আমার গুরুগণ: বিশ

প্রকাশিত: ১:৩১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩০, ২০২২

আমার গুরুগণ: বিশ

মোস্তফা মোহাম্মদ

যাদের পাখায় আমি পথ চলি……………………..

 

মেয়েরা মেতেছে আজ উঠান-গীতের মজমায়। সরকার বাড়ির মেয়েদের সমবেত গান খুলিগীত-বা-উঠানগীতের সান্ধ্যকালীন ধ্বনিমাধূর্যমণ্ডিত পূরবীরাগের তাল-লয় ছিন্ন করে মাগরিবের নামাজের আজানের আহ্বানের সাথে মিলিত হয়ে বক-বালিহাঁস-পাতিহাঁস-ঘুঘুদের ঘরে ফেরার তাড়া হয়ে ডুবুডুবু সূর্যের শেষ রেখায় দিগন্তে মিলিয়ে যায়।

কিছুটা আলো, কিছুটা অন্ধকারে বসে বসে ইসমাইল ভাবে, এই কনে-দেখা আলোয় সরকার বাড়ির উঠানে বসে ঢলঢলিয়া যৌবনের মেয়েদের মনজাগানিয়া উদ্দীপক মহাসঙ্গীতের আয়োজন কেন? তাদের ডাইনে সরকার বাড়ির পদ্মফোটা-পুকুর, সামনের বুক বরাবর দশ-কী-পনের মাইল দূরেই উথাল-পাতাল যমুনার ধারা। চোখের আলো যতদূর যায়, ততদূর দেখা যায়; তারপরে দুনিয়া নিঝুম–শুধু ইসমাইলের মন চলে আর চলে, দূরে ছুটে যায়; আরও দূরে পৃথিবীর ত্রিসীমানার বাহিরে ইসমাইল দেখে ফেলে জল আর জালের, নর আর নারীর, মাছ আর জেলের, পাখ আর পাখালির অমিত সম্ভাবনার আর হারানোর দীর্ঘশ্বাস।

সেই সুখ, সেই দুঃখ, সেই জাগতিক আর মহাজাগতিক খেলায় মেতে ওঠে ইসমাইলের মন–ইসমাইল শিশু হয়ে যায়; তেষ্টায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। ঘুমে-জাগরণে-তন্দ্রার ভেতর ইসমাইল পাখির পালকের নির্ভার আনন্দে উড়তে থাকে চানবাড়িয়া গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতসন্ধ্যার গীতল হাওয়া আর ধীরে ধীরে বয়ে যাওয়া চানমারি হিমের চাগারে ভেসে। তার উড়ন্ত বুকের নিচে পড়ে থাকে হলুদ সরষে-ক্ষেত, ধানের কোমল ডগা, গমের শীষের খসখসে ধারালো নখের আঁচড়, ফুলের সুবাস আর শিশিরের শব্দের পতনের সুর।

তন্দ্রাচ্ছন্ন ইসমাইলের মনে হয় বিশুষ্ক করতোয়ার খাদ পরিবর্তনের কথা। একহাজার বছর-কী-দুইহাজার বছর অথবা আড়াই-তিনহাজার বছর আগে মহাস্থান বিজয়ের আগে সুলতান বাবা আউলিয়া ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে আরব-ইরান-তুরান হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, সমুদ্র থেকে মাছের পিঠের সওয়ার হয়ে করতোয়া নদীর উজান ঠেলে মহাস্থানের গড়ে এসে গড়রাজ্যের রাজা পরশুরামের কাছথেকে নামাজের অনুমতি পেয়ে নামাজ শেষে আখড়া গেড়ে বসেই ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদ রচনা করেন এই প্রাচীন সভ্যতাখ্যাত পুণ্ড্রবর্ধন এলাকায়–সেই ভরানদীর ক্ষুরধারা শুকিয়ে গেলেও রেখা রয়ে গেছে, ইতিহাস কথা কয়–ইসমাইল গানের সুরের খেলায় ভাবে মনে মনে। ভাবে হায়দারের কথা, হায়দারের মায়ের অকালমৃত্যু আর হায়দারের ভবিষ্যতের কথা; নদীর শুকিয়ে যাবার সাথে সংসারের অমিতমায়ার জালের কথা।

সন্ধ্যার এই ঘোরলাগা ঠাণ্ডার দিনে, হিমের আধারে কেনো ছন্নছাড়া যুবতী-ছুড়ির দল উঠানের মাঝখানে খড়ের উপর খেজুরের পাটি আর শনের বিছানা পেতে পীড়িতের গীতগান গায়? এই শক্ত-সামর্থ্য মেয়ের দল তাদের শারীরিক যোগ্যতার প্রমাণ দিতে সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে আসা গরুর দলকে গোয়ালঘরে বাঁধে না কেন? এঁড়ে গরুটার দিকে সাহস নিয়ে এগিয়ে যায়-না-কেন? কেনই-বা তারা মুরগির ঘরার দরোজা লাগায় না খাটাশ আর শিয়ালের হাত থেকে রক্ষার তাগিদ থেকে–এই মেয়ের দলের অসুখটা কোথায়?এরা কী বখে গেলো যুগের হাওয়ায়; যৌবনের উন্মাদনায়!–ইসমাইলকে সরকার বাড়ির মেয়েদের এই আচরণ ভাবনায় ফেলে দেয়। মরিয়ম ও তার সখিদের আচরিত জীবনের জিজ্ঞাসার জালে জড়িয়ে ইসমাইল ভাবনার অতলে হাবুডুবু খেতে খেতে ঘুমের অতলে ডুবিয়ে যায়।

(চলবে)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31