আখতারুজ্জামান ইলিয়াস :‘খোয়াবনামা’— জীবন ও সমাজচিত্র

প্রকাশিত: ১২:১৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২১

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস :‘খোয়াবনামা’— জীবন ও সমাজচিত্র

 

মোস্তফা মোহাম্মদ

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শিল্পসাধনার একটি বড় বিষয় হলো তিনি সাধারণ মানুষের জীবন এবং জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়াদিকে শিল্পের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যার জন্য তাঁকে একটি আলাদা গদ্যশৈলী নির্মাণ করতে হয়েছে। এই আলাদা গদ্যশৈলী নির্মাণ করতে গিয়েই তাঁকে হোঁচট খেতে হয়েছে একাধিকবার। রাতারাতি তাঁর ভাগ্যে জোটে নি কোনো খ্যাতি-জনপ্রিয়তা। প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ থেকেই তাঁর রচনাশৈলীর ভিন্ন সুর বেজে ওঠে, যা পাঠকের মস্তিষ্কে পৌঁছতে সময় লেগেছিল দীর্ঘদিন।
কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভারতের আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হবার পর বিবিসির সাংবাদিক সুবীর ভৌমিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলা উপন্যাসের সংকট প্রসঙ্গে বলেন :
বাংলা উপন্যাসের সংকট শুরু হয়েছিল তো আজ থেকে না, প্রায় উপন্যাস যখন প্রথম লিখিত হয় তখন থেকেই। কারণ আমরা দেখি সব দেশেই মানে যেখানে যখন উপন্যাস শুরু হয়েছে, ধরা যাক ইউরোপে সেখানে সবসময় দেখা যাচ্ছে যে, প্রচলিত যে মূল্যবোধ, প্রচলিত সংস্কার, প্রচলিত রাজ্য কিংবা রাষ্ট্রীয় ধারণা, রাষ্ট্রীয় দাপট এসবকে কিন্তু প্রতিবাদ করে, প্রতিহত করে, এসবের সমালোচনা করে, ব্যঙ্গ করেই কিন্তু উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাসের কিন্তু সবসময়ই ঔপনিবেশিকতা বিরোধী একটা চরিত্র ছিল। কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষায় এটা শুরু হয়েছিল যেমন ‘আলালের ঘরের দুলাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ এসব বইতে একেবারেই মানুষকে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেইটা কিন্তু যখন আমাদের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আমরা বলি, তিনি যখন লিখলেন তখন দেখা গেল পুরনো যে সকল কুসংস্কার, পুরনো যে সব ধর্মান্ধতা প্রভৃতিকে তিনি গৌরব দিতে চাইলেন। কুসংস্কারকে মনে করলেন একটা মূল্যবোধ, ধর্মান্ধতাকে অনেক সময় আদর্শ বলে মনে করেছেন। তার ফলে হয়েছে কী তিনি প্রতিবাদী না হয়ে বরং এখানকার মানুষের যেসব কুসংস্কার ছিল, মানুষের পশ্চাৎপদতা ছিল সেটাকে আরো সমর্থন করে, সেটাকে আরো প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন। এই যে বঙ্কিমচন্দ্রের আমল থেকে শুরু হলো এটা কোনো না কোনোভাবে আমাদের পরবর্তী লেখকদের কোনো না কোনোভাবে হলেও প্রভাবিত করেছে। তারপরে আমাদের এখানে যাকে আমরা বলি ব্যক্তি, যাকে বলি ব্যক্তিবাদ—রহফরারফঁধষরংস সেটা সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজরা আসার পর থেকেই, কিন্তু আমাদের যে ব্যক্তি সেটা ঔপনিবেশিক শাসনের কারণেই প্রথম থেকে পঙ্গু এবং খুব দুর্বল। আমরা রেনেসাঁর যে ব্যক্তি পাই— তারা যেমন শক্তসমর্থ বলীয়ান সেরকম কিছু না। এখন এই ব্যক্তির সর্বস্বতা আমাদের উপন্যাসকে পেয়ে বসেছে। যার ফলে ওই একজন ব্যক্তির দুঃখ, তার বেদনা, তার কষ্ট এগুলো বেশির ভাগই স্যাঁতসেঁতে এবং তরল। এগুলোই নানারকমভাবে ফেনিয়ে ফেনিয়ে আমাদের ঔপন্যাসিকরা আমাদের সামনে দিয়েছে— বেশিরভাগ ঔপনিবেশিকরা। এটাই আমার মনে হয় বড় সংকট।১
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শিল্পসাধনার পেছনে একটি বিদ্রোহী শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস তীব্রভাবে কাজ করেছে। এর পেছনে ছিল তাঁর অধীত বিদ্যার অহঙ্কার এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৃ-তাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক বিষয়ে বিশ্লেষণজ্ঞান। তাঁর এ-বিদ্রোহ ছিল শিল্পের, এ-বিদ্রোহ আঙ্গিকের, এ-বিদ্রোহ শৈলীর, গঠনের। বাংলা উপন্যাসকে একান্তই আমাদের মতো করে, আমাদেরই সমাজের কাটা খালে প্রবাহিত করে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টাই ছিল কথাশিল্পী ইলিয়াসের সাধনার মৌল বিষয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭— প্রায় একুশ বছরের মধ্যে তাঁর মোট আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ (১৯৭৬), ‘খোঁয়ারি’ (১৯৮২), ‘দুধভাতে উৎপাত’ (১৯৮৫), ‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৬), ‘দোজখের ওম’ (১৯৮৯), ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬), ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ (১৯৯৭), ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ (১৯৯৭)।
এই ক’টি গ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকেই ইলিয়াসের শিল্পীসত্তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘সময় এবং সমাজের সঙ্গে নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, বিশ্বাস হারিয়েছেন, নতুন বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন, পুরো সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ব্যবহারযোগ্য চমৎকার কাঠামো সন্ধান করেছেন, সেই সঙ্গে নতুন মূল্যবোধ, নতুন পৃথিবীর একটা ধারণাও অর্জন করেছেন’।২ তাঁর অর্জিত মূল্যবোধের বিনিময়ে তিনি প্রচলিত মূল্যবোধের উপর প্রচ- আঘাত করেছেন। যাকে বলা যায় ‘মূত্রত্যাগ করেছেন’। সামাজিক এ-বিষয়গুলো প্রথমে টের পাননি পাঠক-সমালোচকরা, মূলত ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’-এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় নি, হয়েছে অনেক পরে ধীরে ধীরে। বিশ্বাস ভেঙে যাবার পরে, চুরমার ভাঙচুরের পরে, কঠিন অন্বেষণের পরে, মানব সমাজ ও মানুষকে বীক্ষণের পরে, ইতিহাসের ধারায় চলতে চলতে, হারানো বিশ্বাস ফিরে পেতে পেতে— অন্য সব বই লিখতে লিখতে, মানুষের রক্তঝরা দেখতে দেখতে একটা দুঃসহ কঠিন পথে ইলিয়াস সমস্ত কাঠামো মাটিতে সমান করে দেবার পরে নতুন চোখে মানুষের দিকে চেয়ে কী বিশাল পুনর্নির্মাণের কাজ করতে নেমেছেন তা আমাদের আশ্চর্য করে।৩
আশ্চর্য হবারই কথা, কারণ প্রথম প্রথম সমালোচকরা তাঁকে ‘পুরনো ঢাকার লেখক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কেন পুরনো ঢাকার মানুষেরা কি মানুষ নয়? তারা কি সমাজবদ্ধ সুশৃঙ্খল মানবগোষ্ঠীর বিরাট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন? তাদের জীবনাচার, দুঃখ, কষ্ট, প্রেম-বিরহ, ক্ষুধা, কাম, ক্রোধ এগুলো কি লেখার উপাদান নয়? ‘পুরনো ঢাকার মানুষেরা কি লেখার বিষয় হতে পারে না? আসলে আপনাকে একটা গ-িতে বেঁধে ফেলার যে চেষ্টা একটু একটু লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে আপনি বাঁধা পড়ছেন না, পড়ছেন তাঁরাই, যাঁরা মানুষের সীমানা বাড়াতে পারে না’।৪
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৬) জন্ম বগুড়ায়। বয়সের সীমারেখায় তাঁকে আমরা অকালপ্রয়াত বলব না। ৫৪ বছরের এই জীবন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারে খুব কম কি? কম নয়। সাধারণের শিল্পী হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনের আয়ুকেই তিনি গ্রহণ করেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন ঘষে আগুন জ্বালিয়েছেন, অমর হলেন— নিলেন অমৃতজীবন। কিন্তু তিনি অকালপ্রয়াত এজন্য যে বাংলা গদ্যসাহিত্যের একটি পথ তিনি বিনির্মাণ করলেন এতোদিনের সীমাবদ্ধ শিল্পঋজুতায়-সংহতিতে-সাধনায়। আর অল্প কিছুদিন বাঁচলে হয়তো আমরা পেয়ে যেতাম আরো বড়মাপের আরেকটি কাজ, যার মাহাত্ম্য ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’কে অতিক্রম করে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, যা হতে পারত বাংলা ও বাঙালির চির-আকাক্সিক্ষত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত শিল্পিত, প্রতিবাদী এবং জীবনঘনিষ্ট উপন্যাস। ‘খোয়াবনামা’ এবং ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আজ আলোচিত, আরেকটি লিখতে পারলে সেটিও হতে পারতো মাইলফলক। আরেকটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছে প্রসঙ্গে শিল্পী ইলিয়াস বলেন : ‘আমার একটি খুব বড় পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেটি কি আর হবে, আমি কিছু নোট-টোটও করেছি, আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বগুড়ায় একটি জায়গা আছে মহাস্থান, প্রাচীন একটি নগরীর ধ্বংসাবশেষ সেখানে পড়ে আছে— পু-্রনগরী। সেই এলাকায় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ একটা বিচিত্র রূপ ধারণ করেছিল। আমার ইচ্ছা আছে করতোয়া নদীর তীরে ওই এলাকাটাকে নিয়ে এবং এ সময়টাকে নিয়ে— ১৯৭১ সাল— একটা উপন্যাস লিখব’।৫ সেই উপন্যাসের নান্দনিক সৌন্দর্য থেকে বাঙালি পাঠক বঞ্চিত থেকে গেলেন, কিন্তু তিনি যা দিয়ে গেলেন তা বাঙালি পাঠকদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকল।
আর অতৃপ্ত বলব এ-কারণে যে, কোনো শিল্পীই তৃপ্ত হতে পারেন না, কারণ অতৃপ্তবোধই শিল্পের অনুষঙ্গ, শিল্পীর অনুপ্রেরণা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অতৃপ্ত আত্মার ক্রন্দন আমরা শুনে থাকি মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে আলাপচারিতায়, মানুষের ‘তিনশো বছর বাঁচা উচিত’ বলেই তিনি মনে করেন। আর তিনি অনন্য এজন্য যে, বাংলা উপন্যাসের তথাকথিত সার্থকতার মানদ-ের তুল্যমূল্যে নিজেকে ওজন করেন নি। বেছে নিলেন— গ্রহণ করলেন ভিন্নপথ— বিনির্মাণের, সাধনার, পরিশ্রমের পথ।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ থেকে ‘খোয়াবনামা’ এবং ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ ও ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’র দীর্ঘ পথই ছিল বাস্তবের-শপথের-কঠিনের-সত্যের এবং সততার। এই সৎ-সত্য-সুন্দর-বাস্তব, সুখ-দুঃখের জীবনচিত্রই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাসাহিত্যের মূল বিষয়।
কথাসাহিত্যের মূল সার্থকতা নির্ভর করে ভাষার গাঁথুনির উপর। ‘ভাষা হলো কঠিন একটি সমস্যা, অতিশয় বিরূপ এক প্রেমিকা, যার মন রাখা এবং মন পাওয়া দায়’।৬ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ তীরের মতো ঋজু, ধানী লংকার মতো বদমেজাজি এবং পরনারীর মতো আকর্ষণীয়।’৭ প্রথম গ্রন্থ থেকে শিল্পী ইলিয়াস গদ্যশৈলী নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। সেই ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ বিষবৃক্ষের অমৃত ফলই ‘খোয়াবনামা’।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সমগ্র শিল্পসাধনাকে ক্রমান্বয়ে সাজালে আমরা একটি শৈল্পিক সিদ্ধির অগ্রসরমানতাকেই দেখতে পাই। একদিকে শৈলীর, আর একদিকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের তথা সামষ্টিক বিষয়াদিকে ধারণ করে মহাকালের ধাবমান সত্যের দিকে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা নিয়ে।
‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ থেকে ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ এবং ‘খোয়াবনামা’— যাকে শিল্পীর ক্রমাগত ঊীঢ়বৎরসবহঃ-এর নির্যাস হিসেবে গণ্য করা যায়। তিনি এগুচ্ছিলেন আঁট-ঘাট বেঁধে নিজের পায়ের তলার মাটির উপর দাঁড়িয়েই প্রতিষ্ঠার পথে— সত্যের পথে এগুবার এই মনোভাব ছিল বলেই ‘খোয়াবনামা’র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস নির্মাণ করতে পেরেছেন। ৫৯ পর্বে বিভক্ত, ৩৫২ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ উপন্যাসকে এত স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করো দুঃসাধ্য। তবে উপন্যাসের গঠন ও গুণাবলির উপর ভিত্তি করে একে এভাবে বিশ্লেষণ করা যায় :
খোয়াবনামা : জীবন ও সমাজচিত্র
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘খোয়াবনামা’য় বিশাল ক্যানভাসে সৃজনশীল নির্মাণের মাধ্যমে একটি জাতির জীবনের প্রায় সবগুলো জীবনসত্যকেই একত্রীভূত করতে পেরেছেন। এ-প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদের বিশ্লেষণটি এ-রকম :
একটি নির্দিষ্ট সময়ের মানুষকে অনির্দিষ্ট সময়ের মধ্য দিয়ে দেখা; মানুষের চেতন-অবচেতন-অচেতন জগতের যোগাযোগের রাস্তাগুলো তার লেনদেনের গলি-উপগলিগুলো শনাক্ত করা; মানুষের মধ্যেকার বহুরকম পরিচয় তার শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি, পেশা, গোষ্ঠী, পরিবার ইত্যাদি এবং সেগুলোর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ অর্থাৎ সেগুলোর গতিশীলতাকে, তার নিজের পরিবর্তন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঐক্য, অন্যের সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল, তার অবিরাম চলমান অবস্থা ইত্যাদিকে গভীর উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসা; সমাজ রাষ্ট্র আইনকানুন রাজনীতি ইত্যাদির চেহারা, তার প্রতি ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের মানুষের দৃষ্টিপাত প্রতিক্রিয়া— এগুলোর ধরন ও মর্মবস্তুর পরিবর্তন, মৃতের ও জীবিতের ধারাবাহিকতা— একের সঙ্গে অন্যের যোগসূত্র ও যোগাযোগ একই সঙ্গে ধরে রাখা কি সম্ভব? […] আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর ‘খোয়াবনামা’য় এই কাজটিই করেছেন।৮
এই কালগত চেতনা সমান্তরালভাবে রেলসড়কের মতো আসে নি, ঐতিহাসিক সত্যগুলো এসেছে জীবনের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই। সিপাহী বিদ্রোহ, পলাশীর যুদ্ধ, ফকির বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, দেশ বিভাগ, কংগ্রেসের রাজনৈতিক অভীপ্সা ইত্যাকার বহুবিধ ঘটনাকে পূর্ব বাংলার (বর্তমান বগুড়া জেলা, পূর্বের পু-্রবর্ধন নগরীর) কাৎলাহার বিল ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রাম গিরিরডাঙা ও নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি হাট ইত্যাদি স্থানের মানুষদের জীবনপ্রবাহ, তার দৃশ্য ও অদৃশ্য জগৎ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উদ্ভব, শ্রেণিবৈষম্য, ভালোবাসার বিচিত্র গতির আদলে। বিশেষত, লোভ, ঘৃণা, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতেই ‘খোয়াবনামা’র শরীর নির্মিত হয়েছে।
পূর্ব বাংলার যমুনাবিধৌত-বন্যাকবলিত গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনের সংকটকে ইলিয়াস শিল্পসুতোর বুননে এভাবে সাজিয়েছেন :
সেই কতোদিন আগের কথা, কতো দিন আগের উচ্ছ্বাস, আকালের আগের খুশি, আকালের কাঁটাবেঁধা বছর উজিয়ে এসে কুলসুমের বুকে ছলছল করে ওঠে। গর্ভে তো সে কাউকে ধরলো না, ছেলে বলো আর মেয়ে বলো তমিজই তার সব। এই আবেগ বুকে উপচে পড়লে সারাটা শরীর তার শিরশির করে এবং শরীরের এই উৎপাত থেকে রেহাই পাবার তাগিদে তমিজের দোষ ধরার জন্যে সে হঠাৎ করে হন্যে হয়ে ওঠে। কিন্তু সে হলো মুখ্যু মেয়েমানুুষ, ফকিরের ঘরের বেটি, অতো বড়ো জোয়ান মরদ তমিজের আয়াব তার চোখে পড়ে কী করে? বরং তমিজের বাপের অঘোরে ঘুমের সুযোগে ছেলের ওপর বাপটার এই রাগের খানিকটা চুরি করে সে চাখে : ক্যা বাপু কামের খোঁজে খিয়ার এলাকাত না গেলে হয় না?— কিন্তু আবার কাজের সুযোগ এদিকে দিনে দিনে কমে আসছে। এ কথাও তো ঠিক। বেশি দিন নয়, ময়মুরুব্বির কাছে শোনা গেছে, ১০/১২ বছর আগে এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙায়, বিলের এপার-ওপার জুড়ে ধান রোপা, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা— সব কামই পাওয়া গেছে এখানেই। তখন নাকি কামলা দেওয়ার মানুষই ছিল কম। যখন তখন কোনো কাজ বাধলে যেতে হতো বিলের ওপারের পচার বেটা কসিমুদ্দির কাছে। লোকটা বাপের মতোই বোকা ছিল। জমি ছিল না তার এক ফোঁটা। থাকতো চাষাদের খুলিতে, এর বারান্দায়, ওর গোয়ালে। গাছ কাটা কি ঘর মেরামতের দরকার হলে মানুষ তার হাতে-পায়ে ধরতো। আর দেখো, এই কয় বছরে যেদিকে তাকাও হাজার কসিমুদ্দি। সব শালা খালি কাম খুঁজে বেড়ায়। আকালের বছর এতো মানুষ মরলো, এতো মানুষ ভিটাজমি বেচে দেশান্তরি হলো, তবু শালার মানুষ তো কমে না। [খোয়াবনামা, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা। দ্বিতীয় সংস্করণ, অক্টোবর, ১৯৯৬, পৃ. ২১-২২]
এই কাৎলাহার বিলকে কেন্দ্র করেই ঘটনার বিস্তার। বিল ও বিলপাড়ের মাঝি, কলু, চাষিদের জীবনের সঙ্গে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সূত্রগুলো এসে মিশেছে যুগধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। এই বিলপাড়ের উঠতি শ্রেণির অন্যতম শরাফত ম-ল— যিনি জমিদারের নায়েবের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে বিলের দখলি মালিক হয়েছেন। বিল দখলের কায়দা দেখা যাক ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে :
মুনসির ইশারায় সোভান ধুমার বংশ হয়ে গেল মাঝি। তা এখন বিল তো আবার বুঁজতে শুরু করেছে। আট বছর আগে বড়ো বানের পর পলি পড়ে বিল ছোট হয়ে এসেছে। কতো কতো মাঝি কাঁধে জাল আর বৌদের কোলে-কাঁখে ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে চলে গেল পুবে যমুনার দিকে। আবার কেউ কেউ বিলের পানির ওপর পুরু সর-পড়া মাটিতে লাঙল ঢোকাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু নতুন জমি যা উঠবে সবই নাকি শরাফত ম-লের, জমিদারকে টাকা দিয়ে গোটা বিল সে পত্তন নিয়েছে। [পৃ. ৪৭]
কাৎলাহার বিলকে কেন্দ্র করেই মাঝি ও চাষি শ্রেণির মধ্যে বিরোধ বেধে গেল। যা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, মুসলমানদের হানাফি-রোফাদানি মাজহাব সংক্রান্ত জটিলতায় ভরপুর হয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পন্থায় পর্যবসিত হলো :
মাঝিপাড়া জুম্মাঘরে নামাজের পর কুদ্দুস মৌলবি একদিন বয়ান করেছিল, রফাদানিদের এটাও একটা দোষ, মোনাজাতের সময় হাত এক সাথে করে তারা শয়তানকে বসার সুযোগ করে দেয়। জোড়াহাতের পেছনে এবং এলোমেলো ছড়ানো দাড়ির ভেতরে হুরমতুল্লার কালো ঠোঁটজোড়া বিড়বিড় করে। মোনাজাত শেষ হলে হাত নামাবার পরেও দোয়া পড়া তার থাকে না, তবে তার গলা চড়লে তমিজ শোনে, হুরমতুল্লাহর লক্ষ এখন আল্লাতালা নয়, তমিজ নিজে। কি করম?— ‘ক্যা রে মাঝির ব্যাটা, ম-ল তা’লে জমি তোকই দিল? ম-লকে কয়া হামাকেও এটি থ্যাকা বিদায় দে। মাঝির সাথে জমিত কাম করবার পারমু না বাপু!’ […] জবাব না দিয়ে তমিজ হাঁটু মুড়ে বসে নিজের বর্গা জমির মাটি তুলে দ্যাখে। আউশ কাটা হয়েছে জমি চেঁছে নাড়ার গোড়া যেন কালচে হলুদ চুলের কদমছাঁট হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে মাঠ জুড়ে। নাড়ার গোড়ায় হাত দিয়ে একটু ডলতে তার খড়খড়ে আঙুলে নরম ছোঁয়া লাগে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জমিতে আস্তে আস্তে হাঁটলে পায়ের নিচে বৃষ্টির পানিতে ভেজা মাটি ও নাড়ার ছপছপ বোল ওঠে। কাল খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে হুরমতুল্লার গোয়ালে রাখা ম-লের জোড়া বলদ জোয়াল জুতে চালিয়ে দেবে এই নরম মাটিতে। মাঝির বেটা হলে কী হবে, তমিজ ঠিক বুঝে ফেলেছে, শরীরে লাঙলের ফলা লুফে নেওয়ার জন্যে জমি অস্থির হয়ে উঠেছে। [পৃ. ৫৩]
কাৎলাহার বিলপাড়ের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিলের পানি, বিলের মাছ ও মাটি। শিল্পী ইলিয়াসের বর্ণনায় তা চাষি ও মাঝির অভেদাত্মায় প্রকাশ পেলো :
‘ক্যা রে মাঝির বেটা, মাটি কি মাগীমানুষের দুধ? ওংকা কর‌্যা টিপিচ্ছো কিসক?’— এই ধমকে তমিজের চোখের সামনে জমি যেন উদাম মেয়েমানুষ হয়ে শুয়ে থাকে। শুধু স্তন নয়, তার গোটা গতরে সাঁতার কাটার জন্যে তার নিজের শরীরেই ভয়ানক কোলাহল শুরু হয়। হুরমতুল্লার ওপর রাগ করার সুযোগও তার হয় না। আবার তার শরীরের কোলাহল চাপা পড়ে হুরমতুল্লার উপদেশে, ‘হাত দিয়ে মাটি ছানা হয় না। জমি চায় লাঙলের ফলা বুঝলু? জমি হলো শালার মাগী মানুষের অধম, শালী বড়ো লটি মাগীরে, ছিনালের একশ্যাষ, নাঙ্গলের চোদন না খালে মাগীর সুখ হয় না। হাত দিয়ে তুই উগলান কী করিস?’ [পৃ. ৫৬]
মানুষ তার বংশগতির ধারা হিসাবে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণেই ইন্দ্রিয় দ্বারা তাড়িত হয়। এ-সম্পর্ক তমিজ, ফুলজান, কুলসুমকেও তাড়িত করেছে স্বাভাবিক নিয়মেই :
সেদিন মোষের দিঘির পুবের জমিতে ধানখেতে তমিজের কাস্তের পোঁচ পড়ে এমন তেজে সে দেখতে দেখতে তার আঁটির পরিমাণ হয়ে যায় পাহাড় সমান, হুরমতুল্লা বলে, ‘কেটা কবি চাষার ঘরের মানুষ তুই লোস।’
খুশি হয়ে তমিজ ফুলজানকে তার নিকার কথাটা বলতে চায়। ফুলজানও একটু দূরে থেকে তাকিয়ে ছিল তার ধানের দিকে। তার ঘ্যাগটা আজ বড়ো বেঢপ, কুলসুমের গলার ওই জায়গাটা বড়ো মসৃণ, ওখানটায় গাল দিলে বড্ডো আরাম লাগে। কিন্তু যতোই সন্ধ্যা হয়, বাড়ির দিকে মেলা করতে তার পা আর ওঠে না। অতো সুন্দর মসৃণ গলা সত্ত্বেও কুলসুমকে দেখতে তার ভয় ভয় করে। হুরমতুল্লার বাড়ির উঠানে একটার পর একটা কাজ হাতে নেয়, শেষকালে একবার গুনে-রাখা ধানের আঁটি সে ফের গুনতে শুরু করলে ফুলজান এসে দাঁড়ায় তার পাশে, ‘বাড়িত যাবা না? মাও তোমার একলা আছে না বাড়িত?’ ফুলজান কুলসুমকে তার মা বলায় তমিজের গা ছমছম করে, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে, গলা শুকিয়ে যায়। ফুলজান ফের বলে, ‘মরার বাড়ি, এখনো চল্লিশ দিন হয় নাই। তোমার মাও একলা থাকলে ভয় করবি না? বাড়িত যাও’। [পৃ. ২৭০]
কুলসুম ও তমিজের একের প্রতি অন্যের মিলিত হবার আসক্তি ইলিয়াসের উপমা-প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রাণ পেয়েছে এভাবে :
‘অসন্তুষ্ট জমি হলো কিপটার একশেষ। শালার জগদীশ সাহার চায়াও কিপটা।’ কৃপণতায় মানুষের সঙ্গে জমির তুলনা শুনে কুলসুম হেসে গড়িয়ে পড়ে। তমিজের এই উপমা কি তার হাসির কারণ, না-কি তার হাসির অছিলা তা না বোঝে তমিজ, না বোঝে সে নিজে। কুলসুমের হাসিতে তমিজের উৎসাহ বাড়ে। সে ঘোষণা করে, এবার জমির যে সেবাটা সে করছে তাতে ওই শালা হুরমতুল্লার মুখটা আন্ধার না করে ছাড়বে না। অনেক ধান পাবার সম্ভাবনায় হতে পারে, হুরমতুল্লার অন্ধকার মুখ দ্যাখার আশায় হতে পারে, আবার কুপির শিকার কালচে হলুদ আঁচেও হতে পারে,— তমিজের কালো মুখে বেগুনি রঙের আভা ফুটতে দেখে কুলসুমের সারাটা শরীর শিরশির করে ওঠে। খুব ঝাপসা এই কাঁপনকে কথায় গড়িয়ে নিতে পারলে কুলসুম শুনতো : তমিজের বাপের মুখেও এমনি ছায়া ছায়া আভা কখনো কখনো ফুটে ওঠে। কখন? কখন গো? সেই দিনক্ষণ খুঁজে বার করতে কুলসুম শোঁ শোঁ করে নিঃশ্বাস নিতে থাকে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে তমিজের এই চেহারায় তার বাপের ঠিক সময়ের আদলটা দেখতে পারবে। কয়েকটি বড় বড় নিঃশ্বাসেই পাওয়া গন্ধে কুলসুম সত্যি বুঝতে পারে, তমিজের বাপের মুখে হলুদ-বেগুনি ও কালো ঝাপটা টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার আগে। না, সব দিন নয়, মাঝে মাঝে। কখন? কুলসুম আরো কয়েকবার গন্ধ নেয়। —হ্যাঁ মানুষটা যে রাতে ঘুমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে বাইরে যায়, সে সব সন্ধ্যায় এইসব গাঢ় রঙের ঝাপটা লেগে মুখটা তার ঝাপসা হয়ে আসে। [পৃ. ৫৭-৫৮]
দেশে যখন রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে, মানুষ তার চেতনায় শাণিত হচ্ছে, তখন কাৎলাহার বিলপাড়ের মানুষও সেই ¯্রােত থেকে বঞ্চিত নয়। কথাশিল্পী ইলিয়াসের রাজনৈতিক সচেতনতা উপন্যাসে এভাবে এসেছে :
রানীরপাড়া স্কুলের একটি ছেলে কী জিজ্ঞেস করলে কাদের কয়েক পলকের জন্যে চুপ করে কী একটা ভেবে নেয়। তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করে, ‘আরে গরিবের জন্যেই তো পাকিস্তান দাবি করা হচ্ছে, এটা বোঝবার পারো না? পাকিস্তানে ধনীরা জাকাত ফান্ডে টাকা না দিলে পুলিশ ওই ধনী লোক অ্যারেস্ট করবে। আইন পাস হবে। গরিব না খেয়ে থাকতে না, জাকাতের টাকায় হক থাকবে গরিবের।’
‘জাকাতের কথা ওঠে কেন বাপু?চাষাকে ভিক্ষা দেওয়ার কথা ওঠে কেন? চাষার পাওনাটা দিয়া দিলেই তো মিট্যা যায়। চাষার যা খাটনি, আদ্দেক ফসলে তার পোষায়, তুমিই কও তো বাপু?’ [পৃ. ১৪১]
কাৎলাহার বিল ও বিলপাড়ের ফসলি জমি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে যে বিরোধ তা সম্পূর্ণ স্বার্থসাপেক্ষ। সে স্বার্থ এখানকার মানুষদেরকে ক্রমশ দুর্বিষহ জীবনের দিকেই ঠেলে দেয়। কাৎলাহার বিল পত্তন নেওয়ার ব্যাপারে শরাফতের ভূমিকা উল্লেখ্য :
মুনসির স্বভাব নিয়ে এরকম বাঁকা কথা শরাফতের গায়ে বেঁধে, তার একটু ভয় ভয়ও করে। তবে ছেলের প্রস্তাব সে বিবেচনা করে বৈকি! কাৎলাহার বিল তো একরকম তার নিজের সম্পত্তিই। এই বিল ইজারা নিতে তার কম ভোগান্তি হয় নি। নায়েববাবুকে সেলামি দিতে হয়েছে দফায় দফায়, লাঠিডাঙা কাছারিতে নানা স্তরের আমলা থেকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়েছে পাইক বরকন্দাজ সবাইকে। মনে হয় কুত্তাবিলাইও একটা বাদ পড়ে নি। কলকাতায় জমিদারবাবুকে খাওয়াবার নাম করে নায়েববাবু হাতিবান্ধার দৈ নিয়েছে হাঁড়ি হাঁড়ি। তার পৌঁছানোর খরচা পর্যন্ত জোগাতে হয়েছে শরাফতকে। —এতো কষ্টের বিল তার, জমিতে পানি সেঁচতে সেখান থেকে নালা কাটতে পারবে না কেন? কাদেরের পরামর্শটা ভালো। নালা কাটার কাজে তমিজকে মাগনা খাটানো যাবে, এই ব্যাপারে প্রথম উৎসাহটা তো তারই। [পৃ. ৭৬]
‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ দিক হলো স্থানের যোগসূত্র। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ পু-্রনগরী তথা আজকের বগুড়া জেলার বিভিন্ন জনপদ যেমন, শেরপুর, সান্তাহার, জয়পুর, পাঁচবিবি, নাটোর ইত্যাদি স্থান ঘটনার এবং চরিত্রের পূর্ণতার জন্যই উল্লিখিত হয়েছে। আধিয়ার চাষাদের ফসলের ভাগকে কেন্দ্র করে হাঙ্গামার ঘটনাটি একটি স্থানিক-কালিক-ঐতিহাসিক সত্যে যোগসূত্র স্থাপন করে ঔপন্যাসিক মহাসত্যে— সমগ্রতাস্পর্শী জীবনসত্যে রূপ লাভ করেছে :
‘কিসের গোলমাল ভাই?’ কে যেন জানতে চাইলে ভিড়ের ভেতর থেকেই জবাব আসে, ‘আধিয়ার চাষারা হাঙামা করিচ্ছিলো, পুলিশও খুব সাটিচ্ছে। মদ্দামাগী বাছবিচার নাই, যাক পাচ্চে তাকই ধরিচ্ছে।’
তমিজ জিগ্যেস করে, ‘ওই গাড়ি কুটি যাবি?’
‘শান্তাহার।’
শান্তাহার! শান্তাহারের গাড়ি! শান্তাহারের গাড়ির ইনজিনের হুশহুশ ধ্বনি বলতে থাকে, ‘শান্তাহার!’ ওই গাড়ির ইনজিনের ধোঁয়া পাকিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে লিখে দেয়, ‘শান্তাহার!’ অক্ষরজ্ঞান না থাকলে তমিজ এই লেখাটাই জীবনে প্রথম পড়তে পারে। শান্তাহার যাওয়া মানে সেখান থেকে যাও জয়পুর, যাও আক্কেলপুর, যাও হিলি। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ। আবার অন্য লাইন ধরে নাটোর কিংবা নবাবগঞ্জ। এতো পুলিশ যাচ্ছে, মানে চাষারা দুই ভাগ ফসল তুলছে নিজেদের গোলায়, জোতদারদের গোয়ার কাপড় খুলে গেছে, শালারা দৌড় দিচ্ছে, লুকাচ্ছে পুলিশের গোয়ার মধ্যে। আবার এর মধ্যেই আমনের জন্যে একদিকে চলছে জমি তৈরি, পাট কেটে সেই জমিতে একটা দুইটা তিনটা লাঙল চাষ দেওয়া হলো, এখন বীজতলায় কলাপাতা রঙের ধানের চারা বিছানো। জমি তৈরি হলো সেখান থেকে চারা এনে ধান রোপার ধুম পড়ে যাবে আহা, কাল সারা রাত বৃষ্টি হলো, জমি হয়ে আছে মাখনের মতো, লাঙল ছোঁয়াতে ঢুকে যাচ্ছে দুনিয়ার অনেক ভেতরে, তমিজ সেখান থেকে পানি পর্যন্ত টেনে আনতে পারে। [পৃ. ৩২৫]
শোষিত চাষা, মাঝি, কলু, অন্ত্যজশ্রেণি ও জমিদার, বর্গাদার-বর্গাচাষি প্রমুখের জীবন-সংগ্রামের সংঘর্ষের প্রসঙ্গ রাজনৈতিক অনুষঙ্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটিকে তৎকালীন গ্রামীণ মানুষদের জীবনের সত্য দলিলে পরিণত করছে :
কামার পাড়ায় আগুন লাগিয়ে আসার পর থেকে আফসার মাঝির বালামুসিবত আসতে লাগলো একটার পর একটা। কয়েকদিন আগে চোর এসেছিল তার ঘরে সিঁধ কেটে। ঘরে ঢুকে চোর কিছু না নিয়েই চলে যায়, সিঁধ কাটার গর্ত ছাড়া আর কোনো চিহ্ন রেখে যায় নি, কিছু নিয়েই যায় নি। কিন্তু দশরথ মরার পরদিন আফসারের বৌ টের পায়, চোর সিঁধ কাটতে গিয়েই তার লুকানো টাকার কৌটা পেয়ে গিয়েছে এবং কৌটায় টাকা ছিল দুই কুড়ির বেশি। এ সময় বৌ তার ভরা পোয়তি; তিন দিন পর টাকার শোকে কিংবা কামারপাড়ার অভিশাপে তার একটা মরা ছেলে জন্মালো। দুই মেয়ের পর এক ছেলে, ছেলেটা বাঁচলো না। বৌটা আবার সুতিকার রোগী, প্রসবের পর একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। বারবার তাকে পায়খানায় যেতে হয়। বাঁশঝাড়ে, একদিন পাছার কাপড় তোলা অবস্থায় বেহুঁশ পড়ে ছিল সেখানেই, ওই অবস্থায় তাকে দেখে ফেলে আফসারের এক জোয়ান ভাগ্নে। ঘরে মাচায় শুয়ে বৌটা দিনরাত কোঁকায় আর আফসারকে বকে, কামারপাড়ায় মামলা করে আফসার তার সর্বনাশ ডেকে এসেছে। […] বৈকুণ্ঠ নতুন একটি পথ বাতলায়, ‘তুই না হয় হামার সাথে কামারপাড়াত চল।’ শুনে আফসার আঁতকে উঠলে বৈকুণ্ঠ বলে, ‘যুধিষ্ঠিরের মাও মানুষ খুব ভালো, যুধিষ্ঠিরও চ্যাংড়াটা সাদাসিধে। তুই যুধিষ্ঠিরের মায়ের পাও ধর‌্যা মাফ চালে ঠিকই মাফ কর‌্যা দিবি। মাঝিপাড়ার উপরে কামারগোরে রাগটাও আর থাকবি না চল।’
আফসার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘হামাক লিয়া গেলে হামাক তো ধরবিই, তোমাকেও খাম করবার পারে।’
‘হামাক?হামাক ইস্পর্শ করবি এ শালা কামারের গুষ্টি?’ বৈকুণ্ঠের তেজ জ্বলে ওঠে, ‘আরে হামি হলাম গিরি বংশের সন্তান। এই গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি— ইগলান আগে কার আছিলো, ক তো? কবার পারিস? আরে হামার ঠাকুরদা, তার ঠাকুরদার বাপ, না-কি ঠাকুরদা।’ তার পূর্বপুরুষের সিংহতেজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে সে তার সিদ্ধান্তের সামান্য পরিবর্তন ঘটায়, ‘ঠিক আছে। হামি একদিন যামু, একলাই যামু। যুধিষ্ঠিরের মায়ের সাথে, যুধিষ্ঠিরের সাথে, নারদ, গৌরাঙ্গ, তারপর ওই শালা জামাইার সাথে কথা সাব্যস্ত কর‌্যা আসি, তারপরে তোক লিয়া যামু।’ [পৃ. ২৪৯-৫০]
মিথ এবং পৌরাণিক-ঐতিহাসিক সত্য ব্যবহারে ইলিয়াস ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন, যা ‘খোয়াবনামা’য় ভিন্নমাত্রিকতা লাভ করেছে। এই উপন্যাসটি মিথলজিক্যাল দিক থেকেও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। চেরাগ আলি ও কুলসুমের উক্তি :
‘মাদারিপাড়াত না তোমার দাদা পরদাদা ব্যাবাক মানুষের গোর আছে। একোজন মানুষের কব্বর হয় কয় জায়গাত?’
‘হয় না? তাও হয়।’ চেরাগ আলি নজির দেয়, ‘সেরপুরে এক পীরের দুই মোকাম, দুই মাজার। একটা শিরমোকাম, সেটি গোর দিছে পীর সাহেবের কাল্লাখানা। আরেকটা ধড়মোকাম সেটি আছে তেনার শরীলটা। দুষমনে পীর সাহেবকে কাটিছে দুই ছ্যাও কর‌্যা। গোরও হছে দুই জায়গাত। এক কোশ তফাত।’
‘তোমার পরদাদারা কি সোগলি মরার পর দুই তিনখানা কর‌্যা ভাগ হছে?
এরকম নিষ্ঠুর উক্তিতে চেরাগ আলির মন খারাপ করতো, গলা নিচু করে বলতো, ‘আস্তে বুবু, আস্তে। ময়মুরুব্বি সবই শুনিচ্ছে।’ তবে মন ভালো করার কায়দাও চেরাগ আলির ভালো করেই জানা, সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রয়োগ করে,
সিথানে পাকুড়াগাছ মুনসির বসতি।
তলায় গজার মাছ অতি হিং¯্রমতি। [পৃ. ৩২]
গ্রামীণ অর্থনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ ইলিয়াসের বর্ণনায় ফটোগ্রাফির মতো যমুনাপড়ের কৃষক-মাঝি আর সাধারণ মানুষের জীবনকেই স্মরণ করিয়ে দেয় :
মাদারিপাড়ার কি আর সব ভালো? ওই গাঁয়ে কারো অবস্থাই ভালো নয় গো! ওখানে বারো মাসই আকাল, বারো মাস টানাটানি। একটা দিন খাল পেরিয়ে না ঘুরলে ওখানে ভাত জোটে না। ছোট গ্রাম, ঘর মোটে কয়েকটা, সবাই ফকিরের জ্ঞাতিগুষ্টি। পুবদিকে এক ক্রোশ চাষের জমির পর যমুনা, এর মধ্যে কয়েক বিঘা বাদ দিলে সবটাই চন্দনদহের আকন্দদের, শিমুলতলার তালুকদারদের, রৌহাদহের খাঁদের আর গোঁসাইবাড়ির ম-লদের জমি। মাদারিপাড়ার ফকিরদের বেশির ভাগ মানুষ ওখানে বর্গা করে নয়তো কমলা খাটে। কয়েক বিঘা পতিত জমির মালিক ছিল ফকিররা, তাই নিয়ে তাদের দেমাক কতো! কতো অতো দেমাকের কী আছে? যেখানে পুরনো আমলের গোরস্থান। একটা মস্ত শিরীষ গাছ, কয়েকটা পিতরাজের গাছ আরা দুটো শ্যাওড়া গাছ। জিন আর ভূতের আস্তানা। ফকিরগুষ্টির কেউ মরলে গোর দেওয়া হতো ওখানেই; কিন্তু দাফন সেরেই জ্যান্ত মানুষগুলো তড়িঘড়ি করে ফিরতো। পরে গোর জিয়ারত করতে যাবার সাহসও কারো হয় নি। এখন তো ওসবের চিহ্নমাত্র নাই। [পৃ. ২৯]
কাৎলাহার বিলের দখরদারিত্ব নিয়ে, অধিকার প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে চাষা ও মাঝিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত ধীরে ধীরে রাষ্ট্র-জমিদার তথা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে সংকট উপস্থিত হয়েছে, সেই সংকট থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টাও অব্যাহত থেকেছে যা ইলিয়াসের উপন্যাসে শিল্পিতভাবে উপস্থাপিত। তাই ইলিয়াসের কবি-স্বভাবের বীণার তারে সেই সুর শুনি :
ম-লে করিল কবজা মাঝির কাৎলাহার।
কাঙাল মাঝিপাড়ায় ওঠে করুণ হাহাকার॥
[…]
ম-লে খড়ম মারে বির্ধ মাঝির মাথে।
দুষ্কে শশর্ধর অস্ত যান সাথে সাথে॥
গিরিরডাঙা গ্রামে সূর্য না হন উদয়।
বিলে পদ্ম না ফুটিয়া কুঁড়িমাঝে রয়॥
[…]
মহাস্থানে শায়িত শাহ সুলতান হুজুর।
মাহি সওয়ার নামে তিনি দুনিয়ায় মশহুর॥
তানারে বেইজ্জত করে নাসারা কোম্পানি।
লাজে দুষ্কে শুকাইল করতোয়ার পানি॥
ইলিয়াসের গান আক্ষরিক অর্থের মাহাত্ম্য পেরিয়ে দার্শনিক সত্যে রূপান্তরিত হয়েছে :
মাঝি বিনা বিল আর জল বিনা মাছ।
পুত্রহীন মাতৃকোল পুষ্প বিনা গাছ॥
আওরতে না পায় যদি মরদের চুম।
যতো জেওর দাও তারে রাতে নাহি ঘুম॥
[…]
বিলে না পরশ যদি পায় মাঝি অঙ্গ।
জল শুকাইয়া যায়, না থাকে তরঙ্গ॥
কেরামতে বলে শুন শুন দিয়া মন।
কাৎলাহার জল কান্দে আয় মাঝিগণ॥
এই প্রথম বাংলা উপন্যাসে খ-িত হিন্দু-মুসলিম জীবনবোধকে একত্রীভূত করে স্বাধিকার আন্দোলনের পথে নিয়োজিত করতে পেরেছেন। ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের মজনু শাহ এবং ভবানী পাঠক এরকম দুটি উজ্জ্বল চরিত্র :
মজনু হাঁকিয়া কয় ভবানী সন্ন্যাসী।
গোরাগণে ধরো আর দাও সবে ফাঁসি॥
গিরিবৃন্দ অসি ধরে ভবানী হুংকারে।
গোরাগণে পাঠাইয়া দেয় যমদ্বারে॥ [পৃ. ১৯৯-২২০]
‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে পাকিস্তান আন্দোলন একটি বড় অংশ দখল করে আছে। ‘জাল যার জলা তার’ এই শর্ত-রাজনীতির বাণী কাৎলাহার বিলপাড়ের সাধারণ মাঝি শ্রেণির মধ্যে প্রচার করলেও ফল হয় এর উল্টোটা :
এই পাকিস্তানের আন্দোলনের মোটা দিকগুলো আমরা জানি। কিন্তু এর ভেতরের গড়ে ওঠার নানা সূক্ষ্ম ও জটিল দিকগুলো তৈরি হয়েছে ব্যক্তি, পরিবার, গ্রাম পর্যায়ে অনেক উপাদান ধারণ করে, অনেক দ্বন্দ্ব ধারণ করে, অনেক দ্বন্দ্ব তৈরি করে, আবার অনেক দ্বন্দ্বের নিরসন করে। ইলিয়াস তাঁর উপন্যাসে কলকাতার কেন্দ্র থেকে মফস্বল শহর এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে গ্রাম এমনকি বিল পর্যন্ত বারবার যাতায়াত করেছেন। এখানে ইসমাইলের মতো ব্যক্তি, নায়েব, আনন্দবাজার পত্রিকা, আবার তমিজের বাপ এরা সবাই যার যার অবস্থান জানায়। ইসমাইল বা আজিজ-কাদের-শরাফতরা তাদের অবস্থান সম্পর্কে যতো পরিষ্কার, তমিজের বাপদের তা নয়— উপন্যাসের বুননেও এই বাস্তবতার প্রতিফলন আছে।৯
‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস থেকে আমরা পাকিস্তান আন্দোলনের অভ্যন্তরস্থ নানাবিধ রাজনৈতিক ¯্রােত সম্পর্কে জানতে পারি। একদিকে তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা জমিদারি উচ্ছেদের দাবির কথা বলে, চাষাদের কাছে এসে তেভাগা বাস্তবায়ন ও তার সুফল বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। আর অন্যদিকে জমিদার-নেতারা এসব আন্দোলনের প্রবণতাকে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের সদিচ্ছা বলেই মনে করে। নেতাদের মনোভাব থেকে তাদের চরিত্র সম্পর্কে জানা যায়। কর্মীদের উদ্দেশে নেতারা বলে :
তোমরা জমিদারদের সম্পত্তি কেড়ে নেবে, বড়োলোকদের মারবে। কম্যুনিস্টদের সঙ্গে তাহলে তোমাদের ফারাক কী? এদিকে দীন ইসলামের কথা বলো, ওদিকে নাস্তিকদের কথা ধার করে বলো। আমরা এখন কোনটা ধরি, বলো?’ […] ‘ইসলামে কি কারো সম্পত্তি দখল করার হুকুম আছে? আমাদের হজরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাহিসালাম কি হজরত ওসমান রাজিআল্লাহু আনহুর সম্পত্তি বজেয়াপ্ত করেছিলেন?বরং তাঁর সঙ্গে তিনি তাঁর দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। ধনী-গরিব বড়ো কথা নয় বাবা। পরহেজগার মানুষ আমির হলেও হলো, গরিব হলেও ভালো? ‘তোমাদের লীগের বড়ো বড়ো হোমরাচোমরা তো সবাই জমিদার আর বড়োলোক। তাদের উচ্ছেদ করলে তোমাদের পার্টি টিকবে কী করে? [পৃ. ১০৩]
‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটি কালের ক্রমানুসারে— ঘটনার অনুপুঙ্খতায় সাজানো নয়। কিন্তু উপন্যাসটি পাঠশেষে দু’শো বছরের একটি কালিক ব্যবধানের মধ্যেও যোগসূত্র লক্ষ করা যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাতে এই দু’শো বছরের ব্যবধান শৈল্পিক মর্যাদা পেয়েছে : ‘দু’শো বছর আগে গোরা সেপাই টেলরের বন্দুকের গুলিতে নিহত মুন্সী বয়তুল্লাহ মৃত্যুর পর উঠে বসে কাৎলাহারের বিলের ধারে প্রাচীন পাকুড় গাছে। সেখান থেকে সে দু’শো বছর ধরে বিল শাসন করে’।১০—এ বর্ণনা অভিন্ন সময়বোধে শিল্পিত-পরিশীলিত-মার্জিত এবং শাণিত। এ-দীর্ঘ সময়ের মধ্যেই আমাদের এই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভূ-ভাগে ঘটে গেছে অনেক কিছু : ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ এবং ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগ পর্যন্ত— যদি এ সময়কালকে ধরেই বিশ্লেষণ করা যায় তা হলে পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ইত্যাকার বহুবিধ ঘটনা ঘটে গেছে যা ‘খোয়াবনামা’য় এসেছে ধীরে ধীরে, বর্ণনার জন্য নয়, চরিত্রের প্রয়োজনে। তাই কোনো বর্ণনাকে চাপানো সত্য বলে মনে হয় না, বরং সত্য সত্যের মতোই, জীবন জীবনের মতোই স্বচ্ছ এবং প্রবহমান।
‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের কাহিনীর সূত্রপাত ঘটেছে কাৎলাহার বিল এবং এই বিল পাড়ের দুই গ্রাম গিরিরডাঙা এবং নিজগিরিরডাঙাকে কেন্দ্র করে। মুক্তাবিন্দুর মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে পোড়াদহের মেলা। এই গিরিরডাঙা নিজগিরিরডাঙা, পোড়াদহের মেলা, এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন পু-্রনগরী তথা আজকের বগুড়া জেলা সদর থেকে আট/দশ মাইল পূর্বদিকে। যা যমুনা বিধৌত, যমুনা-বাঙালি-করতোয়া বিধৌত পূর্ব বগুড়ার এই পলল মৃত্তিকাগঠিত ভূ-ভাগের উর্বর মাটিতে প্রচুর কৃষিপণ্য উৎপন্ন হয়। এখানকার মানুষেরা কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী, কামার, কলু, কেউ কেউ ব্যবসায়ী। বৎসরে একবার মাঘ মাসের শেষ বুধবার পোড়াদহের মেলা বসে। এই পোড়াদহের মেলাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই এলাকার কৃষ্টি-কালচার-সভ্যতা-সংস্কৃতি, লোক-সংস্কৃতির এক বিরাট বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মেলাটি। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী দক্ষিণে কয়েক গ্রাম দূরেই এলাঙ্গীতে মেলা বসে। এভাবেই কড়া শীতে মাঘের প্রথম বুধবার থেকে পড়ে যায় মেলার ধুম। মাঘের প্রথম বুধবার এলাঙ্গীর মেলা, দ্বিতীয় বুধবারে বকচর, তৃতীয় বুধবার তেকানী এবং মাঘের প্রথম বুধবারে অর্থাৎ শেষ বুধবারে পোড়াদহের মেলা বসে। এই মেলাকে কেন্দ্র করেই গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি বেঁচে ছিল, আজো আছে, কিন্তু তা ক্ষীয়মান। ক্রমাগত নাগরিক নিষ্পেষণে কালের অতলে তা হারাতে বসেছে। শিল্পী ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে লোকজ এই সংস্কৃতির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা এসেছে :
পরশু পোড়াদহের মেলা। মেলা উপলক্ষে আশপাশের মেয়েরা এসে গেছে বাপের বাড়ি, জামাইরা এখনো আসছে। পোড়াদহের চারদিকে গ্রামগুলো মানুষজনে গিজগিজ করছে। ইসমাইল এই সুযোগটা ছাড়তে চায় না। মেলার একদিন আগে গোলাবাড়ি হাটে মুসলিম লীগের সভা। ইসমাইল হোসেন তো বলবেই, শামসুদ্দিন ডাক্তার কথা দিয়েছে, খান বাহাদুর সাহেবকে নিয়ে আসার জন্য সে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে, বাকি আল্লার ইচ্ছা। বটতলা ঘেঁষে মঞ্চ তৈরি হবে, মঞ্চের জন্যে তক্তপোষ পাওয়া গেছে মুকুন্দ সাহার কাছ থেকে, চেয়ার দেবে নায়েব বাবু। [পৃ. ১৬১]
ইলিয়াসের উপন্যাসে মানুষ— মানুষের জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়াদি প্রধান হয়ে উঠেছে। এক আঁচড়ে গোটা এলাকার মানুষ এবং মানুষের জীবন সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায়। গ্রামীণ সাধারণ মানুষের জীবনে পোড়াদহের মেলার প্রভাব, যা আনন্দের,— ‘পোড়াদহ মেলার সময় বাড়িত জামাই আসিছে, বুঝলা না? শ্বশুর গেছে আমার শাশুড়ি আর শালিক আনতে। আরে শালি না থাকলে মানুষে কি আর শ্বশুরবাড়ি আসে? বোঝো না, বৌ হলো ডালভাতের ডালি। রসের হাঁড়ি জোয়ান শালি’। [পৃ. ১৬৩] কেরামত ও তমিজের সহজ-সরল বাক্যালাপ থেকে অত্র এলাকার মানুষের জীবন এবং রসবোধ সম্পর্কে জানা যায়। পূর্ব বগুড়ার এই বিরাট এলাকা জুড়ে আজো এ ধারা বহমান।
কাৎলাহার বিল, বিলপাড়ের মানুষ, পোড়াদহের মেলা, গোলাবাড়ি হাট, হাটের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, হিন্দু-মুসলমান, নায়েব, জমিদার, কৃষক, শোষক-শোষিত, রাজনীতিবিদ এবং বর্গাচাষি থেকে শুরু করে কলু, মাঝি, কামার সবের বর্ণনা এসেছে ‘খোয়াবনামা’য় ধীরে ধীরে। গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত একটি বিলকে কেন্দ্র করে এতো বড় মাপের উপন্যাস লেখা— এখানেই ইলিয়াস অনন্য। এর আগে এই অঞ্চলের ভোস্তার বিলকে কেন্দ্র করে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সুবোধ লাহিড়ী ‘ভোস্তার বিল’ নামে ১০০ পাতার একটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসটির গদ্যভঙ্গি, বক্তব্য শিল্পমানে উত্তীর্ণ তো বটেই, সেই সঙ্গে গ্রন্থটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে গণ্য হতে পারে।
‘খোয়াবনামা’ একটি দলিল; রাজনীতির ইতিহাস। শোষিত-শোষক শ্রেণির ইস্তেহার, গ্রামীণ অর্থনীতির অনুপুঙ্খ বৃত্তান্ত। মাঝি, চাষি থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষের বিন্যস্ত জীবনেতিহাস। ব্রিটিশ শাসন-শোষণবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে; শোষিত মানুষের সামষ্টিক কষ্ট ক্রন্দনের মধ্য দিয়ে : গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি যে চাষাবাদ সে চাষাবাদের জন্য কাৎলাহার বিলের পানি পর্যন্ত বর্গা চাষিরা বিনা পয়সায় ব্যবহার করতে পারে না। সেই বর্গাচাষিদেরই একজন প্রতিনিধি তমিজ। জোতদারকে পানির মূল্য পর্যন্ত দিতে হয়েছে তাকে। ধান কাটা শেষ হলে, ধানের বাঁক নিয়ে ঘরে ফিরে এলে তমিজের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কথা না বুঝেই সরলমনা কুলসুম ধানের বস্তায় হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধান তোমার কি সোন্দর হছে গো’। [পৃ. ১৩৯] —এই তমিজরা, কুলসুমরা শোষিত-নির্যাতিত। এরা এদের শ্রমের-ঘামের মূল্য পায় নি, পায় না। সামাজিক পদস্থ মানুষের ব্যবহারে এরা সদা তটস্থ থাকে। পাশবিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাদেরকে, তমিজকেও সহ্য করতে হয়েছে। ঘর করা, সুখ ভোগ করা সম্ভব হয় নি তমিজের। ফুলজানের সেবা, কুলসুমের হাসিমুখ বেশি দিন দেখা ভাগ্যে জোটে নি তার। গ্রামীণ শোষণ-পীড়নের শিকার হয়েই তাকে হতে হয়েছে ফেরারি আসামি, সংসারবিমুখ এক পথচারী বিদ্রোহী। এই চিত্র কি সেদিনের শুধু সেই কাৎলাহার বিলপাড়ের তমিজ-কুলসুমের? নাকি সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র? কাৎলাহার বিলপাড়ের শোষিত মানুষের আর্তচিৎকার কাৎলাহার বিলপাড় ছাড়িয়ে বাংলার আকাশ-বাতাসকে কি ভারী করে তোলে না? তোলে। এখানেই শিল্পী ইলিয়াস শিল্পসার্থক সিদ্ধপুরুষ। স্থান-কাল-জনপদ উতরে গিয়ে ‘খোয়াবনামা’ সর্বকালের সর্বস্থানের সর্বজনের লালিত স্বপ্নের ঠিকানায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের উপন্যাস তথা বাংলা উপন্যাস। ব্যক্তির সর্বস্বতা থেকে উপন্যাস মুক্তি পেয়ে সমষ্টির আশা-আকাক্সক্ষার দিকে মোড় নিল, যা আমাদের বড় পাওয়া। নিঃসন্দেহে তমিজ বড় মাপের চরিত্র, কিন্তু প্রধান চরিত্র কোন্টি? তমিজ, না কুলসুম, না ফুলজান— তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কারণ তমিজের সমস্যা একার নয়, সমষ্টির। সামাজিক সমস্যাগুলোই খতিয়ে দেখানো হয়েছে ‘খোয়াবনামা’য় যা সমকালীন বাংলা উপন্যাস থেকে আলাদা। মানিক, তারাশঙ্কর, ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখ প্রধান ঔপন্যাসিকের থেকে আলাদা ইলিয়াসের কাজ। পূর্ববর্তী আধুনিক সার্থক ঔপন্যাসিকগণ বিভিন্নজন বিভিন্ন পথে এগিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তির আত্মার ক্রন্দনের মাধ্যমে। কিন্তু ইলিয়াস কোনো সত্যকে ব্যক্তির উপর চাপিয়ে না দিয়ে, কোনো পথ ব্যক্তিকে বাৎলে না দিয়ে শুধু ব্যক্তি ও সমাজের অসাম্যকে দেখালেন। পাঠক যা গ্রহণ করার তা করবে। অবশ্যই ভালোটি গ্রহণ করা দরকার। মিলান কুন্দেরা উপন্যাসকে সাইকেল রেস মনে করেন না : উপন্যাস কখনো সাইকেল রেস হবে না, হবে অনেক আহার্যের সমাহারে এক ভোজ— ফিস্ট অব মেনি কোর্সেস। ‘খোয়াবনামা’র অনুষঙ্গগুলো পরীক্ষা করে দেখলে এটি আসলেই ফিস্ট অব মেনি কোর্সেস হিসেবে প্রতিভাত হয়।১১
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সমগ্র সাহিত্য-সাধনাকে দুই পর্বে ভাগ করা যায় : এক. প্রস্তুতি পর্ব, দুই. পরিণতি পর্ব। প্রস্তুতি পর্বে পাঁচটি গল্প গ্রন্থ, একটি উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, এবং প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’। আর পরিণতি পর্বের ফসল হিসেবে ‘খোয়াবনামা’কে বলতেই হবে। প্রস্তুতি পর্ব থেকে পরিণতি পর্ব— এই দীর্ঘ পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে এক অভিনব গদ্যভাষা নির্মাণের মধ্য দিয়ে, এই গদ্য ভাষার মাধ্যমে, মিথ-পুরাণের ব্যবহারে— শৈল্পিক উৎকর্ষ সিদ্ধির মাধ্যমে। উপন্যাসের পৌরাণিক উপাদান সৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে লেখকের জাদুকরী ভাষা আর অসংখ্য উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প। ভাষা খুব ‘উঁচুমানের কাব্যানুগ হওয়ায় কাহিনীর বাস্তবতা এক ধরনের স্বপ্নময়, কুহকী মাত্রা অর্জন করেছে’।১২—এ প্রসঙ্গে ‘খোয়াবনামা’ থেকে উদাহরণ টানা যায়, কাৎলাহার বিলের মাছ আর পানির বর্ণনা :
এদিকে পানিও কমে গেছে, বিলের ঠিক মাঝখানেও গলা পানির বেশি নাই। সাটি আর বেলে, পুঁটি আর মৌরলা, ছোট ছোট চাঁদা আর বাঁশপাতা মাছই কেবল পাওয়া যাচ্ছে। মাঝিদের দাপাদাপিতে বিলের পানি কাদা কাদা হয়ে ওঠে, কাদা আরো কাদাটে হয় বকের ডানা থেকে ঝরে পড়া ছায়ায়। এই ছায়ার ইশারাতেই কি-না কে জানে সন্ধ্যা নামে কুয়াশায় ভর দিয়ে। [পৃ. ১৯৮]
একদিকে ‘আর’-এর অনুপ্রাসে আর চিত্রকল্পের দ্যোতনায় গদ্যের প্রবহমানতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পড়তে গেলে বিরক্তি আসে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্যে গন্ধ আছে, শব্দে শক্তি আছে, উপমায় চিত্রকল্পে আছে জীবনবাস্তবতার ছায়াভাস, যা মৌলিক— একান্তই তাঁর, সরলরৈখিক জীবনের মতো।
‘খোয়াবনামা’ ধর্মীয় গোড়ামি-অন্ধত্ব ইত্যাদি কুসংস্কার ও প্রাচীন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে চিন্তাশক্তির স্ফুরণ ঘটাতে সক্ষম একটি উপন্যাস; কামার ও মাঝিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র অন্তত সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। উপরন্তু কামারদের বল্লমের ঘায়ে, ছোরার আঘাতে জাত্যাভিমানী আফসার বলে, ‘খবরদার! হামি গিরির বংশের মানুষ। হামি অভিশাপ দেই, শালা কামাররা তোরা নিব্বংশ হবু’। [পৃ. ২৫১] ‘বন্দেমাতরম্’ আর ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনিও ব্যবহৃত হয়েছে সামাজিক স্বার্থে। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ প্রসঙ্গে এ ধরনের উক্তি দেখা যায় :
বিসমিল্লাহ বলিয়া শুরু করে কেরামত।
ভারতবর্ষে কায়েম হবে ইনসাফ হুকমত॥
প্রথম বলি নিরঞ্জন সংসারে সার।
দ্বিতীয় বলি যমরাজা করিবে সংসার॥
শিঙা হাতে ইসরাফিলে যখন দিবে ফুঁক।
থাকবে না দালান কোঠা থাকবে না তালুক॥
দরবেশ সাধুর মন্ত্র নিতে কেহ ভুইলো না।
লীগ কংগ্রেসের হিংসা কেন গেলো না॥ [পৃ. ২৫৫]
ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বর্ণনার ক্ষেত্রেও কাব্যভাষা নির্মাণের দক্ষতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে অনন্য করেছে। ‘চিত্রকল্পের পুনরাবৃত্তি বাজবঢ়বঃরঃরাব চধঃঃবৎহ ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে মহাকাব্যিক কাব্যগুণ নিয়ে এসেছে’।১৩
কবিয়াল কেরামত, অথবা তমিজের বাপের প্রাপ্ত গানগুলো থেকে ‘খোয়াবনামা’র কাব্যগুণ বিশ্লেষণ করা যায়। তেভাগা আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং প্রেমিকার মনোরঞ্জনের জন্য কবি কেরামত গান বাঁধতে সিদ্ধহস্ত।
মুন্সী বয়তুল্লাহ’র পাকুড় গাছ থেকে অলৌকিকভাবে কাৎলাহার বিল ও বিলপাড়ের মানুষ শাসন, বিলের গজার মাছের ভেড়ার পালে রূপান্তর, সাদা বকের ধবধবে পাখায় ওড়াওড়ি এগুলো ‘কুহকী বাস্তবতায়’ রূপান্তরিত হয়। ঔপন্যাসিকের ইচ্ছাতেই বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ কিছুটা পরাবাস্তব, কিছুটা জাদুর পরিবেশে বাস্তবজীবন কিংবা মরণোত্তর জীবন যাপন করে।১৪
‘খোয়াবনামা’র ভাষাতে এ জাদু ছড়িয়ে আছে, যা বর্ণনায় অসাধারণ। ধানী জমি, জমির মাটির বর্ণনায় অসাধারণ কাব্যিকতার লক্ষণ সুস্পষ্ট, দার্শনিকতায় পূর্ণ, ‘ধানক্ষেত কিন্তু নিজের রঙকে কখনোই সম্পূর্ণ করে দেখায় না; ভোরে শিশিরে এটা টলটল করে, দুপুরবেলা ধানের শীষ থেকে রঙ নিয়ে রোদের তেজ বাড়ে, রোদকে দিয়ে থুয়ে ধানের রঙ হয় একটু ফ্যাকাশে’ [পৃ. ৮৬] —এভাবেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পরিণতি পর্বের শিল্পকর্ম ‘খোয়াবনামা’ থেকে অজ¯্র উদাহরণ দেওয়া সম্ভব যা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষ্যও বটে।
প্রস্তুতি পর্বের দিকে দৃষ্টি দিলে এ-কথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তিনি তিরিশ এবং চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের প্রচলিত ধারার গল্পরীতি থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ এক ভিন্নরীতির গদ্য নির্মাণ করলেন, যাতে মেশালেন প্রচুর আঞ্চলিক কথ্যশব্দ, এবং অভিজ্ঞতার নির্যাসে সেই শব্দ হয়ে উঠলো অসীম শক্তিশালী আর তাই বাড়িয়ে দিল আমাদের গদ্যের সীমানাকে। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিসৃষ্ট, সংস্কৃত ভাষানুগ ফোর্ট উইলিয়াম কালেজীয় বাংলা ভাষার আদল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা গদ্যভাষা নির্মাণ করলেন ইলিয়াস, যা ছিল প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ।১৫ ‘খোয়াবনামা’য় ইলিয়াস প্রচুর পরিমাণে বগুড়ার আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন সার্থকভাবে। পাশাপাশি লেখকের ইনটেলেকচুয়াল গদ্যরীতিও লক্ষযোগ্য। এক চাঁদের রাতে তমিজ ও ফুলজানের কথোপকথন থেকে ইলিয়াসের গদ্যরীতি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট করা যাক : ‘তোমার খুব জাড় করিচ্ছে, না?’ বলে সে তার গায়ের সুতির র‌্যাপারটা মেলে দেয় ফুলজানের পিঠে। ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে ফুলজান চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘ছোল বুঝি হামার বাঁচে না গো’ [পৃ. ৯৩-৯৪] গদ্যশৈলী নির্মাণে তিনি চলিত রীতিকেই ব্যবহার করেছেন কিন্তু কথ্যরীতির ইনটেলেকচুয়াল ব্যবহারে একটি ভিন্নশৈলী দাঁড়িয়ে গেছে যা কথাসাহিত্যের দিগন্তকে প্রসারিত করেছে নিঃসন্দেহে। শব্দ-শক্তির মাধ্যমেই বক্তা কথা বলেন। বক্তার বলার মাধ্যমেই শ্রোতার মনের বিষয়টি নির্ভর করে। শব্দের রঙ আছে, গন্ধ আছে, আলো আছে, ধর্ম আছে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শব্দশৈলীতে সেই শক্তিগুলো বহমান।
কেউ কেউ ইলিয়াসের আঞ্চলিক ও কথ্যরীতির প্রয়োগকে দোষের বলে মনে করেন। তিনি কথ্য ভাষার শব্দ প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের নৈতিক চরিত্রকে ধ্রুপদ রূপ দিয়েছেন, এটা কি দোষের? বিশ্ব কথাসাহিত্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এ-কথার সত্যতা নিরূপণ করা যায়। ‘আঞ্চলিক কথ্যশব্দের সুচতুর প্রয়োগ কথাসাহিত্যের মানকে প্রসারিত করে, গদ্যের সীমানা বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু ভাষাতাত্ত্বিক নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণায় এ-ভাষা একটি দলিল হয় বলেই আমার বিশ্বাস’।১৬
কলকাতার হাসপাতালে ঘাতক ক্যান্সারে আক্রান্ত ইলিয়াসের একটি পা কেটে ফেলা হলো, বিষাদে নিমগ্ন হলেন লেখক কবি সাহিত্যিক-পিপাসু মন। অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখলেন :
[…] দেখুন
আপনাদের শহরে আমার একটা পা রেখে যাচ্ছি
ওই পায়ে বগুড়ার লাল ধুলো লেগে ছিল
যমুনাতীরের, চেরাগ আলির ঘর হয়ে বিক্রমপুর
চিটাগাঙ, হুরমতুল্লা পরামানিকের সঙ্গে
মাঝরাতে মাঠভর্তি ধান দেখতে গেছিল…১৭
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আজ নেই, আছে তাঁর কর্ম। ব্যক্তি ইলিয়াস নৈর্ব্যক্তিকভাবে সামাজিক অসাম্য-ভাঁড়ামির বিরুদ্ধে লিখে গেলেন, রেখে গেলেন, প্রস্তুতি-পর্ব থেকে পরিণতির ফসল। এ-পরিণতিকে আমরা পূর্ণ পরিণতি বলবো না, কালব্যাধির করাল গ্রাসে বঞ্চিত করে গেলেন একটি পূর্ণ মুক্তিযুক্তভিত্তিক উপন্যাসের রসাস্বাদনের তৃপ্তি থেকে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উপন্যাস যেহেতু জীবনের বৃত্ত, আধুনিকতম এবং সমগ্রতাস্পর্শী শিল্পপ্রতিমা, যেখানে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় জীবনের আদি-অন্ত; শিল্পিত স্বরগ্রামে উদ্ভাসিত হয় লেখকের জীবনার্থ আর তাঁর স্বদেশ-সমাজ-কাল এবং প্রচারিত হয় জীবন সত্যের মহাবাণী।১৮সেই বাণীসত্যের বিস্ফোরিত বারুদগন্ধে সকল অন্ধ সংস্কারের ভিত নড়ে যায়, সৃষ্টি হয় এক জীবনঘনিষ্ঠ শিল্প যা জীবনকে শুধু নতুন করে সৃষ্টিই করে না, একে ব্যাখ্যাও করে।১৯ শিল্পী ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ অনেক টুকরা টাকরা ঘটনার সমাবেশে সৃষ্ট একটি সম্পূর্ণ শিল্পিত বাংলা উপন্যাস, যে উপন্যাসের মাধ্যমে শিল্পী যাবতীয় আরোপিত ঔচিত্যবোধ, নৈতিকতা, আশাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে মানুষকে তাঁর সম্ভাবনা এবং ক্ষয়ের বৈপরীত্যে সম্পূর্ণ অবয়বে ধারণ করতে পেরেছেন। মূলত এটিই ইলিয়াসের উপন্যাসের মূল থিম।২০ বাংলা উপন্যাস তথা কথাসাহিত্যের জগতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কতোটুকু স্মরণীয় বরণীয় পূজনীয় তা ভেবে দেখবার নয় কি?
উপন্যাসের নাম, আরম্ভ, শেষ এবং ঘটনার বিস্তৃতিতে যে স্বপ্নালুতার ছায়াভাস লক্ষ করা যায় তা শিল্পী ইলয়াস সচেতনভাবেই করেছেন। অলঙ্কার নির্মাণের জন কিছুটা খাদ যেমন অত্যাবশ্যক তেমিন শিল্প-সৃষ্টিতেও যুক্তিহীনতার শক্তিকে কিছুটা বেড়াবার সুযোগ দিতে হয়। তা না-হলে শিল্প সৃষ্টি অসম্ভব। মূলত জীবনের মৌলভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে মৌল আবেগসমূহকে উপজীব্য করে তোলার জন্য যে বিশাল, গভীর ও পরিশীলিত মানসপট প্রয়োজন তা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছিল।

তথ্যনির্দেশ
১. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘শিল্পপ্রাঙ্গণ’, সাক্ষাৎকার, ধারাবাহিক অনুষ্ঠান, বিবিসি বাংলা বিভাগ।
২. হাসান আজিজুল হক, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষের অমৃতফল’, পাক্ষিক শৈলী, ২ বর্ষ, ২২ সংখ্যা, ১ জানুয়ারি ১৯৯৭, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা, পৃ. ১৪।
৩. প্রাগুক্ত পৃ. ২৫।
৪. রশীদ হায়দার, ‘চলে গেলেন ইলিয়াস’, পূর্ণতা, বসন্ত সংখ্যা, ১৪০৩, পৃ. ১২।
৫. প্রাগুক্ত, বিবিসি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকার।
৬. হাসান আজিজুল হক, ‘ব্যক্তিগত জীবন : শিল্পীর মুখে’, সেমিনার বক্তব্য, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭।
৭. হাসান আজিজুল হক, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষ’, পূর্ণতা, বসন্ত সংখ্যা, ১৪০৩, পৃ. ৫।
৮. আনু মুহাম্মদ, খোয়াবনামা : মানুষ ও সময়, শৈলী, ২ বর্ষ ২২ সংখ্যা, ১৯৯৭।
৯. খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, ‘খোয়াবনামার মাঝি ও চাষিরা’, পাক্ষিক শৈলী, ২ বর্ষ, ২২ সংখ্যা ১৯৯৭, পৃ. ৩৮।
১০. আনু মুহাম্মদ, খোয়াবনামা : খোয়াবে-চেতনায় মানুষ ও সময়; সংস্কৃতি, ডিসেম্বর ১৯৯৬।
১১. ওয়াসি আহম্মেদ, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : সংশয়ে বিশ্বাসে স্বপ্নে’, পাক্ষিক শৈলী, ২ বর্ষ, ২২ সংখ্যা, ১৯৯৭, পৃ. ৩৮।
১২. প্রাগুক্ত পৃ. ২৮।
১৩. প্রাগুক্ত শৈলী, পৃ. ২৯।
১৪. প্রাগুক্ত শৈলী, পৃ. ২৭।
১৫. আহমদ ছফা, ‘ইলিয়াসনামা, ‘খোয়াবনামা’, উত্থানপর্ব, প্রথম সংখ্যা, ১ চৈত্র ১৪০৩, পৃ. ১২১।
১৬. ড. আফিয়া দিল, ‘ভাষা’, সেমিনারের বক্তব্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২৯ মার্চ ১৯৯৭।
১৭. অনিতা অগ্নিহোত্রী, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে’, দেশ, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬।
১৮. বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ১।
১৯. জি. ভি প্লেখানভ, ‘শিল্প ও সমাজ’, অনুবাদ : আফজালুল বাসার, বাংলা একোডেমি, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ১৯৮৯, পৃ. ২।
২০. শাহাদুজ্জামান, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : ব্যক্তিগত কোলাজ’, শৈলী, ইলিয়াস সংখ্যা, পৃ. ৫৭।

 

 

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930