টাইমস নিউজ
মো. খালিদ হাসান
বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় তের লক্ষ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান, প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অন্যদিকে প্রায় তিন কোটি মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ে আহত হয়। যদি সারা বিশ্বে দুর্ঘটনার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে তবে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি হবে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিশ্বের মোট যানবাহনের অর্ধেকের কম যানবাহন থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনাজনিত আহত ও প্রাণহানির ঘটনার ৯০ শতাংশ এসব দেশেই ঘটে থাকে।
বাংলাদেশের পরিবহণব্যবস্থাকে প্রধানত স্থল, নৌ ও আকাশ পরিবহণ এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। স্থল পরিবহণ আবার রেলপথ ও সড়কপথে বিভক্ত। সড়ক মহাপরিকল্পনা সমীক্ষা অনুয়ায়ী দেশের শতকরা ৬৬ ভাগ পণ্য ও ৭৩ ভাগ যাত্রী সড়ক পথে পরিবহণ হয়ে থাকে। জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হলেও আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে পঁচানব্বইতম দেশ। আয়তন ও জনসংখ্যার এই অসামঞ্জস্যতা বাংলাদেশে সড়কব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
বলা হয়ে থাকে কোন রাষ্টের উন্নয়নের প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে উন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকেই সে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিগত কয়েক দশক জুড়ে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে সড়ক পরিবহণ ও যোগাযোগ খাত। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক মনোযোগের দাবিদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক ও জাতীয় মহাসড়ক এবং ২ লাখ ১৭ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এসব সড়কে চলাচল করে ৫৬ লাখ নিবন্ধিত মোটরযান । এর বাইরে লাখ লাখ অটোরিকশা-অটোভ্যান, নছিমন-করিমন-ভটভটিসহ নানারকমের অনিরাপদ যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করে এসব সড়ক-মহাসড়কে ।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নিরাপদ সড়ক চাই, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এবং সেভ দ্য রোড- এই চারটি বেসরকারি সংস্থা সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের বার্ষিক ও মাসিক তথ্য প্রকাশ করে আসছে। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্তের সংগ্রহ করে থাকে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান ব্যবহার করে সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তাদের কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করে আসছে।
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে গত বছর থেকে বিআরটিএ নিজেরা তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনার মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালের প্রারম্ভে বিআরটিএ কর্তক প্রথমবারের মতো সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, গত বছর প্রতিদিন সড়কে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিআরটিএ-র তথ্য বলছে, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন ।
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ হাজার ৮৩৭টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে, যা মোট দুর্ঘটনার ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। দেশের মোটরসাইকেল চালকদের একটি বড়ো অংশ কিশোর ও যুবক। যারা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন এবং অন্যদের আক্রান্ত করছেন। তারপর রয়েছে ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান ১৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, বাস/মিনিবাস ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ, অটোরিকশা ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহন বাকি দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার কর্তৃক প্রাকশিত গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবছর বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১.৩ শতাংশ ক্ষতিসাধন করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পথচারী এবং প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার আনুমানিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ১৩.৬ জন।
সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে বহু কারণ দায়ী এবং এই কারণগুলো একটির সঙ্গে অপরটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত । অর্থাৎ বহু কারণের সমষ্টিগত ফলাফল সড়ক দুর্ঘটনা। যেমন সড়কের ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও আবহাওয়াগত সমস্যা, চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া আচরণ, ক্লান্তিজনিত ঘুম, পথচারীর অসচেতনতা নানাবিধ কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ওভারটেকিং প্রবণতা। সাধারণত রাস্তায় ধীরগতির গাড়িগুলোকে ওভারটেকিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় হর্ন বাজিয়ে সামনের গাড়িকে সংকেত দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় সংকেত না দিয়ে একজন আরেকজনকে ওভারটেক করার চেষ্টা করে, যার ফলে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি বের হতে না পেরে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তাই সঠিক নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ওভারটেক করা উচিত। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ সড়কব্যবস্থা।
মহাসড়কগুলোতে বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড়ো কারণ হল মহাসড়কগুলোতে দ্রুতগতির যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির যানবাহন চলাচল। গতির তারতম্য থাকায় দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধীরগতির বাহন রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে। ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
আমাদের জাতীয় জীবনে সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব বহুমাত্রিক। সড়ক দুর্ঘটনা আকস্মিকভাবে জীবন ও সম্পদের উপর হুমকি তৈরি করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিসাধন করে থাকে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকেই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে, কেউবা পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হন।
গত দশকের প্রারম্ভে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ যুগে পা দিয়েছে যার ফলে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশই তরুণ ও যুবক। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই হলো এই শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী। ফলে এধরনের দুর্ঘটনার শিকার পরিবারের পক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা থেকে বেড়িয়ে আসা অসম্ভবপর হয়ে ওঠে। সড়ক দুর্ঘটনা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মনোসামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করে অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশের সুফল ঘরে তোলা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জন, সার্বিকভাবে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নয়ন, প্রেক্ষিত্ পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে উন্নত স্বনির্ভর রাষ্ট্র বিনির্মানে বাঁধার সৃষ্টি করে।
সড়কে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সরকার সল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানাবিধ পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সাল থেকে দেশটির সরকার সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কৌশলগত কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করছে। এখন পর্যন্ত আটটি কর্মপরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। সবশেষ কর্মপরিকল্পনায় ২০২৪ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা ৫০% নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন করা লক্ষ্যে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ পাস করা হয়েছে। সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে উক্ত আইনে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসা দিতে সারা দেশে ২১টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত আহতদের দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে প্রায় সবগুলো ট্রমা সেন্টারই মহাসড়কের পাশে নির্মান করা হয়েছে। প্রতিটি ট্রমা সেন্টারে সাতজন পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালট্যান্ট), তিনজন অর্থোপেডিকস সার্জন, দুজন অ্যানেসথেটিস্ট (অবেদনবিদ), দুজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স এবং ফার্মাসিস্ট, রেডিওগ্রাফার, টেকনিশিয়ানসহ ৩৪টি পদ সৃজন করা হয়েছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্তত দুটো টার্গেট সরাসরি সড়ক নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত। এসডিজি টার্গেট ৩.৬ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বব্যাপী মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেক নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে এসডিজি টার্গেট ১১.২ অনুসারে নিরাপদ, সাশ্রয়ী, সার্বজনীন টেকসই পরিবহণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি সকলের জন্য সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে সড়ক নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তার অপরিহার্যতার দিকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয় বরং সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রত্যেককে তার স্ব স্ব অবস্থান থেকে সড়ক পরিবহণ আইন বাস্তবায়নে তৎপর হতে হবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। সড়কে লেন মেনে গাড়ি চালানো, সুনির্দিষ্ট গতিবেগ অনুসরণ করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং না করা, রাস্তা পারাপারে আবশ্যিকভাবে জেব্রা ক্রসিং অথবা ফুট ওভার ব্রিজ ব্যবহার করা, মহাসড়কে অননুমোদিত যানবাহন চলাচল বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। এক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগই পারে সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিতের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
#
লেখকঃ সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, ঢাকা
সংবাদটি শেয়ার করুন