বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্ঠা

প্রকাশিত: ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩

বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্ঠা

 

ফারিহা হোসেন
দেশকে বাল্য বিয়ে মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নের্তৃত্বে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে।

বাল্য বিয়ে বন্ধে দেশে রয়েছে আইন, রয়েছে স্থনীয় প্রশাসন । এ জন্য রয়েছে মনিটরিং ব্যবস্থা। তবুও বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বাল্য বিয়ে শূণ্যের কোটায় নিয়ে আসতে কাজ করছে সরকার।

প্রসঙ্গত:বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে ২০১৮ সালে সরকার জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তাতে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করে নানামূখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের জরিপেও এরকম তথ্য প্রকাশ করেছে। গত নভেম্বরে ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, দেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৩৬ শতাংশেরই ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হয়। এর আগে ২০১৪ সালে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি, তাতে বাল্যবিয়ের হার ছিল ৫৫ শতাংশ। এ হিসেবে বাল্য বিয়ের হার অকেন কমে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১২-১৩ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপে দেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫২.৩ শতাংশেরই বাল্যবিয়ে। অর্ধযুগ পর ২০১৯ সালে সেই জরিপে বাল্যবিয়ের হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৪০.৪ শতাংশে। সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে ইউনিসেফ সম্প্রতি এ প্রতিবেদনে বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলে গত দশকের তুলনায় যথাক্রমে কমপক্ষে ১৭ গুণ ও আট গুণ বেশি কাজ করতে হবে বলে প্রতিবেদনে জানায় ইউনিসেফ। ফরাশি দার্শনিক নেপোলিয়ান বোনাপার্টের উক্তি ‘তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো।’ তিনি এও বলেছেন, ‘একটি সুস্থ্য জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা।’ অথচ এ সকল মায়েদের শিক্ষিত করার পরিবর্তে অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে তাদের। বাল্য বিবাহ সমাজে এখনো একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে রয়েছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ আইন যথাযথ বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসন,.জনপ্রতিনিধি,সুশীল সমাজ,গণমাধ্যম কর্মী এবং প্রতিটি পরিবারকে সমন্বিত ভাবে কাজ করতে হবে।
প্রতি বছর ৮ই মার্চ আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করে আসছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে দেশের পুরুষদের তুলনায় নারীদের সার্বিকভাবে অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছলতা ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হয়। একটি দেশ ও জাতি গঠনের পেছনে নারী পুরুষ উভয়েরই প্রয়োজন থাকে সমভাবে । কারণ দুটি জেন্ডারের সমান অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিতে যে কোনো কর্ম প্রচেষ্টা সফলতা এনে দিতে পারে। এরকম অসংখ্য নজির রয়েছে সমাজে।
শিশু বিবাহ একটি প্রথা যা নারীদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক মূল্যবোধ ও অসম অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু বহুদিন আগের এই প্রথা ও মানষিকতা এখন অনেকটাই বদলেছে। বাংলাদেশে নারীদের প্রায়ই আর্থিক বোঝা হিসাবে দেখা হলেও শিশু ও বাল্য বিয়ে ধীরে ধীরে কমেছে। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে সন্তানদের বিয়ের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা মূল প্রভাব বিস্তার করে। একজন মেয়ে শিশু যখন যৌবনপ্রাপ্ত হয়, তাদের পিতা-মাতা তখন তাদের সতীত্ব রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে।
২০৪১ সালের মধ্যে বাল্য বিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রসঙ্গত:বাল্য বিবাহে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভূমিকা বর্ণনাতীত। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এসব দুর্যোগ অনেক পরিবারকেই গভীর দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়, যা তাদের মেয়েদের কম বা ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে নদীভাঙনে ক্রমাগত ধ্বংসযজ্ঞের ফলে যারা ঘর-বাড়ি, জমিজমা হারান তাদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দারিদ্রতা হলো মূল বাধাঁ। কারন, সা¤প্রতিক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, যেসব পিতা-মাতা মেয়ে শিশুদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, তারা মেয়ে শিশুর বয়ঃসন্ধির শুরুতে যৌন নির্যাতনের ভয় অনুভব করে। কিন্ত অনেক বিবাহিত কিশোরী দৈহিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বা এসবের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। যদিও শিশুদের বিয়ে দেয়া এক ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে বলে দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলা মনে করে।
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ ও শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাল্য বিয়ের ফলে এসব অধিকারের বাস্তবায়ন ও সুরক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সত্যি কথা “বাল্য বিবাহ” করোনাভাইরাসের মতো ভয়ঙ্কর। এ সমস্যা শুধু জীবনকেই নয় বরং সমাজ এবং অর্থনীতিকেও ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে। মূলত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অনেক দরিদ্র পরিবারই মেয়ে শিশুদের বাল্য বিয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাল্যবিয়ে দেশের উন্নয়নে একটি বড় বাধা। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পরিস্থিতির অবনতি হয়। বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের চিন্তা, তাদের কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিতে হবে আগে ভাগে। কারণ কন্যার সুখ শান্তি,নিরাপত্তা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকেই এসব চিন্তা তাদের মনে আসে। এ ক্ষেত্রে বাল্য বিয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের কন্যা শিশুকে। তাছাড়া রয়েছে দারিদ্র্যতা, কুসংস্কার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষায় অধিকারের অভাব, সামাজিক চাপ, হয়রানি প্রভৃতি। যেমন মাধ্যমিক পর্যায়েই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া, গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা, আগাম গর্ভধারণ যা মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে, স্বামী পরিত্যক্ত হওয়া, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার মতো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতর মুখে পড়তে হয় পরিবার এবং মেয়েকে।
জাতিসংঘ বলছে, সারা বিশ্বে বাল্য বিবাহের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে, কমছে বাংলাদেশে ও তবে সে হার কম। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে আড়াই কোটি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ৫ জন নারীর মধ্যে একজনের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই। কিন্ত এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল প্রতি ৪ জনে একজন। ইউনিসেফ বলেছে, বিশ্বজুড়ে গত এক দশকে বাল্য বিয়ে পনের শতাংশ কমে এসেছে।
সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে এখন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। অল্পবয়সী মেয়েরাও এখন তাদের বিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার শূন্যের কোঠায় নেমেসে । ২০১০ মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৪-৪১ শতাংস স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিরাপত্তা সংকট, অভিভাবকদের কাজ হারানো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাছাড়া বাল্য বিয়ের যেহেতু একটি ট্রেডিশন আছে তাই করোনাকে বিয়ে দেয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছে অনেকেই। যারা এই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তারা সবাই স্কুলের ছাত্রী। আর বিয়েগুলো হয়েছে শুক্র-শনিবার বন্ধের দিন বা রাতে। বাল্য বিয়ে বন্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে অনেক মেয়ে বাল্য বিয়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে হয়েছেন ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রভাষক, আইনবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা, ইউএনও, ডিসি ও বিচারক। এই ধরা অব্যাহত থাকলে দেশ সমাজ জাতি এগিয়ে যাবে। প্রত্যাশা থাকবে মানুষের সচেতনতা, প্রশাসন,জনপ্রতিনিধি,সুশীল সমাজ,অভিভাবকদের সমন্বিত প্রচেষ্ঠায় বাল্য বিয়ের অভিশাপ থেকে সমাজ,রাষ্ট্র, মানুষ নিষ্কৃতি পাবে।
#
লেখক: ফ্রিলান্স সাংবাদিক এবং নারী- শিশু,বায়োকেমেস্ট্রি ও পরিবেশ বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত