সরস্বতী সমাচার

প্রকাশিত: ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩০, ২০২৩

সরস্বতী সমাচার

 

অম্বরীষ দত্ত

পাকিস্তান আমলে সিলেট গভর্ণমেন্ট পাইলট বয়েজ হাইস্কুলের কোনো সরস্বতী পূজা হতোনা। কেন হতোনা জানিনা। অন্যান্য সব স্কুল কলেজের পূজা হতো। কোনোটা প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে, কোনোটা বাইরে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ খ্রীস্টাব্দে, আমরা যারা স্কুলের শেষবর্ষে, ওল্ড টেন অর্থাৎ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নাইন টেনের ছাত্রদের সাথে নিয়ে, প্রথমে উদ্যোগ নিই এবং স্যারদের সাথে আলাপ আলোচনা করে তা আয়োজন করি। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত স্কুল প্রাঙ্গণে পূজার অনুমতি পাওয়া যায়নি। অগত্যা বাইরে, চালিবন্দরে একটা খোলাজায়গায়, প্যাণ্ডেল বানিয়ে তা আয়োজিত হয়। সলাজে বলি, আমি ছিলাম স্কুল পূজাকমিটির সম্পাদক। সন ১৯৭৩। ছাত্রদের কাছেতো বটেই, সাধারণ্যেও তার একটা সাড়া পড়েছিল। যদ্দুর জানি, গভর্ণমেন্ট স্কুলের নামে পূজাটা এখন অব্দি চালু আছে।
সচেতনভাবে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা বারোয়ারি পূজায় আমার যুক্ততা সেটাই সর্বশেষ… পঞ্চাশ বছর আগে।
শিবের গীতটা আগে গাইলাম, এবার ধানভানা…
আগে সিলেট শহরে সরস্বতী পূজার পরে পাড়ায় পাড়ায় অনেকগুলো সারস্বত সম্মেলন হতো। অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হতো। বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকতেন বিদ্বৎ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষজন। সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণ পুরোহিত থাকতেন, কথা বলতেন। থাকতেন আধুনিক চেতনায় আলোকিত মানুষজন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ-মর্যাদার মানুষজনও থাকতেন, জ্ঞাণগর্ভ বক্তব্য প্রদান করতেন। এমনকি যাঁদের কোনো ধর্মপ্রীতি নেই বা ছিলোনা, তাদেরকেও থাকতে দেখেছি। সকলেই বড় বেশি বিনয়ী ছিলেন, মাটিমেশা। শ্রোতারা তাঁদের কথা শুনে ঋদ্ধ হতেন। সাথে থাকতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সত্যিকারের সারস্বত আবহ যাকে বলে। তরুণ সমাজের ভিড়টাও থাকতো লক্ষনীয়। অর্থাৎ পূজা অর্চনার যে সাত্বিক চেতনা, সরস্বতী পূজায় তার সর্ব্বোত্তম প্রকাশটা ঘটতো।
বিচ্যুতিটা শুরু হয় স্বাধীনতার পর থেকেই। বিশেষ করে যখন থেকে পূজা মণ্ডপগুলো বৈদ্যুতিক আলোকচ্ছটায় সেজে ওঠা শুরু হলো, তখন থেকে। দিনে দিনে আরো কত অনুষঙ্গ এসে যুক্ত হলো তাতে… রীতিমতো রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার… আর এখন যা রূপান্তরিত হয়েছে চুড়ান্ত তামসিকতায়।
এখন আর কোনো সারস্বত সম্মেলন কোথাও হয় বলে আমি জানিনা, অন্তত বিগত চার দশকে কোথাও তেমন আয়োজন হয়েছে বলে শুনিনি।
এখন পূজা নয়, সজ্জাটাই আসল… বোধ নয়, ভঙ্গিটাই প্রধান। আমরা সকলেই অধিকতর পূজারী হয়ে গেছি। ধৃ-বঞ্চিত ধার্মিক। বিদ্বানেরা এইসব আয়োজনাদি থেকে দূরে সরে গেছেন… কিংবা আমরাই খেদিয়ে দিয়েছি। এ বড় ভয়ংকর বার্তাবাহী… অশনিকাল। পূণ্যার্থী পূজারীদের জন্যেতো বটেই, সামগ্রিকভাবেই সমাজের জন্যে।
পূজা করি বা না করি, সরস্বতী আমার বড় প্রিয় দেবতা… প্রাণের… আত্মনিবেদনের আশ্রয়।
সামনের দিনের অপেক্ষায় থাকলাম, দেখবো বলে… ভিন্ন কোনো আবহ তৈরি হয় কি না ।