প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প

প্রকাশিত: ১:১৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ৫, ২০২০

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প


তিশা মণ্ডল

শিখা রাণী দাস বয়স চল্লিশ ঊর্ধ্ব। গ্রামে বাস করা হত দরিদ্র শিখা রাণী জীবন সংগ্রামে কিভাবে সফল হয়েছেন তার কিছু দিক আলোকপাত করা হলো। জীবন সম্পর্কে বুঝে ওঠার পূর্বেই বিয়ে হয়েছে তার। সারাদিন সংসারের কাজ এবং সেই সাথে সন্তানের লালন-পালনও করতে হতো তাকে একাই। প্রতিদিন শুশুর বাড়ির নানা অত্যাচার সহ্য করতে হতো। বিশ্রাম ও ঘুমের সুযোগ কম ছিল আর চিত্তবিনোদনের সুযোগ পাওয়াটা ছিল কল্পনার বাইরে। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অন্য কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। সন্তানদের মানুষ করা, অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করার জন্য টাকা কোথায় পাবে এ চিন্তায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। বাবার বাড়িতে এসে শুরু হয় অর্থ উপার্জনের সংগ্রাম। কোনো কোনো দিন তাদের না খেয়ে থাকতে হতো। অন্যের বাড়িতে গৃহস্থলির কাজ করে সন্তানদের লালন-পালন করেন।

বেশ কিছু দিন পর আত্মীয়ের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ-১ আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প সম্পর্কে। গ্রামের উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে প্রকল্পের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পান এবং প্রকল্পের আওতায় গঠিত সমিতির সদস্য হন। প্রতি মাসে অনেক কষ্টে ২০০ টাকা করে সঞ্চয় করেন। ৬ মাস পর উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে সমিতির সকল সদস্যের সর্বসম্মতিক্রমে ক্ষুদ্রাকারে খামার করার জন্য প্রথমে তিনি ১০ হাজার টাকা ঋণ পান। সেখান থেকেই তার উন্নয়নের যাত্রা শুরু। নিজের কষ্টার্জিত জমানো টাকা আর গৃহিত ঋণের টাকা একত্রে বাবার বাড়িতে প্রাথমিক অবস্থায় ছোট পরিসরে ছাগল ও হাঁস-মুরগির খামার করার চিন্তা করেন। প্রথম দিক দিয়ে ঋণ পরিশোধের সমস্যার সণ হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাকে আর অন্যের বাড়িতে গৃহস্থলির কাজের জন্য যেতে হয়নি।

খামার শুরু করার পর থেকে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হাঁস-মুরগির ডিম, ছাগলের বাচ্চা বিক্রয় করে তার ঋণের কিস্তি পরিশোধসহ বাড়তি আয় দিয়ে অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ, ছেলেমেয়ের পড়াশুনা খরচ ও সংসার খরচ মিটেছে। দুই বছর পর দ্বিতীয় ধাপে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খামারের আয়তন বৃদ্ধি করেন। ইতোমধ্যে অর্ধডজন ছাগল বিক্রি করেন এবং বর্তমানে তার খামারে বাচ্চাসহ এখন ১২টি ছাগল, ৯৫টি হাঁস-মুরগি রয়েছে। এখন প্রতিদিন তার খামারে গড়ে ৮৫টি ডিম সরবারহ হয় এবং এতে তার প্রতিদিন আয় হচ্ছে প্রায় ৭৫০ টাকা। ডিম বিক্রয় করে যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি আয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর সংসারে এখন আর অভাব নেই। শিখা রাণী দাস সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখছে ও বসবাসের জন্য পাকা বাড়ি তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যা এক সময় তার কাছে অকল্পনীয় ছিল। টাকার জন্য এখন আর চিন্তা করতে হয় না তাকে। তিনি এখন স্বাবলম্বী। শিখা রাণী দাস এর মতো অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেশে সর্বত্র বিরাজ করছে।

নিজস্ব জমিতে বসবাস করে জীবনের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার আশা থাকে প্রতিটি মানুষের। কিন্তু সমাজে বিভিন্ন মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। কেউ কাজের অভাবে আয় না থাকায় নূন্যতম মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারে না, আবার কেউ পুঁজির অভাবে চাষাবাদসহ কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগ করতে পারে না। ফলে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণতো দূরের কথা, নিয়মিত খাবারের সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হয়। এ সুযোগে স্বার্থনেশি অনেক এনজিও সহযোগিতার নামে সাধারণ মানুষদের উচ্চ সুদে ঋণের ফাঁদে ফেলে। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যথ হলে দেনার দায়ে বসতবাড়ি ও ভিটামাটিসহ বিক্রি করতে হতো। এককথায় এতে দরিদ্র মানুষগুলো আরো দরিদ্র এবং ভূমিহীনরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েতো। এসব দ্ররিদ্র মানুষদের আত্মনির্ভরশীলভাবে সক্ষম করে দারিদ্র্য নিরসন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে, চাষাবাদসহ অন্যান্য আয় বৃদ্ধি করে তাদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান, জীবিকায়ন ও সামাজিক আত্মমর্যাদার সমৃদ্ধি ঘটানোই আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য।

উন্নয়নের মডেল হিসেবে যে সব প্রকল্প আজ প্রশংসিত তা যেন অব্যাহত থাকে সেটা আমাদের সবারই একান্ত কাম্য। তথাপিও কোনো প্রকল্প যেহেতু চিরস্থায়ী নয় সেক্ষেত্রে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটির মেয়াদও এক সময় শেষ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সমিতির সদস্যেদের দুচিন্তার কোনো কারণ নেই। এ প্রকল্পের আওতায় গঠিত হয়েছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। সমিতির সদস্যেদের যে তহবিল গঠিত হয়েছে তা স্থায়ী লেনদেন করার জন্য দেশের প্রত্যেক উপজেলায় এ ব্যাংক গঠিত হয়েছে। এ ব্যাংক থেকে প্রত্যেক সদস্য ১০০ টাকা মূল্যমানের শেয়ার ক্রয় করে ব্যাংকের অর্জিত লাভ অনুসারে লভ্যাংশের অর্থ নিজস্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক সদস্যগণ যে কোনো সময় উত্তোলন করতে পারবেন। পুকুরে মাছ, গবাদিপশু পালনসহ বাড়ির আঙিনায় শাকসবজির আবাদ করে একজন কৃষক যখন নিজের যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে দু’পয়সা আয়ের পথ দেখে তখন সে নিজের উদ্যোগে কাজে আত্মনিয়োগ করে। প্রয়োজন শুধু তাকে পথ দেখানো, বাকি দায়িত্ব সে নিজের সুবিধার কথা বিবেচনা করে নিজেই কাঁধে নিতে সক্ষম।

সরকার রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আমার বাড়ি আমার খামার’ (একটি বাড়ি একটি খামার) প্রকল্প গ্রহণ করে। সারাদেশে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। সহযোগী হিসেবে রয়েছে সরকারের আরো বেশ কিছু সংস্থা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণাধীন এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। আর এ প্রকল্পের সমন্বয় করছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা যায়, দেশের ৮বিভাগ ৬৪টি জেলায় এবং ৪৯০টি উপজেলাতে ৪৫৫০টি ইউনিয়নে ৪০৯৫০টি ওয়ার্ডে এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের ওয়েব সাইডে প্রকাশিত তথ্যেরভিত্তিতে ২৮ মে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের আওতায় সমিতি গঠন হয়েছে ০১ লক্ষ ১৭ হাজার ২০৪টি, উপকারভোগী সদস্য পরিবার ৫১ লক্ষ ২৭ হাজার, সদস্য সঞ্চয় ১৮৬৭ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা। সরকার প্রদত্ত বোনাস ১৬১৯ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা, ঘূর্ণায়মান তহবিল ২৮৩৩ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা, মোট ঋণ গ্রহণকারী উপকারভোগী সংখ্যা ৪১ লক্ষ ১৫ হাজার জন, মোট ঋণ বিতরণ ৯৮৭৫ কোটি ০৮ লক্ষ টাকা, প্রকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়বর্ধক খামারের সংখ্যা ২৩ লক্ষ ৯১ হাজারটি, মোট তহবিল-৬৫৬১কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা।

বর্তমান সরকার ১৯৯৬ এ সরকার গঠনের পর যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে তখন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয় তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন ২০০৯ সালে । আজ দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে দিন বদলের সনদ হিসেবে দেশের মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিতকরণ, সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান, সদস্য সঞ্চয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ বোনাস প্রদান, সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছাশক্তিকে বাস্তবে পরিণতকরণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পুঁজি গঠনে সহায়তা প্রদান, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার কার্যক্রমসহ বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

প্রকল্পের কার্যক্রমে এমনভাবে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে যাতে দরিদ্র মানুষগুলো নিজেই তার প্রয়োজনকে তুলে ধরতে পারে। এখানে দরিদ্র কৃষক নিজস্ব সক্ষমতা যাচাই করে তার চাহিদা অনুযায়ি এবং পছন্দ মাফিক কৃষিভিত্তিক যে-কেনো কাজে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবে। এ প্রকল্পে ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে সরকারের তরফ থেকে দ্বিতীয় ধাপে দেড় লক্ষ টাকা প্রতি বছর গ্রাম উন্নয়ন সংস্থাকে দেওয়া হয়। সদস্যদের নিজস্ব তহবিলে বোনাস হিসেবে আত্মীকরণ হয়ে থাকে। প্রত্যেক গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা (ভিডিও) এর চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সমিতির ৬০ জন সদস্যের পাঁচজনকে পাঁচটা প্রদর্শনী খামার গড়ে তোলার জন্য কৃষি, নার্সারি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগির খামার এবং গবাদি পশুপালন এ পাঁচটি ক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারই ভিত্তিতে অন্যান্য সদস্যরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কাছ থেকে একইভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়ে উঠে।

বাংলাদেশে দরিদ্রের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান সরকারের গত দশ বছরে গৃহিত ও বাস্তবায়িত নানা উদ্যোগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত থাকায় দারিদ্র্যবিমোচন ঘটেছে দ্রুত। দারিদ্রবিমোচনে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ একক প্রকল্প। দরিদ্র নিরসন একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলেও তা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়া প্রধানতম কাজ সরকারের। সেক্ষেত্রে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটি আমাদেরকে উপহার দেবে দ্রারিদ্র্যমুক্ত একটি সোনার বাংলাদেশ। মুজিব জন্মশতবর্ষে সে প্রত্যাশা হোক আমাদের সকলের।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31