অদন্ত হয় , কিন্তু আলোর মুখ দেখে না : ডঃ সাদেকা হালিম

প্রকাশিত: ১০:৪৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৬, ২০২৩

অদন্ত হয় , কিন্তু আলোর মুখ দেখে না : ডঃ সাদেকা হালিম

অধ্যাপক ডঃ সাদেকা হালিম একজন সমাজ বিজ্ঞানী । তাঁর বাবা ফজলুল হালিম চৌধুরী ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামে ।

সাদেকা হালিম ঢাকার উদয়ন বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান সাদেকা হালিম। পরবর্তীতে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি কমনওয়েলথ স্টাফ ফেলোশিপ নিয়ে পোস্ট-ডক্টরেট সম্পন্ন করেন যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে। ২০০৯ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য কমিশনে প্রথম নারী তথ্য কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি তিন মেয়াদে শিক্ষক সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ও তিনবার সিনেট সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক সাদেকা হালিম জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি-২০০৯ এর ১৮ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের কমিটিতে সদস্য ছিলেন। পেশাগত জীবনে সাদেকা হালিম অতিথি অধ্যাপক হিসেবে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার বকু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজ বিভাগ ও আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হায়ার এডুকেশন লিংক প্রোগ্রামের অধীনে কুইন্স-এর ভিজিটিং ফেলো ছিলেন সাদেকা হালিম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার লেখা প্রায় ৫০টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লিঙ্গ-সমতা, বন ও ভূমি, উন্নয়ন, আদিবাসী ইস্যু, মানবাধিকার এবং তথ্য অধিকার প্রভৃতি তার গবেষণার বিষয়।[ ২০২২ সালের কাউন্সিলে তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য করা হয়। সম্প্রতি তিনি আওয়ামীলীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির কো চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছেন । তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন রেডটাইমসের প্রধান সম্পাদক সৌমিত্র দেব

 

সৌমিত্র দেব : আপনি তো শিক্ষকতা পেশায় আছেন অনেক দিন ,তথ্য কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন নতুন একটা দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগে কো-চেয়ারম্যান হিসাবে  ।  আপনি কিভাবে এই কাজটা করতে চান বা আপনার পরিকল্পনা কি এই কাজটি নিয়ে?

 

ডঃ সাদেকা হালিম : প্রচার আর প্রকাশনার বিষয়ক যে উপ কমিটি , সেটাতে তো আমি কেবল কো চেয়ারম্যান হিসাবে রয়েছি । আমি চেয়ারম্যান নই। আমি কো চেয়ারম্যান। তো আমি কিভাবে করবো সেটা একক ভাবে বলতে পারি না । উচিতও নয়। কেননা, এটা সামষ্টিক কাজ হবে এবং এই কমিটিতে বিভিন্ন জন সদস্য হবে। তারপর আমাদের যে মিশন-ভিশন, এই রাজনৈতিক দলটির, সেটাকে বিষয়বস্তু রেখে আমরা আশা করছি যে ভবিষ্যতে কাজটি করবো।

 

সৌমিত্র দেব :  আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন অনেকটা এগিয়ে গেছে । আমরা বোধহয়, রাষ্ট্রপতি হিসাবে একজন নারীকে পাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী তো আছেনই, সংসদে উপনেতা আছেন এবং আপনি বাংলাদেশে প্রথম নারী তথ্য কমিশনার ছিলেন। সে হিসাবে আপনার মূল্যায়নটা কি? বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন এখন কোন পর্যায়ে আছে এবং এটা আপনি কিভাবে দেখছেন?

 

ডঃ সাদেকা হালিম : প্রথমত যে, আপনার মুখ থেকে আমি শুনলাম যে একজন নারী রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন। এটা আসলে এখনও অফিসিয়ালি কোনও কিছু হয়নি। আমি এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। যিনি রাষ্ট্রপতি হবেন তাঁকেই আমরা স্বাগত জানাবো। আর নারী ক্ষমতায়নের ব্যাপারটা আমি এইভাবে দেখি যে, অবশ্যই নারী ক্ষমতায়নের ভিত্তিটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৈরি করে দিয়ে গেছেন এবং সে সময়কার যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল, সে সময় কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নারীদের উন্নয়ন কিভাবে হতে পারে সে বিষয়ে তিনি একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেভাবে কাজও হয়েছে। সে সময় প্রাথমিকভাবে কাজগুলো সরকারি পর্যায়ে হয়েছিল, একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নারীরা কিভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন, তাঁদের কর্মসংস্থান এবং সবচেয়ে বড় বিষয়টা যা বঙ্গবন্ধু দেখেছেন যে যুদ্ধের সময় আমাদের যে মা-বোনেদের সম্মানহানি করা হয়েছিল, এবং আমরা জানি প্রায় দুই লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তাদেরকে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা সবসময় দেখি যে পৃথিবীর সব যুদ্ধে নারীরাই কিন্তু আক্রমনের শিকার হয়। সেখান থেকে বাংলাদেশও ব্যাতিক্রম ছিল না । একটা জায়গায় ব্যাতিক্রম, সেটা হচ্ছে, আমি অনেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়েছি এবং আমি কোনো দেশে এমন উদাহরণ পাই নি, যেভাবে এসব নারীদেরকে বঙ্গবন্ধু নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন আর তাঁদেরকে তিনি বীরাঙ্গনা বলেছেন। বীরাঙ্গনা বলার জন্য কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। বীরাঙ্গনা কেন বলেছেন? বীরাঙ্গনা বলে সহজ করে পরিচয় চিহ্নিত করার ব্যবস্থা হয়ে গেল। বীরাঙ্গনা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন- বীর নারী। বঙ্গবন্ধু তো বেশীদিন বাঁচেননি, তাকে যে নির্মম ভাবে হত্যার করা হয় ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট, সে কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁর অনেক স্বপ্নই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কিন্তু ওই সময়টায় যাঁদেরকে তিনি বীরাঙ্গনা বলছেন, তাঁদেরকে ভাতা দেওয়া ব্যবস্থা করা, পূর্নবাসন করা, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং অনেককে তিনি বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । তাঁদের অনেকের সন্তান জন্ম নিয়েছে, সে সময় যাদেরকে আমরা যুদ্ধশিশু বলেছি। অনেকে বলেছিল যে তাদের তো কোনো পিতার নাম নেই। তাকে যদি বিয়ে দিতে হয় সেখানে কার নাম লিখবে, বাবার নাম কি হবে? সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ঠিকানা হবে ৩২ নাম্বার, আর পিতার নাম হবে আমার নাম। এই যে মহানুভবতা, এটা কিন্তু আপনি যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করেন, এই রকম মহানুভবতা দেখা যায় না। অর্থাৎ, নারীর সম্মান, অধিকারকে তিনি সম্মান দেখিয়েছেন। তিনি বলছিলেন যে, আমরা যুদ্ধ করেছি, শহীদ হয়েছি। কিন্তু যে নারীকে তার মাতৃত্ব, সতীত্বকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, সে নারীদের তিনি বীরাঙ্গনা বলেছেন। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের সূচনা, বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে সূচনাটা যেদিন থেকে । কিন্তু খুবই দুঃখজনকভাবে আমরা জানি, তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় এবং তার অসম্পূর্ণ যে স্বপ্নগুলো সেগুলো আমি মনে করি ৯৬ এ যখন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি কিন্তু প্রথম বাংলাদেশে জাতীয় নারী নীতি প্রণয়ন করেন ৯৭ এ। এই নীতিতে প্রথম বলা হয়েছিল, নারীরা সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করতে পারবে। আগে কিন্তু ছিল না। যদিও, সেটা সংরক্ষিত আসন অর্থাৎ, একজন নারী আরেকজন নারীর বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা যে সংরক্ষিত করা এবং নির্বাচন করা, এটা তো বিরাট ব্যাপার ছিল। পলিটিকাল পার্টিসিপেশনে আমরা দেখি। কিন্তু নির্বাচন করা, রাতদুপুরে ঘুরে বেড়ানো, ক্যাম্পিং করা। পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নারীদের প্রবেশ করানো- এটা কিন্তু তিনি প্রথম করেছেন। এবং আরেকটা জিনিস করেছিলেন , ৯৭ সালের নারী নীতিতে, উত্তরাধিকার প্রশ্নে, নারীরা সমান পাবে। এবং সমঅধিকার না, সমানাধিকার। আমাদের যে সংবিধানে আছে, all and equal be for law. এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই সমান আইনের দৃষ্টিতে এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এবং সবকিছুতে আমরা অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিকার রাখি। অর্থাৎ, সংবিধান যে স্বীকৃতি দিয়েছে এটা তো বঙ্গবন্ধু করেছেন। অর্থাৎ, সংবিধান রচনার তো সে সময় হলো ৭২ এ। সেখানে যে চারটি স্তম্ভ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে , অনেকে এটা ভুল ব্যবহার করে, ভুল ব্যাখাই জানে অনেকে । সেজন্য তারা বাংলাদেশের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাকে যারা পছন্দ করেননি তাঁরাই এটাকে বিভ্রান্তির জায়গায় নিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু কোনোদিনও বলেনি, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মহীন বা ধর্মান্ধ। তিনি বলেছেন, আমরা সবাই ধর্মভীরু। তিনি নিজে একজন আপাদমস্তক ধর্মভীরু মানুষ ছিলেন। আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একজন অসম্ভব ধার্মিক মানুষ। এই যে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি এবং সেখানে যখন দেখলাম যে তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করার পরে সেক্যুলারিজমকে সরিয়ে দেওয়া হলো, বলা হলো যে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবে। এবং বিসমিল্লাহ রহমানির রহিম- এটাও এলো সংবিধানে। যার ফলে অন্য ধর্মালম্বী মানুষজন আছেন তাদের জন্য বলছি যে, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সেখানে তাঁরা কিন্তু একটা বিভ্রান্তকর পরিস্থিতিতে চলে গেলেন। এখন বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পরে ৯৬ তে আওয়ামী লীগ প্রথম আসে ক্ষমতায় আর প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

সৌমিত্র দেব:  নারীর ক্ষমতায়নের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা যোগাযোগ কি?

ডঃ সাদেকা হালিম : এটা আমি যেভাবে দেখি, ধর্মনিরপেক্ষতা এমন একটা বলয় সৃষ্টি করে বা আবহাওয়া সৃষ্টি করে সেখানে একটা প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটে। এবং নারীর উন্নয়ন টা কিন্তু সে রকম। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ হচ্ছে নারী। তাহলে এই ৪৮ শতাংশ নারীকে তো আমি ঘরে বসিয়ে রাখতে পারি না। তাঁদেরকে প্রোডাক্টিভ হতে হবে। তারা বাড়িতেও যে কাজটি করে সেটার একটি হিসাব নেওয়া উচিত। আমরা নিতে পারিনি । এখনো, সেটার জন্য একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দরকার। আবার যাঁরা বাইরে কাজ করছেন, তাঁরা তো কেউ বসে নেই। তাঁরা কাজ করছেন। অর্থনৈতিক চাকা ঘুরানোর জায়গায় নারীদের যে অবদান তার স্বীকৃতি কিন্তু দেওয়া উচিত। এবং তার জন্য একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা। তাকে বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যে শিকার হলে হবে না। সে যদি চাকরি, মজুরি, তার পরিবেশ, যৌন হয়রানি বা তার সিটিজেনশীপ এইসব দিকে তাকে সমানাধিকার দিতে হবে। যে কারণে দেখা যাচ্ছে যে উত্তরাধিকার জায়গাটা যেটা খুব প্রগ্রেসিভ একটা চিন্তাভাবনা ছিল। ইসলামিক দেশগুলোতে ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, সুদান, কাতার সহ এইসব দেশে কিন্তু উত্তরাধিকার জায়গাটা পরিষ্কার। আমরা হতে পারিনি। যখন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ এ আসতে পারলো না। তখন কিন্তু ২০০৪ সালে গোপনে নারী নীতি পরিবর্তন হয় এবং এটাই বাদ দেওয়া হলো । উত্তরাধিকার জায়গায় নারীরা সমান পাবে না। পরবর্তীতে নতুন ভাবে নারী নীতি তৈরি করার পরেও কিন্তু আমরা ওই জায়গাতে ফেরত আসতে পারলাম না। এটা একটা সমস্যা। আমরা আশা করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সাহসী এবং তাঁর দ্বারা সম্ভব। কারণ, তিনি ছাড়া কিন্তু এইধরনের যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না। আজকে দেখেন , অভিভাবকের জায়গায় মায়ের নাম দিতে হবে এটা হাইকোর্টে রুল জারি করা হয়েছে। সিটিজেনশীপের জায়গায় একজন পুরুষ বিদেশি মহিলা বিয়া করলে তার সন্তানের জন্য নাগরিকত্ব পেত। একজন নারী বিদেশি বিয়ে করে পাচ্ছিল না। এখন কিন্তু সেটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এবং এই যে পরিবর্তনগুলো এইগুলো খুবই সূক্ষ্ম চোখে দেখা যায় না। দিনে দিনে কিন্তু এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে । আমি মনে করি, বাংলাদেশে নারীরা পাবে, পুরুষ পাচ্ছেন, সমাজ পাচ্ছেন, রাষ্ট্র পাচ্ছেন। তো ক্ষমতায়ন জায়গাটা খুবই একটা বিমূর্ত বিষয়। কেউ মনে করছে যে আমি অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী আমার ক্ষমতায়ন হয়ে গেছে, কেউ ভাবছেন সামাজিক ভাবে পেয়েছি। আমি মনে করি সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে, এটাই সমান অধিকার।

 

সৌমিত্র দেব:  সমঅধিকার আর সমানাধিকারের মধ্যে পার্থক্যটা কি? আপনি বলেছিলেন যে দুটো এক জিনিস না।

ডঃ সাদেকা হালিম : সমানাধিকারটা হচ্ছে সমান। ধরেন আমিও চাকরি করি, আপনিও চাকরি করেন। নারী পুরুষ দুইজনই। সেখানে দুইজনই সমান মজুরি পাবেন। মজুরিতে কোনো বৈষম্য হবে না। আর সমঅধিকার হচ্ছে অধিকার প্রতিষ্ঠা করাটা। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে কিন্তু সমান অধিকার নেই। এই যে সমাজে দেওয়া হয় না, খ্রিস্টানদের দেওয়া হয় না, ইসলামের, সেকেন্ড হাফ হাফ ব্রাদার গেটস ওই জায়গাটায় আমি তো সমান হলাম না। হলাম? যে আমি অধিকার পেতাম আবার অনেক সময় সেটাও ভাইরা দেয় না বা বাবারা দেয় না। বিয়ের সময় তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছি, লেখাপড়া করাচ্ছি, তোমাকে মানুষ করাচ্ছি, তোমার জামাইয়ের সাথে সমস্যা হলে বাড়িতে ফেরত আসতে হতে পারে একটা ইন্সুরেন্স হিসাবে রেখে দেওয়া হয়। হিন্দু সমাজে তো সেটা আরো ভয়াবহ।

প্রসৌমিত্র দেব:  আপনি শুধু সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক নন, একজন সমাজবিজ্ঞানী। এবং সমাজ উন্নয়ননে আপনি অনেক কাজ করেন। তো এখন আমাদের সামাজিক যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়। আমি জানি অনেক জায়গায় আপনি নিজেও যান সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে । এই সম্প্রীতি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ কি হতে পারে ?

ডঃ সাদেকা হালিম : দেখুন, আমি মনে করি যে বাংলাদেশে এতো সুন্দর একটা সংবিধান দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । কিন্তু আমরা সেই সংবিধানকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি। এবং সে চারটি স্তম্ভকে অনুসরণ করে কতটুকু আসলে আমরা দেশকে গাইড করতে পারছি? সেক্যুলারিজম বঙ্গবন্ধু হত্যা করার সাথে সাথে বাদ দিয়েছে। হপরবর্তীতে পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ম নিরপেক্ষতা কে ফেরানো রয়েছে। কিন্তু আমি কাগজে কলমে ফেরাতে পারি, মাঠে ময়দানে ফেরানো, মানুষের মনো-জগতে ফেরানো এটা বড়ই কঠিন কাজ।

 

সৌমিত্র দেব : এটা তো পুরোপুরি ফেরে নি । আমি যতদূর জানি, সংবিধানে দুটোই আছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে আবার রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামও আছে।

ডঃ সাদেকা হালিম : দুটোই আছে। অবশ্যই দুইটাই আছে। আমি তো এটাই বলছি। ওইটা থেকে তো আমি সরতে পারিনি। এখন যা দাড়িয়েছে যে একটা বড় সময় চলে গেছে, আমরা যেটা মনে করি যে যুদ্ধে স্বাধীনতার পরপরই সব কিছুর মীমাংসা হয়ে গেছে- আমি সেটা মনে করি না। যদি ৩০ শতাংশ লোক বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে তারা আছে, তাদের বংশধরেরা তো আছে। যুদ্ধাপরাধীর ছেলেমেয়েরা আছে, আল-বদর, আল-শামসের ছেলেমেয়েরা আছে রাজাকারদের বংশধরেরা আছে, সবাই আছে, সবাই মিলে বাংলাদেশ। এখন বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম চিন্তা করছে এবং সেখানে এই যে একটা ভ্যাকিউম, জাতির পিতা মারা যাওয়ার পর হয়ছে, ভীষণ বড় একটা সময় যে সামরিক শাসনের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ গেছে, এবং কোনো রকম কোন রাজনৈতিক সরকার সেখানে ছিল না। সেটা আসতে অনেক সময় নিয়েছে। সে সময়টায় কিন্তু আমাদের অনেক কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে, স্কুলের পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের গানবাজনা পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের জীবনে আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের পোশাকও পরিবর্তন হয়েছে। এখন যদি আমি মনে করি, বাংলাদেশে.. আমি বিশ্বাস করি এবং আমি জানি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানে অসম্প্রদায়িক। কিন্তু কিছু ক্ষমতাসীন লোক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য অনেক সময় কিন্তু এটাকে ইস্যু করে। এখন আমরা এমন একটা যুগের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমটা হচ্ছে বড় প্ল্যাটফর্ম। এখন তো মাঠে ময়দানে আন্দোলন হয় না। সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করে। এখন বলা হচ্ছে যে, এটা ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশ। সবাই আমরা মুসলিম, সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখন যদি একজন অন্য ধর্মের মানুষের নাম দিয়ে বলা হয় যে সে কোরান অবমাননা করছে। পবিত্র কোরান শরীফকে পূজা মন্ডপে রেখে আসছে । এগুলো তদন্ত করতে হবে। এবং আমরা দেখি তদন্ত কমিটি গঠন হয় কিন্তু কোনো ফলাফল আসে না। রাইট? এটাও একটা বিষয়। যতগুলি ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোকে আমরা বলছি যে সব জায়গায় ঘটনাগুলো ঘটেছে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে টেনশন তৈরি করার জন্য হয়েছে। কমিউনিটির সাথে কমিউনিটিকে ধ্বংস করার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এইযে এতো সব কমিটি হচ্ছে আমরা আলোর মুখ কিন্তু দেখছি না। আমরা দেখছি যে, যাকে দোষারোপ দিচ্ছে সেই আসলে ইনোসেন্ট। যারা এটাকে ইস্যু তৈরি করে ঘরবাড়ি দখল করছে, জমি দখল করছে, গয়নাগাটি লুট করছে, ঘরবাড়ি পোড়াচ্ছে তাদের কিছু হচ্ছে না। উল্টো ভিক্টিমদের আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ঠেলে দিচ্ছি তারা কিন্তু ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সব ক্ষেত্রে কিন্তু আমি বলবো না। আমার একটা বড় জায়গা হচ্ছে যে আমি এটাকে একটা একাডেমিক ইস্যু হিসেবে কাজ করি। আমি যখন পিএইচডি করে আসি তখন আমি ‘সোশিওলজি অ্যান্ড মাইনরিটি’ এই কোর্সটি পড়াই প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে। আমার এই কোর্সটি নিয়ে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়াচ্ছে। এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি কলেজে এটা কিন্তু যুক্ত করা হয়েছে। সেটা কিন্তু রুট লেভেল পর্যন্ত। অর্থাৎ আমি (আইডিওলজিকাল) লেভেলে একটা ফাইট করি । ঠিক ফাইট বলবো না সাবধানতা তৈরি করি। আমরা হিন্দু ধর্মটাকে দেখি , খ্রিস্টান ধর্ম দেখি, ইসলাম ধর্ম দেখি, বৌদ্ধ ধর্ম দেখি তাদের মধ্যে সম্পর্কটা কি রকম। আমি পড়াই । আমাদের আন্তধর্মীয় সম্পর্ক গুলো কেমন? কেমন ছিল দেশ বিভাগের আগে? দেশ বিভাগে কেন সংঘর্ষ হলো। তারপরে আমরা কি রকম আছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। তাই এইগুলো যে আমি করি, একটা খুবই ইন্টারেস্টিং । । আমি বিষয়গুলো নিয়ে অনেক গভীরে যাই। আমি দেখি যে কোনো এলাকায় আমার যাওয়া সম্ভব, আমি সেখানে যাই কথা বলি মানুষজনের সাথে। বোঝার চেষ্টা করি এবং আমি যখন মিডিয়াতে অনেক কথা বলি আমাকে অনেকে চিনেও। তাদের অনেককে লক্ষ্য করেছি যে তারা আস্থা নিয়ে কিন্তু আমার সাথে কথা বলে। কোনো সাংবাদিকও না বলবেন না। তো এইজন্য আমি মনের করি যে পলিসি মেকারদের নিতে হবে। ওই সমস্ত এলাকায় যেখানে আমার অন্য ধর্মলম্বী ভাইবোনরা বাস করে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টা দেখতে হবে । তারা যেন সহজে তাদের জীবন যাপন করতে পারে। তাদের যাপিত জীবনে যেন বিব্রত হতে না হয় এটা কিন্তু সে এলাকার মেম্বার অফ দা পার্লামেন্টের দেখা প্রয়োজন। অনেক সময় প্রশ্ন যে আসে তারা আওয়ামী লীগের ভোটার। সবসময় আওয়ামী লীগকে ভোট করবে এটা যদি আমরা ভাবি এটা তাদেরকে টেকেন ফোর গ্র‍্যান্টেড করে ফেলি। তাহলে এটা হয় যে তাদের সাথে অনেক কিছু করতে পারি, দিনের শেষে আমাকে ভোট দেবেই। এই জায়গাতে আমাদেরকে এলার্ট হতে হবে। ২০০১ সালে কি পরিমাণ অত্যাচার আমাদের দেশে বিশেষ করে হিন্দু কমিউনিটির উপর হয়েছে যে আট বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কেন হয়েছে? ওই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত ঘটনা যেন না ঘটে। কারণ, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। তারা স্ব ইচ্ছা থেকেছে। তারা বংশ পরম্পরায় এখানে থাকেন। আমাদের মুসলিম ভাইরাও কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রে থাকেন। সে জন্য আমাদের বিষয়টা এইভাবে আমাদের দেখা প্রয়োজন। অনেক সময় বলা হয় যে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ যে দেশগুলোতে আমরা কম, সেখানে কি হচ্ছে? সে প্রশ্নটা তোলা যায়। তাদেরকে বলতে হবে আমাদের সম্পর্কে। আমরা কেনো সাম্প্রদায়িক হবো? অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা এটা পুরা গ্লোবালি, আমাদের নিতে হবে। এটা শুধু দেশ ভিত্তিক আলোচনা করলে চলবে না। আমরা বলি যে আমাদের বর্ডার আছে। পাসপোর্ট ভিসা লাগে। কিন্তু আমরা বর্ডার ছাড়া ছিলাম ৪৭ পর্যন্ত। তাই বর্ডার ছাড়া পরিস্থিতি থেকে আমরা বর্ডার সহ আসছি। আমরা বিরাট বেঙ্গলের ভিতর ছিলাম। পূর্ব বঙ্গ রয়েছে, পশ্চিম বঙ্গ রয়েছে, তারপর পূর্ব, পশ্চিম পাকিস্তান তারপর বাংলাদেশ। তাহলে এই ইতিহাসকে তো আমরা অকার্যকর করতে পারবো না। হ্যাঁ এখানে অনেক কনফ্লিক্ট ছিল মেজারমাইন্ড ছিল। কিন্তু এখন আমরাআধুনিক রাষ্ট্রে্র নাগরিক। সেখানে কাউকে সাম্প্রদায়িক হতে বলা হয়নি, এবং আমাদের সংবিধান সেটা বলে না। আমরা যদি নিজেদের ধর্ম স্টাডি করি সেখানে কিন্তু সাম্প্রদায়িক হওয়ার কোনো ধরনের বিষয় নেই। কিন্তু আমি মনে করি ধর্মকে ভিত্তি করে রাজনীতিটা বন্ধ করা প্রয়োজন।

 

অনুলিখন : জুলিয়ান ডি কস্টা

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31