এবারে ঈদের ছুটিতে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নিয়ে সিলেটে গিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে দশজন। কাজেই দলটাকে বেশ ভারীই বলতে হবে। অবশ্য মাস দেড়েক আগেই বিমানের টিকেট না কেটে ফেললে এ যাত্রায় যাওয়া হতো কি না সন্দেহ। বিমান যখন সিলেটের আকাশের নিচে, তখন পানির বিশাল বিস্তার। কথা ছিল একটা রাত টাঙ্গুয়ার হাওড়ে কাটাব। তবে হাওড়ের বাড়-বাড়ন্ত পানিতে সে পরিকল্পনায় গুড়ে বালি। বিমানের জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আমার এগারো বছরের ভাগ্নের প্রশ্ন- ‘এটাই কি টাঙ্গুয়ার হাওড়?’
রাতে সিলেটের বাসায় ডিনারে যোগ দিয়েছেন সিলেটের পরিচিত সাংবাদিক দম্পতি সুবর্ণা ও সাকি। কথায় কথায় সাকি বলছিলেন তার শঙ্কার কথা। এভাবে চলতে থাকলে সিলেট মহানগরের অভিজাততম আবাসিক এলাকা উপশহর পরিত্যক্তই না হয়ে যায়! ঝট করে মনে পড়ে গেল টার্কিশ সাইপ্রাসের ঘোস্ট সিটির কথা। আজকের টার্কিশ সাইপ্রাসের অন্তর্ভুক্ত এই শহরটিতে এক সময় গ্রিক সিপ্রিয়টদের বসতি ছিল। সাইপ্রাস টার্কিশ ও গ্রিক এই দু’ভাবে বিভক্ত হওয়ার পর শহরটির বাসিন্দারা রাতারাতি বাড়িঘর ছেড়েছুড়ে সাইপ্রাসের গ্রিক অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
শহরটিতে এখন সারি-সারি বাড়ি, দোকানপাট সব ঠিকঠাক, শুধু মানুষের দেখা নেই। টার্কিশ সাইপ্রাসের এই ভূতুড়ে শহরটি এখন ওখানকার একটা জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ। ১৫ দিনে দুবার আর ফি বছর যে বসতি রাতারাতি বানের পানিতে তলিয়ে যায়, সেই উপশহর যদি সত্যি সত্যি টার্কিশ সাইপ্রাসের ভূতুড়ে শহরের মতই জনমানবহীন ইট-পাথরের বসতিতে পরিণত হয়, তবে তাতে আর অবাকের কি?
অবস্থা এখন এমনই যে, সিলেট আর বন্যা যেন এখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিলেটের বন্যা না বন্যার সিলেট? সিলেটে ঈদের ছুটিতে মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা, সিলেটের আমজনতার দৃষ্টিতে এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যাগুলোর মূল কারণ ‘উজান-ভাটি’ তত্ত্ব। উজানে ভারতের বাঁধ খুলে ছেড়ে দেওয়া পানিতে ডুবে সিলেট আর ভাটিতে কিশোরগঞ্জের হাওড়ের অল ওয়েদার সড়কে বাধা পেয়ে সেই পানি সরতে পারে না। বেশিরভাগ সিলেটির ধারণা এখন এমনটাই।
যদিও আমি পানি বিশেষজ্ঞ নই, তারপরও আমার মতো করে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। কথা বলেছি নানা শ্রেণীপেশার মানুষ আর বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ- সবার সঙ্গেই। একটু আগেই যে উপশহরের কথা বলছিলাম, আশির দশকে সেই জায়গায় ছিল ধুবরি হাওড়। দেশের আরও অনেক জায়গাতেই পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রেখে জলাধার আর নিন্মভূমি ভরাট করে উন্নয়ন কর্মযঞ্জ বাস্তবায়নের যে উদাহরণগুলো আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সেই তালিকাতেই আরেকটি নাম এই ধুবরি হাওড় টার্নড আজকের উপশহর।
সিলেটের মতো অতি বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চলের আশির দশকের এই অপরিণামদর্শিতার পরিণাম যে একটা সময় ভয়াবহ হতে বাধ্য, সে তো বলাই বাহুল্য। সিলেটে এমনি আরও কিছু অপরিকল্পিত উন্নয়নকেও এজন্য দুষছেন এই শহরের অনেকেই। যেমনÑ জৈন্তায় একটি বড় খালের প্রবাহ বন্ধ করে সড়ক নির্মাণের উদাহরণ দিয়েছেন কেউ কেউ।
সিলেট শহরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছড়া অর্থাৎ পাহাড়ি ঝর্ণা। শহরের যে অংশে আমার আদি ভিটা, তার নামইতো ছড়ার পাড়। তারপরও জলাবদ্ধতা। অতি বৃষ্টিতে ছড়া উপচে ছড়ার পাড় ডুবে কোমড় পানিতে। অথচ সিলেট শহরের এই জলাবদ্ধতা নিরসনে সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলোও কিন্তু কম নয়। সিলেটে নিয়মিত যাতায়াতের কারণে আম্বরখানা, দরগা গেট, ওসমানী মেডিক্যাল ইত্যাদি এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়নের যে মহাযঞ্জ, তাতো নিজের চোখেই দেখা।
অথচ এই সিলেট শহরেই সুরমা পাড়ে বন্যার্তদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করতে গিয়ে দেখেছি, শহরের রাস্তা যখন পানির নিচে, সুরমার পানি তখন রাস্তারও নিচে। অথচ সুরমা আর রাস্তা দুই জায়গাতেই এখন পানি থৈ থৈ। হতে পারে দেশের আরও অনেক নদীর মতই সুরমার নাব্য হ্রাস পাওয়াটা এর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। সুরমার ড্রেজিং হয়তো হতে পারে এর উত্তর। সিলেটের বন্যাদুর্গত এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ও এ বিষয়ে সরকারী উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। তবে কাজটা চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে সুরমা যখন অসম থেকে বুক ভরে-ভরে দফায়-দফায় এত পলি নিয়ে নামে।
পাশাপাশি আরেকটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকেই। সিলেটের যে ছড়াগুলো তার অনেকটাই এক সময় বেদখল হয়ে গেলেও, পরবর্তীতে সেগুলো বহুলাংশেই উদ্ধার করা হয়। সিলেট শহরে এমনি দু’পাড় বাঁধানো ছড়া প্রায়ই চোখে পড়ে। তবে কারও কারও ধারণা, ছড়ার পাড় বাঁধাতে গিয়েই ঝামেলা পাকানো হয়েছে। কারণ, এর ফলে দু’পাড়ের পানি ছড়াগুলো শোষণ করে নিতে পারছে না। সুরমার ড্রেজিংয়ের সময়ও দু’একটা বিষয় বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ অনেকের।
২০২২-এর বন্যার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সফর করে নদী খননের নির্দেশ দিয়েছিলেন। শোনা যায়, বিপত্তিটা বেঁধেছিল নদী খনন করতে গিয়ে। সুরমাগর্ভে পলিথিনসহ এত বর্জ জমা হয়েছে যে, প্রচলিত খনন যন্ত্র ব্যবহার করে ড্রেজিং করা নাকি কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এর সম্ভবত সমাধানও আছে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিক ভাইয়ের মুখে একই রকম সমস্যার কথা শুনেছিলাম। উত্তরের খালের ভিতর জমে থাকা বর্জগুলো অপসারণের জন্য তারা এখন বিশেষ ধরনের শক্তিশালী সাকার মেশিন ব্যবহার করছেন। সুরমাতেও প্রয়োজন এবং সম্ভব হলে এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়তে পারে।
সমস্যা আছে আরও। সিলেটের নদীগুলো থেকে দেদার বালু এবং পাথর উত্তোলনও কারও কারও মতে এই অঞ্চলের বন্যার হালের প্রকোপের জন্য অনেকটাই দায়ী। নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু এবং পাথর উত্তোলনে নদীর পাড় কাটা পড়ে নদীর নাব্য এক সময় কমে যায়। সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলায় যে বায়ান্নটি নদী আছে, সেই নদীগুলোতে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা এক হাজারের বেশি। নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে একের পর এক স্থাপনা, এমনকি শিল্পকারখানাও। সরকারী উদ্যোগে শতাধিক দখলদারকে উচ্ছেদ করা হলেও সেই উদ্ধারকৃত নদী ধরে রাখা যায়নি বলেও অনেকের অভিযোগ।
কদিন আগে টিভির খবরে সৌদি আরব কিংবা দুবাইয়ে প্রবল বর্ষণে বন্যার দৃশ্য আমরা যারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি, তারাই কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে নিজের ঘরের পাশে কি হচ্ছে সে বিষয়ে অনেক সময়ই উদাসীন থেকেছি। সিলেট এবং সিলেট সংলগ্ন ভারতের মেঘালয় এমনিতেই বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। সিলেট সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি আর মৌসিরামে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এমনিতেই সিলেট অঞ্চলে একটা কথা প্রচলিত আছে- মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি হলে সিলেটে বন্যা হবে বারো ঘণ্টা পর।
আর অসমের অতিবৃষ্টিতে সিলেটে ঢল নামে সাত দিনের মাথায়। ২০২২ সালে যখন আরও একবার সিলেট বানে ভেসেছিল, তখন ১৭ জুন মৌসিরামে বৃষ্টি হয়েছিল ১০৩৩ মিলিমিটার, যা ঐ সময়ের স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি এবং একটি বিশ^ রেকর্ডও বটে। একই দিনে চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টি হয়েছিল ৯৭২ মিলিমিটার আর ভাটির সুনামগঞ্জ বানে ভেসেছিল ১৮ জুন। এ বছরও ১৭ জুন মৌসিরাম ও চেরাপুঞ্জিতে যথাক্রমে ৭৮০ মিলিমিটার ও ৪৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা গতবারের চেয়ে কম হলেও বরাবরের চেয়ে বেশি। আর ফলশ্রুতিতে সুনামগঞ্জ আবারও ডুবেছে। গতবারের মতো অত বেশি না হলেও বরাবরের চেয়ে বেশি।
কথায় কথায় যে অপপ্রচার, ভারত বাঁধ খুলে বাংলাদেশকে ডোবাচ্ছে- এর বাস্তব কোনো ভিত্তিই নেই। হিসাবটা একদমই গড়ল না, বরং যথেষ্টই সরল। এত বিশাল জলরাশি বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। বাঁধ না থাকলে তা যেমন উজান থেকে আপন নিয়মে নেমে এসে ভাটির সুনামগঞ্জ-সিলেটকে ভাসিয়ে দিত, তেমনি বাঁধের দরজা না খুললে তা একটা সময় বাঁধ ভেঙে হলেও নেমেই আসত। একই রকম আরেকটা অপপ্রচারের জায়গা তৈরি হয়েছে কিশোরগঞ্জের হাওড়ের অলওয়েদার সড়কটিকে ঘিরে। সিলেট আর সুনামগঞ্জের পানি মেঘনায় পৌঁছায় সুরমা থেকে কিশোরগঞ্জের ধনু নদী হয়ে।
আর সিলেটের কুশিয়ারার পানি মেঘনায় যায় ঐ কিশোরগঞ্জের হাওড়েরই কালিনী নদী হয়ে। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে হাওড়ের বুক চিরে যে ত্রিশ কিলোমিটার অলওয়েদার সড়ক, তাতে যে তিনটি নদী পড়ে, সে তিনটির ওপরই আছে তিনটি বড় সেতু আর অনেক বক্স-কালভার্ট। তবে তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এই সড়কটি ধনু আর কালিনী নদী দুটির আড়াআড়ি নয়, বরং সমান্তরাল। কাজেই হাওড়ের সড়ক কিংবা ভারতের বাঁধতত্ত্ব সিলেটের বন্যার সঙ্গে বাস্তবে যায় না।
তবে ভারতে সমস্যা একটা ঠিকই আছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপকভাবে বনভূমি উজাড় করে আর খনিজ সম্পদ আহরণের কারণে ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে পলির পরিমাণ বাড়ছে। এতে শুধু সিলেট অঞ্চলের নদীগুলো নয়, পাশাপাশি হাওড়ের তলদেশের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। সঙ্গত কারণেই এসব নদী আর হাওড়ের জলধারণ ক্ষমতা ক্রমেই কমছে।
তবে যা অত্যন্ত জরুরী তা হলো, এই সমস্যার স্থায়ী একটা সমাধান খুঁজে বের করা। সিলেটের যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিবছর লাখো মানুষ ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করছে, আর আমরা সারাদেশ থেকে সিলেটের জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাতারগুল, সাদাপাথর আর লালাখালে ছুটছি, সেই বিমানবন্দরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বাইশটিলার মানুষ যদি বছরে বারোর মধ্যে ছয় মাসই পানিতে ডুবে থাকে, সেটা কোনো কথা হতে পারে না। সিলেটে বন্যা ছিল, আছে, থাকবে, কিন্তু ‘বন্যার সিলেট’ থেকে তো সিলেটকে মুক্তি দিতেই হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান,
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com