পীর হাবিবুর রহমান
৫৪ চলে যাওয়া মানেই কবরের দূরত্ব কমে আসা!যতোদিন বাঁচি সম্মান নিয়ে যেনো বাঁচি!
হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে নানামুখী উত্থান ও পতনের ভেতর দিয়ে খবরের বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে জীবনের ৫৪টি বসন্ত ঝরে গেল! বাবা-মায়ের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা অষ্টম সন্তান হিসেবে তারা আমাকে পৃথিবীতে এনেছিলেন। বুক ভরে পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণের মধ্য দিয়ে অবাধ স্বাধীনতায় তারা আমাকে বেড়ে উঠতে দিয়েছিলেন। জন্মের একমাসের মধ্যে তাদের এক সন্তান চিরনিদ্রা নিলেও আট ভাইবোনের সংসারে নানা টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে গভীর মায়া মমতায় আমরা বেড়ে উঠেছিলাম।সে কি উপচে পড়া সূখের সৃতি!
১২ নভেম্বর ১৯৬৩, বেলা ১২টায় আমার জল জোছনা, হাওড়-বাঁওড়, প্রেম-কবিতা, আড্ডা ও গানের শহর সুনামগঞ্জ শহরের গাছগাছালি ঘেরা বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলাম। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালীর স্বাধিকার-স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অধ্যায় দেখতে দেখতে আমার শৈশব কেটেছে।
পঞ্চাশের পর বয়স কমে। জীবনের সামনে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকে। ফেলে আসা দিন স্মৃতিকাতরতায় কাঁদায়। নষ্টালজিক হতে হতে বুকের ভেতর জীবনের পড়ন্ত বেলায় মনে হয় আহারে আর ১৫টি বছর পেছনে যদি ফিরে পেতাম, কিংবা আবার যদি নতুন করে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসতাম তাহলে জীবনের মধুর ভুলগুলো বেশি বেশি করে জীবনটাকে অন্যভাবেই হয়তো সাজাতাম।
মেঘালয়ের কোলে সীতান দিয়ে শুয়ে আছে যে শহর তার বুকচিরে বহমান সুরমার গোধূলি বেলার রুপ দেখে মুদ্ধ হতে হতে বেড়ে উঠেছি। পাখির কুজন, কোকিলের প্রাণ আকুল করা ডাক, রিকশার টুং টাং শব্দ, বাউলের গান, নিশিরাতের বাঁশি, গাছে গাছে মিতালী, ফুলের বাগানের সৌরভ, মাটির মমতা মাখানো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য সাধারণ সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছি।
দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পর মাঠ কতো ঘুড়ি উড়িয়েছি, কতো খেলায় না খেলেছি লুকোচুরি থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস হয়ে তাসের আসর। যাত্রাপালা, নাটক ম্যাটিনিশোতে সিনেমা, রাত জেগে কবিয়াল লড়াই, সেই ছেলেবেলা থেকেই উপভোগ করেছি। স্কাউটিং করেছি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছি, কৈশোর থেকে সোনালী যৌবন বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শে ছাত্ররাজনীতির মিছিলে উজাড় করে দিয়েছি।
হাঁটা শিখতেই মা কোমরে ঘুঙর বেধে দিয়েছিলেন, চারদিকে পুকুল খাল বিল কোথায় না ডুবে মরি এই আশঙ্কায়। সেই থেকে শৈশব হয়ে উঠেছিল ঝর্ণার মতো চঞ্চল, কৈশোর ছিলো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের নায়ক ফটিকের মতো ডানপিঠে দুরন্ত। সেই শহরে কতোদিন বৃষ্টিতে গা ধুয়ে ঘরে ফিরেছি। জোছনায় ভিজতে ভিজতে শহরের পথে পথে হেঁটেছি। ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি থেকে ছেলেবেলায়ই দস্যু বনহুর দস্যু বাহারাম, কুয়াশা, মাসুদ রানা, নিহার রঞ্জন গুপ্ত, জেমস বন্ডের জিরো জিরো সেভেন তালিম নিতে নিতে রহস্যময় গোয়েন্দা হওয়ার মনোজগতে আচ্ছন্ন হয়েছি নিজের অজান্তে।
অলস দুপুরে ঝোপের আড়ালে গাছের তলায় বই পড়ার সেই সুখ স্মৃতিসহ কতো স্মৃতি এখনো মনে ভিড় জমায়। আমাদের ছেলেবেলায় জন্মদিন মনেই থাকতো না, পালনও হতো না।
আমাদের সন্তানদের মতো প্রযুক্তিনির্ভর কবুতরের খোপ মার্কা ফ্লাটের বন্দি জীবন ছিলো না। আমাদের প্রকৃতিনির্ভর জীবন ছিলো ধুলোবালি, জলকাঁদা মেখে হুইহুল্লোড় আনন্দে খেলাধুলায় বেড়ে ওঠার, নয়ন জুড়িয়ে আকাশ দেখার। সেই আকাশের নিচের সবুজ ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার।
কবিতা, গান ও জল জোছনার প্রেমের শহরে জন্মেছিলাম রবীন্দ্রনাথের হৃদয় নিয়ে। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের মানবিক শহরে জন্ম নিয়ে হতে পারতাম গ্রামীণ বাউল, কিংবা ক্ষয়ে যাওয়া হৃদয়ের কবি। বিশুদ্ধ প্রেমিক হতে এসেছিলাম, মানুষ হতে এসেছিলাম, সাধারণের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলাম। কতোটা পারলাম, বিচারের ভার অনাগত প্রজন্মের হাতেই থাকলো।
৫৪ বসন্তের এই জীবনে বড় অর্জন জন্মের পর যুদ্ধ দেখেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। সেই রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে জীবনের প্রতিটি বাঁকে আলোকিত মানুষের সাথে পায়ে পায়ে হেঁটে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছি।
এই ৫৪ বসন্ত কবি নজরুলের অন্তহীন হাহাকার, অতৃপ্তি, দহন আর দ্রোহ নিয়ে পথ চললেও বরাবর স্মরণ করেছি আমিও মানুষ। জীবনে মধুর ভুল আছে। কিছু ভুলে অনুশোচনা আছে। অপরাধ বা মানুষের অকল্যাণ কখনো শিখিনি। তাই গ্লানি বা লজ্জা কখনো আমাকে তাড়া করেনি।
খোলা বইয়ের মতো জীবনকে উন্মুক্ত রেখে এতোটা পথ হেঁটে এসেছি। এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। মাঝেমধ্যে এতটাই কন্টকাকীর্ণ মনে হয়েছে যে স্রোতের বিপরীতে সাঁতারই কাটিনি, পাথর কেটে কেটে পথ চলেছি। উত্থান পতন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মধুর কাব্যে মোড়ানো এই জীবন কেবলই যে বিষাক্ত সাপের ছোবল খেয়েছে তা নয়; অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে।
বন্ধুভাগ্য আমার গৌরবের। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড়প্রাপ্তি, বড় অর্জন এই ৫৪ বছরে আর কিছু নেই। অন্তর চন্দ্রস্মিতার মতো দুটো সন্তান মানুষ হলেই জীবনের কোন আফসোস নেই। চিন্তাশীল অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় দিয়েই ভালোবেসেছি পেশার তারে জড়ানো জীবন। ইবাদতের মতো খবরের ফেরিওয়ালা হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। যখন যেখানে ছুটে গেছি শালুক সন্ধানীর মতো খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেছি।
পূর্বপুরুষদের দেখানো একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে এখনো পথ হাঁটছি। নানা মত, নানা পথ, গণতন্ত্রের বড় সৌন্দর্য; এটা বিশ্বাস করেছি। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি মনে হয়েছে। এই জীবনে নির্জীবের জীবন কখনো চাইনি, দাসের জীবন তো নয়ই।
৫৪ বছর পার হলেও নিজেকে আমার কতটা হলো চেনা? মানুষের মনোজগত অন্বেষণে, সুখ শব্দের গভীরতার সন্ধান পেতে ৫৪ বছর কি আদৌ যথেষ্ট? রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, অতীত বর্তমানের ওপর ভবিষ্যতের রোডম্যাপ দাঁড় করানো কি আদৌ সহজ?
পৃথিবীর তিনভাগ নোনাজল আর এক ভাগ স্থল! এই ৫৪ বছরে তার কিছুই কি দেখা সম্ভব? জীবনের পরতে পরতে যেখানে সংগ্রাম, সেখানে জীবন এতোই ছোট কেনো? না দেখলাম জল না দেখলাম স্থল! না দেখেছি মানুষ, না দেখেছি প্রকৃতি। তবুও সেই লেখক সাহিত্যিকদের মতোই প্রশ্ন থেকে যায়, কচ্ছপের জীবন যেখানে ৩০০ বছর সৃষ্টিশীল চিন্তাশীল বলবান শক্তিশালী মানুষের জীবন কেনো এতো ছোট। তবুও এই ৫৪ বছরে একটি বড় অংশ কাটিয়েছি আড্ডায়। আড্ডার সঙ্গে প্রাণশক্তির যোগসূত্রই নয় সৃষ্টিশীলতারও গভীর সংযোগ রয়ে গেছে, এটি বিফলে যায়নি।
৫৪ কে পেছনে ফেলার এই মহেন্দ্রক্ষণে কতো কথা কতো ছবি চোখের সামনে মাথার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে যায়। মনে পড়ছে ফেলে আসা চঞ্চল শৈশব, দূরন্ত দস্যিপনায় কাটানো কৈশোরের কথা খুব মনে পড়ছে আমার। দস্যিপনার জন্য স্কুল ও বাড়িতে প্রচন্ড বেত্রাঘাতের শব্দগুলো আজ দিনমান আমার পিঠ থেকে বুক জুড়ে সওয়ার হয়েছিল। দূরন্তপনাকে যেমন আমি কখনো অপরাধ মনে করিনি তাই স্কুলের উগ্র শিক্ষক বা পারিবারিক কঠোর অভিভাবকের বেত্রাঘাতের সঙ্গে তাল লয় ছন্দ মিলিয়ে আওড়ানো ‘বল আর করবি না কখনো’ এমন প্রশ্নের মুখেও না বের হয়ে আসেনি আমার মুখ থেকে। কখনো সখনো হাতের তালু রক্তাক্ত হয়েছে। শরীরে পড়েছে কালসিটে দাগ। সন্তানের নির্যাতন সইতে না পারার যন্ত্রনায় মমতাময়ী মা জায়নামাজে পড়ে মাথা ঠুকতেন। ছেলেটি তার কবে শান্ত সুবোধ বালক হয়ে যাবে।
সেইসব দিনগুলোতে বা লতাগুল্মের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ওঠা তারুণ্যের নানা বেদনাবোধ থেকে নেওয়া পাঠ আমার কখনো সইতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘আমার তো মেঘে মেঘে বেলা হল/বিকেল গড়িয়ে রাত্রি এল শেষ/তবু মেঘে মেঘে ঘোরা হল না শেষ/আকাশে আকাশে ওড়া হল শেষ।’
জন্মদিন এলেই উৎসবে মন ডাকেনা, আলাদা কিছুর তাগিদও মনে হয় না। ৫৪ বসন্তের কপাল এমন ছিলো না যে একজন প্রেমিকা একগুচ্ছ শেতশুভ্র গোলাপের তোড়া আমার চিত্তকে প্রফুল্ল করে দেবে, দিনটি ফুরফুরে মেজাজে ভরিয়ে দেবে। বালক বেলায় যেমন কোন বালিকার চোরা চাহনি কপালে জোটেনি তেমনি জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও এমন কোন রমনীর হাসি জুটেনি যে , একটু হৃদয়টাকে আকুল ব্যাকুল করে দেবে।
চিঠির যুগে আসেনি চিঠি, টেলিফোনের যুগে আসেনি টেলিফোন, মুঠোফোনের যুগে আসেনি খুদেবার্তা। জীবনে তেমন কিছু হতেও পারিনি। সহজ-সরল সাদামাঠা জীবনের মানুষ হয়ে মানুষের কাতারেই থাকতে চেয়েছি। দেশ ও মানুষকে গভীরভাবে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। মানুষকে সন্তুষ্ট করার মতো দুরুহ কাজ মনোবিজ্ঞানীদের সম্ভব হয়েছে কিনা জানি না আমার পক্ষে নিয়ত কঠিন মনে হয়েছে।
হৃদয় ক্ষয়ে গেছে অনেক আগেই ।মেরামত করা হৃদয় নিয়ে পথ হাঁটতে গিয়ে চিকিৎসকের শৃঙ্খলে বাধা পড়িনি। চাঁদের আলোর সাথে প্রতিটি জোছনা রাতে মনোজগতের যে পরোক্ষ রহস্যময়তার সৃষ্টি হয়, সেটি আমি খুব উপভোগ করেছি। আর জেনেছি মানুষের মনোজগতের চেয়ে রহস্যময় পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়ার শেষ নেই। কিছুই দেখা হয়নি কিছুই জানা হয়নি তার মধ্যেও অনেক কিছু দেখেছি, অনেকের সঙ্গে অনেক পথ হেঁটেছি ।আনন্দ বেদনা একাকিত্ব ও সকল বন্ধন যেমন উপভোগ করেছি ,তেমনি পেশাগত জীবনে ঝুট-ঝামেলা যাই থাক সেখানেও নিজের মতো সুখি হওয়ার চেষ্টা করেছি।
সুখের অন্বেষণ করতে করতে খবরের ফেরিওয়ালা হয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে এই সত্যই জেনেছি, জন্ম তারিখ ফিরে আসা মানেই কবরের দূরত্ব কমে আসার বার্তা আহরণ করা ছাড়া কিছু নয়।
আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা আর সকল স্বজনের কাছে মিনতি, আমি যেনো লেখার শক্তি নিয়ে বুকভরা সাহস ও স্বাধীনচেতা চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে দীর্ঘজীবি হই। লোভ যদি কিছুতে থাকে সেই নির্মম সত্য হচ্ছে সুস্থভাবে স্বাধীনভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার লোভ। ৫৪ কে বিদায় জানানোর মুহুর্তে কতো মুখ কতো স্মৃতি তাড়া করছে আমায় !আমি কাকে রেখে কারকথা বলি, কোনটা রেখে কোনটা তুলে আনি!সবাইকে অভিনন্দন!
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com