চাকরিকে না বলে ৭ বছর আগে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ শুরু করেন গাজীপুরের নজরুল ইসলাম বাদল। কৃষিকাজে নতুন সম্ভাবনা খুঁজতে গিয়ে সন্ধান মেলে সৌদি খেজুরের। সেই থেকে যাত্রা শুরু।
এখন মরুভূমির এ ফল চাষ করে দেশে খেজুরের চাহিদা মেটানোর স্বপ্ন দেখছেন বাদল।একই সাথে খেজুর চাষে উৎসাহিত করে অনেককেই পরামর্শ প্রদান ও উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি।
সদর উপজেলার পিরুজালী ইউনিয়নের আলিমপাড়া এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমান খানের ছেলে বাদল খেজুর চাষের পাশাপাশি খেজুর চারার নার্সারিও গড়ে তুলেছেন। ৪১ বছরের বাদল ২০০৩ সালে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে অর্নাস পাস করেন।
পড়াশুনার পাট চুকিয়ে এনজিওসহ কয়েকটি টেলি কমিউনিকেশন সংস্থায় পরিবেশকের চাকুরি করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। কৃষি কাজে যোগ দেওয়ার পর দেশ বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জমিতে ‘সৌদি ডেট পাম ট্রিস ইন বাংলাদেশ’ নামে খেজুরের বাগান গড়ে তোলেন তিনি।
বাদলের খেজুর আবাদের সফলতায় দেশের বিভিন্ন জেলার আগ্রহী চাষিরা এখন তার কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে খেজুর চাষে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন।
যাত্রা শুরুর গল্পে বাদল বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে সম্মান ডিগ্রী অর্জনের পর চাকুরি করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরপর কৃষক বাবার সঙ্গে মন দেন কৃষিকাজে। তখন থেকেই কৃষিতে নতুন কিছু করার চিন্তা ভাবনা ছিল তার। সেই ভাবনা থেকে তিনি সৌদি আরব প্রবাসী বন্ধু হযরত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে খেজুরের চারা আনেন।
এরপর ২০১৫ সালে শুরুর দিকে ওই বন্ধুর সহযোগিতায় খেজুরের চাষ ও নার্সারি করার পরিকল্পনা করেন।
মরুভূমি অঞ্চলের ফসল বাংলাদেশের কাদামাটিতে ফলানো সম্ভব কিনা তা নিয়েও তার ভাবনার অন্ত ছিল না। পরে প্রবাসী ওই বন্ধুর সহযোগিতায় বিশ্বের ছয়টি দেশ থেকে বিভিন্ন জাতের খেজুরের বীজ ও চারা সংগ্রহ করেন। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমে ১৮টি চারা রোপন করে মরুর খেজুরের চাষ শুরু করেন।প্রথমেই ৫২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান বাদল।
বাদল প্রথমে ৭০ শতক জমিতে সৌদি আরবের খেজুরের জাত নিয়ে বাগান শুরু করেন। ২০১৭ সালে প্রথম তার বাগানের খেজুর গাছে ফলন আসতে শুরু করে। খেজুরের বীজ কিংবা সাকার থেকে চারা উৎপাদন করে খেজুরের নার্সারিও গড়ে তোলেন। সেই বছরেই বাগান থেকে ৬২ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি।
বর্তমানে বাগান ও নার্সারিতে ১৬ প্রজাতির খেজুর গাছ রয়েছে।মানুষের ব্যাপক চাহিদার যোগান দিতে তিনি আরও ১৪ জাতের চারা বাইরে থেকে এনেছেন। বর্তমানে নার্সারিসহ তার খেজুর বাগানটি সাড়ে ৭ বিঘায় সম্প্রসারিত করেছেন। সাকার থেকে উৎপাদিত চারায় ফলনের হার বেশি।
সাকারের চারা রোপনের এক/দুই বছরের মধ্যেই খেজুর ধরে। এ ধরনের প্রতিটি সাকার ২৫ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর খেজুর ধরা অবস্থায়ও চারা বিক্রি করা হয়, যার দাম ৩ লাখ টাকা। আর বাগান পরিচর্যা ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিমাসে তার ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়।
বাদল জানান, পরীক্ষামূলকভাবে তিনি শুরুতে বিভিন্ন জাতের ১৮টি গাছ রোপন করেছিলেন। ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথমে ১৮টি চারা রোপন করে মরুর খেজুরের চাষ শুরু করেন। এ বছরও বাগানের গাছগুলোতে অনেক খেজুর ধরেছে। এক একটি খেজুরের কাঁদির ওজন প্রায় ২৫ কেজি।
৩০ হাজার চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খেজুরের নার্সারি গড়ে তুলেছেন বলে জানান বাদল। বলেন, তার এ ‘সফলতা’ খেজুর চাষে আগ্রহীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
বাদলের সংগ্রহে খেজুরের যেসব জাত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আজওয়া, মরিয়ম, আম্বার, খুনিজি, হেলালি, ম্যাডজেলি, বারহি, খালাস, ওমানি, সুক্কারি ও সাফাওয়ি উল্লেখযোগ্য।
যেভাবে ফলন হচ্ছে, তা ঠিক থাকলে অচিরেই দেশের খেজুরের চাহিদা মেটাতে পারবেন বলে প্রত্যাশা বাদলের।
বাদল বলেন, টিস্যু ও কলম চারা থেকে ১ থেকে ২ বছরে ফলন পাওয়া যায়। একটি টিস্যু চারা ৮ থেকে ১০ হাজার, কলম চারা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং বীজের চারা ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ৮/১২টি বাদি ধরে। প্রতি বাদিতে ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে খেজুর হয়। তাছাড়া বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় ফলন আসতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ বছর। বীজ থেকে উৎপাদিত চারার দাম তুলানামূলক কম।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকার হাজী মমতাজ উদ্দিন বাদলের কাছ থেকে চারা কিনেছেন এবং তাতে ভাল ফলন হচ্ছে বলে জানান।
তিনি বলেন, “২০২০ সালে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে দুইটি খেজুর চারা কিনেছিলাম। ২১ মাস পরে এসব গাছে ফুল ও ফলন আসে। এখন প্রতিটি গাছে চারটি বাদির খেজুরগুলো পরিপক্ক হয়েছে।”
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রায় তিন বিঘা জমিতে সফলভাবে সৌদির খেজুর চাষ করছেন বাদল। বাংলাদেশে সৌদি আরবের খেজুর চাষ একটি সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। এর জন্য কৃষি পর্যায়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।