২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০১৮
ম ইনামুল হক
বাংলাদেশের হাওর, বাওড়, এবং বিলগুলি একসময় মাছে পরিপূর্ণ ছিলো এবং জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর সমাহারে এইসব স্থানে এক বিশেষ প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বিরাজ করতো। কিন্তু এগুলিকে ক্রমশঃ নিষ্কাশিত করে চাষযোগ্য করা হয়েছে, এবং আগাম বন্যায় ফসল যাতে না ডুবতে পারে সেজন্যে চারপাশে বাঁধ দিয়ে ঘেরা হয়েছে (পোল্ডার)। এই ব্যবস্থা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে, মাছ পাখী এবং জলজ জীব তাদের বাসস্থান হারিয়েছে। এই ব্যবস্থা অনেক দুষ্প্রাপ্য পাখী, মাছ ও জলজ প্রাণীর বংশ ধ্বংস করেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ এর ৪.৯ ধারায় হাওর ও জলাভূমিগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের রামসার, ইরান এর জলজপাখী বিষয়ক ঐকমত্য এবং ১৯৯২ সালের রিও, ব্রাজিল এর জীববৈচিত্র বিষয়ক ঐকমত্য এর প্রতি সম্মতি দিয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ও নিবেদন প্রকাশ করেছে। জাতীয় পানি নীতির ৪.১৩ ধারায় হাওর, বাওড় এবং বিলগুলির গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, এবং এগুলি সংরক্ষণের জন্যে সরকারের নীতি বিবৃত করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ এর ২০ ধারায় ভূপরিস্থ জল স্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। এই আইনের ২২ নং ধারায় অতিথি পাখিদের নিরাপদ অবস্থানের জন্য জলাধার সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে ও ২৬ ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারকে কোনমতেই নিঃশেষ করতে না বলা হয়েছে। কিন্তু এইসকল নীতি ও আইনের প্রয়োগ হতে জনসেবক ও জনপ্রতিনিধিদের দুর্বলতা ও অনীহা লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে ‘জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি’ প্রণয়ন করে। এই নীতিমালার ২ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘জলমহাল এমন জলাশয়কে বুঝাবে যেখানে বছরের একটি সময় বা সারা বছর জলমগ্ন থাকে এবং যা হাওর, বাওর, বিল, ঝিল, পুকুর, ডোবা, হ্রদ, দীঘি, খাল, নদী, সাগর ইত্যাদি নামে পরিচিত। এমন জলমহাল বদ্ধ বা উন্মুক্ত হতে পারে। বদ্ধ জলমহালের নির্দিষ্ট চতুঃসীমা থাকবে এবং উন্মুক্ত জলমহালের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট চতুঃসীমা থাকবে না।’ সরকারের এই ‘জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি’ আসলে দেশের জলাভূমিগুলির ভেতরে অবস্থিত ২০ একরের কম এবং ২০ একরের অধিক বদ্ধ জলমহালগুলি লীজ দেবার নীতি। কিন্তু এই নীতির অপব্যবহার করে হাওরসহ ‘খোলা জলমহাল’গুলি ‘বদ্ধ জলমহাল’ হিসেবে দেখিয়ে লীজ দেয়ার অবৈধ প্রক্রিয়া চলছে। ‘জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি ২০০৯’ এর ২৯ ধারায় জলাশয়সমূহে অভয়াশ্রম করার কথা আছে ও ‘মা’ মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা বলা আছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত একটি করে এইরকম অভয়াশ্রম তৈরী করা দরকার। এইরকম স্থান পাওয়া কঠিন নয়, কারণ সুদূর অতীত থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রতিটি ইউনিয়নেই এক বা একাধিক বিলের ভেতরে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে খাস জমি নির্দিষ্ট করে গেছেন। ২৯ ধারায় মৎস্যজীবীদের টোকেন ফি দিয়ে লাইসেন্স দেবার কথাও বলা আছে। এই পদ্ধতি চালু করলে লীজ ব্যবস্থাপনার চাইতে অনেক বেশী রাজস্ব আদায় হবে।
২০১৭ সালের এপ্রিলের গোড়ায় হাওরে ঢলের বন্যা হয়েছে যা’ নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল ডুবিয়ে দিয়েছে। হাওরে প্রায় প্রতি বছরই বন্যার ঝুঁকি থাকছে। এই দুর্যোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আমরা একটি ইতিপূর্বে ৬ দফা করণীয় প্রস্তাব করেছি। ‘হাওরের পাশে বাংলাদেশ’ সাদিয়া জেরিন পিয়া সম্প্রতি হাওর পরিদর্শন করে লিখেছেন, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ সকালে দেখার হাওড়ে গিয়ে দেখা হলো কৃষক নুরুল হক ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে। কাবিখার অধীনে মোল্লাপাড়া ইউনিয়ন থেকে পাশ্ববর্তী ইউনিয়নে ডুবো সড়ক তৈরীর কাজে ব্যস্ত তাঁরা। ৬ সন্তানের জনক এবং ৯ জনের পরিবারের কর্তা জনাব নুরুল হকের সাথে কথা বলে জানলাম, গত মৌসুমে নিজের ও বর্গা নেয়া মোট ১৮ কেয়ার (বিঘা) জমিতে তিনি ফসল ফলিয়েছিলেন। কিন্তু চৈত্র-বৈশাখের প্রলংকরী পাহাড়ি ঢলের কারনে একমুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। সরকারি সাহায্য বলতে পেয়েছেন একবার ৩০ কেজি চাল এবং এবার ১০ কেজি বীজধান। সংসার কিভাবে চলে জিজ্ঞেস করাতে ম্লান হাসি হেসে জানালেন ২ ছেলে এবং নিজে মিলে এদিক-সেদিক দিনমজুরী করে যা পান দা দিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে কোনরকম দিন কেটে যাচ্ছে।
এবার কত পরিমান জমি চাষ করছেন জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ১৪ কেয়ার জমি চাষ করছেন। ১০ কেজি বীজে হবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে আমার অজ্ঞতা দেখে হাসলেন। বললেন, মহাজন থেকে মাসিক ১০% সুদে ঋণ নিয়ে ৬ বস্তা বীজ ধান কিনেছেন, ৫ বস্তা ৫০০/= টাকা হারে এবং ১ বস্তা ৬০০/= টাকা দিয়ে মোট ৬ বস্তা বীজ কিনেছেন। কিন্তু হাওড়ের পানি সময় মত না সরাতে সময়ানুযায়ী বীজতলা তৈরী করতে পারেননি। তাই আগামী ফসল নিয়ে শুরু থেকেই আশংকায় মৌসুম শুরু করছেন। কারন এখন যে ধান লাগাচ্ছেন তা পাকতে পাকতে প্রায় বৈশাখের শেষ লাগবে। এদিকে ফসল-রক্ষা বাঁধের কাজও সময়ানুযায়ী শুরু করা যায়নি। এখন একমাত্র উপরওয়ালাই ভরসা। – তাঁদের এই ভরসার উপর উপরওয়ালার কৃপা বর্ষিত হোক। আর মনুষ্য সমাজ গঠিত রাষ্ট্রীয় সরকারের কাছে আমাদের দাবি, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করে এই আদম সন্তানদেরকে প্রকৃতি ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা করুন।
সাদিয়া জেরিন পিয়ার প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট হয় না যে, নুরুল হক মহাজন থেকে মাসিক ১০% সুদে ঋণ নিয়ে যে ৬ বস্তা বীজ ধান কিনেছেন, সেগুলি কোন জাতের ধানের বীজ? তবে বলা হয়েছে যে সেগুলি বৈশাখের শেষ নাগাদ পাকবে। তাহলে কৃষি দপ্তর কোথায়? ২০১৭ সালের এপ্রিলের গোড়ায় অর্থাৎ চৈত্রের শেষে বন্যা আসে যা’ নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল ডুবিয়ে দিয়েছে। তাহলে নুরুল হক সহ সারা দেশের হাওরে ও বিলে যারা এখন ধানের বীজতলা করছেন এবারও তাঁদের ধানে বন্যার ঝুঁকি থাকছে। হাওরগুলির বাঁধ যথাসময়ে নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ না করা ও দুর্নীতি এর পেছনে একটা বড় কারণ বটে। তবে এর সাথে হাওরে রোপনযোগ্য ধান যথাসময়ে চাষ না করে অধিক উচ্চ ফলনশীল দীর্ঘ জীবনের ধান লাগানো এবং হাওরের মুক্ত জলামহালগুলিকে বদ্ধ জলমহাল দেখিয়ে লীজ দেয়াও কম বড় কারণ নয়। তাই হাওরের এই দুর্যোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আমরা ‘হাওর/ জলাভূমি পঞ্জিকা’ গ্রহণসহ ৬ দফা করণীয় বিষয়ে অবহিত করছি।
১। সারা দেশে খোলা জলমহাল যথা নদী, খাল, বিল, হাওর ‘বদ্ধ জলমহাল’ দেখিয়ে লীজ দেয়া বন্ধ করতে হবে। জলমহাল নীতির ২৯ ধারা মোতাবেক জেলেদেরকে ‘টোকেন ফি’ নিয়ে মাছ ধরার সুযোগ দিতে হবে। দায়িত্ব জেলা রাজস্ব দপ্তর।
২। প্রত্যেক জলাভূমির মাঝে নির্দিষ্ট খাস জমিতে মাছেদের মা’ বাবাদের থাকার ‘অভয়াশ্রম’ তৈরি করতে হবে। জলাভূমিকে অতি নিষ্কাশন করে সম্পূর্ণ এলাকা ধান চাষের আওতায় আনা যাবে না। দায়িত্ব মৎস মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
৩। হাওর ও বিলে ১৬০ দিন জীবনকালের বিআর ২৯ বা ঐ জাতীয় ধান, ১৪০ দিন জীবনকালের উফশী ধান ও স্থানীয় জাতের ধান কোন হাওরে কবে থেকে কি পরিমাণ আছে তা জরীপ করা এখনই প্রয়োজন। দায়িত্ব কৃষি ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়।
৪। হাওর অঞ্চলের বাঁধকে ফাল্গুন মাসের মধ্যে মেরামত করে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত বন্যা মোকাবিলা করতে হবে। ১ বৈশাখ খালের মুখ কেটে মাছেদের প্রজননের জন্য হাওরে পানি প্রবেশ করতে দিতে হবে। দায়িত্ব পানি সম্পদ ও মৎস মন্ত্রণালয়।
৫। মাঠ পর্যায়ে এনজিও সংস্থাগুলি যাতে দেরীতে লাগানো বা বন্যার ঝুঁকিগ্রস্ত ধানের বিগরীতে ঋণ দিয়ে চাষীদেরকে বিপদে ফেলতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, কৃষি ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়।
৬। মেঘালয় ও ত্রিপুরা থেকে আসা নদীর পানি নিয়মিত পরীক্ষা করে খনির বর্জ্য মাছ ও অন্য জীবের কি ক্ষতি করছে তা’ নিরুপন করতে হবে ও প্রতিকারের জন্য ভারতকে জানাতে হবে। দায়িত্ব মৎস, পানি সম্পদ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com