নিউজ ডেস্ক:
লাগামহীন শিক্ষাবাণিজ্য চলছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- সবখানে লাগামহীন ঘোড়ার গতিতে যেন বেড়েই চলেছে শিক্ষাব্যয়।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাব্যয় এখনো সাধ্যের মধ্যে থাকলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ চার্জ আদায় করা হয় অন্তত ১০ গুণ। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় যেন প্রায় শতগুণ হয়ে যায়।
ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষাব্যয়েরও নেই বাঁধাধরা কোনো নিয়ম। সবই যেন চলছে ফ্রিস্টাইলে। শিক্ষার কোনো পর্যায়েই টিউশন ফি নির্ধারণ নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় ইচ্ছামতো আদায় করা হচ্ছে গলাকাটা টিউশন ফি।
এমন নৈরাজ্যে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের চরম আর্থিক দুরবস্থার মুখোমুখি হতে হলেও কর্তৃপক্ষের যেন টনক নড়ছে না।
তথ্যমতে, ইংলিশ মিডিয়ামে এক শিশু শিক্ষার্থীকে প্লে শ্রেণিতে ভর্তি করতেই লেগে যায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আর বার্ষিক ফি রয়েছে আরও প্রায় দুই লাখ টাকা। কেজি থেকে গ্রেড ৫ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক টিউশন ফি নেওয়া হয় ৩১ হাজার ২০০ ডলার, এমন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও রয়েছে এ দেশে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৪ লাখ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষাব্যয় আকাশচুম্বী।
চার বা পাঁচ বছরের স্নাতক কোর্সের জন্য কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আদায় করছে ১৫ লাখ টাকা। অথচ একই বিষয়ে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো পড়তে লাগছে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন টাকারই খেলা। গ্রামগঞ্জ থেকে শহরাঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব স্কুলের শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে কোনো বেতন পান না।
তাই খেয়ালখুশিমতো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করছেন গলাকাটা ফি। প্রত্যন্ত গ্রামেও শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ৫০০ থেকে কয়েক হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের কাছ থেকে এসব কিন্ডারগার্টেন নিবন্ধন নেওয়ার কথা থাকলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে মাত্র ৩ শতাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নিবন্ধন রয়েছে।
অথচ সারা দেশে এ সংখ্যার প্রায় ১০ গুণ কিন্ডারগার্টেন স্কুল চলমান রয়েছে। সব স্কুলেই আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছামতো টিউশন ফি। চার বছরের বেশি আগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি-সংক্রান্ত নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত হয়নি নীতিমালাটি। ফলে টিউশন ফি আদায়ে শৃঙ্খলাও ফেরেনি এ খাতে।
ঢাকার কিছু বেসরকারি স্কুল-কলেজ থেকে টিউশন ফির পাশাপাশি আদায় করা হয় আইটি চার্জ, বিদ্যুৎ ফিও। নির্দিষ্ট খাত উল্লেখ না করে ‘অন্যান্য’ খাতেও নিচ্ছে অনেক টাকা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিতে একটি নীতিমালা করা হচ্ছে। এ নীতিমালা কার্যকর হওয়ার পর এসব প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছামতো টিউশন ফি আদায় বন্ধ হবে।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলছে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষা বোর্ড থেকে নিবন্ধন নেওয়ার নিয়ম থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে মাত্র ১১৯টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নিবন্ধন রয়েছে। বাকিগুলো চলছে কোনো নিবন্ধন ছাড়াই।
কোনো নীতিমালা না থাকায় গলাকাটা টিউশন ফি আদায় করছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে (¯œাতক) শুধু টিউশন ফি বাবদ প্রায় ১৫ লাখ টাকা আদায় করছে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।
এ ছাড়া আদায় করা হচ্ছে অ্যাডমিশন ফি, লাইব্রেরি ফি, ল্যাব ফিসহ নানা ফি। জানা গেছে, রাজধানীর বারিধারায় অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব ফার্মেসি (বি ফার্ম প্রফেশনাল) কোর্সে নেওয়া হচ্ছে ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা।
এ ছাড়া ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচারে ১২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইই) বিভাগে নেওয়া হচ্ছে ১১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া প্রতি বিভাগে অ্যাডমিশন ফি ও কশন মানি বাবদ নেওয়া হচ্ছে আরও ৩৫ হাজার টাকা।
মহাখালীতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার কোর্সে টিউশন ফি বাবদ আদায় করা হচ্ছে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ২০০ টাকা। ব্যাচেলর অব ফার্মেসিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেওয়া হচ্ছে মোট ১০ লাখ ৮২ হাজার ৪০০ টাকা। অ্যাডমিশন ফি, ল্যাব ফি, লাইব্রেরি ফি বাবদ প্রতিটি বিভাগে আরও ৮০ হাজার ৬০০ আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তেজগাঁওয়ে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার কোর্সে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় টিউশন ফি নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ করতে একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে।
কমিশনের পূর্ণসভায় এ নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। নীতিমালা হওয়ার পর টিউশন ফি নিয়ে অভিযোগ থাকবে না বলে প্রত্যাশা করি। ’
সংবাদটি শেয়ার করুন