গণজাগরণ মঞ্চ ও যুদ্ধাপরাধ

প্রকাশিত: ১১:২৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩

গণজাগরণ মঞ্চ ও যুদ্ধাপরাধ
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

 

গণজাগরণ মঞ্চ ও যুদ্ধাপরাধ
অসংখ্য দিবসের ভারে ভারাক্রান্ত পৃথিবীতে অনেক অগুরুত্বপূর্ণ দিবসের পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিবসও নীরবে হারিয়ে যায়

 

অসংখ্য দিবসের ভারে ভারাক্রান্ত পৃথিবীতে অনেক অগুরুত্বপূর্ণ দিবসের পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিবসও নীরবে হারিয়ে যায়। যেমন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ নিভৃতে এসে চলেও গেল গণজাগরণ মঞ্চের দশম বর্ষপূর্তি। সত্যি বলতে কি, দিনটির কথা আমি নিজেই বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। মনে করানোর জন্য ছিল না পত্রিকায় কোনো খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটাও নিস্তরঙ্গ। এমনকি যে ফেসবুক প্রতিদিনই এটা সেটা মনে করিয়ে দেয় ছিল না সেই ফেসবুকের পক্ষ থেকেও মেমোরি শেয়ার করার কোনো পরামর্শ।

 

অবশ্য থাকার কথাও নয়। কথায় বলে বাঙালির গোল্ডফিশ মেমোরি। গোল্ডফিশ যেমন দুই সেকেন্ড আগে কোথায় ছিল ভুলে গিয়ে ঘুরে ঘুরে অ্যাকুরিয়ামের ওই একই জায়গায় আসা-যাওয়া করতে থাকে, বাঙালির ইতিহাসবিমুখতা ঠিক তেমনই পীড়াদায়ক। আর তারচেয়েও বেশি পীড়াদায়ক বাঙালির ইতিহাসবিস্মৃতিপরায়ণতা। এ নিয়ে অন্য একদিন লেখা যেতেই পারে। কাজেই বাংলা মিডিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চ থাকার চেয়ে না থাকাটাই যেমন স্বাভাবিক, তেমনি স্বাভাবিক আমার বাঙালি মগজ থেকে গণজাগরণ মঞ্চের দশম বর্ষপূর্তি ডিলিট হয়ে যাওয়াটাও।

 

দিনটির কথা প্রথম মনে করিয়ে দিল গণজাগরণ মঞ্চেরই একজন ছোট ভাই। সন্ধ্যায় অধুনালুপ্ত প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের কিছু সংগঠক আয়োজন করেছেন মশাল মিছিলের। সেই কার্যক্রমে যোগ দিতে এসে সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের নবনির্মিত সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালের লিভার আউটডোরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ওর মুখেই সারাদিনে প্রথমবারের মতো শুনলাম দিবসটির কথা। শোনার পর থেকে বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ফেসবুক কেন মনে করিয়ে দিল না! পরে মনে পড়ল গণজাগরণ মঞ্চের শুরুর দিনটিতে নুজহাত চৌধুরী আর আমি ছিলাম দেশের বাইরে।

 

দুদিন পর দেশে ফিরেই বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে গিয়েছিলাম প্রজন্ম চত্বরে। সে কারণেই ফেসবুকের এআই আমাকে দিনটির কথা মনে করিয়ে দিতে বেমালুম ভুলে বসে আছে। রাতে ভার্চুয়াল সম্প্রীতি সংলাপের আলোচনার বিষয়বস্তুও গণজাগরণ মঞ্চ। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সেদিনের এই নিয়মিত সাপ্তাহিক ভার্চুয়াল আয়োজনে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছিলেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা। সেই তালিকায় যেমন ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ, তেমনি ছিলেন নামজাদা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আর অন্য আরেকটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের হালের ভিসি মহোদয়ও।

 

এতসব রথি-মহারথির ভিড়ে সংগঠনটির সদস্য সচিব হিসেবে স্বাগত বক্তব্যটা দিয়ে, ক্যামেরাটা বন্ধ করে চেম্বারে রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম কে কি বলছেন। চোখটা হঠাৎই আটকে গেল চেম্বারের দেওয়ালে ঝোলানো টিভি স্ক্রিনের পর্দায়।

 

আমার চেম্বারে দুপাশে দুটো টিভি সচল থাকে, তবে দুটোরই সাউন্ড থাকে অফ। তার বদলে স্পিকারে লো ভলিউমে বেজে চলে রবিন্দ্রসংগীত আর আমি ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে স্ক্রলে দেখে নেই রাশিয়া-ইউক্রেন আর দেশের ভেতরকার সর্বশেষ। এবার অবশ্য চোখটা আটকে গেল কোনো স্ক্রলে নয়, টিভির পর্দায় পাকিস্তানের আকর্ষণীয়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছবিটাই চোখটাকে টিভির স্ক্রীনে টেনে নিয়ে গেল। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে পাকিস্তানের এই প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎ ঘটে। সেই সাক্ষাতের বয়ান করছেন মন্ত্রী মহোদয় মন্ত্রণালয়ের দুয়ারে হাজির সংবাদমাধ্যমের সহকর্মীদের সামনে।

 

যার শানে নজুল এই যে, পাকিস্তানি এই প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রস্তাব দিলে মন্ত্রী মহোদয় একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনাকে পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন। সঙ্গে তিনি তার পাকিস্তানি কাউন্টারপার্টকে এও বলে এসেছেন যে, পাকিস্তান ক্ষমা চাইলে তিনি বিবেচনা করতে সম্মত আছেন। মন্ত্রী মহোদয় তার স্বভাবসুলভ হাসি হাসি ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমার কাছে শুনে মনে হচ্ছিল এদেশের ত্রিশ লাখ শহীদ আর তিন লাখ বীরাঙ্গনার প্রতি এর চাইতে বড় উপহাস বোধ করি আর কিছু হতে পারে না।

 

যতদূর বুঝি, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীকে দুতিয়ালির দায়িত্ব দিয়েছেন, বিবেচনায় নয়। ক্ষমা চাওয়া তো পরের বিষয়, আগে তো বিচার। পাকিস্তান ক্ষমা চাইলেই তাদের একাত্তরের সব মানবতাবিরোধী অপকর্ম ধুয়ে-মুছে যাবে এমন সরল সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক কোনো ব্যক্তি কিভাবে হন? দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জাপান দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে অনুশোচনা করেছে এই সেদিন। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী জাপানি সেনা সদস্যদের তো ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে সেই কবে।

 

যদি ধর্মের কথাও বলেন, ধর্মেও তো হত্যাকারীকে ক্ষমা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র ভিক্টিমের পরিবারকে, কোনো ব্যক্তিকে নয়। তাছাড়াও এখনো মীমাংসার অপেক্ষায় পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের প্রাপ্য হাজার হাজার কোটি টাকার বিষয়টি, যা তারা এদেশে চব্বিশ বছর দখলদারিত্বের সুযোগে লুটে নিয়ে গিয়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্সে নাকে খত দিয়ে দিনে-দুপুরে আত্মসমর্পণের পর নব্বই হাজারেরও বেশি আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতে। সিমলা চুক্তিতে পাকিস্তান লিখিত অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা তাদের একশ’ পঁচানব্বইজন যুদ্ধাপরাধী সেনা সদস্যের বিচার পাকিস্তানের মাটিতেই করবে।

 

পাকিস্তানি বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। তবে ইবলিশের কাছে যা প্রত্যাশিত কার্যত হয়েছেও তাই। পাকিস্তান তার কথা রাখেনি। এসব চিহ্নিত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ পাকিস্তানের কোনো সরকারই নেয়নি। এমনকি হিনা রব্বানী খারের সরকারও নয়। ঠিক যেমন পাকিস্তান সরে এসেছে এদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থেকেও, যাদের আমরা চিনি ‘বিহারী’ হিসেবে।

 

মন্ত্রীর বয়ানে আমরা এও জেনেছি যে, হিনা রব্বানী খার তাকে জানিয়েছেন পাকিস্তান এক সময় ভারতের মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে যে পলিসি গ্রহণ করেছিল সেই একই পলিসি তারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও গ্রহণ করতে আগ্রহী। পাকিস্তানের সেই পলিসিটি হচ্ছে- ‘ফরগেট দ্য পাস্ট এন্ড লুক ফরওয়ার্ড’। তবে ভারত আর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের অতীতটা তুলনীয় নয়।

 

পাকিস্তানিদের হাতে ত্রিশ লাখ ভারতীয় শহীদের রক্তে যেমন রঞ্জিত হয়নি ভারতের মাটি, তেমনি পাকিস্তানিরা সুযোগ পায়নি তিন লাখ ভারতীয় মাকে সম্ভ্রমহানির, যে অপরাধগুলো তারা সংঘটিত করেছিল একাত্তরে বাংলাদেশে। কাজেই ভারত হয়ত পাকিস্তানকে সামনে তাকানোর একটা সুযোগ দিলেও দিতে পারে। কিন্তু তেমনটি করার অধিকার আমাদের দেয়নি লাখো শহীদ আর মা-বোন।

 

নিজেও বিশ^াস করি যে, প্রধানমন্ত্রী নিজে মানবতাবিরোধী অপরাধের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী, ১৫ আগস্টের রাতে যিনি হারিয়েছেন তার পুরো পরিবারকে, যিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন, তিনি কখনোই পাকিস্তানের মতো একটি ঘৃণিত অপরাধী রাষ্ট্রকে বিনা বিচারে ক্ষমা করে দিতে পারেন না। সাম্প্রতিক সময়েই আমরা দেখেছি কিভাবে আগুন সন্ত্রাস আর ঢালাও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মোকাবিলা করে তিনি আইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। প্রচলিত আইনে বিচার করেছেন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের।

 

ছাড়াও আজ থেকে দশ বছর আগে গণজাগরণ মঞ্চেই তো এদেশের মানুষ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি একবিন্দুও ছাড় নয়। জনতার সরকারও জনতার সেই প্রত্যাশা পূরণে আইন সংশোধনে ন্যূনতম দ্বিধা করেনি। কাজেই ধরে নিতেই পারি যে, পাকিস্তানি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের কথোপকথনে যে বিষয়বস্তুর অবতারণা হয়েছে তা একান্তই তার নিজস্ব মতামত, সরকারের নয়।

 

বৈবাহিক কারণে শহীদ পরিবারগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেশবরেণ্য শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকের মেধাবী সন্তানকে সিএনজি চালিয়ে সংসারের চাকা ঘুরাতে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে পাকিস্তানি মেজরের বন্দুকের বাঁটের আঘাতে আহত আমার পিতাকে দেখেছি তার জীবনের শেষ কটি বছর কোমড়ের ব্যথায় রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে পার করতে। কারণ, শেষের দিকে কিডনিরও সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাকে ব্যথার ওষুধগুলোও আর দেওয়া যেত না। কাজেই সাফ কথা, একবিন্দু ছাড় নয়।

 

লেখক : ডিভিশন প্রধান

ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও

সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

লাইভ রেডিও

Calendar

May 2024
S M T W T F S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031