আমার গুরুগণ: একাত্তর

প্রকাশিত: ৪:১১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

আমার গুরুগণ: একাত্তর

মোস্তফা মোহাম্মদ

 

 

দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সুর,
গান আর প্রাণ আর দান,
কান্না জমাট বাঁধা শ্মশানের খুলির ভিতর;

 

সংসার সমুদ্র যতো,
আমাদের জীবনের মতো,
অবিরত বয়ে যায় করতোয়ায়;

 

শীলাদেবী-মুক্তি-মরিয়ম,
তোমাদের আমাদের আমার,
চোখের জলের ভিতর শতধারা;

 

বয়ে যায় অবিরাম অবিরত,
অবারিত জ্যোৎস্নার ভিতর,
ঘূর্ণিঝড় ভয়হীন বেহুলার বাসর;

 

রতিহীন জ্যোতির্মাণ মৃত্যুসাগর,
শীলাদেবীঘাট গোকুল মেধ,
কালিবাড়ি কালিঘাট,
প্রত্নপ্রদীপ্ত পুণ্ড্রনগর রাজা পরশুরাম;

 

নাগরিক কোলাহল নাই,
খুঁজে পাই দূরের ভিন গাঁয়,
আরও দূর নীলিমায়,
ঘোড়ার খুরের শব্দ আর,
হাতি-কাছি-লাঠি-ত্রিশূল;

 

বাঁশের বাঁশরী বাজায়,
বিলের অতল জল ডাহুকী সকল,
ধানের উঠান জুড়ে অশান্তির ঝড়,
মুক্তি আর মরিয়ম আর সুবোধ,
লুটোপুটি রাজহাঁস,
চাষার সমস্ত কাজ,
সুবোধের ইসমাইলের মাথার উপর;

 

কালীবাড়ি কালিদহ,
শ্মশান-ঈদগাহ,
আর বৈরাগীর দহের ভিতর;

 

শুদ্ধ-সমুজ্জ্বল মহাস্থান গড়,
মাটির টান আর মাটির মাটির মায়ায়,
যুদ্ধবিধ্বস্ত কবর-নগর-নটীর কায়ায়;

 

—-সুদামপুরের গোবরা ঘোষের নৌকা থেকে জেলখানা পার হয়ে কোর্টচত্বর বরাবর নামার পর ইসমাইলের মাথার ভেতর মহাস্থান গড়, জাহাজঘাটা, শীলাদেবীর ঘাট তথা প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতির কলকব্জা খুবলে খেতে চায়; বিশেষত, শীলাদেবীর আত্মবিসর্জন ইসমাইলকে ব্যথিত করে তোলে তীব্র থেকে তীব্রতর। প্রাচীন এই দুর্গনগরীর চারদিক এমনভাবে সাজানো-বিন্যস্ত যে, করতোয়ার পশ্চিম পাড় ঘিরে ডাইনে-বামে-পিছনে শিক্ষা, শিল্প, ধর্মসহ কৃষি-বাণিজ্যের নানা উপকরণ তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ দেবার জন্য যথেষ্ট। লোকমুখে প্রচারিত এবং মাটি খুঁড়ে বের করা ঐতিহাসিক সত্য যে, সুলতান বলখী মাহী সওয়ার (রঃ) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে সাতসমুদ্র-তেরোনদী পাড়ি দিয়ে, করতোয়ার উজান বেয়ে আছরের নামাজের ওয়াক্তের সময় পুণ্ড্রনগরীতে নেমে রাজা পরশুরামের কাছে জায়নামাজ বিছানোর আনুকূল্য লাভ করে নামাজ শেষে নিজের আসন পোক্ত করেন সময়ের পরিক্রমায়। ক্ষুব্ধ-রাজা পরশুরামের সাথে যুদ্ধ হয়; রাজা পরাজিত হলে রাজভগিনী শীলাদেবী সতীত্ব এবং হিন্দুত্ব বাঁচানোর জন্য করতোয়ার পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ কেমন মৃত্যু! নগর রাষ্ট্রের অধিকর্তার ভগিনী কেন আত্মহত্যা করবে?
—ইসমাইল নিজের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় একের পর এক।
—-শীলাদেবীর এই অপমৃত্যু মেনে নিতে পারছে না ইসমাইল; নদীর পাড়ে বসে একাকী মনে মনে কষ্ট পায়, আর ভাবে সুবোধের কথা।

উকিলের কাছে আগে থেকেই বলা ছিলো সুবোধের আত্মসমর্পণের কথা।
সুবোধ তো আর চোর-ডাকাত-বাটপার নয়, একজন স্বাধীনতাকামী, মানবতাকামী, নীতিবোধ-সম্পন্ন রাজনৈতিক কর্মী; সাম্যবাদের বাণীর প্রচারক, মানুষ ও মানবতার সেবায় জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত এমন একজন বন্ধু—ইসমাইল স্বগতোক্তির সুরে উকিলের সামনে কথাগুলো বাতাসে ছেড়ে দেয় জোর গলায়—গতপরশু উকিলের অফিস-কামরায়। ইসমাইলের চোখে ভেসে ওঠে কাকীমার মুখ; সুবোধের মা সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলো বলেই আজকের এই আয়োজন, স্বেচ্ছায় কারাবরণ।

 

মুহুরির সাথে উকিলের অফিসের বারান্দায় ওঠার আগেই দেখা হয় সিদ্দিক, সাত্তার, মুক্তি আর নিতাইয়ের পাশাপাশি দাঁড়ানো অসংখ্য কর্মীর।
ইসমাইল মুক্তি কুণ্ডুর সাহস আর আবেগের তারিফ না-করে পারে না—এগিয়ে গিয়ে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশপূর্বক কথামালা আকাশের নীলে উড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ সুবোধকে ধরতে না-পারার ক্ষোভের বশে দুই-দুইবার সুবোধের মায়ের বাড়ির সমস্ত মালামাল ক্রোক করে মাটির দেওয়ালের একচালা টিনের দুটি ঘর মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশের সুবিধাসুলভ শোষণমূলক আইন অমান্য নয়, ধরাপড়ার আগে পার্টির কর্ম ও বাণী সাধারণ কর্মী এবং নিপীড়িত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য যতদূর সম্ভব, যতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে পার্টির কাজ করা যায়, ততই ভালো—এইজন্যই সুবোধের বিরুদ্ধে হুলিয়া; হুলিয়া-আসামি সুবোধ আজ স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে কারারুদ্ধ আসামি।

 

বগুড়া কোর্টের ডাকসাইটে উকিল সদরুদ্দিনের ধারণা ছিলো সুবোধ আজ কোর্টের এজলাসের কুঠুরির ভেতর দাঁড়িয়ে জজ সাহেবের মুখোমুখি হলেই জামিন পেয়ে যাবেন; না জামিন হলো না—জজ সাহেব সুবোধের জামিন-আবেদন না-মঞ্জুর করেন এবং বগুড়া জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠিয়ে দিয়ে কোর্টের অর্ডার অগ্রাহ্য করার ঝাল মেটান।
শুরু হয় সুবোধের জেল জীবন। সুবোধের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে জেলগেট থেকে বিদায় নিয়ে ইসমাইল, সিদ্দিক, সাত্তার এবং মুক্তি কুণ্ডু নিয়মিত শেরপুর-বগুড়ায় চলাচকারী ‘গয়নার নৌকা’খ্যাত যাত্রী পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত নৌকার শেষ ট্রিপে করে শেরপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়।

 

সকলেরই মন খারাপ; সুবোধের জন্য—মুক্তির একটু বেশিই বলা যায়। এক অপ্রকাশ্য বেদনাবোধ করতোয়ার স্রোতের অনুকূলে ছুটেচলা যাত্রীবাহী নৌকার উড়ন্ত বাদামের বাতাসের সাথে, যাকে বলে পালের বাতাসে দোল খায়। চোখের জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ নৌকার গলুয়ের সাথে বাড়ি দেয়, যেন মুক্তির বুকের জমানো ক্ষতের তীব্র দহন। জ্বালা ইসমাইলেরও কম নয়, কোনোটা দেখা যায়; আর কোনো অদৃশ্য বেদনার ঝড় হয়ে অপেক্ষায় থাকে মোল্লাবাড়ির আত্মীয়—চন্দনবাইশার চানবাড়িয়া থেকে ঘুরতে আসা মরিয়মের ধনুকের ছিলায়। জায়দার মোল্লার কাছে মোল্লাবাড়ির আত্মীয় মরিয়মের আগমনের খবর পেয়ে সুবোধের কোর্টে হাজিরা-সংক্রান্ত জটিলতায় এবং দায়বোধের কারণে মরিয়মের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ইসমাইলের; আজ দুদিন হয়।