বৃদ্ধাশ্রমে একদিন

প্রকাশিত: ২:৪১ অপরাহ্ণ, মে ৩১, ২০১৯

বৃদ্ধাশ্রমে একদিন

খায়রুন নাহার চৌধুরী

গত ২৬ মে আমরা কজন বন্ধু একটি বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলাম । উদ্দেশ্য একদিনের জন্য হলেও এই অবহেলিত মায়েদের পাশে বসে সুখ দুঃখের কথা বলা। উনাদের পছন্দের খাবার খাওয়ানো। এ সকল অবহেলিত মায়েদের জন্য কিছু করার পরিকল্পনাও মাথায় ছিল।
কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর আমার সমস্ত চিন্তা ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো। কিসের সুখ দুঃখের গল্প? চারিদিকে শুধু দুঃখ আর দৈন্যতা, অবহেলা আর অপমান । সবাই যেনো মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। জীবনের উপর তাঁদের চরম বিতৃষ্ণা । বৃদ্ধ বয়সে কি মানুষের কোনো মূল্যই তবে থাকে না! যে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলাম সেটার নাম”আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম” । ঠিকানা খোঁজে বের করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। শেষ পর্যন্ত পৌছালাম।এখানে যারা আছেন বেশীর ভাগ আশ্রিতাদের স্মৃতিশক্তি নেই। নাম ,ঠিকানা এমন কি নিজের পরিচয় পর্যন্ত মনে করতে পারছেন না কেউ। কয়েকজনের মানসিক সমস্যাও আছে। বেশীর ভাগ বৃদ্ধাদের বিভিন্ন পার্ক আর রাস্তা থেকে তুলে এনে এখানে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। যদিও আমার কাছে এই ব্যবস্থাকেও ভীষণ রকম অপ্রতুল মনে হয়েছে । তবুও মন্দের ভালো, অন্তত মাথা গোঁজবার জন্য একটা ছাঁদ তো পাওয়া গেলো। দুবেলা ভাতের জন্য আর হাত পাততে হচ্ছে না রাস্তায় রাস্তায় দ্বারে দ্বারে । অসুখ বিসুখে দুই একটা paracetamol অথবা তারচেয়ে বেশী কিছু হয়তো পাওয়া যাচ্ছে। এখানে ১০০ বছরের উপরে একজন বৃদ্ধ মাকে দেখলাম,নাম জহুরা। উনার এই নামটা ছাড়া আর কিছুই মনে নেই। ছবি তুলতে একদমই পছন্দ করেন না । অন্য আরেক মা আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন জহুরা মায়ের কাছে, বললেন, “তুমি ছবি তুলো ,আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি”। কয়েকটা ছবি নিলাম,যিনি নিয়ে গেলেন ,তাঁর বয়সও ৮০ উপরে,নাম রাবেয়া। মোট ৬৫ জন মা আছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে । সবাই বয়সের ভারে ন্যুব্জ । মাত্র ছোট তিনটি আর বড় একটি এই চার কক্ষে এতো মানুষ থাকাটা যে কতো কষ্টের সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না । পরিবেশটা বসবাসের অযোগ্য । তবুও কারো কোনো অভিযোগ নেই । হয়তো অনেক অভিযোগ বুকের ভীতরে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছেন মায়েরা। একটি যুবতী মেয়েকে দেখে কাছে ডাকলাম । মেয়েটির নাকি মানসিক সমস্যা আছে। জিজ্ঞাসা করলাম কি করে তার এই অবস্থা হলো। যা শুনলাম খুবই দুঃখজনক! একটা বাসায় কাজ করতো মেয়েটি,সেই বাসার সাহেব তাকে নিয়মিত ধর্ষণ করতেন। এক সময় সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। পেটে তখন পাঁচ মাসের বাচ্চা । এই অবস্থায় তাকে বের করে দেয়া হলো সেই বাড়ি থেকে । তারপর রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে আরো অনেক বার ধর্ষিত হতে হতে এক সময় প্রাকৃতিক নিয়মে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো। বাচ্চা একটা মেয়ে, যার মা বাবা কেউ নেই,আরো একটা বাচ্চার দায়িত্ব ঠিক মতো নিতে পারছিল না। এক সময় বধ্য উন্মাদ হয়ে যায় । তখন কোনো এক হৃদয়বান ব্যক্তি তাকে গুলশান পার্ক থেকে এই আশ্রমে দিয়ে যান। সে ছেলে সহ এখানেই আছে। জিজ্ঞেস করলাম ছেলে বড় হলে কি বানাতে চাও? উত্তরে বললো পুলিশ, আমার ছেলে বড় হলে পুলিশ হবে। কেনো পুলিশ হতে হবে, সেটা সে জানে না।
আমাদের দেশে কি অসহায় বৃদ্ধদের জন্য সরকারি ভাবে কোনো আশ্রয়ের ব্যাবস্থা নেই? হয়তো আছে আমার জানা নেই । আমার বার বার মনে হচ্ছিল, সরকার আর উচ্চবিত্তরা যদি এই দুঃস্থ অসহায় মানুষগুলোর পাশে একটু দাঁড়াতো । তাহলে এই মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া মুখগুলো অন্তত শেষের কটা দিন সুখ দুঃখের গল্প করে যেতে পারতো। হয়তো আরো কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছেও হতো ,কে জানে!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930