িতে কাটিয়ে বাসা থেকে আমি একা ফিরতাম সেদিন আপন মনে শ্রীকান্ত বা হ্যাকিলবেরিফিন হয়ে যেতাম। আপন মনে চেনা অচেনা জায়গাগুলো ঘুরে ফিরে দেখে ফিরতাম। কখনো একাই সিনেমা হল বা চাইনিজ রেস্তুরায় ঢুকে পরতাম। সুযোগটা আরো বেশী পেলাম কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর। সন্ধ্যা নাগাদ একই নিয়মে গেইট বন্ধ হলেও সারা দিন মুক্ত থাকার আনন্দ ছিল।
চলতি পথে কত কিছুর সাথে দেখা হয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়। দিনে দিনে বদলে যায় ভাবনা আজ যা ভালোলাগে কদিন পর তা তেমন আবেদন রাখে না আর। নতুন সংযোগ হয় জীবনের তালিকায়। তবে প্রতিটি মানুষের ভিতর সুক্ষভাবে কিছু বিষয় থাকে যা স্বকীয়তা, নিজস্বতা ব্যাক্তি মানুষের। বই শিল্প সাহিত্যে আঁকাঝোঁকা আমার মনে অদ্ভুত ভাবে বাসা বেঁধেছিল। কোথাও সে আবহের খবর পেলে তার সাথে যোগাযোগটা হয়ে যেত। অথবা খুঁজে পেতাম। নিভৃতে গোপন ডায়েরিতে আঁকা, লেখার মতন খুঁজে পাওয়ার এই তীব্র নেশা লালন করতাম হৃদয়ে।
নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে ঘুরা আমার খুব প্রিয় ছিল। ঘোরা ফেরা শেষে নোভল আইসক্রিমের দোকানে একটা বড় সর আইসক্রিম নিয়ে বসে নতুন কেনা বই পড়ে বেশ খানিক সময় কাটিয়ে দিতাম। বিদেশের মানুষদের দেখি টিমহার্টন, ডানকিনডোনাটের দোকানের এ বসে পড়ালেখা করতে। আমি সেই আমলে নোভেলের দোতালায় বা চাইনিজ রেস্তরায় খাবার অপেক্ষার সময়টা বই পড়ে কাটাতাম নিজের মতন একা।
বইয়ের দোকানে বই কেনা ছাড়া প্রিয় কেনার বিষয় ছিল চিঠি লেখার সুন্দর প্যাড। নীল চিঠির পাতার চেয়ে ছবি আঁকা পাতাগুলো আমার বেশী পছন্দের ছিল। কিন্তু খুব বেশী পাওয়া যেত না। তখন টি এসসি ছাড়িয়ে মৌলিতে খেতে যেতাম শাহবাগে। মৌলির পাশে রেখায়ন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দৃষ্টি নন্দন র্কাড, একদম নতুন ধরনের দেশীয় ঐতিহ্যের স্বপ্ন বুননের কারখানা যেন। একদম ভিন্নমাত্রার সজ্জা লৌকিক আবহের পসরা নিয়ে ব্যাতিক্রমি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দোকানটা। সুযোগ পেলেই রেখায়নে ঢুকে ঘুরে বেড়াতে চলে যেতাম। হাতে আঁকা ছবিগুলো দেখতে খুব ভালোলাগত। আর ছুটির সময় ঈদ পুজায় বাড়ি যাওয়ার আগে রেখায়ন থেকে কার্ড, চিঠির প্যাড কিনে নিয়ে যাওয়া কর্তব্য হয়ে গেল। বাজারে প্রচলিত যে ঈদ পুজার কার্ড ছিল আমার তেমন পছন্দ হতো না তাই নিজের মতন কার্ড বানাতাম বন্ধুদের ঈদ পুজা নববর্ষের, শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। রেখায়ন আমার কার্ড বানানোর কষ্ট লাঘব করে দিয়েছিল। প্রতিদিন একসাথে থাকা বন্ধুদের বিচ্ছেদ বেদনায় অস্থির হয়ে চিঠি লিখতাম। তার জন্য রেখায়নে পেয়ে যেতাম সুন্দর ডিজাইনের চিঠি লিখার খাতা। চিঠি লেখা চিঠির অপেক্ষায় থাকা। শব্দ শব্দ আবেগ বিনিময় করার সময়টা বড় মধুর ছিল আমাদের।
গিরিবাজ পায়রার পায়ে বেঁধে দেয়া পত্র দিয়ে যোগাযোগের যে মাধ্যম শুরু হয়েছিল সে খবর জেনে অত্যাশ্চর্য হয়ে গেছি। মানুষের শক্তি কত! পাখিকে পোষ মানিয়ে ঠিক শিখিয়ে পরিয়ে নিয়েছে।সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে খবর। যদিও পায়রার পায়ে বেঁধে চিঠি পাঠাইনি কখনো কিন্তু বিষয়টা ভাবলেই মন ভালো হয়ে যায়।
আবার শেরশাহের সময় ঘোড়ার ডাকের প্রচল হয়েছিল, এই ইতিহাসের খবর কেবল হাসির খোরাক যোগাত মনে। ঘোড়া কি তবে তার আগে ডাকত না শেরশাহ ঘোড়াকে ডাক শিখালেন কিভাবে। তবে যতই হাসাহাসি করি বাক্যটি নিয়ে মানতেই হয় আধুনিক চিন্তায়, সময়কে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুচারুরূপে কল্যাণকর ভাবে।
সেই দৌড়ে চলা রানারের পথচলা এখন স্থিমিত হয়ে গেছে অর্ন্তজালের ছোঁয়ায়। পরিবর্তনশীল সবটাই আনন্দের আমার কাছে। তবে নিজস্বতা ধরে রাখার চেষ্টাটা জানলে বিষয়টা সুন্দর ব্যাতিক্রমী হয়। সবাই এটা পারে না কেউ কেউ পারে।
সময় এবং প্রয়োজনের সাথে মানুষ নিজের মতন নানা পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছে। যেমন রেখায় রেখায় এঁকে রেখাঙ্কন নতুন এক নান্দনিক সময়ের সুচনা করেছিল সেই সময় যা ছিল দেশীয় ঐতিহ্য এবং ভালোলাগার হৃদয় ধারন করে তারুণ্যের প্রজন্মের কাছে বিশেষ ভাবে তুলে ধরেছিল রেখায়ন। প্রায় সময় লোকারণ্য থাকত দোকানটি, অস্থিরমতি টগবগে তারুণ্য কিছু করার ইচ্ছায় জড়ো হতেন সেখানে। আড্ডায় কাল কাটানোরও সুযোগ ছিল রেখায়নে। অনেকের সাথে পরবর্তি সময়ে দীর্ঘ দেখা সাক্ষাত চলার সুযোগ হয়েছে। কেউ কেউ নেশা ছাড়তে না পেরে লেখার সাথে আঁকার সাথে সংগঠনের সাথে কাব্য এবং নাট্য চর্চার সাথে জড়িয়ে আছেন এখনও।
পথ চলার অনেক সংযোগ বিয়োগের মধ্যে রেখায়ন বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু কিছুদিন আগে নতুন যোগাযোগ মুখ বন্ধনের মাধ্যমে হঠাৎ রেখায়নের রাগীব আহসানের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি যে কাজগুলো করে গেছেন। যে কাজগুলো নিভৃতে আমার ভালোলাগার ছিল। উনার সাথে সরাসরি কথা বলায় সে ভালোলাগা বিনিময়ের সুযোগ এসে গেল। লম্বা রেখার পথ ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে অবাক সময় বক্র রেখা বৃত্ত এঁকে মিলিয়ে দিল আমাদের এক সমীকরণে। যেখানে আমাদের ভাবনাগুলো ক্রিয়েটিভ কাজের সাথে জড়িয়ে আছে। যেখানে শিল্প এবং সৃজনশীলতা সেখানে সুবাতাস সাচ্ছন্দ আপন মনে ঢেউ তুলে । কি ভাবে যেন সময় ছেকে বেছে দলগুলো ভাগ করে নেয়। মালা গেঁথে ফেলে প্রকৃতি এক রকম মুক্ত দিয়ে।
ভালোলাগল নতুন করে জেনে। তিনিও নতুন দেশে আবাসন নিয়ে নতুন ভাবে তার শিল্প কর্মের মাত্রা বিশ্ব অঙ্গনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। শাহবাগের কোনার রেখায়ন এখন নিউইয়র্কে বসে আছে। অগ্রগামী হোক বিশ্বের সাথে সার্থক ভাবে যোগ সম্পন্ন হোক দেশীও ধারা ঐতিহ্য কিছুটা হলেও জানুক বিশ্ববাসী। কেউ কেউ যে ঐতিহ্য প্রকাশ করতে পারেন রাগীব আহসান তার মধ্যে একজন। তিনি পারবেন আশা করি দেশীয় ভাবধারা বিশ্বায়নে পৌঁছে দিতে নতুন উপস্থাপনায়। আর রেখায়নের সুযোগটা হলো অনুবাদের কোন বিষয় নেই, ভাষার চেয়ে ছবি সহজ। ছবি তো সবার মনে একই ভাবে কথা বলে। রেখায়ন বিশ্বভাষার সুবিধা ভোগ নিয়ে, বিশ্বের বিশাল বাজারে, বাংলাদেশেকে পৌঁছে দিতে পারবে বলে আশা করছি।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com