আব্দুল করিম কীমঃ কোথাও কেউ কি আছেন ? আমি কোথাও কাউকে খুঁজে পাই না । চারপাশে দেখি চোখ বুজে থাকা মানুষের মুখ । সুনশান নিরবতা ভাঙ্গে না কেউ । খুব বেশি হলে ফেইসবুকে দু’চার লাইন । কিছু লাইক, কিছু কমেন্ট, ব্যাস । চারপাশে এতো অনাচার দেখে দেখে ভোঁতা হয়ে যায় অনুভূতি । প্রতিবাদের আওয়াজ ওঠে না, রাজপথে যাওয়ার তাড়না নেই কারো । তাড়না দেয়ার মতও কেউ নেই । অদ্ভুত এক আঁধার ঢেকে দিচ্ছে দশদিক । অনিয়ম-আনাচার, বীভৎসতার নিত্য নতুন তথ্য জানান দিচ্ছে খবরের কাগজ । খবরের কাগজ কিছু এড়িয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগে অন্যের শেয়ারের কল্যাণেও অপ্রীতিকর সংবাদ দেখতে হয়।
গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে । গুমের তালিকায় কে নেই ? সকল শ্রেনীপেশার মানুষ আছে । জালিয়াতি, সরকারী সম্পদ লুট, আর্থিক কেলেংকারী নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার । নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা, সংখ্যালঘুদের ভিটেছাড়া করা অতি সাধারণ বিষয়। হটাৎ করে দুয়েকটা ঘটনা ঘুমন্ত বিবেককে নাড়া দেয় । বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে বিচ্ছিন্ন অপরাধীদের বিরুদ্ধ্যে ব্যাবস্থাও নেয়া হয় । কিন্তু সমাজ তাতে শুদ্ধ হয় না । পৌনঃপুনিক ঘটতেই থাকে অপরাধ । এসব অপরাধ হটাৎ করে ঘটছে না । এর পেছনে আছে মনোজগত ধ্বংস করে দেয়া নানা পারিপার্শ্বিকতা ।
দখল-দূষন-লুট-হয়রানী-ঘুষ জাতীয় জীবনে এখন আর অপরাধ নয়, ঘটনামাত্র । এসব ঘটনা সংগঠনের জন্য সাধারনত কাউকে কারাবাসে যেতে হয় না । কস্মিতকালে কেউ যদি যায়ও শেষতক সে বীরদর্পেই সমাজে ফিরে আসে । চলমান সময়ে সর্বজন স্বীকৃত অপরাধীদের স্বসম্মানে প্রত্যাবর্তন এমনটাই শিক্ষা দেয় । সমাজের এই পচে-গলে যাওয়া অবস্থা কাউকে বিচলিত করে না । এসব নিয়ে কেউ কথাও বলে না ।
এ সিলেট অঞ্চলেই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধ্যে লড়াইয়ের নানান আখ্যান রয়েছে । নানকার আন্দোলন থেকে শুরু করে ব্রিটিশ খেদাও, পাকিস্থান খেদাও হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে সিলেটের নেতারা বাংলাকে পথ দেখিয়েছেন । সমৃদ্ধ ইতিহাস থাক । ইতিহাসের পাতায় নাইবা গেলাম, নিজের শৈশবে দেখা আশির দশকের কথা বলি- স্থানীয় পর্যায়ের অনাচারের বিরুদ্ধ্যে গর্জে উঠতে দেখেছি এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের । দেশ ও দশের স্বার্থহানিকর যে কোন অনাচারের বিরুদ্ধ্যে দলমতের উর্ধ্ব্যে ওঠে আন্দোলনে লড়েছেন। মানুষ সে লড়াইয়ের ডাকে অংশ নিয়েছে । সিমিটার বিরোধী আন্দোলন, মধুবন আন্দোলন কিভাবে ভুলে যাওয়া যায় ? সর্বশেষ গত দশকে টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন, সিংহবাড়ি আন্দোলন এই সিলেটের রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে হয়েছে ।
এই দশকের শুরু থেকেই সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুন্যতা উপলব্ধি হচ্ছে । সিলেট যেন অভিভাবক শুন্য । না সরকারে অভিভাবক আছে, না রাজপথে আছে । সরকার পরিচালনায় যখন যেই থাকুক স্বাধীন বাংলাদেশে সিলেটীদের সব আমলেই অভিভাবক ছিল । দল-মত-নির্বিশেষে সে অভিভাবকের কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিল সবার । সিলেটের সমস্যা নিয়ে সে সব অভিভাবকদের সাথে অন্তত কথা বলা যেত । আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সাইফুর রহমান, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, এ এস এম কিবরিয়া এরা অভিভাবক ছিলেন । আজ সরকারেও অভিভাবক নেই, রাজপথেও অভিভাবক নেই । সরকারে থাকা দুই মন্ত্রী একসময়ের পরিবেশবাদী সুশীল অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও সাবেক কমরেড শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কোন ভাবেই সিলেটবাসীর অভিভাবক নন । উনারা অভিভাবকের অবস্থানে নেই । দূরের মানুষ হয়ে গেছেন । সিলেটের প্রকৃতি আজ ধ্বংসের শেষপ্রান্তে । যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভয়ানক রকম খারাপ । শিক্ষা ক্ষেত্রেও আশার কিছু নেই । এই যে অকাল বন্যা গেলো, মানুষের হাহাকার, এই যে পাথর শ্রমিকদের লাশের সারি এসব নিয়ে সরকারে থাকা এ দুই অভিভাবকের ভাবনা কি নাগরিকদের সন্তুষ্ট করে ? উনাদের নিয়ে সাধারণ নাগরিকেরা কি ভাবে উনারা কী তা জানেন ?
আজ সরকারের মত রাজপথও অভিভাবক শুণ্য । চলমান অনাচার নিয়ে রাজপথের অভিভাবকদের কোন কর্মসুচি নেই । এই যে প্রকৃতিবিনাশ, শ্রমিকের লাশ এসব কি শুধু পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের বিষয় ? এসব ইস্যু কি রাজনৈতিক ইস্যু নয় ?
কোথায় আছেন আমাদের রাজপথের কমরেড’রা ? অনেকেই দেশ ছেড়েছেন । যারা আছেন তাঁদের অনেকে বেছে নিয়েছেন ছাপোষা নাগরিক জীবন । ভরসা রাখার মত অবশিষ্ট যে কয়েকজন রাজনৈতিক পরিচয়কে ধারন করে এখনো টিকে আছেন, দুঃসময়ে তাদেরকেই খুঁজি ।
কমরেড Bedananda Bhattacharjee কি আইন পেশাতেই মুখ গুঁজে থাকবেন ? ব্যারিস্টার @আরশ আলী কেবল নাট্য উৎসবের ফিতা কাটবেন ? জননেতা Lokman Ahmed কি বহুমুত্র রোগীদের সেবাকেই জীবনের শেষ ইচ্ছা ভেবে নিয়েছেন ? Emad Ullah Shahidul Islam কি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে কেবল বক্তৃতা রেখে যাবেন ? কিংবদন্তীর ছাত্রনেতা Zakir Ahmed কি আর জ্বলে উঠবেন না ?
সিলেটের গৌরবময় সদ্য অতীতের কথা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন । অনেকে ভুলেন নি । এখনো সব চোখে ভাসে । সুদূর প্রবাস থেকে সেই সময়ের অন্যতম সংগ্রামী কমরেড Shahab Uddin ছাত্রাবাসের জায়গা দখল করে রাগীব আলী’র মধুবন মার্কেট গড়ে তোলার প্রতিবাদে সে সময়ের গর্জে ওঠা মিছিলের পুরনো এক ছবি ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখে যান স্মৃতির এলিজি-
“ছবি ঝাপসা হয়।
ঘটনা ঝাপসা হয় না।
এ ছবির অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকেই জীবনের নানা নোংগরে হারিয়ে গেছেন। ছড়িয়ে গেছেন বিশ্বময়।
বেঁচে আছেন কেবল রাগীব আলী ।
যদিও দানবীর উপাধি নিয়েছেন চাটুকার আর পদলেহীদের কাছ থকে। মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজের সম্পর্ক বানিয়ে ইতিহাসও লিখিয়েছেন কিন্তু মিথ্যা, সত্য হয়ে যায়না ।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করে যার যাত্রা শুরু, দেবতার সম্পত্তি ভোগ করে কারাবাস।
এদের পরিনতি এমনই হয়। প্রায়শঃচিত্ত কড়ায় গন্ডায় করতে হবে, করতে হয়।
ছবির আব্দুল হামিদ,আব্দুন নুর মাস্টার বা সৈয়দ আবু নছরদের ছবি ঝাপসা হয়।কিন্তু তাদের স্মৃতি জ্বলজ্বল করে ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়ে।
একই ইতিহাসের কলংকের অধ্যায়ে লেখা থাকে রাগীব আলীদের নাম।
এ অধ্যায় ধিক্কারের, এ অধায় ঘৃণার।
অনাগত ইতিহাসও এক পক্ষকে কুর্নিশ জানাবে, অন্যকে জানাবে ধিক্কার।
আমাদের মহিমান্বিত যৌবনের উজ্জ্বল স্মৃতি, ঘৃনা আর ধিক্কারের আর্তি বৃথা হতে পারেনা।
জয় হোক লড়াকু, আপোষহীন জনতার।”
তাঁর এ লেখায় সে সময়ের অনেক সংগ্রামীর মন্তব্য জমা হয় । সে লেখায় ভুলে না যাওয়ার স্পস্ট উচ্চারণে সাংবাদিক Ibrahim Chowdhury খোকন লিখেন-
“অনেক কিছুই আমরা ভুলে যেতে চাই । পারি না । আব্দুল হামিদ, আব্দুন নুর মাস্টার, আব্দুর রহিম, সৈয়দ আবু নছর, ম আ মুক্তাদির, সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর, আ ন ম শফিক বহু নাম ভাসছে ।
সিলেট পাইলট স্কুলের ছাত্রাবাস নিয়ে প্রথম প্রতিবাদী মিছিলটার কথা মনে পড়ছে।
কতো মুখ হারিয়ে গেছে। কতো সতীর্থ আপোষের গলিপথে নিজেদের বলি দিয়েছে – সে হিসেব অন্যদের দরকার নেই।আমাদের কাছে আছে ।
ইতিহাসের অনেক ঘটনা রুপক হয়ে উঠে। মীর জাফর বা রাজাকার শব্দ দু’টি আর শব্দ থাকে না।
তেমনি সিলেট অঞ্চলে রাগীব আলী নিজের নাম নিয়ে নিজেই পরিচিত হয়েছেন।
প্রায় এক দশকের টানা আন্দোলনে আমাদের মিছিলে এমন কোন ছাত্র ছিলোনা,যে একবার প্রতিবাদী ঢিল তাঁক করেনি,পুলিশের ধাওয়া খায়নি। ছাত্রাবাসের স্থানে গড়ে উঠা মৌবনে হামলা করে প্রতিবাদ জানায়নি, এমন শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না পুরো নব্বই দশকে।
বহুজনের পালিয়ে বেড়ানো রাত, নির্যাতনের শিকার বহু দ্রোহি যৌবন -নরাধমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে।
আজো আইফেল টাওয়ারের নীচে, টাইম স্কোয়ারে বা টেমসের পারে কেউ ঝাপটে ধরে। বলে, আপনাদের সাথে মিছিলে ছিলাম। কে কোথায় আছেন?
বুকটা হাহাকার করে। ভেসে আসে বহু মুখ। বহু উজ্জ্বল নাম।
হ্যা, কিছু সময়ের জন্য থমকে যেতে হয়।
দেখি, স্বৈরাচার আছে, আছে আমাদের নিপীড়ক আর সর্বভুক খাদকের দংগল।
এদের তাড়াতে যৌবনের মিছিল দীর্ঘ ছিল।
মিছিলের সেই উজ্জ্বল সময়ে ফিরে যাই শাহাব উদ্দিনের লেখা পড়ে।ঝাপসা ছবিতে চোখ বুলিয়ে।
ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা তাঁদের প্রতি- যারা সময়েও তাদের উজ্জ্বল্য হারাননি। ধিক্কার তাদের-যাদের তখনো ধিক্কার দিয়েছি,আজো দিয়ে যাই।
লড়াই চলমান!”
আসলেই লড়াই চলমান । লড়ে যেতে হবে । এক রাগীব আলী’র পচন যেখানে শেষ হচ্ছে না, সেখানে আরও অসংখ্য রাগীব আলীর উত্থান ঘটছে । প্রকৃতিবিনাশ করে অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে কেউ পর্যটন ব্যাবসায়ীর ভেক ধরছে, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে, কেউ নিশ্চিত অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে আইন প্রণেতার ছায়াসঙ্গী হচ্ছে । সিলেটের ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদ নির্দয় ভাবে উত্তোলন করে আগামী দিনের রাগীব আলীদের যেভাবে জন্ম হচ্ছে, তাতে ভয়ানক দুষ্কালের পদধ্বনি শুনতে পাই । কোথাও কেউ কি আছেন ? কেউ কি শুনছেন ?
সংবাদটি শেয়ার করুন