একজন প্রেমিক ও দার্শনিক কবির কবিতা পাঠ

প্রকাশিত: ১:৫৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ২০, ২০২১

একজন প্রেমিক ও দার্শনিক কবির কবিতা পাঠ

 

নাজনীন খান
১। মধ্যাহ্ন খরায় তবু আসে প্রেম (২০১৪)
প্রচ্ছদ- ময়েজুল ইসলাম
প্রকাশক -বিবকেবার্তা পাবলিকেশন্স, জাপান

২। সূর্যের ঘরের নামতাতে (২০২১)
প্রচ্ছদ- কাব্য কারিম
প্রকাশক -অনুপ্রাণন প্রকাশন

মোহাম্মদ আনওয়ারুল কবীর যিনি একজন কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট। পেশায় কম্পিউটার বিজ্ঞানী। এফবিতেই পরিচিত হওয়া উনার লেখালেখির সাথে।
সম্প্রতি কবির দুটো কাব্য গ্রন্থ (১)’মধ্যাহ্ন খরায় তবু আসে প্রেম’ ( ২০১৪) এবং (২) ‘সূর্যের ঘরের নামতাতে’ ( ২০২১) হাতে পেয়েছি। পড়েছি কবিতাগুলো।
চমৎকার লিখেন। প্রথম বইটি নর-নারীর প্রেমকে উপজীব্য করে লেখা। কবিতাগুলো প্রেম বিষয়ে কবির ব্যক্তিগত বিক্ষিপ্ত ভাবনার প্রতিফলন হলেও এর সার্বজনীনতা পাঠক মনে আচঁড় ফেলবে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই প্রেম আসে। আর মানবজীবনের এই প্রেমানুভূতির বিচিত্র ভাবনা ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ‘মধ্যাহ্ন খরায় তবু আসে প্রেম’। এই কাব্যের নাম কবিতাটি পাঠ করা যাক –
মরা গাঙেও বান আসে
ভাটির টানে শান্ত নদী আচমকা বর্ষার ছোঁয়ায়
হয়ে যায় ঋতুবতী চপলা তরুণী।

নিস্তরঙ্গ নিথর সময়
বিপ্রতীপ কোণে তুমি আর আমি
যাপিত জীবনে মধ্যাহ্ন খরা।

হঠাৎ দমকা হাওয়া-
কড়া নেড়ে যায়
তোমার তানপুরায় আমার সুর।

বাঁধভাঙা জোয়ারের জল
শুনছো কি তুমি…
ভেসে যাবে সমাজ-সংস্কার,নিষেধের তর্জনী।

নারী তুমি হয়ে গেছো উচ্ছল নদী
আমি নামছি জলে….
করব যে এবার জলকেলি।

মধ্যবয়সী প্রেমিকের সাহসী উচ্চারণে মাঝবয়েসী প্রেমিকাও এখানে হয়ে উচ্ছল তরুণী।
মানুষের হৃদয়ের গভীরে শেষটায় তরতাজা রয়ে যায় তার প্রেমাস্পদ। এ ভাবনা থেকেই ‘তরতাজা স্মৃতি’ শিরোনামে কবির উচ্চারণ —
বদলে গ্যাছো তুমি
বড়ই ক্লিশে ইদানিং।

ক্ষয়িষ্ণু আয়ুরেখার অসহায় চোখ
দ্যাখে ঘুণপোকার কারুকাজ
জোনাকি ছড়ায় ম্রিয়মাণ আলো।

তবু তরতাজা স্মৃতি দ্যায় সুখ –
স্বপ্ন নভোযানে বসন্ত বাসর
সলাজ চকিত চাহনি তোমার।

বইটির অন্যান্য কবিতাগুলোও পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে এ প্রতীতি আমার আছে। বইটির কবিতা পাঠে পাঠকের মনে হবে এক প্রেমিক কবিকে যেন পাঠ করছেন তিনি।
কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের, সর্বোত্তম শব্দের, সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে।’ পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু কবিদের দেয়া কবিতার সংজ্ঞার সাথে এই মতের মিল পাওয়া যায়। আমি নিজে একজন কবিতাপ্রেমী বা কবিতা পাঠক হিসেবে মনে করি কবিতা সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন একটা শাখা। সবার দ্বারা কবিতা লেখা সম্ভব না। বইটির কবিতাগুলো পাঠকের মনকে আলোড়িত করবে বলে আমার ধারণা।
কবির দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘সূর্যের ঘরের নামতাতে’ কবি মানুষের যাপিত জীবনের বিভিন্ন বিষয়কে তুলে ধরেছেন কবিতার মাধ্যমে। কবির প্রথম কাব্যের তুলনায় এটি যেন এক কোয়ান্টাম উল্লম্ফন। এখানে প্রেম-ভালোবাসা থেকে শুরু করে জীবন -জিজ্ঞাসা, রাজনীতি সব কিছুই স্থান পেয়েছে। কবির অর্ন্তজগতের দার্শনিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে বইটির প্রতিটি কবিতায়।
শুরুতেই নাম কবিতাটি পাঠ করা যাক–
আখেরে হয়তো কোথাও আর যাওয়া নেই
তবু হেঁটে চলি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
চটুল পায়ের ছাপ পড়ে কি পড়ে না

সুড়ঙ্গের মুখে কেউ কেউ দেখে আলো
আমি তো দেখি না-
সূর্যের ঘরের নামতাতে মেতে আছি

‘বৃত্ত’ কবিতাটি পাঠককে ভাবায়, মনে পড়ে যায় অনিবার্য ভবিতব্যের কথা –
বিন্দু থেকে বৃত্ত
প্রসারিত হচ্ছে ব্যাস ও ব্যসার্ধ
বড় হচ্ছি আমি,বড় হচ্ছি আমি
দখিনা বাতাস বয়ে আনে আনন্দ লহরী

বৃত্ত বড় হতে হতে এখন অনেক বড়
আমি আর কত বড় হবো?

বিবশ সময় উড়ায় বিষন্ন সুর
আয়না দেখায় ভাঙনের পালা
সময় প্রলেপে ভেসে ওঠে বলিরেখা
একে একে নিভেছে দেউটি-
ক্রমশ উধাও হচ্ছে আশীর্বাদকের হাত

আজও প্রসারিত হচ্ছে ব্যাস ও ব্যাসার্ধ
বৃত্ত আর কত বড় হবে?

সমাজ সচেতন কবি দার্শনিক চেতনাতে ঘুণেধরা এ সমাজ পরিবর্তনে বিপ্লবের কথাও ভাবেন। বিপ্লব ছাড়া শুধু সংস্কার করে যে প্রত্যাশিত ফল আসবে না সে বিষয়ে তিনি সচেতন। তাই তিনি প্রগতি ভবন কবিতায় বলে ওঠেন-
বাড়িটা আমার, বেঢপ আকার
দেয়ালে ফাটল, পলেস্তারা খসে পড়েছে
কালের চাবুকে ভিত নড়বড়েও বটে
সংস্কারে সংস্কারে বহুদিন …

কাঠামোটি ভেঙে ফেলা আজ সময়ের দাবি

অনিবার্য ভবিতব্য –
উঁকি মারছে রক্তাক্ত প্রান্তর
ধ্বংসের ভিতেই গড়ে ওঠে প্রগতি ভবন

পরিশেষে একজন পাঠক হিসেবে বলতে পারি দুটো গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই ভালো লাগার মতো। যারা আবৃত্তি করেন বা করতে পছন্দ করেন তাদের জন্য দারুণ সব কবিতা আছে বই দুটোতে। দুটো বইয়েরই প্রচ্ছদ অসাধারণ। প্রচ্ছদ দেখেই একধরণের ভালোরাগা অনুভূতি এসে যায় মনে।
(নাজনীন খান একজন সাহিত্য পাঠক, কাব্যরসিক ও সাহিত্য সমালোচক। বর্তমানে তিনি পেট্রোবাংলার সিলেট গ্যাসফিল্ডে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31