মো. মামুন অর রশিদ
ভাবনা থেকে কর্মের সূচনা। ভাবনা যত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত হবে, কর্ম ততই নিখুঁত হবে। প্রত্যেকটি সৃষ্টি একেকটি ভাবনার পরিশীলিত রূপ। পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে মানুষের ভাবনার জগতেও প্রয়োজন নতুনত্বের ছোঁয়া। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে একজন স্মার্ট নাগরিকের ভাবনা হবে সৃজনশীল, প্রযুক্তিকেন্দ্রিক, যুগোপযুগী ও বাস্তবায়নযোগ্য। যাকে স্মার্ট ভাবনা হিসাবেও অভিহিত করা যায়।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বর্তমান সময়ের বহুলব্যবহৃত ও আলোচিত একটি বিষয়। স্মার্ট বাংলাদেশ একটি রূপকল্প, যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত আগামীর বাংলাদেশ। ২০২২ সালের ১২ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই বলিষ্ঠ ঘোষণার আলোকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কার্যক্রম। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রভাবশালী নিয়ামক তথা মূল স্তম্ভ হলো স্মার্ট নাগরিক। এই স্মার্ট নাগরিকের মাধ্যমেই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ।
আধুনিক ও অগ্রসর চিন্তাশীল মননের যে ব্যক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মনস্কতা ধারণ করেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করেন— তিনিই স্মার্ট নাগরিক। একজন স্মার্ট নাগরিকের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। স্মার্ট নাগরিক হবেন দেশপ্রেমিক, বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, পরিশ্রমী, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল এবং সমস্যা সমাধানের মানসিকতাসম্পন্ন।
পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য সঠিক পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। একজন স্মার্ট নাগরিকের ভাবনা স্বল্পমেয়াদি না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদন-ব্যবস্থা ও জীবনধারণের পদ্ধতি পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের কায়িক পরিশ্রম কমছে এবং মানুষ অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভর হয়ে যাচ্ছেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী কর্ম হারাবে। আধুনিক প্রযুক্তি এসব কাজ দখল করবে। ধারণা করা হচ্ছে— পোশাক খাতে ৬০ শতাংশ, আসবাবপত্র খাতে ৫৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ৪০ শতাংশ, চামড়া ও জুতা শিল্পে ৩৫ শতাংশ এবং সেবা খাতে ২০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ কাজহীন হয়ে পড়বে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই চ্যালেঞ্জকে ভাবনায় নিয়ে একজন স্মার্ট নাগরিককে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সরকারি চাকরির প্রতি এক ধরনের মোহ রয়েছে। অনেকে চাকরিতে প্রবেশের শেষ দিন পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সংগ্রাম চালিয়ে যান। আবার কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনৈতিক পথের সন্ধান করেন। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করা দোষের কিছু নয়। সরকারি চাকরিতে পদের সংখ্যা সীমিত। তাই শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বিকল্প বৈধ পন্থায় অর্থ আয়ের চিন্তা করতে হবে। বর্তমান সময় ফিল্যান্সিং করেও অনেকে ভালো আয় করছেন। দেশে বর্তমান ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা সাড়ে ছয় লক্ষের অধিক। একজন দক্ষ ফ্রিল্যান্সারের আয় বাংলাদেশের যে-কোনো সরকারি চাকরিজীবীর চেয়ে অনেক বেশি। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের অনলাইনভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং পেশায় সংযুক্ত হওয়ার বিষয় ভাবনায় রাখতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং ছাড়াও অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন সেক্টরে অর্থ উপার্জনের বিষয়ও মাথায় রাখা প্রয়োজন।
বর্তমান জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক সরকারি সেবা স্মার্ট পদ্ধতিতে দেওয়া হচ্ছে। একজন নাগরিককে অনলাইনে স্মার্ট পদ্ধতিতে সেবা গ্রহণের মানসিকতা অর্জন করতে হবে। স্মার্ট সেবা গ্রহণ করতে হলে একজন নাগরিককে অবশ্যই ডিজিটাল সাক্ষর হতে হবে। সরকারি স্মার্ট সেবা গ্রহণ ও অনলাইন যোগাযোগে স্মার্ট ফোন ও কম্পিউটার ব্যবহার করার সক্ষমতাই হচ্ছে ডিজিটাল সাক্ষরতা। দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী অনলাইনভিত্তিক সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির শরণাপন্ন হন। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হলে দেশের প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জন করতে হবে।
একজন স্মার্ট নাগরিকের ভাবনায় থাকবে ‘আমি নিজেই সমাধান’। যিনি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এবং নিজের কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করতে পারেন— তিনিই স্মার্ট নাগরিক। নিজের সমস্যা নিজে সমাধানের জন্য একজন নাগরিককে ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনের পাশাপাশি তথ্য সাক্ষরতা অর্জন করতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে বের করার যোগ্যতা, তথ্যের সঠিকতা যাচাই এবং তথ্যকে কাজে লাগানোর সক্ষমতাই হচ্ছে তথ্য সাক্ষরতা। তথ্য সাক্ষর একজন নাগরিক কখনো গুজবে কান দেবেন না। কারণ, তিনি জানেন কোনটি গুজব, কোনটি তথ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন গুজবে অনেকেই প্রভাবিত হচ্ছেন। শিক্ষিত মানুষও গুজবে কান দিচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পাদনাহীন মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা দেখছি, সবই সঠিক— এই মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। একজন স্মার্ট নাগরিক সেই তথ্যকে বিশ্বাস করবেন, যার সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র আছে। রাষ্ট্রীয় ও মূলধারার গণমাধ্যম এবং কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির তথ্য ছাড়া অন্য কোনো ভিত্তিহীন তথ্যের উপর আস্থা রাখা সমীচীন নয়।
একজন স্মার্ট নাগরিকের ভাবনায় থাকবে উদ্ভাবনী উদ্যোগ। এই উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা ও কাজকে সহজ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যাবসায়িক ও পারিবারিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ভাবনার সফল প্রয়োগ করা সম্ভব হলে একদিকে সেবা সহজ হবে, অন্যদিকে অর্থ সাশ্রয় হবে। যা দেশকে সমৃদ্ধ করবে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে একজন স্মার্ট নাগরিককে সাইবার নিরাপত্তার বিষয় আবশ্যিকভাবে মাথায় রাখতে হবে। যে প্রযুক্তি আপনাকে স্মার্ট করে তুলবে, সেই প্রযুক্তি আপনার ক্ষতির কারণও হতে হবে। এজন্য সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় ভাবনায় রাখতে হবে। প্রথমত, কোনো ব্যক্তিগত তথ্য নেটওয়ার্ক-সংযুক্ত যন্ত্রে রাখা যাবে না। দ্বিতীয়ত, পাসওয়ার্ড ব্রাউজারে অটোসেভ করে রাখা যাবে না। তৃতীয়ত, কম্পিউটারে অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করতে হবে। চতুর্থত, কোনো ক্র্যাক ভার্সন ব্যবহার করা যাবে না। পঞ্চমত, কোনো ধরনের বিজ্ঞাপনে ক্লিক করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, শুধু ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড আপনাকে সাইবারজগতে নিরাপদ রাখতে পারবে না। সাইবারজগতে কিছু করার আগে একটু থামুন, চিন্তা করুন, এরপর আপনি কোনো সাইটে প্রবেশ করবেন কিনা— সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।
পারিবারিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার ক্ষেত্রেও একজন স্মার্ট নাগরিকের ভাবনার জগতে ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়া উচিত। এখনো অনেক শিক্ষিত অভিভাবক সরকারি চাকরিজীবী পাত্র ছাড়া মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না। এই চিন্তা থেকে বের হওয়ার সময় এসেছে। এখন অনেকে বেসরকারি চাকরি কিংবা অনলাইনভিত্তিক কাজ করে বৈধ পথে অনেক টাকা আয় করছেন। যাঁরা বৈধভাবে টাকা আয় করছেন, তাঁদের সম্মান করতে হবে। বিয়ের পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিকে প্রধান ও একমাত্র শর্ত বিবেচনা না করে পাত্রের আর্থিক, পারিবারিক ও চারিত্রিক বিষয় বিবেচনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
কাউকে পিছনে ফেলে নয়, বরং সবাইকে নিয়েই স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের মূল কারিগর হচ্ছে স্মার্ট নাগরিক। এই স্মার্ট নাগরিকের স্মার্ট ভাবনায় থাকবে সৃজনশীলতা ও বুদ্ধির ছোঁয়া। আমার বিশ্বাস, নাগরিকের স্মার্ট ভাবনার বহুমুখী প্রয়োগ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করবে। (পিআইডি ফিচার)
লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা এবং সিনিয়র তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com