আমার গুরুগণ: উনিশ

প্রকাশিত: ১:৫১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২২

আমার গুরুগণ: উনিশ

মোস্তফা মোহাম্মদ

যাঁদের পাখায় আমি পথ চলি……………………..

 

নৌকা আছে বৈঠা আছে তুমি লগি বাও,
মুরোদ থাকে পুরুষ তুমি যাও যমুনাত যাও;

পরের মাঝি ঘরের আপন তুমি কুটুম জান,
তোমার লাগি সাঁঝের কালে কান্দে সখির পরান;

ধান-কাউনের আবাদ তুইলা ফিইরা আইসো ঘরে,
তোমার লাইগা বুকের মদ্যে ঢিপঢিপানি বাড়ে;

 

আমার বাবা ইসমাইল হোসেন মণ্ডলের মাথায় সংসার নামের যে-ভূতটা চাপিয়েছিলেন মুরুব্বিগণ, সেই পাজি ভূতটা কী-করে ইজতুল্লা সরকারের উঠানে বসে সারাপাড়ার উঠতি বয়সের মেয়েদের গলায় গীত হয়ে ধ্বনিত হয়। আর বাড়ির সব বৌঝি-বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা গোল হয়ে, বারান্দায় টুলপেতে বসে পানের বাটা সামনে নিয়ে গীতের সাথে গলা মিলায়।

 

পুকুর, পুকুরের চারদিকের রাস্তায় পায়চারি করে সরকার বাড়িতে ফিরে এসে উঠানের কোণে দাঁড়িয়ে ইসমাইল গান আর গীত আর টিপ্পন্নির অর্থ খুঁজে দেখার চেষ্টা করে।

এই গান-গীতেরা আমার জ্যাঠাই-মা অর্থাৎ, আমার বাবার প্রথম-বৌয়ের মৃত-আত্মায় ভর দিয়ে বংশবিস্তারের আশায় ভবিষ্যতের দিশা খুঁজে পায় সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশার চানবাড়িয়া গ্রামের ইজতুল্লা সরকারের দীঘলকায়া ডাগর চোখের মেয়ে মরিয়মের ঠোঁটের মায়ায়। মরিয়মের টানাটানা চোখের ভাষায় ইসমাইল বুঝে নেয় মৃত স্ত্রীর নিথর ঠোঁটের হিরন্ময় আগুন।

 

একবার অগ্রহায়ণ-কী-পৌষ-কী-মাঘ মাসে বগুড়ার মহাস্থানে পীরে কামেল সুলতান বাবা আউলিয়ার মাজারে ইসমাইলের বন্ধু চকপাথালিয়ার মজিবর পণ্ডিতের সন্তান-লাভের আশায় মানতের ওয়াদা পূরণের জন্য জোড়াখাশির পোলাও-মাংশের পশারসহ শুক্রবারের নামাজের পর মিলাদ শেষে মুসল্লি ও মিসকিন খাওয়ানোর পর করতোয়া নদীর পাড়ে শিলাদেবীর ঘাটে ঝুঁরিনামা বটগাছের শেকড়ের উপরে বসে যুদ্ধপরাজিত রাজা পরশুরামের অনিন্দ্যসুন্দর ভগ্নির করতোয়ার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মবিসর্জনের হেতুতে কষ্ট পেয়েছিলো ইসমাইল।

 

করতোয়ার স্রোতের টানে শিলাদেবীর নিথর দেহের ভাষা, অথবা তার চোখের জলের দাম কত হতে পারে?—এইসব বিশৃঙ্খল চিন্তার সাথে সরকারের মেয়ে মরিয়মের চোখের ভাষার স্বপ্নসাধনার সাথে যমুনার অথৈ জলের ভাষার লালিত্য গুলিয়ে ফেলে ইসমাইল।

 

সরকার বাড়ির মেয়েদের মুখে মুখে গান বানিয়ে সুর করে গাওয়ার মধ্যে ইসমাইল বগুড়ার পূর্বাঞ্চলের গ্রাম্য-বিয়ের গীতের চেয়ে বেশি কিছুর স্বাদ পেয়ে বসে। যমুনার ওপারেই অবিভক্ত ভারতবর্ষের ময়মনসিংহ জেলা। আয়তনের দিক থেকে এই বিশাল জেলার মানুষের জীবন বহুমুখী-বহুরৈখিক ধারার সংমিশ্রণে গঠিত। জামালপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ সদর, টাঙ্গাইল মিলিয়ে এই এলাকার জীবন ও সংস্কৃতি বিরাজমান। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সোমেশ্বরী, ঘোড়াউত্রা, ধলেশ্বরীসহ অসংখ্য ছোট-বড় নদীর ধারায় গড়েওঠা এই জনপদে আছে বিশাল বিশাল মাছের-ধানের আধারর–জল আর জলার মিশ্রিত রূপ পূর্ববাংলার হাউরি ভূভাগ। গানের, গীতের সেই গীতল ধারা–গীতলতার আবহ এই বড় বড় নদী-হাওড় পাড়ি দিয়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার চন্দনবাইশা ইউনিয়নের চানবাড়িয়া গ্রামের সরকার বাড়ির মেয়েদের গলায় সুর হয়ে ভাঁজে কীভাবে?—ইসমাইলকে বিষয়টি ভাবনায় ফেলে দেয়। ভাবনার জাল ছিন্ন করে ইসমাইল সরকার বাড়ির অতিথিখানার বিছানায় বালিশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930