বঙ্গবন্ধু তুমিই বাংলাদেশ, তুমিই আমাদের পরিচয় : আব্দুল কুদ্দুস

প্রকাশিত: ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২১

বঙ্গবন্ধু তুমিই বাংলাদেশ, তুমিই আমাদের পরিচয় :  আব্দুল কুদ্দুস

বাংলাদেশের জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নৃশংসভাবে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। তখন আমার দুই বছর   বয়স মাত্র। নাটোরের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জাতীয় সংসদের সাতবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস মুজিব হত্যাকান্ডের পর ছিলেন কারাগারে। হত্যাকান্ডের দুদিন পরেই তাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ৪ বছর ১১মাস ১৭ দিন জেল খেটেছেন সেসময়। কারাগার থেকে কারাগারে ঘুরতে হয়েছে তাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হায়েনারা শুধু হত্যা করেই বসে থাকেনি তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তালিকা তৈরী করে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের জেলে পাঠিয়েছিল, হত্যা করেছিল। নির্যাতন চালিয়েছিল পাশবিকভাবে। সেই ইতিহাস আমাদের জাতির সামনে কোনদিনও তুলে ধরা হয়নি। অপ্রকাশিতই থেকে গিয়েছে সেই সব অন্ধকার দিন-রাতের ঘটনাগুলো। কালের বিবর্তনে হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে এইসব ইতিহাস ও আত্মত্যাগের কথা। শৈশব-কৈশরে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনেছিলাম, সাদা কাগজ পেয়ে কাঠ পেন্সিল দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আকাঁআকিঁ করেছিলাম। যৌবনে যখন রংপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা বাড়ালাম তখন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ইত্তেফাক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছি। হৃদয়ে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসে হাজির হয়েছে।
ইত্তেফাক পত্রিকার বার্তা কক্ষে মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধুর ছবি অনেক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নিরব সাক্ষী হয়েছিল। যখন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের অনুসন্ধানে বের হয়েছিলাম, তখন অনেক অজানা ইতিহাস আর ঘটনার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম আমি। আমার রেকর্ডারে একের পর এক রেকর্ড হতে থাকলো বঙ্গবন্ধুর অনেক ঘনিষ্ঠ নেতাদের রাজনৈতিক জীবনের অনেক অজানা কথা। মুজিব শতবর্ষে আবার বের হয়েছি বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীদের-সহযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাগুলো রেকর্ড করতে। সেই পর্বে যুক্ত হয়েছে আজ আব্দুল কুদ্দুস। আমার সাথে আব্দুল কুদ্দুসের যোগাযোগ হলো জাতীয় সংসদের ন্যাম ভবনে। মার্চের এক বিকেলে তাঁর সাথে এই সাক্ষাৎ প্রথম সাক্ষাৎ নয়। ইতিপূর্বেও অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কিন্তু এবার দেখা হলো বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে মুজিব শতবর্ষে কথা বলার জন্য। অনেক পুরোনো পরিচয় ছিল তৃণমূল এই নেতার সাথে। সম্পর্কের সেই ডালপালাও অনেক বিস্তৃত। প্রায় এক যুগ পূর্বে পরিচয়। কখনো কখনো টেলিফোনে কথা হয়। টেলিফোনে তিনি সব সময় আমাকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি জানাতেন। অত্যন্ত মার্জিত স্বভাবের মানুষ। পেশাজীবনে অধ্যাপনা করেছেন। চরিত্রের একদিকে প্রচন্ড কঠোরতা আর অন্যদিকে শিশুর মতো কোমলতা মিলে যতবার তার কাছাকাছি পৌঁছার সুযোগ আমার হয়েছিল ততবার যেনো আমি জাতির জনকের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছি তার মাঝে। ষাটের দশক থেকে রাজনীতি করেও অর্থ বৈভবের পিছনে ছুটতে দেখা যায়নি তাকে। ঢাকা শহরে নেই তার নিজস্ব বাড়ি। তার সাথে আমি প্রাণখুলে কথা বলতে পেরেছিলাম। একদিন বলেছিলাম সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় একটি বাড়ী করছেন না আপনি। তিনি যেনো সেই কথা শুনেননি এমন একটি ভাব করলেন। যতবার তার বাসভবনে গিয়েছি আমাকে অনেক  স্নেহ করে আপ্যায়ন করেছেন। নাটোরের কাঁচাগোল্লা, ¯œাকস, কফি আগে খেতে হয়েছে। তারপর তিনি কথা বলতেন। খুব স্পষ্টবাদী ও ইতিহাসের খুঁটিনাটি প্রসঙ্গে বেশ সচেতন স্বভাবের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুল কুদ্দুস ষাট দশকের রাজনীতিতে অনেক ইতিহাসের নিরব সাক্ষী। গণমাধ্যমে নিজেকে খুব প্রচার করতে তার দ্বিধার শেষ ছিল না। প্রচার বিমুখ মানুষ। কিন্তু যতবার তাকে টেলিফোন করেছি এক যুগে বারবার তিনি আমাকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর নিয়ে আমি ধানমন্ডিতে আমার বাড়ী ফিরেছি। পত্র-পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব প্রকাশিত হয়েছে। মুজিব শতবর্ষে ‘বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত এক ইতিহাসের প্রচ্ছদ’ গ্রন্থের জন্য বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কালের সাক্ষী আব্দুল কুদ্দুস আমাকে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর বাসভবনে। আমি যখন টেলিফোন করেছিলাম সেসময় তিনি ছিলেন নাটোরে এবং কিছুদিন পর ঢাকায় এলেন যখন আমি পূর্ব নির্ধারিত সময়ে তার বাসভবনে উপস্থিত হয়েছিলাম। ‘মুজিব শতবর্ষে’ আব্দুল কুদ্দুসের দেয়া সাক্ষাৎকারটি এখানে প্রকাশ করা হলো। উল্লেখ্য ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আব্দুল কুদ্দুসের প্রথম দেখা হয়েছিল। আজ থেকে ৫৭ বছর আগের দিনগুলো কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে নিরবে নিভৃতে বাংলাদেশের ইতিহাসে।

 

লুৎফুল্লাহ হীল মুনীর চৌধুরীঃ আমাদের সৌভাগ্য আমরা বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত এক ইতিহাসের প্রচ্ছদ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জীবন যাত্রায় আপনার সাথে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ কখন ঘটেছিল এবং এই সম্পর্কে কতটুকু বিস্তার লাভ করেছিল?

 

আব্দুল কুদ্দুসঃ ধন্যবাদ আপনাকে। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে যার নেতৃত্বে তিনি মহাকালের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নাম শুনেছিলাম স্কুল জীবনে। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। তিনি সেসময় বঙ্গবন্ধু খেতাবে জনসমাজে পরিচিত ছিলেন না। বাংলার প্রান্তিক মানুষের কাছে তিনি তখন শেখ সাহেব নামে পরিচিত। সেসময় আমাদের রাজনৈতিক প্রভাবও বিকশিত হয়নি। আমাদের গন্ডি বিদ্যালয়ের চত্বরেই সীমাবদ্ধ ছিল তখন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল’ল জারি করলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সেসময় আমিও মিছিলে গেলাম। মিছিল শেষে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য মাইকে আমার চিন্তাজগতে-নানাভাবে আলোড়ন ঘটিয়েছে। বক্তারা বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান জনগণের মুক্তির দাবিতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে চলেছন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে জেল খেটেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন প্রদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছিল। মেট্রিক পরীক্ষার পর রাজশাহী কলেজে আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। সেসময় উপমহাদেশে রাজশাহী কলেজের যথেষ্ট সুনাম ছিল। উপমহাদেশের দ্বিতীয় কলেজ ছিল রাজশাহী কলেজ। ইংরেজ শাসক গোষ্ঠি প্রথমে প্রতিষ্ঠা করেছিল কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ। এরপর তারা রাজশাহী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। তৃতীয় কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো দিল্লী কলেজ এবং চতুর্থ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো ঢাকা কলেজ। ১৯৬৩ সালে আমি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ঠিক তার পূর্বের বছরেই পাকিস্তান সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করার পর পরই পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। তখন সেই আন্দোলনের সাথে আমরা যুক্ত হয়ে পরেছিলাম। আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত করেছিল। জিন্নাহ-লিয়াকত-নাজিমুদ্দিনরা পাকিস্তানে যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল সেই কাজটি আইয়ুব-মোনায়েম-সবুর-ফজলুল কাদের চৌধুরীরা করার চেষ্টা চালাতে যায়। তারা বাংলা অক্ষরকে আরবী হরফের রূপ দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই কর্মকান্ডকে সফল করার জন্যই শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজে আন্দোলন শুরু হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে অনেক প্রাণহানীর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সরকার কমিশন বাতিল করে। ১৯৬৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান রাজশাহীর এক জনসভায় এসেছিলেন। আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ) গঠন করেছিল। এনএসএফের নেতৃত্বের অধিকাংশ কর্মীই ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এই দুটো সংগঠন। তবে আমরা হাতেগোনা দশ বিশ জন ছাত্র ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েছিলাম তখন। রাজশাহীর জনসভার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমানকে রাজশাহী কলেজে একটি সংক্ষিপ্ত পথসভায় বক্তব্য প্রদানের জন্য ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম রাজশাহী কলেজের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে আরও উজ্জীবিত হতে পারে যেনো। রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে টেনিস গ্রাউন্ডে আমিসহ দশ বারোজন ছাত্রলীগের কর্মীরা জড়ো হয়েছিলাম। আমার বন্ধু নুরুল হোসেন ঠান্ডু এসময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি দেশ স্বাধীন হবার পর রাকসু’র ভিপি ছিলেন। তিনি আজ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। পুলিশের এডিশনাল আইজি নুরুল আলম সাহেবও সেখানে ছিলেন। তাঁর বাড়ী ছিল চট্টগ্রাম। বাংলার বাণীর ফকির (সহ সম্পাদক) আব্দুর রাজ্জাক, নাজমা শামীম লাইজু ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টের সংরক্ষিত আসনের সদস্য ছিলেন, আনোয়ার ভাই সেখানে উপস্থিত ছিল সেদিন। আমরা প্রত্যেকেই ছাত্র ছিলাম। এসময় এনএসএফের হাসান জাফর ইমামের নেতৃত্বে সোবহানের নির্দেশে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। তারা চেয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান রাজশাহী কলেজে যাতে কোন বক্তব্য দিতে না পারে। তারা আমাকে ও নুরুল হোসেন ঠান্ডুকে টেনিস গ্রাউন্ডে ফেলে দিয়ে ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমান রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যালয়টি ডাকবাংলো ছিল তখন। বঙ্গবন্ধুকে ডাকবাংলো দেয়া হলোনা সেদিন। আমার মাথায় ২৯টি সেলাই দিতে হয়েছিল। নুরুল হোসেন ঠান্ডুরও একই অবস্থা হয়েছিল। আমরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে জনসভায় উপস্থিত হলাম। বঙ্গবন্ধুকে মাদ্রাসা ময়দানে জনসভার অনুমতি দেয়া হয়নি। জনসভায় মাওলানা তর্কবাকিশ উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান এসময় সাধারণ সম্পাদক। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এসময় মোঃ কামরুজ্জামান সাহেব। এই সভার সভাপতিত্ব করেছেন মোঃ কামরুজ্জামান সাহেব। মুসলিম লীগের আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে এনএসএফের কর্মীরা আবার জনসভায় হামলা চালায়। সেসময় ডিএম ছিলেন পিয়ার আলী নাজির ও এসপি ছিলেন একজন নন-বেঙ্গলী। তার নাম আব্দুল আওয়াল। সেদিন জীবনে প্রথম নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসিকতা। তিনি হামলার মধ্যেই বক্তব্য চালিয়ে গেলেন। আমরা সভা চলাকালীন সময়ে মারামারি চালিয়ে গেলাম দফায় দফায়। এস সময়ে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের প্রচন্ড দাপট ছিল। হঠাৎ আমরা দেখলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে মঞ্চ থেকে মাইকের স্ট্যান্ড নিয়ে নেমে এসেছেন। মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে ডিউটি দিচ্ছিলেন এসপি আব্দুল আওয়াল। বঙ্গবন্ধু তার ইউনিফর্মে ধরে মুহুর্তেই শূন্যে তুলে ফেললেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশালদেহী ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় সৌম্য পুরুষ। এই অঞ্চলে তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব খুব কম ছিল। তিনি বললেন, ‘ইউ বাস্টার্ড এসপি ডু ইউ নো মি’। আই এম শেখ মুজিবুর রহমান। আই ডোন্ট কেয়ার এনিবডি’। সেই মিটিং আর কোনভাবেই শেষ হলোনা। মিটিং পন্ড হয়ে গেলো। বঙ্গবন্ধু এরপর কর্মীদের নিয়ে ডাকবাংলোতে চলে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের কে কে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করে আইয়ুব খান, মোনায়েম খান ও এনএসএফের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারো। তখন বঙ্গবন্ধুকে আমরা আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে আমরা চেষ্টা করছি। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম যোগাযোগ স্থাপন। পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছিলাম বঙ্গবন্ধু প্রথম পরিচয়কে কখনো ভুলতেন না। তাঁর ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি। পরের বছর ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের  সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে জনসভা করেছিলেন। এই যুদ্ধ যদি বিস্তার লাভ করে পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত সম্পৃক্ত হয়ে যেতো তাহলে খুব সহজেই ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে ফেলতে পারতো। হয়তো ভূ-রাজনৈতিক কারণেই সেটা ঘটেনি। পাক-ভারত যুদ্ধের পর যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠি নানা কারণে খুব অরক্ষিত এবং ইংরেজ শাসক শ্রেণীর দ্বারাও এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষজন কোন রকমের সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন। পাকিস্তানের সাথে আমাদের বৈষম্য সব কিছুতেই সুস্পষ্ট ছিল এসময়। পার্লামেন্টের আসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারী চাকুরী, প্রতিরক্ষা, পুলিশ বাহিনী ও অর্থনীতি সব জায়গাতেই দুই পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল ১৯৬৫ সালে। আমরা খুব অবহেলিত ছিলাম। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু এজন্যই ছয় দফা পেশ করলেন। ছয় দফার পর বঙ্গবন্ধু উত্তরাঞ্চলে এলেই আমরা বঙ্গবন্ধুর পাশে পাশে থেকেছিলাম। এসময়ের একটি কথা মনে পরে গেলো হঠাৎ করে আজ। আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা এসময় হকার হিসেবে কাজ করতাম। ঢাকা থেকে যখন ইত্তেফাক রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছাতো আমরা সেই পত্রিকা বাড়ী বাড়ী বিক্রি করতাম। ইত্তেফাক কিন্তু ছয় দফার পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিল সেটা সকলেই জানে। এই কারণে আইয়ুব সরকার ১৯৬৭ সালে ইত্তেফাকের মালিক মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করেছিল। ইত্তেফাকের প্রকাশনা তারা বন্ধ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে পারলে প্রতিদিনই মামলা দিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছিল তখন ছাত্রলীগ ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আমরা ছাত্রলীগকে সংগঠিত করে ফেলেছিলাম। ঠিক এই সময়ে আমি রাজশাহী কলেজ ও রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে চলে এলাম। ১৯৬৭-৬৮, ১৯৬৮-৬৯, ১৯৬৯-৭০ এবং ১৯৭০-৭১ এর চার বছর আমি রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। রাজশাহী জেলা সেসময় মহকুমা ছিল। নওগাঁ জেলা, নাটোর জেলা ও রাজশাহী জেলা নিয়ে রাজশাহী মহকুমা। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সমাজের সভাপতি ছিলাম ১৯৭১ সালে। বঙ্গবন্ধুর সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আগেই আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে এবং আরেকবার যখন রাজশাহী গিয়েছিলেন তিনি, তখন দেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাথে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা নিজেদের প্রস্তুত করো, পূর্ব পাকিস্তানকে আমরা একদিন স্বাধীন করবোই।’ মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আওয়ামী লীগেও অনেক ভাঙ্গা-গড়ার হিসেব-নিকেষ ছিল। ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির অনেক রাজনীতি পক্ষে-বিপক্ষে ছিল। এসব ঘটেছিল ১৯৬৬ সালে ছয় দফার পরপরই। তাদের অনেকেই ছয় দফাকে গ্রহণ করেনি। ছয় দফার পক্ষের শক্তিকে তারা সিআইএ’র দালাল বলেছিল। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি আমাদের ভারতের দালাল বলতে শুরু করে। তারা রাজপথে আমাদের বিপক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দিয়েছিল এসময়। তাদের মুখে বলতে শুনেছিলাম, ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ, লুঙি খুলে ধুতি পিন্দ’। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি এখনো বাংলাদেশে এসব ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ থেকেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা গ্রেফতার করেছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এদিকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি দেয়া হলো এর পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্সের মাঠে সংবধনা দেয়া হলো। তোফায়েল আহমেদ আমাদের টেলিফোনে এবং রেল বিভাগের টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমরা যেনো কর্মীদের নিয়ে সেই সংবর্ধনায় যোগদান করি। আমরা ২২ তারিখেই ট্রেনে ঢাকার পথে রওয়ানা দিয়েছিলাম। কমলাপুর রেল স্টেশনে নেমে আমরা পায়ে হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে চলে গিয়েছিলাম। ইকবাল হলের পুকুরে গোছল করে দুপুর দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে চলে গিয়েছিলাম। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন তোফায়েল ভাই। এই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে তোফায়েল আহমেদ ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব দিয়েছিলেন। তোফায়েল ভাই তার ভাষণে বঙ্গবন্ধু খেতাবই দেননি শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলেও সম্বোধন করেছিলেন সেদিন। তিনি ভাষণে বলেন, ‘তুমি বাঙালীর মুক্তির জন্য ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছো এবং তোমার ঋণ বাঙালীরা কখনোই শোধ করতে পারবে না। আজ তোমাকে বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম।’ এসময় চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসলো। এবং কিছুক্ষণ পর মেঘের গর্জনের চেয়ে অধিক শক্তিতে স্লোগান শুরু হয়ে গেলো। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। ‘বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হও, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হও।’ স্লোগান উঠল, ‘পাকিস্তান না বাংলাদেশ, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ।’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। ‘ঢাকা না পিন্ডি, ঢাকা-ঢাকা।’ ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ সমাবেশ ও সবর্ধনার পর আমাদের বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেসময় ১৯ জেলার ৩৮ জন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সবাই ঐদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, শেখ শহিদসহ আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে এদিন উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা তুমি রাজশাহী কুদ্দুস না?’। আমি বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরার পরে তিনি আমাকে অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাকে ¯েœহ করেছিলেন সেদিন। তিনি আমাকে বললেন, ‘গুড, গুড, গুড’। কোথায় ১৯৬৪ আর কোথায় ১৯৬৯ সাল। প্রায় পাঁচ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সাথে আবার দেখা হলো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে উত্তরাঞ্চলে ছিল ১৭টি সিট। ১২টি আসন ছিল প্রাদেশিক পরিষদের এবং ৫টি আসন ছিল ন্যাশনাল এসেম্বলির জন্য। এসময়ও অনেক ঘটনা ঘটে গেলো। সেসব কথা এখানে বলতে চাইছি না। পূর্ব পাকিস্তান নির্বাচনে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করেও এসেম্বলিতে যেতে পারলো না। ফলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে গেলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ-ছাত্রসমাজ-পেশাজীবি-সাধারণ জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নেতৃত্বের একটি বিষয় ছিল। আমি মুজিব বাহিনীর জেলা কমান্ডার হলাম। দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। পানিপিয়া ছাত্র-যুবকদের ভর্তি করলাম। পলিটিক্যাল মোটিভেটর ছিলাম। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশে প্রবর্তন করলেন পাকিস্তানের মিয়াওয়ালী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে। আমরা ৮ জানুয়ারী জেনেছিলাম বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন। মোঃ কামরুজ্জামান সাহেবের সাথে আমাদের সবসময় যোগাযোগ ছিল। উনারাই জেনে গিয়েছিলেন ৮ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার মুক্ত করে লন্ডনের পথে পাঠানো হবে। বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লী হয়ে ঢাকা ফিরবেন। ১০ জানুয়ারী। বঙ্গবন্ধু ঠিক ঠিকই ১০ জানুয়ারী ঢাকা ফিরলেন। লক্ষ জনতা বঙ্গবন্ধুকে, বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে অর্ভ্যথনা দিয়েছিল এয়ারপোর্টে। সেদিন আমরা আসতে পারিনি। তিনি যখন ১২ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতির শপথ পাঠ করলেন আমরা ১৪ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলাম। এরপর আমরা বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট আমি ঢাকায় ছিলাম। তকন বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এদেশে। আমরা ১৩ আগষ্ট ঢাকায় এসেছিলাম। রাজশাহী শহরে বাকশালের অধীনে একটি উপ-নির্বাচন হয়েছিল। বাকশাল গঠনের পর সিদ্ধান্ত হয়েছিল নির্বাচিত আঞ্চলিক নেতা বাকশালে যোগ না দিলে তার সংসদ থেকে আসন চলে যাবে। আমাদের এখানে জাসদের নেতা ময়েন উদ্দিন মানিক বাকশালে যোগ না দেয়ার কারণে সেই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন, এমএজি ওসমানি সাহেবও বাকশালে যোগদান করেননি। মোট তিনটি আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছিল এজন্য। ৫ আগষ্ট এই উপ-নির্বাচন হয়েছিল। মহসিন সাহেব ছিলেন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তিনি উপ-নির্বাচনে জয়লাভের পর শপথ পাঠ করতে ঢাকা এসেছিলেন ১৩ আগষ্ট। এসময় মালেক উকিল সাহেব ছিলেন স্পীকার। শপথ অনুষ্ঠানের পর আমরা গণভবনে গিয়েছিলাম। নতুন গণভবনে। আগের গণভবনটি ছিল বেইলি রোডে। গণভবনে গিয়ে বাকশালের সেক্রেটারী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ মনি ও মোঃ কামরুজ্জামান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হলো। আমরা যখন গণভবনে ঢুকছি সেসময় মোস্তফা মহসিন মন্টু ভাইও গণভবনে ঢুকছিলেন। গণভবনের লেকে বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন বিকেলে বসতেন। কখনো কখনো মাছ ধরতেন। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম বঙ্গবন্ধু উঠে এসে মোস্তফা মহসিন মন্টু ও আমার কাঁধে হাত রেখে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে বললেন, ‘এই হলো আমার দুই জেনারেল, একজন ঢাকার ও অন্যজন রাজশাহীর।’ ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত আমরা ঢাকাতেই ছিলাম। এমপি হোস্টেলে ছিলাম মহসিন সাহেবের কক্ষে। খুব সকালে আমি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর জানতে পেরেছিলাম। আমি লুঙ্গি পরেই বের হয়ে এসেছিলাম। রাস্তায় বের হয়ে ট্যাংক দেখতে পেলাম। ধানমন্ডি দুই নাম্বার সড়কে হেনা ভাইদের বাসা ছিল। আমি পায়ে হেঁটে সেই বাসায় গেলাম। পরে রাজশাহী ফিরে যাই। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর এর অভ্যুত্থানে মেজর হাফিজ জড়িত ছিলেন। ১৭ আগষ্ট আমরা রাজশাহী ফিরেছিলাম। সেটা ছিল শবে-ই-বরাতের রাত। ১৮ আগষ্ট আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। জেলে ছিলাম ৪ বছর ১১ মাস ১৭ দিন। আমাকে প্রথমে পাঠানো হয়েছিল রাজশাহী জেলে। সেখান থেকে পাঠানো হয়েছিল বরিশাল জেলে। পরে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম কারাগার, চট্টগ্রাম কারাগার থেকে সিলেট কারাগার, সিলেট থেকে ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ থেকে বগুড়া এবং সবশেষে বগুড়া থেকে পূনরায় রাজশাহী কারাগারে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। কারাবাসের দিনগুলিতে আমি কারাগার থেকে কারাগারে ঘুরেছি।

 

 

লুৎফুল্লাহ হীল মুনীর চৌধুরীঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন খুব সাহসী ও আদর্শবান নেতা। তিনি মানুষের মুক্তির আন্দোলন করতে চেয়ে সুনির্দিষ্ট আদর্শের পথে হেঁটেছেন। তাঁকে হত্যার পর কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিফলন আওয়ামী লীগের কর্মীদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়েছে আপনার?
আব্দুল কুদ্দুসঃ বঙ্গবন্ধু চিলেন এই জাতির প্রাণকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রাণকেন্দ্র। আমি একটি কোটেশান তৈরী করেছিলাম একসময় যেটা অনেক বিখ্যাত লোকও ব্যবহার করেছেন। দুটি ঘটনা বলতে চাই প্রথমে কথাপ্রসঙ্গে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারী সফরে আমাকে রাশিয়া ও পূর্ব জামার্নীতে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন ১৯৭১ সালে কিন্তু বাংলাদেশের নাম তাদের জানা ছিল না। তারা নাম জানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আমরা রাজনৈতিক ট্রেনিং-এ রাশিয়া গিয়েছিলাম। মস্কো থেকে প্রায় তিনশত মাইল দূরে একটি কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারখানার একজন এক্সিকিউটিভ ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছো’। আমরা যতবারই বাংলাদেশ এর কথা বললাম তিনি ততবারই বললেন এটা কি ভারতের অংশ। এক পর্যায়ে আমরা তাকে বলেছিলাম, আমরা সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ এর নাগরিক ও আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আজ হয়তো রাসেল ভাই আপনি বিশ্বাস করবেন না আমাদের এই কথা শোনার পর সেই সামরিক কর্মকর্তা বললেন, ‘ও তোমরা বিখ্যাত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এর দেশের কথা বলছো।’ সাধারণত অতিথীদের যেভাবে আপ্যায়ন করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশী সম্মান ও ভালোবাসা দিয়ে আমাদের তারা তখন আপ্যায়ন করেছিল। আমি সরকারী সফরে যখন জাপানে গিয়েছিলাম একটি সেমিনারে তখনও লক্ষ্য করেছিলাম জাপানের মানুষরা বাংলাদেশের চেয়ে বঙ্গবন্ধুকে বেশী চিনে। আমার নির্বাচনী এলাকায় বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল করেছি যার তিন দিকে একটি কথা লেখা রয়েছে। ‘বঙ্গবন্ধু তুমিই বাংলাদেশ, তুমিই আমাদের পরিচয়।’ আমি কোলকাতা থেকে ছবিটি করে এনেছিলাম। আজ অনেকের মুখেই এই কথাটি আমি বলতে শুনি। আমি জেনেভায় গিয়েছিলাম একবার সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এসেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্ট ইউনিয়ন (আইপিইউ) এর চেয়ারম্যানও সেখানে ছিলেন সেদিন। সেখানেও লক্ষ্য করলাম বিশ্বে বঙ্গবন্ধু কতটা জনপ্রিয় ও পরিচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ একটি বৃহৎ পরিসর। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন ও আদর্শের প্রতিফলন না ঘটলে আমাদের স্বাধীনতাই বিসর্জন দিতে হবে হয়তো। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুই মুক্তির অপর এক নাম, বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করা না হলে এই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকে থাকার কথা নয়। আমরা যারা ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী, বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করছি, বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও দিকনির্দেশনা মনে রেখেছি তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু চিরকাল অমর হয়ে রয়েছে। এদেশে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শারীরিকভাবে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্নকেও হত্যা করতে চেয়েছিলেন। জিয়া-এরশাদ-খালেদা ও একাত্তরের ঘাতক-দালালরা বঙ্গবন্ধুর সব কিছুই বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো। তারা বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করার উৎসবে মেতে উঠেছিল। এর সাথে অনেক ইতিহাসবিদরাও যুক্ত হয়েছিল। অনেক সাংবাদিক, সম্পাদক, পত্র-পত্রিকা ও লেখকরাও এই কাজে যুক্ত হয়েছিল। জাতিসংঘ ইউনেস্কোর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীতে এমন স্বীকৃতি কতজন রাষ্ট্রনায়ক পেয়েছেন সে প্রশ্ন আমরা বাংলাদেশ থেকে তুলতেই পারি।
লুৎফুল্লাহ হীল মুনীর চৌধুরীঃ বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। একদিকে আমাদের বিজয়ের পঞ্চাশ বছর অন্যদিকে মুজিব শতবর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের ভাবনা কি?
আব্দুল কুদ্দুসঃ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্ম বার্ষিকী ‘মুজিব বর্ষ’ উদযাপন করছে বছর ব্যাপি। সেই সাথে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেরও পঞ্চাশ বছর এটি। ২৬ মার্চের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হলো এই বছর। ১৬ ডিসেম্বররের বিজয় দিবসের পঞ্চাশ বছর এই ২০২১ সাল। আমরা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্ম বার্ষিকীর এই মাহেন্দ্রক্ষণ দেখে যেতে পারলাম। সেটা চরম সৌভাগ্য তাদের জন্য যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন। সুবর্ণ জয়ন্তি বারবার ফিরে আসবে না। এর প্রেক্ষাপটকে ঐতিহাসিক ভাবেই আমরা বিবেচনা করবো। বিশ্ব মহামারী ও করোনা ভাইরাস যদি জনজীবন স্থবির করে না ফেলতো তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তি উদযাপন করতে পারতো জাকজমকপূর্ণভাবে।
লুৎফুল্লাহ হীল মুনীর চৌধুরীঃ প্রিয় নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ শিষ্য-কর্মী-অনুসারী আপনাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পথচলার কিছু ঘটনা বর্ণনার জন্য আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আপনি ও আপনার পরিবার এবং কর্মীদের মুজিব শতবর্ষে-স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
আব্দুল কুদ্দুসঃ ধন্যবাদ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31