কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতা ও বিচ্যুত আচরণ

প্রকাশিত: ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৭, ২০২১

কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতা ও বিচ্যুত আচরণ

সাধারণত সমাজ বিরোধী বা আইন বিরোধী কোন কাজকে অপরাধমূলক কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। তবে এর সাথে বয়সের বিষয়টি সরাসরি জড়িত। যেমন বাংলাদেশের শিশু আইনে অনুর্ধ্ব আঠার বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হয়। এই নির্ধারিত বয়স সীমার মধ্যে যারা বিভিন্ন ধরনের সমাজবিরোধী বা আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে তাদেরকে মূলত কিশোর অপরাধী বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বয়সের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। আবার তাদের অপরাধের কারণ ও ধরন নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও হয়তো ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যাবে।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই বিষয়ে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তবে এই ক্রমবর্ধমান চিত্রে মেয়ে শিশুরাও আলোচনায় চলে আসছে কখনো কখনো । প্রশ্ন জাগতে পারে কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতার চিত্রটি আসলে কেমন? ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুরা একই ধরনের অপরাধ প্রবণতা জড়িয়ে পড়ছে কিনা, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল যে মেয়ে শিশু বা কিশোরীরা সবসময়ই যে সরাসরি আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে তা নয়। তারা অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়। সম্প্রতি কিশোরীদের মাঝে মাদক বহন ও বিক্রীর প্রবণতা একটু বেড়েছে। তবে চুরির মত একটি কাজে কিশোরীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বেশ পুরনো। গৃহস্থালীর কাজে নিয়োজিত গৃহকর্মী কিশোরীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। সাধারণত কিশোরীদের বিরুদ্ধে চুরি, মাদক বহন ও বিক্রী, খুন, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা, ছেলে বন্ধুদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগগুলোই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের যে সমস্ত মেয়ে শিশুরা এ সমস্ত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তাদের সংশোধন কিংবা পুনর্বাসনের জন্য গাজীপুরের কোনাবাড়িতে রয়েছে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র (বালিকা)। আঠার বছর বয়সের নিচে যে সকল মেয়ে শিশু এখানে আছে তাদের অনেকেই পরিস্থিতির শিকার বা না বুঝেই এধরনের কাজগুলো করেছে।

 

পৃথিবীতে প্রতিটি শিশুই হতে পারে অপার সম্ভাবনার উৎস। তবে এ সম্ভাবনা তখনই সম্পদে পরিণত হবে যখন আমরা ছেলে শিশুদের পাশাপাশি মেয়ে শিশুদের ব্যাপারেও সমান যত্নবান থাকবো। বাংলাদেশের কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে অধিকাংশই সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে পারেনি। পাশাপাশি বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার অভাব, পারিবারিক ভাঙ্গন, বাবা-মায়ের পরিচর্যার অভাব ও আইন সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞাত থাকার কারণে বর্তমানে কিশোরীরা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিভিন্ন কিশোর গ্যাং এর সাথেও কিশোরীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

 

বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এই সময়টিতেও কিশোর অপরাধ প্রবণতা যেন উস্কানি পাচ্ছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে কিশোর কিশোরীরা ঘরে বসেই সময় কাটাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন: ট্যাব, স্মার্টফোন ইত্যাদির সাথে গড়ে উঠছে সখ্যতা। এর ফলে বিশেষ করে ইউটিউব, উস্কানিমূলক ভিডিও গেমস, পর্নোগ্রাফিতে কিশোর-কিশোরীদের আগ্রহ সমানভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়াও বৈশ্বিক মহামারীর এই সময়ে বাবা-মায়ের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, মানসিক অস্থিরতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অভাবে কিশোর-কিশোরী উভয়কেই অসহিষ্ণু করে তুলতে সহায়তা করছে। যার ফলে আমরা বলতে পারব না শুধুমাত্র কিশোরদের সাথেই অপরাধ শব্দটি যুক্ত হচ্ছে। কিশোরীরাও সমাজবিচ্যুত আচরণে (Deviant behavior)  সমান ভাবে জড়িয়ে পড়ছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মেয়ে শিশু হিসেবে কিশোরীদের উপর পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে কিশোরদের মত পরিবারের বাইরে গিয়ে কিশোরীরা সহজেই অপরাধমূলক কাজের সম্পৃক্ত হতে পারে না। তাই  হয় তো কিশোর গ্যাং বারবার আলোচনায় আসলেও এর সাথে  কিশোরীদের সরাসরি সম্পৃক্ততার খবর আমরা সেভাবে পাইনা।

 

কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা। আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা একদিকে যেমন কিশোরীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনুকূলে নয়, তেমনি দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণার বিষয়ে যত্নশীল নয়। তাই অপ্রাপ্ত বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার ভয়াবহ পরিণতি কী হতে পারে তা না জেনে অধিক সংখ্যক কিশোরী এই ধরনের বিচ্যুত আচরণ করে থাকে। তাছাড়াও চুরি বা মাদক বহন ও বিক্রীর বিপরীতে দেশে কি ধরনের আইন প্রচলিত আছে এ সম্পর্কে আমাদের দেশের কিশোরীরা অবগত নয়। অনেক সময় পারিবারিক স্নেহ-ভালবাসার অভাব ও নানা বঞ্চনার শিকার হয়েও কিশোরীরা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।

 

বর্তমান সময়ে ভয়াবহ একটি সমস্যা কিশোর অপরাধ। আইন দ্বারা নির্ধারিত বয়স সীমার নিচে কিশোর-কিশোরীরা অস্বাভাবিক ও সমাজবিরোধী আচরনে আজকাল সক্রিয় হয়ে উঠছে। সামাজিকভাবে শেখা আচর (Socially learned behavior) যা কিশোর কিশোরীরা অর্জন করে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে; সেই পরিবেশকে সুগঠিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। একজন কিশোরীর দায়িত্বশীল ও যৌক্তিক আচরণের পূর্ব শর্ত হলো পারিবারিক সুসম্পর্ক। বাবা-মায়ের দায়িত্বশীল আচরণ, পরিবারের সকলের স্নেহ -ভালোবাসা  এবং সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতাকে রুখে দিতে পারে। তাছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাত্ত্বিক জ্ঞান বা সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সুষ্ঠু বিনোদন কিশোরীদের সমাজবিচ্যুত আচরণকে অনেকাংশে প্রতিহত করতে পারবে।

 

সুহেলী সায়লা আহমদ : সহকারী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান) মানবিক বিভাগ  ,খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।