আমার গুরুগণ: পঁয়তাল্লিশ

প্রকাশিত: ৯:২০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৫, ২০২৩

আমার গুরুগণ: পঁয়তাল্লিশ

মোস্তফা মোহাম্মদ

যাঁদের পাখায় আমি পথ চলি………………..

সকালের পায়চারি শেষে বাড়িতে এসে হায়দারের খোঁজ করে ইসমাইল। পরশুদিন হরিতলা মাঠের সান্ধ্য-গানের আসরে বসা নিয়ে হট্টগোলের সময় শালের গজি আর মাফলারে মুখঢাকা অবস্থায় হায়দারকে ঠিকমতো দেখতে পারেনি ইসমাইল। আলো-আঁধারিতে ছায়ার মতো মুখ লুকিয়ে অগণিত দর্শকের ভীড়ে হারিয়ে গেলেও ইসমাইলের অন্তরকে ফাঁকি দিয়ে পালাবে সেই সাধ্য কার!
৬ মাসের বাপ-মরা অনাথ হায়দারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে হায়দারের মা-কে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিলো ইসমাইল। পিতার অপত্য স্নেহে লালিত হায়দার মানুষের ভীড় ঠেলে দূরে পালালেও তার গায়ের গন্ধে ইসমাইল টের পায় হায়দারের অস্তিত্ব।
দশবছরের মা-মরা হায়দার কেন যেন বয়স বাড়ার সাথে বেয়াড়া হয়ে উঠছে, ইসমাইল এই রহস্যের তল খুঁজে না পায়!

বেতুয়ার বিলের পায়চারি শেষে ঘরে ফিরে এসে নাস্তা নিয়ে বড় ভাতিজা মাওলাবক্সের বৌ নূরজাহান ইসমাইলের কাছে এলে ইসমাইল জিগায়, ‘বৌমা হায়দারকে দেখেছো, হায়দার কোথায়?’
—ইসমাইলের কণ্ঠস্বরের ওজস্বিতার মাঝে একটু ক্রোধ-রাগ খুঁজে পায় মণ্ডলবাড়ির লক্ষ্মী-বৌ নূরজাহান। ভাতিজা-বৌ হলেও ইসমাইলের কাছে নূরজাহান মায়ের মতন। চাচাশ্বশুর প্রতাপশালী ইসমাইলের ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য আড়ালে গিয়ে বলে, ‘হামি সকালে দেখিছিনু বাজান; সকাল বেলাত ভাত খায়া ছোটোমিয়া চোখের পলকে বই আর বল লিয়া কুণ্টি যেন হাওয়া হয়া গেলো আর দেখি নাই।’
—নূরজাহানের কথার মাঝে লুকোচুরি দেখে নাস্তা সেরে পোশাক পরে শেরপুর থানা কাউন্সিলে যাবার জন্য ঘোড়ার গদি লাগাতে বলে ইসমাইল।
জুতা, টুপি, আস্কান গায়ে জড়িয়ে ঘোড়ায় ওঠার আগে খেয়াল করে দেখে যে, পিয়ারবক্স ও কাদেরবক্স আজ স্কুলে যায় নাই। বিমর্ষ ইসমাইল চাবুক হাতে মণ্ডলবাড়ির উত্তর দুয়ারি ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই ক্যারম খেলারত হায়দার, পিয়ারবক্স আর কাদেরবক্স ঘরের বারান্দার চাটাইয়ের বেড়া ভেঙে উত্তরের রাস্তা দিয়ে সোজা মোল্লাবাড়ির দিকে পালিয়ে নিখোঁজ হয়।

 

এই পুত্রবৎ ভাতিজাদের পড়াশোনা নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়ে খুব অসহায় হয়ে পড়ে ইসমাইল। বাড়ির বড়-বৌ নূরজাহানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘শোন বৌমা, আজ থেকে এই বেতমিজ বদমাইশদের পাতে ভাত বাড়া নিষেধ; মনে রাখবা কিন্তু’
—নূরজাহান তার চাচাশ্বশুর ইসমাইলের কাছে দেবরদের জন্য লজ্জিত হয়ে পড়ে। ইসমাইলের কথায় মাথার ঘোমটা টেনে লজ্জিত নূরজাহান ‘জ্বী বাজান’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। আর ইসমাইল ভগ্নহৃদয় নিয়ে শেরপুর থানা কাউন্সিল ভবনে এসডু সাহেবের কৃষির উন্নতি ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।

 

মিটিংয়ে এসডিও সাহেব যতটুকু-না-কৃষির উন্নতির দিকে নজর দেয়, তার চেয়ে বেশি জোর দেয় ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের দমনের দিকে। বিশেষত, শেরপুর ডিজে হাইস্কুলের ছাত্র সুবোধ লাহিড়ীর শোষণ-বিরোধী সরকারি টেলিফোনের তারকাটা বিষয়ক কেসের বেয়াড়াপনার উচিত শিক্ষা দেওয়া এবং তাকে ধরে জেলে পুরে চাকরির নিশ্চয়তা বিধানসহ নিজেকে সুরক্ষা দেওয়ার দিকেই মনোযোগ বেশি।

 

সুবোধের কথা বলতেই ইসমাইলের মাথায় রক্ত উঠে যায়। ইসমাইল ভাবে, এই বেনিয়ার দল শাসন আর শোষণের নিমিত্তে হেন কাজ নাই যা তারা করে নাই, করেই যাচ্ছে। সুবোধ লাহিড়ী ও তার বামরাজনীতিতে বিশ্বাসী বন্ধুরাই আমাদের কৃষকের বন্ধু। ইসমাইল মনে মনে ভাবে এই বালের বক্তৃতা শোনার জন্য এসেই ভুল করেছি। কিন্তু না, কিছু বলার সময় এখন নয়। ইসমাইলের চিন্তা, হায়দার ও তার সহযোদ্ধা ভাইদেরকে যেকোনোভাবেই হোক লেখাপড়া শিখিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরির ব্যবস্থা করতে হবে; মাঠের বাইরে থেকে গোল দেওয়া যাবে না—মাঠে টিকে থেকেই সমাজ পরিবর্তন করতে হবে, তার জন্য শিক্ষার কোনোই বিকল্প নাই।

 

এসডিও সাহেবের মিটিং শেষ হলে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ইসমাইল। পড়ন্ত বিকেলে পাখিরা ফিরে আসে ঘরে। মাগরিবের নামাজ শেষে মদজিদ থেকে বাড়ি ফিরে পড়ার ঘরে গিয়ে দেখে কেউ নাই। ল্যাম্পও জ্বলে নাই আজ। হায়দার, পিয়ারবক্স, কাদেরবক্স—কেউই পড়তে বসে নাই আজ। রাতের খাবার খেতেও আসে নাই। খাবার সময় বড় ভাতিজা মাওলাবক্সকে জিজ্ঞেস করতেই মাওলাবক্স জানায়, ‘কাদের বক্সের ভীষণ পেট ব্যথা, পড়তে বললেই তার পেটব্যথা ওঠে বাপু; সেই সাথে দাস্ত আর বমি বমি ভাব করে শুধুই পানিভর্তি বদনা লিয়া পায়খানার দিকে আর কলপাড়ড়োত ছুট্যা যায়। আর তাছাড়া পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ নাই; ওরে দিয়া হাল চষা ছাড়া কিছুই হবার নাই, চাচমে’
—মাওলাবক্সের কথায় হতাশার সাগরে নিমজ্জিত ইসমাইল কোনোমতে রাতের খাবার সেরে নিজের ঘরে গিয়ে কপাট লাগায়।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31