সুমন সরদার এর কবিতা

প্রকাশিত: ৩:২৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৭, ২০২৩

সুমন সরদার এর কবিতা

 

নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে সুমন সরদারের বিশিষ্টতা হলো, কবিতায় তিনি ছন্দ-পরম্পরা ঠিক রেখেই প্রতীক-চিত্রকল্পে কাব্যভাষাকে সাংকেতিক করে তোলেন।

কবিতার ছন্দ, ভাষা এবং নির্মাণ কৌশল নিয়ে তিনি ভাবেন, কিন্তু কখনও কবিতাকে অস্পষ্ট করে তোলেন না। তাঁর কবিতায় মেসেজ থাকে কিন্তু বিবৃতিধর্মী নয়। ছন্দ থাকে কিন্তু তা প্রাচীনপন্থীদের মতো নয়। গদ্যের কাছাকাছি, অথচ ছন্দমাত্রায় সুগঠিত। কবিতাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া কম কথা নয়। গত প্রায় তিন দশকের অধিক সময় ধরে নিরন্তর সাধনায় সুমন সরদার নিজেকেই অতিক্রমণ করেছেন।

সুমন সরদারের জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১, মুন্সিগঞ্জে। পৈত্রিক নিবাস শ্রীনগরের শ্রীধরপুরে। শিক্ষা- এম.এস.এস (রাষ্ট্রবিজ্ঞান); এলএল.বি।

শৈশব থেকে বসবাস ঢাকা শহরে। কৈশোর উত্তীর্ণ হবার নিকটপূর্বে মুক্তিযুদ্ধের একটি বছর কেটেছে তাঁর গ্রামে। কবিতা দিয়ে লেখালেখির শুরু। কবিতার পাশাপাশি লিখেন প্রবন্ধ, গীতিকবিতা আর নাটক। কৈশোর পূর্ব একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আর ফেলে আসা পথের ঘটনা, নদী ও বৃক্ষ, ফসল ও তৃণের ছায়া তাকে অনুসরণ করে সর্বক্ষণ। সেসবের মিশেলে এক অন্যরকম ঘ্রাণ এসে ছুঁয়ে যায় তাঁর কবিতাকে। সেই ছোঁয়া লেগে থাকে অনেকদূর পর্যন্ত, হঠাৎ কখনও প্রবল হয়ে উঠলে অন্যকোন মাধ্যমে তা রাঙিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ‘বিপন্ন বসবাস’ (কবিতা), ‘আগুন রঙের ডানা’(কবিতা), ‘তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়’ (কবিতা), ‘মানবযাত্রা’ (কবিতা), বিষন্ন নির্জনে একা (কবিতা), ÔHuman RaceÕ (amazon.com, USA, কবিতা), ÔInward JourneyÕ (Bilingual, কবিতা), ‘নীলবাড়ির দীর্ঘশ্বাস’ (উপন্যাস), ‘সপ্তসুরের কাব্যগাথা’ (গীতিকবিতা)।

সম্পাদিত গ্রন্থ- ‘নির্বাচিত বাংলা কবিতা: নব্বইয়ের দশক’ (বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা)।

উল্লেখযোগ্য নাটক- ‘অল আউট’ (ধারাবাহিক), নীলবাড়ি (ধারাবাহিক) ও ‘ভালবাসা ১০০ ভাগ’।

 

 

সুমন সরদার-এর   পাঁচটি কবিতা

 

স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি-১

 

নদীর যৌবন যখন ফুরোয়

মাছের যৌবন তখন থেকেই শুরু

আনন্দে ডিগবাজি দিয়ে কাদামাটি মেখে হোলি খেলে

না হলে মানুষ এতো স্বপ্ন বুনে কেন!

কাদামাটিমাছ হয়ে মানুষের স্বপ্ন হেঁটে যায়

তবু কারও মন চায় মেকি অট্টালিকা,

শ্বেতপাথরের সুখ

 

চুপি চুপি ফেরি করা যৌনতার লোভে

ও পাড়ার কিছুলোক মাছ নয় মাছি হতে চায়

জীবনের জয়গান গাইবার আগে

অশুদ্ধ বেভুল দিনাচার লাফালাফি করে

ওসব সমূলে ধুয়ে মুছে দিতে সত্য ও সুন্দর

দেবতার শূন্য আসন দখল করে…

 

 

স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি-২

 

যে যা চায়, দাও তার পাতে তুলে

মরুক বাঁচুক তাতে কিবা আসে যায়

যে যাবার সেতো যাবে চলে, যে আসার সে আসবে

পৃথিবীটা যেন ফুলে ফেঁপে ওঠা এক রঙ্গমঞ্চ

মঞ্চ থাকলেই বা কী, না থাকলে বা কী!

রঙ্গ আছে সাতরঙে রাঙা মানুষের পায়ে পায়ে।

 

এখানে বাজার মিলে, সকালের রোদে

এখানে বাজার মিলে, সন্ধ্যার মায়ায়

এখানে পাওয়া যায় সন্ধ্যার মৌনতা আর

বিশুদ্ধ যৌনতা…

একটা কিনলে একটা ফ্রি, নীতি ভাল

রীতি ভাল

রিরংসু-আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাক সভ্যভব্য

 

মাটি ভেদ করে ওঠা বৃক্ষের শেকড়

শুধু ভেংচি কাটে… ভেংচি কাটে…

 

 

স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি-৩

 

মানুষভ্রমর উড়তে পারে

গাঁওগেরামে ঘুরতে পারে

বসতে পারে পূর্বপাড়ার সবুজ শ্যামল ঘাসে,

কারও গোলায় হানা দিয়ে

সাজতে পারে নতুন টিয়ে

বারো রঙে সাজে ওরা বাংলা বারো মাসে।

 

ক’জনা তার হিসেব রাখে

গেলো কোথায় কোন্ সে বাঁকে

নাই নাই নাই বাড়ি সে নাই খুঁজবে কোথায় বলো,

সীমান্তের ওপারে গিয়ে

চাক বাঁধে সে স্বস্তি নিয়ে

সব ভুলে ভাই আবার তবে নতুন ফসল তোলো।

 

এক ভ্রমরের দুই চরিত্র দুইটি কর্মে ভরা,

একটি হলো লুট করা আর একটি মজুত করা।

 

 

স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি-৪

 

আমার দীঘলছায়া ক্ষুদ্র হতে হতে

নিশ্চুপ-আমাকে ফেলে কোথায় কখন চলে যায়

গতরাতেও তো ওকে দুধকলা-আদর করেছি

এই ভেবে, অন্তত দিনের ঘোর লাগা সময়ের

সঙ্গী হোক… পরিশ্রান্ত দেহে…

 

আমার ছায়া কী বলো আমার হয়েছে কোনদিন

নাকি জোছনার চক্রান্তে ভ্রুকুটি মেলে সরে যায়

নাকি দেবতার পায়ে চলে যায় জন্মভিটা ছেড়ে

তোমাকে খোঁজার বাহানায় ধ্বস দেখি

চতুর্দিকে, সবুজ প্রান্তরে।

 

আমি থেকে আমার ছায়ার জন্ম

নাকি সেই ছায়া থেকে আমার জন্মের যাত্রা শুরু

জানে কি বৃত্তান্ত বৃত্তাভাস;

ছায়া নেই, আমি নেই

ছায়া আছে, আমি আছি।

 

কিছু ছায়া না থাকলে, জন্ম বৃথা, তোমার… আমার…

 

 

স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি-৫

 

একবার ছুঁয়ে দেখো ওই মেঘ, অনুভবই সার

কুয়াশার বাক্সে ভরা, তবু গর্জনের শেষ নেই

প্রধান সড়কে, দূরে, মরীচিকা ঢের জ্বলে নিভে

মাতাল রাজ্যের রাজার মুকুট পরে–

দুর্দণ্ড প্রতাপে হেঁটে যায়, বালকেরা তালি দেয়

পাংকুরাও তালি দেয় কাপড়ে বা চামড়ার উপরে

ওদের তালুতে বাসা বাঁধে রাজ্যের বেগানা মোহ

ঘর্ষণে ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে, দূরের তারারা হাসে

কাছে গেলে কিছু নাই, দেখি সবই মেকি…

 

রঙের ঝিলিকে বিশ্বময় ঝলোমলো

শুধু এ পাড়ার ঘরে নিশিদিন

কাশিতে কাশিতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে..