ড. নাঈমা খানম
যে কোন কাজেরই পূর্বশর্ত হচ্ছে সৃজনশীলতা।সৃজনশীলতায় বিশ্বে নারীর অবদান কম নয় পুরুষের চেয়ে।
তার পরেও জেন অস্টেন, জর্জ ইলিয়ট কিংবা মেরি কারমাইকেলের মতো লেখিকারা অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের স্তরে উন্নীত হতে পারেননি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা অসঙ্গতি ও প্রতিবন্ধকতার কারণে।
বিংশ শতকের ও আগে নারী তার অবস্থান নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে নারীর স্বাধীন চেতনা সত্তা তথা নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নারীবাদ নারীর ওপর সকল প্রকার বৈষম্য দূর করবার এক মতাদর্শ।নারীবাদ উত্তর আধুনিক সাহিত্য বিচারে পরিচিত এক নাম। সমঅধিকারের সংজ্ঞা হচ্ছে মানুষের বিচিত্রতাকে গ্রহণ করে প্রত্যেককে স্বতন্ত্র সমাধান বিস্তারে এক লড়াইয়ের নাম।১৭৯২ সালে নারীবাদী আন্দোলনের বীজমন্ত্র লিখিত যে বইটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় তা হল মেরী উইলস্টোন ক্রাফটের লেখা 'A vindication of the Rights of Women' গ্রন্থটি। বলবার অপেক্ষা রাখেনা বইয়ের শিরোনামেই তার বিষয়বস্তু, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অত্যাচারিত দিশেহারা নারী আপনার স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় উদগ্রীব।
এতে পরিলক্ষিত হয় বহু পূর্ব থেকেই পুরুষতন্ত্রের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ক্রমশ নারীবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। নারী সমাজ সম্মিলিত ভাবে সংসারের আবর্ত থেকেই বৃহৎ প্রতিবাদের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে আপন স্বতন্ত্র রক্ষায় তৎপর হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় নারীসমাজ ১৮৩৭ সালে প্রথম আমেরিকায় দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলন করে।ফলস্বরূপ দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৮৯৩ সালে Suffragette আন্দোলন যে সাফল্যের মুখ দেখে, তাতে নিউজিল্যান্ডে প্রথম নারীরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটদানে সক্ষমতা লাভ করে।
কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারাজেট কিনের নেতৃত্বে ডেনমার্কের ওপেন হেগেনে ১৯১০ সালে নারীদের একত্রিত করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সেটিরই পরবর্তী রূপ হিসাবে বিশ্বজুড়ে ১৯১৪ সালে ৮ ই মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। আর ১৯১৮ সালে ইংল্যান্ডের নারীরা প্রথম ভোটাধিকার পেয়ে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করে। কিন্তু তা স্বত্বেও নারীর কর্ম ও সৃজনশীল প্রতিভার দিকটি পুরুষ সমাজের কাছে পুরোপুরি অবহেলিতই থেকে গেছে। লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত 'A room of one's own' বইতে সরাসরি স্পষ্টভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি আঙ্গুল তুলতে ছাড়েননি।তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সুযোগের অভাবেই নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে সেকেন্ড সেক্স বা গৌণ লিঙ্গ।তার দাবী, নিজস্ব পরিসর পেলে সৃজনশীলতার উৎকর্ষে সমাজে পুরুষের সমান দক্ষতা দেখাতে সক্ষম নারী।
নারীর স্বাধীন স্বাতন্ত্রের নানারূপের মধ্যে শক্তিমত্তা এবং সৃজনশীলতা হচ্ছে বড় বৈশিষ্ট্য যে উৎকর্ষতায় একজন নারী তার নারী রহস্যকে যত সহজে ভাঙতে পারে বা নারীমনের রহস্য বুঝতে পারে, একজন পুরুষ তা পারেনা। পুরুষ সমাজের কাছে চিরকালই নারীর উৎকর্ষতা অবহেলিত। সাহিত্য ও শিল্পকলায় নারীর সজাগবোধ ও অংশগ্রহণকে আমল না দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক্ল জাতাকলেই বন্দী রাখতে পুরুষের প্রয়াসকে গুড়িয়ে দিতে ১৯৪৯ সালে সিমেন দ্য বোভেয়ারের 'The Second Sex' গ্রন্থে প্রতিবাদের কঠিন ভাষা ব্যক্ত হয়েছে। এই বইয়ে লেখিকার এক বিখ্যাত উক্তি রয়েছে যা নারীবাদের প্রতিবাদের ভাষা- "কন্যা সন্তান নারী হয়ে জন্মায় না সমাজ তাকে নারী করে তোলে"।তিনি মনে করেন নারীর সজাগবোধকে আমল না দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর স্বকীয়তা ও দায়িত্ব বহনের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত কেটি মিলাটের বহু আলোচিত 'Sexual Politics' গ্রন্থে পুরুষতন্ত্রের ধর্ষকামিতার বিরুদ্ধে খোলা গলায় প্রতিবাদ করা হল। তার মতে চরিত্র চিত্রণএর নামে পুরুষ সাহিত্যিকরা সাহিত্যের পাতায় পাতায় বিকৃত নারী চরিত্রের আমদানি করে তাদের চরিত্রের কলঙ্কময় ধর্ষকামীরই পরিচয় দিয়ে চলেছে। তিনি একে যৌন রাজনীতি বা Sexual Politics বলে অভিহিত করেছেন। তপ্ত এই বক্তব্যে উৎসাহিত নারীবাদীদের বিরাট অংশ সাহিত্য বা শিল্পকলায় নারীদের অংশগ্রহণকে চুলচেরা বিশ্লেষণে নিজেদের প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় ও স্বরূপকে অন্বেষণ করতে লাগলেন।পরবর্তী নারীবাদীরা পুরুষদের রচনায় নারীর নেতিবাচক ভাবমূর্তি জনসম্মুখে শুধু তুলেই ধরেননি, নারীর স্বরচিত শিল্পসাহিত্যের ঐতিহ্যমন্ডিত তালিকা ও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এতে পুরুষ সমাজের কবল থেকে রক্ষা না পেয়ে যে সব নারী রচিত সাহিত্য লুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো আধুনিক নারীবাদীরা গাইনোক্রেটিক পদ্ধতিতে তাদের মূল্যায়নে তৎপর হলেন। নারী রচনার বৈশিষ্ট্য সমূহের একটি তালিকা ও তারা নির্দিষ্ট করলেন নারী-পুরুষ দুই বিপরীত লিঙ্গের দুটি পৃথক শ্রেণীর সংস্কৃতি তথা শিল্পের লালন করার কথা ভাবলেন। সর্বোপরি মানদণ্ড চাইলেন দেশকালাতীত নারীর স্বরূপটি অনুভূতিতে যাতে বিকশিত হয়। এক্ষেত্রে তারা প্রাধান্য দিয়েছিলেন নারীর মানসিক বিবর্তন অনুভূতি গুলোর দিকে।
১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মোয়েরস Literary Women : The Great writers নামের একটি প্রবন্ধ সংকলন করলেন। এতে নারীর জৈব শরীর এবং জন্যই পুরুষদের রচনা থেকে তাদের রচনা পৃথক হয়ে যায়। শোওআল্টারই নারী সংস্কৃতির বিবর্তনের তিনটি ধাপ বা পর্যায়ের কথা বলেছেন যথা- Feminine, Feminist ও Female! প্রথম পর্যায়ে আধিপত্যকারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা বিষয়গুলো অনুকরণ করতে সচেষ্ট হয়, দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে প্রতিবাদ, প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তৃতীয় পর্যায়ে নারী তার আত্নআবিষ্কার করে পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বাধীন হয়ে উঠছে। তিনি কালাক্রমিক বিন্যাসেও এই বিবর্তনটিকে দেখাতে চেয়েছেন তার মতে ১৮৪০-১৮৮০ প্রথম পর্যায়ের, ১৮৮০-১৯২০ সাল দ্বিতীয় পর্যায় এবং ১৯২০ সাল থেকে সাম্প্রতিক পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়। এরপর গিলবার্ট ও সুসান গুবাত নারীবাদের স্বপক্ষে বলেন সমাজ যেহেতু পুরুষ শাসিত শিল্পের সংজ্ঞাও নির্মিত হয় পুরুষের দ্বারাই। সাহিত্য শিল্পের সংজ্ঞা পুরুষ নির্মিত বলেই নারীর শিল্পকলা যথার্থ বিচার থেকে বঞ্চিত নারীর রচনায় সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা থেকে বন্ধনমুক্তির প্রসঙ্গগুলি ফিরে আসবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। এইভাবেই নারীবাদী বিষয়গুলো আজও নতুনভাবে এগিয়ে চলছে যা নারীর সৃজনশীল শক্তিকে কখনো প্রকটভাবে, কখনো প্রচ্ছন্ন ভাবে উপস্থাপন করে।
এর মধ্যে বড় হলো আর্থিক সমস্যা। নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর।সাহিত্য রচনায় কেন নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে? এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া উলফ তার বিখ্যাত বই 'A Room Of One's Own' এ বলেছেন নারীর অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকার কথা। সেই সঙ্গে বলেছেন, অনেকের নিজের একটি ঘরও নেই যা সৃজনশীলতার জন্য খুব প্রয়োজন।
মানবসভ্যতার এই যুগে এদেশে এমন কোন পেশা নেই যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নেই। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সাহিত্যে নারীর পদচারণা কতটুকু? বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে অনেক নারী ভালো লিখতে জানেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকে জীবনের সাধনা হিসেবে নিতে পারেন না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সাংসারিক দায়িত্ব, সন্তান দেখাশোনার ভার- এই বিষয়গুলোই মূলত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কে তাকে জায়গা করে দেবে সাহিত্য সাধনায় একক মনোনিবেশের জন্য? তার উপর প্রশ্ন তোলা হয় কোণঠাঁসা নারী সাহিত্যিকের সাহিত্য মান নিয়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা নারী লেখকদের জন্য বেশ কঠিন। কারণ তাকে সহযোগিতা করার মতো মানসিকতা সবার থাকে না। কিন্তু ভাবুন,পুরুষের মতো সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যদি নারীরাও বড় হতেন, তাহলে বেগম রোকেয়া, সিমন দ্যা বুভ্যেয়ার, মহাশ্বেতা দেবী, মৈত্রীয় দেবীর মতো দিনের পর দিন আরও অনেক নারী লেখক তৈরি হতো সমাজে।
সারা পৃথিবীতেই নারী সাহিত্যিকের উপস্থিতি অনেক কম।সৃজনশীল কাজে বিঘ্নহীন বা নিরিবিলি সময় বা জায়গা নারী পায় কই? সাহিত্য সাধনায় একটি একক জীবনে সময় এবং একাগ্রতা খুব বড় বিষয়।লেখালেখি করা সাধারণ কোন কাজ নয়। এটা একটা সাধনা। মানসম্মত লেখার জন্য সাহিত্যপাঠ ও চর্চার কোন বিকল্প নেই।লেখকের গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করতে হলে নিজের মান যাচাই করতে হয়।নিজের সীমাবদ্ধতা আগে দেখা দরকার। ভালো লিখতে না পারলে সেটা একসময় ডাস্টবিনে যাবেই। একটি বা দুটি বই প্রকাশ করলেই কেউ ভালো লেখক হতে পারেন না।লেখকস্বত্ত্বা আজীবনের সংগ্রাম। আসলে মেয়েদের নিজেদেরকেই সবসময় নিজের ভেতরের শক্তিকে পরিচর্চা করতে হবে।নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে নিজেদেরই। নিজের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। জীবনের সবজায়গায় সমস্যা থাকে। সমস্যাকে ভয় পেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে- পারিবারিক, সামাজিক দায়িত্বকে পাশ না কাটিয়েও লেখকের নিষ্ঠা দিয়ে সমস্যাকে জয় করা সম্ভব। 'প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনীতে সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ি, নারী-পুরুষের সমতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখি' এই অঙ্গীকারনামা হোক আমাদের সৃজনশীল আজকের নারী লেখকদের একান্ত চাওয়া।
- ড. নাঈমা খানম
গবেষক, কবি ও লেখক
[email protected]
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com