রিফাত কান্তি সেনঃ
বাংলাদেশে এখন সচরাচর প্রশ্ন ফাঁস নতুন কোন বিষয় নয়।আধুনিকতার মারপ্যাঁচে মানুষ যত উন্নত হচ্ছে ততই হচ্ছে অমানবিক।ধরতে পারেন প্রযুক্তির বদৌলতে মানুষ এখন আর মানুষে নাই! সবাই এখন ডিভাইস খোঁজে।খোঁজে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার।গত কয়েকদিন ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা (পিইসি) এর প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে উত্তেজিত ছিল মিডিয়া মহল।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ছিল তুমুল ঝড়।এ-যেনো বছরের সেরা ট্রফিক্স।অন্যদিকে চুপচাপ কতৃপক্ষ।এ যেনো ধরাকে, সড়া জ্ঞান।পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস যেনো ঠেকানোই যাচ্ছে না।প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এটা যেমন চিন্তার বিষয়,তেমনি নতুন এক চিন্তা ও আমাদের মাঝে দেখা দিয়েছে।খুব স্বাভাবিক আমরা মানুষ লোভী।কিছু ভাল সুবিধা পেলে তা সাদরে গ্রহন করিতে ভ্রুক্ষেপ করি না।বলতে পারেন সুবিধা পেলে লাফাই আমরা।চিন্তা তো করিই না বরং নৈতিকতা বিসর্জন যাক তবু মোর পোলায় কিছু পাক।বলছিলাম অভিভাবকদের ও কিছু দোষের কথা।অভিভাবকরা চায় আমার সন্তানটা শিক্ষিত হোক; কিন্তু কেউই চায় না সন্তানটা ভাল মানুষ হোক।
কথাগুলো এজন্য বলছি যে 26-11-17 পিইসি গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এটা যেমন অনৈতিক কর্ম ;তেমনি অভিভাবকরা দেখলাম কিছু যায়গায় নিজেরা লিখে দিচ্ছে তা আবার সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা আমরা দেখতে পেলাম।
শুধু গণিত নয়, প্রথম দিন থেকেই মিডিয়ায় আমরা প্রশ্ন ফাঁসের খবর দেখতে পাচ্ছি।
আমি নিজেও কয়েকদিন ধরে একটি দৃশ্য অবলোকন করে আসছি আর তা হলো শিক্ষক/অভিভাবকদের মিশ্র একটা দৌড়-ঝাঁপ।না এটা কোন নির্বাচনের দৌড়/ঝাঁপ নয়, এটা শুধু মাত্র ছোট্ট সোনামনিদের প্রশ্ন ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তর মিলাবার ব্যর্থ প্রয়াস।এ যেনো ছোট থেকেই চুরি সেখানো।প্রাথমিক থেকেই ওরা শিখছে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন পাওয়া যায় আর সে প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দিলে জিপিএ ফাইভ পাওয়া যায়।একথা একবিন্দু ও মিথ্যে নয়।আমি নিজে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করলাম, পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?
চমৎকার জবাব, গতকাল রাতে ফেসবুক থেকে নামিয়ে পড়েছি।পরিবারের অমুক সদস্য নামিয়ে দিয়েছে! বাহ চমৎকার কথা।একবার ভাবুন তো কোমলমতী এ শিশুদের কতবড় আত্মবিশ্বাস যে ফেসবুকে প্রশ্ন পাওয়া যায়।দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে আমাদের অভিভাবকদের খাম-খেয়ালিপনার বলি হতে চলেছে প্রজন্মের ধারক বা বাহকেরা।
একবার চিন্তা করে দেখুন অসুস্থ জিপিএ ফাইভ পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারনে কতটা ক্ষতি করছেন আপনার সন্তানের!
যেহেতু আমি ছোট খাটো একজন সংবাদকর্মী। তাই গত কয়েকদিন ধরে কিছু অভিভাবকের সাথে মিশে জানতে চেয়েছিলাম আসলে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কেনো এ সুযোগ করে দিচ্ছে।একটাই উত্তর মিলল সকলের কাছে,আমার সন্তান জিপিএ ফাইভ পেতে হবে!
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য আমি কয়েকজন শিক্ষককে দেখলাম তাঁদের সন্তানদের জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্য খুব উঠে-পরে লেগেছেন।একদম ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বের করে সন্তানকে দিয়ে খুব উল্লাসে আছেন।
গল্পের ফাঁকে প্রশ্ন করলাম, সন্তানাকে তো নষ্ট করে দিলেন? একটু ক্ষেপে গিয়ে মানে কী? বললাম,’এই যে বাচ্ছাকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা দেয়াচ্ছেন এতে কী তাঁর মেধা বিকশিত হচ্ছে?নাকি চুরি শিখছে?
বলল আরে পজিশনে টিকে থাকতে হবে।জিপিএ ফাইভ না পেলে মান-ইজ্জত থাকবে?
একটু মুচকি হেসে বললাম,আপনার কী মান ইজ্জত আছে?
যা ই হোক এবার বুঝলেন তো আসল সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে অভিভাবক এবং কর্মক্ষেত্র সব খানেই অসুস্থ জিপিএ ফাইভ নামক যে অন্ধ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এতে করেই প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হতে চলেছে।
আমি যদি আমার সন্তানকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অন্য কোথা থেকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বের করে না দেই, তবে সে ঐ প্রশ্ন পাবে কই?
আমরা অভিভাবকরা কী তাইলে প্রজন্ম ধ্বংশের সাথে পায়তারা চালাচ্ছি না?
অসুস্থ এ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন আগে আমাদের মানুসিকতার পরিবর্তন।শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের প্রয়োজন জিপিএ ফাইভ নামক ভূত তাড়ানো।
এ ভূত কখনোই যোগ্যতা নির্নয়ের হাতিয়ার নয়।সবাই কিন্তু এই জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্যই নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে চিন্তায় থাকেন কখন আসবে একটু সুবিধা!
শুধু পিইসি নয়।দেশের বহু পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নই ইদানিং সচরাচর ফাঁস হচ্ছে।এতে করে আসল মেধার মূল্যয়ণ কমে আসছে।
একজন অভিভাবক তো বললেন,ভাল চাকরি পেতে হলে জিপিএ ফাইভ এর বিকল্প নেই!শিক্ষাবিদদের কাছে জানতে চাই এ থেকে উত্তোরনের উপায় কী?
এমন একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে যে এখান থেকে চাইলেই রাতারাতি আমাদের পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
আবার নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হলে মিনিটেই পরিবর্তন আনা সম্ভব।
একবার ভেবে দেখুন না, জাপানে নাকি একাডেমিক পর্যায় থেকেই শিশুদের ভাল মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়।হ্যালো,দুঃখিত এবং ধন্যবাদ তিনটি শব্দের গুরুত্ব খুব যন্ত সহকারে শিখানো হয়।আর আমরা তো শিশু বয়স থেকে চাপের উপর চাপ প্রয়োগ করতেই থাকি।সুযোগ বুঝে অসাধু শিক্ষকরা প্রাইভেট, কোচিং সহ অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
অভিভাবক ও চাচ্ছে না সন্তান ভাল মানুষ হোক;অভিভাবক চায় ভাল পাস।ভাল পাস করলে নাকি মেলে ভাল চাকরি।জীবনে উন্নতি করতে পারবে শতভাত গ্যারান্টি!
আচ্ছা পরীক্ষা কী কমানো যায় না? ক’দিন আগে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা খবর পড়লাম।তাঁদের দেশে নাকি পরীক্ষা নামক ঝঞ্জাট নেই বললেই চলে।ক্লাস টিচারের ইচ্ছা হলে শিশুদের বলে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন।
ক’দিন আগে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানে দেখলাম অনেক জিপিএ ফাইভ শিক্ষার্থী সাধারণ জ্ঞানে এতটা নিচু যে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সহ অনেক কিছুই জানে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এরা কী আসলেই সুশিক্ষিত হচ্ছে? নাকি সুশিক্ষার অভিনয়ে কুশিক্ষার ব্যাগ ভারি করছে?
এখানে আমাদের অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা কতটুকু? আর চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান গুলোর জিপিএ ফাইভকে যোগ্যতার চাবিকাঠি মাপার মানে টা কী? জানতে চাচ্ছিলাম সচেতন মহলের কাছে।
আমার মনে হয় প্রশ্ন ফাঁসের চেয়ে আমাদের মানুসিকতা বেশী ক্ষতি করছে আমাদের প্রজন্মের ধারকদের।
আমরা অভ্যাসের দাস,অভ্যাসে যা পরিনত তা করতেই আমরা সাচ্ছন্দবোধ করি।যেমন ছোটকাল থেকে চুরি শিখছি,বড় হলে ডাকাত হবো!
এবার পরিবর্তন আনা উচিত।আমি যে বিদ্যালয়ে খন্ডকালীন চাকরি করি সেখানকার ৮০% শিশু শহীদ মিনারে জুতা পায়ে উঠে না।অতচ কদিন আগে ১০০% ই জুতা পায়ে উঠতো।এর কারণ আমি তাঁদের শিখাতে পেরেছি শহীদ মিনার স্মৃতিবিজড়িত,সম্মান প্রদর্শনের স্থান।এখানে খালি পায়ে উঠতে হয়।এমন কী এ ও শিখিয়েছি, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া কিংবা বাজার শব্দ শোনা মাত্র দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।
এখন দেখেন সবই সম্ভব।স্কুলে শুধু Narration আর Changing Sentence শিখাতে পারলেই সেই শিক্ষার্থী ভাল শিক্ষার্থীতে রুপান্তর হতে পারবে না;প্রয়োজন সামাজিক শিক্ষার।আমি এমন ও শিখিয়েছি যে তোমার থেকে এক সেকেন্ডের বড় তাকেও সম্মান করে কথা বলো।আগে ভাল মানুষ হও তবেই ভাল শিক্ষার্থী হতে পারবে।অভিভাবকদের বলব,প্রশ্ন ফাঁস হলে সেটা শিশুদের বের করে দিয়েন না।অভিভাবকরা আব্রহাম লিংকনের মতো হয়ে উঠুন,আর শিক্ষকরা গাইবান্ধার লুৎফুর রহমানের মত এক টাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর গুরু দায়িত্ব নিন।দেখবেন সমাজে অসংখ্য ভাল মানুষ তৈরি হবে।
লেখকঃ রিফাত কান্তি সেন
খন্ডকালীন শিক্ষক,সাংবাদিক।
সংবাদটি শেয়ার করুন