তারার নাম ধ্রুবতারা

প্রকাশিত: ১২:৫২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৫, ২০২১

তারার নাম ধ্রুবতারা

 

মিলি হক
অপরাহ্ণের রোদে বিবর্ণ পাতা ঝরে পড়েছে। রাধাচূড়া বা কৃষ্ণচূড়ায় তেমন ফুল আসেনি। গ্রিল ধরে প্রতিদিন একই দৃশ্য। চিলেরা বুঝি ক্লান্ত সুনসান নিরবতা।
অলকানন্দা গাছে পানি দিলাম ‌টেলিফোনের ক্রিংক্রিং শব্দে ছুটে গেলাম‌। এই একটা যন্ত্রের শব্দ সচল রেখেছে। তাছাড়া কেউ কলিং বেল দেয়না।
হকার পেপার দেয় না। দুধওয়ালা দুধ দিতে আসে না।
ডিস কারেন্ট বিল কয়েক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
প্রতিবেশীর জানালায় কারো মুখ দেখা যায় না।
দরজা খোলা পেলে পাশের ফ্ল্যাটের ছোট নাতি হাঁটি হাঁটি করে চলে আসতো হাত বাড়িয়ে খেলনা দিত।
ফোনের ও প্রান্ত থেকে দোলার কণ্ঠস্বর
” খালা শুনেছেন বোধহয় মামি সি এম এইচে ভর্তি আছে। অসুস্থ বুকে ব্যথা ছিল গ্যাস হতে পারে চিন্তা করতে না করেছেন।”
মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠেছি।
উঠেছি বলব কেন মৃত্যুর খবর পেয়ে যেতে পারিনি।
নানীর মৃত্যুর খবর শুনে বোনের দুই ছেলে বাইক ভাড়া করে মাওয়া হয়ে নানী বাড়িতে গেছে।
রাত দশটা পর্যন্ত লাশ রাখবে।
পাঠাও এম্বুলেন্স তারা কেউ যেতে রাজি হয়নি পার্মিশন পাবে না তাই।
মাকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবি না।
চতুর্দিকে মৃত্যুর খবর‌। মায়ের বয়স হয়েছিল তিনিতো মৃত্যুর কাছে সমর্পিত ছিলেন।
মাকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই নাহিদ এসে যায়।
নাহিদ আমার ছোটবেলার বন্ধু একই স্কুলে একই খেলার মাঠে খেলে বড় হয়েছি।
এমনকি পুতুল খেলায় ও সে আমাদের সঙ্গী ছিল।
ইন্টার পাশ করার পর ও রাজশাহীতে পড়তে গেল আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ছুটিতে বাড়ি আসলেই আমার খোঁজে চলে আসতো।
একবার রাজশাহী ভার্সিটিতে যেতে বললো।
মন্নুজান হোস্টেলে ওর সহপাঠীর সাথে থাকলাম।
সন্ধ্যার পর পদ্মার পাড় ধরে হাঁটলাম।
কাঠ জুঁই এর বেদিতে বসে কত গল্প বলতো।
পাস করেই বিয়ের কাজ সেরে নিবে।
প্যারিস রোডের উঁচু উঁচু গাছের ফাঁকে সূর্যের আলো এসে পড়তো।
বলতো মা তোমাকে খোকার মা বলে ডাকবে লজ্জা পাবে না।
আমি মায়ের এক ছেলে । মায়ের খুব ইচ্ছা বিয়ের পর আমি ছেলের বাবা হই।
এতো আগাম স্বপ্ন।
আমার বিয়ের জন্য কোন তাড়া নেই।
মাকে বললাম মা নাহিদ বিয়ে করতে চায়।
মা বললেন তুমি জেনেশুনে কাউকে ঠকাতে চাও।
একথা কেন মা?
নাহিদ সারাজীবন বলেছে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না।
ঠকানোর প্রশ্ন কেন?
মা বললেন আগে তোমার ডাক্তারি পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। তুমি হয়তো জানো না জীবনে তুমি মা হতে পারবেনা।
তুমি যখন ইন্টার পড়ো পি জি হাসপাতালের তোমার টেস্ট করিয়ে ছিলাম।
অন্য কোন মেয়ে হলে ভেঙে পড়তো ।
আমি ভয় পাইনি। মা হব না তাতে কি নাহিদ তো আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।
তবে বিয়ের আগে আমি সব নাহিদকে বলবো তার কাছে কিছু গোপন করবো না।
নাহিদ সব শুনলো , ডাক্তারি টেস্ট করতে দিল ।
যেদিন রিপোর্ট দিবে আমি ওকে রিপোর্ট আনতে বললাম।
না নাহিদ আর আমার সাথে দেখা করিনি কোনদিন কোন শব্দ পর্যন্ত করেনি।
একবার আমার কর্মক্ষেত্র কলেজে এসেছিল ভিজিটর
হয়ে। এক কলিগ বলেছিল এক্স হাজবেন্ড নাকি?
শুনেছি নাহিদ বিয়ে করেছে ছেলের বাবা হয়েছে।
আমি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি প্রতিবেশীরা তেমন কেউ আসেন না। আমার সম্পর্কে কার কেমন কিউরিসিটি জানিনা।
করোনার এই লকডাউনে আমার তেমন আলাদা অনুভূতি হয় না।
আমার আগেও যেমন এখনো তেমন নিঃসঙ্গতা।
আমি উপভোগ করি কবিতা পড়ি গল্প লিখি।
তবে করোনা আক্রান্ত বিশ্বের খবরে মনে হয় এ পৃথিবী ধ্বংস হবে।
নুহ আলাই সাল্লাম এর সময়ের মত কিস্তিতে ভাসবে কয়েকজন। শুধু বাঁচবে যারা তাদের জন্য অন্য এক পৃথিবী হবে।
ডাইনোসরের বিলুপ্ত হয়েছে । প্লেগ স্প্যানিশ ফ্লু কত কি হয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো পরিবর্তন মেনে নিতে হবে।
তিন দিন আগে কলটা এসেছিলো।
আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছে জানতে ইচ্ছা হয়নি।
নাহিদ কোন হসপিটালে আছে কেবিন নাম্বার জানিয়ে বললো করোনা আক্রান্ত একবার দেখতে চায়।
প্যারিস রোড এ হাঁটার সময় বলতো তুমি আমার অক্সিজেন।
তুমি আমার ধ্রুবতারা তোমার দিকে তাকিয়ে আমি সারা জীবন বাঁচবো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অপরাহ্ণের হলুদ আলো নিভে গেছে। পাখির ওড়াউড়ি নেই।
মেট্রোরেলের নির্মাণ বন্ধ কোলাহল হাঁকডাক নেই।
আকাশ স্বচ্ছ নীল।
আকাশে একটা তারা উঠেছে
ধ্রুবতারা।