বেনজির শিকদারের তিনটি কবিতা

প্রকাশিত: ১১:৩৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩

বেনজির শিকদারের তিনটি কবিতা

 

 

 

 

ধ্রুপদী আর্তি

 

একদিন আমারও প্রেম হবে।

ধ্রুপদী ঠোঁটে—

তুমুল উষ্ণতায় চুমু দিয়ে যাবে বেহায়া রোদ্দুর!

চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পাবো

পৌষালি মায়ায় নিকটে এসেছে সমূহ অতীত!

স্পর্শে এসেছে অনির্বাণ, ছিল যা অনন্ত সুদূর!

 

একদিন আমাকে নিয়েও

কেউ একজন ভেসে যাবে খরস্রোতা ঢেউয়ে;

সুরে সুরে ডাকবে অবিমিশ্র-পাহাড়, অভিজাত স্বরে।

হিসেবের বিকিকিনিতে ঘোষণা দিয়ে হারিয়ে যাবো

পায়ে-পায়ে ফিরবো না আর বিচ্ছুরণশীল প্রাক্তন-ঘরে।

যুক্তিরোহিত মনস্তত্ত্ব কিংবা বেচে দিয়ে দুঃখের হিস্যা,

ছিন্নমূল রোমান্টিকতায় উটের মতো হেলেদুলে চলবো!

টানাপোড়েনের অভিধান ভুলে

সূচিমুখে ফুটবে; পানশালার নয়নাভিরাম ঢেউসুখ!

 

একদিন যাবতীয় আবদার থেমে যাবে;

অপার্থিব অনুভবে খুব করে চাইবো না,

আরও দু’কদম সাথেই হাঁটো;

আরেকটু সামনে যাই,

সূর্যের ছায়া হোক বিদ্রোহে খাটো।

দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে দিক দীর্ঘদিনের বিষাদ;

একদিন কিছুতেই চাইবো না উত্তীর্ণ সময়ের মাধুর্য মূল্যায়ন;

প্রাগৈতিহাসিক হৃদয়ে লালিত হবে অনন্ত নিষাদ।

 

এই বিষাদ-নিষাদের পথ স্বনির্মিত

কোথাও থাকবে না আর পৌঁছে যাওয়ার তাড়া;

একদিন তোমার চারপাশে সবই থাকবে, আমি ছাড়া।

 

 

 

মুক্তিমোহ

 

বহুদিন পর বুকের ওপর চেপে থাকা হিমালয়

মনের ওপর বসে থাকা বৃদ্ধ উপত্যকা

আর বোধের সাথে যুদ্ধলিপ্ত পাহাড়টা

মেঘের মতো ভেসে গেল সুন্দরের দেশে!

 

যেন বহুকাল পর আমি আকাশ দেখলাম

অনন্তকাল পর আমি শ্বাস নিলাম;

কোটিবর্ষ কারাবাসের পর মুক্তি পেলাম;

বহুদিনের বৃষ্টিভেজা চোখ দেখলো—

যূথবদ্ধ আকাঙ্ক্ষায় পিপাসার পাখি

উড়ে গেল অন্যকোনো বনে।

 

যে বনের প্রতিটি বৃক্ষে

থাকার কথা ছিল আমার স্পর্শ;

যে বনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে হারানোর কথা;

যে বনের মাতোয়ালা পথে এঁকে দেবার কথা

আমাদের যুগল পদরেখা।

সে বনের মালিকানা-বদলে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই!

একবারও কাঁপেনি হৃদয়ের ভাঁজ

একবারও মনে হয়নি কিছু হারালাম কোথাও!

আমি তো জানি—

প্রাপ্তি শুধু দৃশ্যমান বলয়ে নয়;

পরাজিত মানুষেরও থাকে অন্যরকম জয়!

 

কে আজ পরাজিত, কার হলো স্বপ্নভঙ্গ?

এমন স্বার্থান্বেষী দ্বিধারমুকুল ফোটেনি এই মনে।

কে কাকে কতটুকু চেয়েছিলাম;

কার দায়ে কতটুকু খোয়ালাম!

আমাদের প্রাপ্তির খাতায় স্বপ্ন বুনেছে

নানারকম অপ্রাপ্তি আর অর্থহীন উন্মাদনা!

উন্মাদনার কাছে গিয়ে আরও উন্মাদ হয়েছি;

মাতালের মতো পরিভ্রমণ করেছি আঁধারি অচেনা পথ!

 

আমরা দুজনেই ভুলে গেছি যৌথ চলাচল;

ভুলে গেছি; দরবিগলিত দীর্ঘশ্বাসে—

জখমের কাছে ছিল বেদনার শপথ!

 

 

 

কাঙ্ক্ষিত নির্বাসন

 

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

ভাতের লাগি নয়, একখান কাপড়ের লাগিও নয়

ব্যথিত বৈশাখ, খোঁয়ারি-স্বপ্নগ্রস্ত এইসব ভ্রূণহীন দিন

বিবর্ণ অনুভবে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া জীবনদৃশ্যাবলী

আমার ভালোলাগে না— আমি নির্বাসন চাই।

 

বিবেকের করিডোরে দীর্ঘশ্বাস পুড়ে যায় ব্যক্তিগত বোধ;

হিমঘরে শায়িত দুহিতা’র দেহ; ভীতু সেনাপতির মতো

দূরে বহুদূর, পালিয়ে যায় খোয়াবি ভোর! নাকছাবি প্রেম

প্রিয়তম আকাশ, বেহুলা বাতাসে— কাঁপে থরথর।

 

যেন চম্পকনগর ছাড়িয়ে গোটা জাহানময়—

ব্যাকরণহীন-ঔদ্ধত্য-উন্মাতালে সর্পকূলের মাতম!

শূন্য করতল, নীলক্ষতে কুঁকড়ে যায় অনিকেত প্রেম,

লোলুপ দৃষ্টিতে উপচানো ক্ষুধার্ত বাঘের দখলি-প্রান্তর

ঘ্রাণহীন-প্রাণহীন স্রোতের বিপরীতে স্তব্ধ বাকরুদ্ধ স্বর।

 

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

ভাতারের লাগি নয়; একখান ভিটার লাগিও নয়

অনন্ত ফেরারির মতো ক্ষমতা প্রহরীর সেয়ানা চোখ;

মাকড়সার জাল, নীল-নকশায় সাজানো দাবার ছক

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

 

প্রণত মস্তিষ্ক নয় অহিনকুল মত্ততায় বোধিবৃক্ষ মানুষ

কুহেলিকা রাত্রি— ব্যাঘ্র হুংকারে জাগে মন্বন্তর কুকুর!

বাতাসে লক্ষীপেঁচার ভুল সংকেত; গৈরিক বসনে—

কাঁদে জাহ্নবী-জল! ভালোবাসা পরে আছে লৌহশেকল!

 

অনিদ্রার আগুনে দগ্ধীভূত; ত্রাতাহীন অসহায় ত্রাণ

মায়ার নিবিড়ে অনুর্বরতা-প্রাণের নিবিড়ে মানবিক হ্রাস

ঊর্মিল উন্মাদনায় অনুভূতির জলাশয়ে শ্বাসরোধের চাষ;

কালকেউটের ছোবলে লীন পৃথিবীর মুখ-গ্রীবা-কণ্ঠস্বর

নালিশ নেই; ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবান—সমীপেষু বরাবর।

 

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

সোহাগের লাগি নয়; একখান সংসারের লাগিও নয়

জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি— ভালোবাসার শেষ সমর্পন

নতজানু প্রেম, পৌষালি চুমু— এই সব অকাল-সংযোগ;

আমার ভালোলাগে না; আমি নির্বাসন চাই।

 

 

 

 

 

কবি পরিচিতি:

 

বেনজির শিকদার এর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুরে। ছোটোবেলা থেকেই কবিতার সাথে সখ্য। শৈশব কেটেছে যমুনা, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা বেষ্টিত নির্জন প্রকৃতির কোলে। তিনি জীবন খুঁজে বেড়ান- বই প্রকৃতি সংগীত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির মাঝে। বর্তমানে বেনজির শিকদার সপরিবারে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।

 

প্রকাশিত গ্রন্থ:

নাকফুল (২০১৮)

অনুভূতির মিছিলে ভালোবাসার জীবাশ্ম (২০১৯)

দ্যুতিবিথার (২০২৩)