আমার রবীন্দ্রবোধ

প্রকাশিত: ৮:২২ অপরাহ্ণ, মে ১১, ২০২৩

আমার রবীন্দ্রবোধ

আমিনুল ইসলাম

সৃষ্টিশীলতার ভুবনে অথবা ব্যক্তিজীবনে–কোথাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক সুফী ছিলেন না কিন্তু সুফীদের কাছাকাছি এক অনন্যসাধারণ সংসারী মানুষ ছিলেন। তিনি সংসারপ্রেম ও ঈশ্বরপ্রেমকে অভিন্ন চিত্তে ও একাকার ভালোবাসায় ধারণ করেছিলেন। সেই অনুভব ও অনুভূতি তাঁর চিন্তাধারাকে একইসঙ্গে বৈরাগ্য ও ভোগবাদ থেকে সযত্নে দূরে রেখেছিল। যদিও প্রথম জীবনে তিনি অন্যান্য অনেক বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের মতো অনেককিছুতেই আনন্দ পেতেন কিন্তু বয়স যত বেড়েছে তিনি ততই গভীরচারী নিবিড়চারী ও মহাবিশ্বচারী হয়ে উঠেছেন। তিনি প্রচলিত ধর্মগুলোর কোনোটিকেই তার আনুষ্ঠানিকতায় গ্রহণ করতে পারেননি কিন্তু নিজের মনের মাঝে একটা অঘোষিত অনানুষ্ঠানিক ধর্ম সৃষ্টি করে সেখানে ডুব দিয়েছেন অবসর সময়ে। তিনি জমিদার ছিলেন জন্মসূত্রে, কিন্তু জমিদারি থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে খরচ করতেন না। আর যত দিন গেছে তিনি জমিদারিটাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন এবং সাধারণ কৃষকদের দুরাবস্থা দেখে ব্যথিত হয়েছেন। তিনি বৈপ্লবিক মানসিকতার মানুষ ছিলেন না বলেই বোধকরি জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে বাস্তবে আন্দোলন করতে পারেননি কিন্তু জমিদারি প্রথার নেতিবাচক দিকগুলো তাঁর বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন, উদাহরণস্বরূপ ‘দুই বিঘা’ জমি’– কবিতার কথা বলা যায়। তাঁকে হিন্দু মেলাতে অংশগ্রহণ করতে উস্কানি বা অনুপ্ররেণা দেওয়া হয়েছিল, তখন তাঁর বয়স কম ছিল। একইসঙ্গে সেটা ছিল উত্তেজনাকর সময়ের চাপ। যত দিন গেছে– তিনি বুঝতে পেরেছেন বিভাজনভিত্তিক ধান্দাবাজ রাজনীতির শোষক ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র, তিনি সেখান থেকে সরে এসে নির্মল সাহিত্য সাধনায় বেশি করে মনোযোগী হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ক্ষুদিরাম বা সাভারকার কোনোটাই হওয়া সম্ভব ছিল না। সেরকম কোনোকিছু হলে আমরা অন্তত ‘গল্পগুচ্ছ’ এর রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না, ‘গীতিবিতান’-‘গীতাঞ্জলি’ এর রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না, ‘ছিন্নপত্র’-এর রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না।
রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলাটা তাঁর প্রতি সুবিচার নয়। যে কোনো অথবা সকল বিচারেই তিনি যে কোনো দেবতার চেয়ে পরিচ্ছন্ন, পরিশীলিত, সংযমী, অহিংস, অকর্তৃত্বপরায়ণ ও অ-ভোগবাদী জীবন যাপন করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ চিন্তাভাবনায় মাঝেমাঝে আকাশ বিহার করেছেন কিন্তু আকাশচারী হননি। তিনি বলাকার মতো আকাশে উড়েছেন কিন্তু তাঁর ভালোবাসার বাসাটি থেকেছে মাটিতেই। কবিতা, নাটক, ছোটোগল্প, উপন্যাস, সংগীত, কাব্যনাটক, ভ্রমণকাহিনি, পত্রসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, কিশোর সাহিত্য, প্রবন্ধসাহিত্য এবং বিশ্বস্বীকৃতি— সবকিছু মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ন্যায্যভাবেই বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বড় আসনটি দখল করে আছেন এবং সেখান থেকে তাঁকে আসনচ্যুত করার মতো কোনো কবি-সাহিত্যিক আজ অবধি বাংলা ভাষায় গড়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও রক্তেমাংসে গড়া এই মাটির মানুষ ছিলেন। মানুষ হিসেবে তাঁরও কিছু ভুলত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা ছিল। তাঁর পরিবার, সমাজ, প্রচলিত শাসনব্যবস্থা, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি চারপাশে রচে রেখেছিল নানাবিধ বেড়া। তিনি সব বেড়া ভেঙে ফেলতে পারলে হয়তো আমরা কেউ কেউ আরও বেশি খুশি হতাম। কিন্তু একজন মানুষের জীবনে সবকিছু হওয়ার কথা নয়। আবার সেসব করতে গেলে হয়তো-বা আমরা একজন বিপ্লবী কবিকে পেতাম কিন্তু আজকের বটগাছের মতো সর্বশাখা বিস্তারী কবি-কথাকার-নাট্যকার-সংগীতকার-নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না। হয়তো-বা তিনি জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টির প্রতিও সবখানি সুবিচার করতে পারেননি। তারপরও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সর্বতোভাবে তাঁর অতুলনীয় অবদানের কথা মনে রাখলে সেসব সীমাবদ্ধতাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া যায়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এত এত কাজ ও ভাবনায় জড়িত থেকেও তিনি সৃষ্টি করেছেন এত এত শিল্প-সাহিত্য। তারপরও গভীর বিনয় সহকারে তিনি স্বীয় সীমাবদ্ধতার কথা বলে গেছেন:“ তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা/ আমার সুরের অপূর্ণতা/ আমার কবিতা, জানি/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’’ এরপরও রবীন্দ্রনাথকে দোষারোপ করার কী যুক্তি থাকতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ রাজত্ব করে যাচ্ছেন বাংলাভাষী সবখানি ভূগোলে। তাঁর বাইরেও তিনি বিরাজমান ডিঙিয়ে ভূগোলের সীমা। তাঁকে নিয়ে আলোচনায় কোনো ছেদ নেই। কিন্তু তাঁকে সঠিকভাবে বুঝে ওঠার চেষ্টা নেই বললেই চলে। একশ্রেণির মানুষ তাঁকে ‘দেবতা’, ‘গুরুদেব’ বানাতে উন্মাদপ্রায় যা তিনি হতে চাননি কখনো; তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক , আমি তোমাদেরই লোক।’ অন্ধ ভক্তরা সেটা ভুলে থেকে রবীন্দ্রনাথকেই অপমান করেন প্রকারান্তরে। যদিও সংখ্যায় কম তবু আরেক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি, জমিদার কবি, বুর্জোয়া কবি ইত্যাদি হিসাবে দেখে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মের উপাসনাকারী ছিলেন না, হিন্দু ধর্মের তো নয়ই; কারণ অন্তত জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের মানুষ। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হননি ফলে তাঁর পক্ষে বুর্জোয়া বা কম্যুনিস্ট কোনোটাই হওয়ার কারণ ঘটেনি। তিনি জমিদার ছিলেন , এর জন্য তাঁর জন্ম দায়ী যার ওপরে তাঁর কোনো হাত ছিল না।
যত দিন গেছে, রবীন্দ্রনাথ ততই গভীরচারী হয়েছেন তাঁর জাগতিক ভাবনায়—ঈশ্বরভাবনাতেও। এমনি করে তিনি জীবনের পরিণত পর্যায়ে এসে এমন একজন মানুষে পরিণত হয়েছেন যাকে সাধারণ মানুষ বলা যায় না আবার দেবতা বা সুফীসাধকও নয়। ব্যাপক জ্ঞানরাশি আর বিপুল আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে তিনি জীবনসাধক হয়ে উঠেছেন। তিনি প্রচলিত অর্থে ধার্মিক ছিলেন না আবার অধার্মিকও নন; তিনি পোপ-পুরোহিত-মৌলানাদের মতো আস্তিক ছিলেন না কিন্তু তাঁকে নাস্তিক বলারও কোনো অবকাশ নেই। আসলে রবীন্দ্রনাথ শেষপর্যন্ত নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, নিজেই একটি ধর্ম , নিজেই একটি জীবনাদর্শ হয়ে উঠেছেন– যাকে আর কারও সাথেই তুলনা করার সুযোগ নেই। এমনকি আজকের বিশ্বভারতীতে কিংবা শান্তিনিকেতনেও রবীন্দ্রনাথকে সবখানি পাওয়া যায় না।
রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে অপারগ বিভেদকামী হিংস্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতাগণ; তাঁকে ধারণ করতে অপারগ গোষ্ঠীপ্রেমী ও কূপমণ্ডূক কবিসাহ্যিত্যিক-বুদ্ধিজীবী; তাঁকে ধারণ করতে অপারগ ভোগবাদী লম্পট-ধর্ষক-লুটেরা শিক্ষিত লোকজন; তাঁকে ধারণ করতে অপারগ সাম্রাজ্যবাদী ও উৎকট জাতীয়তাবাদে মাতাল আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কগণ; তাঁকে ধারণ করতে অপরাগ ফাঁপা মনের উপরিকাঠামোচারী মানুষজন। রবীন্দ্রনাথের গান করা বা তাঁর কবিতা আবৃত্তি করা কিংবা ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়ানো অথবা তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করা আর রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা এক জিনিস নয়।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের অবশ্যই আলোচনা ও সমালোচনা করা যায় এবং সেটা শিল্পসাহিত্য দাবিও করে। কিন্তু মনে অগ্রিম বিদ্বেষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছোটো করার চেষ্টা যেমন অযৌক্তিকতায় ভরা রবীন্দ্রবিরোধী অসুন্দর কাজ– তেমনি রবীন্দ্রনাথের বড়ত্বকে উপস্থাপন করতে গিয়ে অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিককে ছোটো করাও রবীন্দ্রচেতনাবৈরী অপকর্ম। রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক ভাবনার আঘাতবিন্দু হলে সেটা হবে চরম আত্মবিরোধী কূপমণ্ডূকতা, রবীন্দ্রনাথকে কেউ সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক দখলদারিত্বের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইলেও তা হবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সহাবস্থানে সক্রিয়ভাবে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের প্রতি সীমাহীন অবিচার। কুয়োর ব্যাঙের মন নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে চাইলে প্রকৃত রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা যাবে না, মাঝখান থেকে বদনাম হবে রবীন্দ্রনাথের; আর অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় রবীন্দ্র-বিরোধিতা জিইয়ে রাখার মধ্যে নিজেকে অনন্য সাহিত্য-সংগীতের সধুারস থেকে বঞ্চিত করা ছাড়া আর কোনো ফল হবে না।
তো রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে কে? বোঝে কারা?

আমিনুল ইসলাম : কবি ও প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব