বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তাল গাছের বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ১২:১৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তাল গাছের বিকল্প নেই

শাহ আলম সরকার

বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। বলা হয়ে থাকে বজ্রপাত সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের ফলে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হওয়াকে বজ্রপাত বলা হয়। বজ্রপাতের ফলে যে উচ্চমাত্রার বৈদ্যুতিক বিভব সৃষ্টি হয় তার প্রভাবে তার পতনস্থলে অগ্নিকাণ্ডসহ গাছপালা ও জীবজন্তুর প্রাণহানি ঘটতে পারে। আবহাওয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই সময়ের মধ্যে বজ্রপাতের হার সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানির সংখ্যা আশঙ্কিতভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন প্রতিবছর বর্ষাকালে বজ্রপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত কয়েক বছরে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সাড়ে নয়বছরে বজ্রপাতে দেশে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ বছরের সাড়ে পাঁচমাসে বজ্রপাতে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, গত ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মারা গেছে দুই হাজার দুইশত ছিয়াত্তর জন। ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১ জন. ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৯৮জন, ২০২০ সালে ২০১ জন এবং ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ১০৭ জন মারা গেছে। বজ্রপাতে গড়ে প্রতিবছর দুই শতাধিক লোক মারা যায়।

বজ্রপাত প্রতিহত করা বা একে থামানোর মতো কোনো প্রযুক্তি এখনো পর্যন্ত মানুষের হাতে নেই। তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে এর থেকে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেতে পারে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ঝড়বৃষ্টির পাশাপাশি বজ্রপাতেরও পূর্বাভাস দেওয়া হয়ে থাকে। তাই নিয়মিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে হবে এবং বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকলে ঘরে অবস্থান করতে হবে।

বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকলে পাকাবাড়ির নীচে আশ্রয় নিতে হবে। ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু জায়গায় যাওয়া যাবে না। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভালো হয়, যদি কোনো দালানের নীচে আশ্রয় নেওয়া যায়। উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। খোলা জায়গায় কোনো গাছ থাকলে তা থেকে অন্তত ৪ মিটার দূরে থাকতে হবে। এ ছাড়া ফাঁকা জায়গায় কোনো যাত্রীছাউনি, নদী, বিল, মাঠঘাট বা বড়ো গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে। ঘরে থাকলে বজ্রপাতের সময় জানালা থেকে দূরে থাকতে হবে। জানালা বন্ধ রাখতে হবে। ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সবযন্ত্রপাতি বন্ধ রাখতে হবে। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখতে হবে। বজ্রপাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার চেষ্টা করতে হবে। বজ্রপাত হলে গাড়ি পাকা ছাউনির নীচে রাখতে হবে। এ সময় গাড়ির কাচে হাত দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালিপায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। যদি একান্ত বেরোতেই হয় তাহলে পা ঢাকা জুতা পরে বের হতে হবে। রবারের গামবুট এক্ষেত্রে সবথেকে ভালো কাজ করবে। খোলা জায়গায় বা ফসলের মাঠে কাজ করা অবস্থায় আশ্রয়ের জায়গা না থাকলে যতটা সম্ভব নীচু হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পড়তে হবে। কোনো অবস্থাতেই মাটিতে শোয়া যাবে না। জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। নৌকায় থাকলে ছইয়ের নীচে থাকতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৪০ বছরে বাংলাদেশর তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসেবে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে তালগাছ লাগানোকে বিশেষজ্ঞরা গুরু্ত্ব দিচ্ছেন। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ বেশ কার্যকর। তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হতে পারে। তালগাছের পাশাপাশি নারিকেলগাছ, সুপারিগাছ এর মতো উচ্চতাসম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরী। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রকৃতিই বাঁচার উপায়।

বজ্রপাত শুধু বংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্তনেই। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ কাজে লাগানো দরকার। সরকারিভাবে তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই কার্যক্রমকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি নারিকেলগাছ, সুপারিগাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রায় ৩১ লাখ ৬৪ হাজার তাল বীজ রোপণ করা হয়েছে।

বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাকৃতিকভাবে লম্বা গাছ যেমন তালগাছ, সুপারিগাছ, নারিকেলগাছ, বটগাছ কমে যাবার কারণেও বজ্রপাত এখন যেখানে সেখানে আঘাত হানছে। আগে বড়ো বড়ো বটগাছ, তালগাছ ও সুপারিগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় বজ্রপাত হতো এসব গাছের ওপর । বড়ো বড়ো গাছ কেটে ফেলায় বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা উদ&‡eগজনক হারে বেড়েছে। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসতবাড়িতে, রাস্তার পাশে, ফসলি জমির আইলে তালগাছ, সুপারিগাছ নারকেল গাছ রোপণ করতে হবে।

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ঝড়বৃষ্টির জলোচ্ছ্বাস বন্যা খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এদেশের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, অধিকমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ, বায়ুমন্ডলে সি এফ সি গ্যাসের নির্গমন, ওজোন স্তর ক্ষয় হওয়া প্রভৃতি কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী জেলাগুলোর অবস্থান একটি উল্টানো ফানেল আকৃতির হওয়ায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট যে কোনো ঘূর্ণিঝড় প্রাকৃতিক নিয়মেই বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে আঘাত হানে। উপরন্তু দুর্বল অবকাঠামো এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার কারণে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে এদেশের মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা অধিক পরিমাণে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে প্রাণহানি বৃদ্ধি এই আশঙ্কারই বাস্তব প্রতিফলন। বজ্রপাতের ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে তাই আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
এজন্য বেশি করে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। শিল্পায়ন ও অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবেশ সুরক্ষার দিকটি বিবেচনা করতে হবে সর্বাগ্রে। একই সাথে দুর্যোগের সাথে সহনশীল জনবসতি গড়ে তুলতে হবে। বজ্রপাতের ন্যায় অপ্রতিরোধ্য দুর্যোগের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে। এজন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে পর্যাপ্ত জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। বজ্রপাতকে যেহেতু প্রতিহত করা বা থামিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় তাই এর আঘাত থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে নিজেদেরকেই। বজ্রপাতে প্রাণহানি রোধ করতে সরকার সম্ভব সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড়বৃষ্টির পাশাপাশি বজ্রপাতের পূর্বাভাসও দিয়ে থাকে। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস মোতাবেক আমাদের সম্ভাব্য সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

আর এদেশ যেহেতু ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ একটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত, বজ্রপাতে তাই মৃত্যুহার এদেশে বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং সম্ভাব্য সকল সাবধানতা অবলম্বনই হবে এই দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র হাতিয়ার।

সরকার ইতোমধ্যে বজ্রপাতকে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আঘাতে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ হতে। অন্যান্য দুর্যোগের ন্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের পূর্বাবাসও দিয়ে আসছে নিয়মিত। বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষের প্রাণহানি প্রতিরোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বিভিন্ন জেলায় সড়ক মহাসড়কের পাশে তাল বীজবপন করার কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলার সড়ক মহাসড়কের দুই পাশে রোপণ করা হয়েছে কয়েক লক্ষ তালগাছ। উল্লেখ যে তালগাছ শাখা-প্রশাখা বিহীন ও লম্বা হবার কারণে আশপাশের অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে উুঁচু ও সরু বস্তুকে আগে আঘাত করা। তাই এসব তালগাছ এক সময় বড়ো হয়ে দিগন্তে মেলে ধরবে পাতা, আর বজ্রপাতের আঘাত এসে লাগবে এর গায়ে। ফলে আশপাশের জনবসতি রক্ষা পাবে সম্ভাব্য প্রাণহানির থেকে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31