মসয়ূদ মান্নান ও বন্ধু আমার

প্রকাশিত: ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ, মে ১০, ২০২১

মসয়ূদ মান্নান ও বন্ধু আমার

কামরুল হাসান 

মসয়ূদ মান্নান আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। কলেজ জীবন থেকেই তাকে চিনি, চেনার সূত্র একই কলেজ নয়, আমরা দুটো ভিন্ন কলেজে পড়তাম। চেনার সূত্র বিতর্ক। কলেজ জীবনে আমরা দুজনেই বিতর্ক করতাম; বিতার্কিক হওয়া ছাড়াও মসয়ূদ ছিলো বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজক। ঢাকা তখনো একটি মফস্বলের-গন্ধ-লেগে-থাকা শহর, শ্বাসরুদ্ধকর ও জনবহুল নয়, খোলা জায়গা, মুক্ত বাতাসের শহর। এ শহরে প্রথম বিতর্ক ক্লাবটি সম্ভবত মসয়ূদই প্রতিষ্ঠা করেছিলো। তরুণ বয়স থেকেই সে ছিলো সংগঠক, নানা ধরণের কর্মকাণ্ডে জড়িত। নিজের বাবার নামে তার মা যে ‘বারী ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলো, সেই ক্লাব নিয়ে মেতে থাকতো মসয়ূদ। কিশোর বয়স থেকেই বিবিধ সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজে তার আগ্রহ, জন্মসূত্রেই সে একজন নেতা। তার দেহের দীর্ঘগঠন এক্ষেত্রে সহায়ক ছিলো। ধানমন্ডিতে ওর নানার বাড়িতে অনেকবারই গিয়েছি, যোগ দিয়েছি প্রাণবান আড্ডায়।
পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমরা সহপাঠী হই। তারও কিছুকাল পরে আমরা দুজনেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য মেডিকেল কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে দেই। আমি চলে যাই খড়গপুর আইআইটিতে, মসয়ূদ রয়ে যায় বুয়েটে। আমাদের ব্যাচের কারুরই তখনো অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়নি, মসয়ূদ দ্রুতই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয়, সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্যাডার ফরেন সার্ভিসে যোগ দেয়, আমাদের ঢের আগেই সে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। পরে সে আমাকে বলেছিলো, মেধা ছাড়াও তরুণ বয়সের বিতর্ক, সংগঠন করা, নেতৃত্বদান প্রভৃতি তাকে বিসিএসে উত্তীর্ণ হবার পেছনে, ভালো করার পেছনে অবদান রেখেছিল।
বড়ো ঘরে মসয়ূদ মান্নানের জন্ম। মা-বাবা দুজনেই নামকরা অধ্যাপক। বাবা ডা. আবদুল মান্নান নিউরোলজির আর মা বশিরা মান্নান দর্শনের অধ্যাপক। কলাবাগানে লেক সার্কাস রোডে তার বাবা নিউরোলজির একটি হাসপাতাল স্থাপন করেছেন, যার উপরে কয়েকটি ফ্লাট নিয়ে মসয়ূদরা থাকতো। ডা. মান্নান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ। কলাবাগান থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড পায়ে হাঁটা দূরত্বে। তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী আসনে, যে কটিয়াদীতে ছিল সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের ভিটে, বেশ কয়েকবার নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন, ছিলেন সংসদ সদস্য।
মসয়ূদ বেশ কিছু বছর ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছে। পৃথিবীর বহু দেশেই সে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। গ্রহটির যে দেশেই সে গেছে, বন্ধুদের আহবান জানিয়েছে সেদেশে বেড়াতে যেতে। সে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও অমায়িক। মসয়ূদ মান্নান যখন চীনে ছিল তখন আমায় উদাত্ত আহবান জানিয়েছিল বেইজিং যাওয়ার। কিশোরবয়সে অতিবাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি, সে কারণে মাও-জে-দুংয়ের চীন দেখার তুমুল আগ্রহ ছিল আমার। মসয়ূদ যখন একসঙ্গে আফ্রিকার পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূত, আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল অন্ধকার মহাদেশটির ইউরোপীয় আলোক-পাওয়া নগর কাসাব্লাঙ্কায় বেড়াতে যেতে। সে আমায় বলেছিল অন্ধকার রাতে মরুভূমের মাটিতে শুয়ে সংখ্যাতীত নক্ষত্রজ্বলা আকাশ দেখাবে। বলেছিল, সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা! সে বিরল দৃশ্য আমার দেখা হয়নি কেবল টাকার অভাবে, কেননা আমার বন্ধুর উষ্ণ আমন্ত্রণ ও আমার যাওয়ার আগ্রহ- দুটোই ছিল সমান টানটান।
মসয়ূদ যখন জার্মানীসহ ছয়টি ইউরোপীয় দেশের রাষ্ট্রদূত, তখনও সে আমায় ইউরোপ ভ্রমণে যেতে আহবান করেছিল। সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের অপূর্ব মেলবন্ধনের মহাদেশ ইউরোপ দেখা আমার আজন্মলালিত সাধ। বিমানভাড়া জোগাড় করতে পারিনি বলে সে আমন্ত্রণও আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তাই একবার যখন সে আমাকে তাসখন্দ যাবার আমন্ত্রণ জানাল, আমি প্রস্তাবটি খুবই আগ্রহের সাথে বিবেচনা করতে থাকলাম। কী করা যায়? আমার ছোট ভাই সৈয়দ খায়রুল হাসানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যাবি নাকি? চল, ঘুরে আসি ‘ আর কেউ নয়, স্বয়ং রাষ্ট্রদূতেরর আমন্ত্রণ ওর কাছে আকর্ষণীয় মনে হল। খায়রুল বিদেশে ঘুরেছে প্রচুর, কিন্তু কখনো কোনো রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণ পায়নি। সে রাজি হল। বড় ভাইয়ের কাছে তার একটি প্রতিশ্রুতি ছিল আফ্রিকার একটি দেশ ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনার। আফ্রিকা নয়, আমরা গিয়েছিলাম মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে।
মসয়ূদ আমায় বলোছিলো ‘মেঘদূত আবৃত্তি সংসদ’-এর সদস্যদের আহবান জানাতে, যদি তারা কেউ যেতে রাজি হয়, তবে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। মসয়ূদ নিজে কবিতা লেখে না, কিন্তু সে কবিতা ভালো আবৃত্তি করে। ‘মেঘদূত’ তারই প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। মেঘদূত ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আবৃত্তিদলগুলোর ভেতরে অন্যতম প্রাচীন, তাই বনেদী। যে বছরগুলোতে সে ঢাকায় পররাষ্ট্র দফতরে দায়িত্বরত ছিলো, সে বছরগুলোতে ‘মেঘদূত’ ঢাকায় অনেকগুলো কবিতাপাঠের আসর বসিয়েছিল। প্রধানত জার্মান কালচারাল সেন্টারে মেঘদূতের আসর বসত। জার্মানীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত থাকার সুবাদে জার্মান কালচারাল সেন্টারের পরিচালক, জার্মান রাষ্ট্রদূত প্রমুখের সাথে মসয়ূদের হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ওই কেন্দ্রের বাইরেও অনেকগুলো অনুষ্ঠান সে সংগঠিত করেছিল। এর একটি ছিল এল টোরো নামক গুলশানস্থ এক মেক্সিকান রেস্তরাঁয় চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার কবিতা নিয়ে অনুষ্ঠান। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় মাতৃভাষা নিয়ে লেখা কবিতা নিয়ে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি সে আয়োজন করেছিল বনানীর ইকবাল সেন্টারের দশ তলায়। শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মৃতিসৌধেও মেঘদূতের কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেছিল বিরল সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মসয়ূদ মান্নান।
কবিতা লিখি ও আবৃত্তি করি বলে মসয়ূদ সর্বদাই আমাকে ডাকতো এবং আমি দর্শক হিসেবে নয়, অংশগ্রহণকারী হিসেবেই সেসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। মূল অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হবার আগে তার ইস্কাটন ও কলাবাগানের বাসায় মেঘদূত সদস্যদের রিহার্সাল চলতো। বিবিধ ব্যস্ততার মাঝে জড়িয়ে থাকলেও আমি সেসব রিহার্সালে যোগ দিতাম। উষ্ণ আড্ডা ছাড়াও চমৎকার সব খাবার মিলতো, আর মসয়ূদের সঙ্গ ছিলো প্রাণপূর্ণ । এসব আড্ডার মধ্য দিয়ে আমি মসয়ূদের আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। সে হচ্ছে আমার কবিতার একজন ভক্তপাঠক এবং আমার কবিতা সম্পর্কে উচ্চধারণা পোষণকারী।
পরামর্শ মেনে মসয়ূদের পক্ষ থেকে আমি মেঘদূতের সদস্যদের তাসখন্দ বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণ জানাই। আমি একে একে ডা. ফারহানা, কবি সৌমিত্র দেব, কবি দিনার সুলতানা বিন্তী, ব্যাংকার সালাহ উদদীন ও মুতাকিল্লা- মেঘদূতের সক্রিয় সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করি। বিবিধ কারণে মেঘদূতের অন্য সদস্যরা উজবেকিস্তান ভ্রমণে যেতে পারেনি। তখন আমরা দুভাই চলে যাই সেই দেশে যে দেশ থেকে মোগলরা এসেছিল আর ভারতবর্ষ শাসন করেছিল ৩৩১ বছর। তাসখন্দে আমরা আতিথ্য নেই রাষ্ট্রদূত ও তার সুযোগ্য সহধর্মিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নুজহাত মান্নানের বাড়িতে। বাড়িটি দেখে আমি ভীষণ মুগ্ধ হই। বস্তুত জীবনে যত বাড়িতে থেকেছি সেসবের ভিতর এটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনদিন আমরা রাজার হালে ঘুরে বেড়াই তাসখন্দে।
প্রথমদিনেই মসয়ূদ আমাদের তাসখন্দ চিত্রশালায় নিয়ে যায় চিত্রকলা দেখাতে। সেখানে ফুলের মতো সুন্দর উজবেক শিশুদের একটি অনুষ্ঠান আমরা উপভোগ করি। এরপরে মসয়ূদ আমাদের নিয়ে যায় একটি রাষ্ট্রিয় ভোজসভায় যেখানে উপস্থিত ছিলেন উজবেকিস্থানের উপ-প্রধানমন্ত্রী। পরিচিত হই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে। পরদিন সে আমাদের পাঠায় উজবেকিস্তানের জাতীয় কবির নামে নামাঙ্কিত আলীশের নভই অপেরা ও ব্যালে থিয়েটারে একটি রাশান অপেরা দেখতে। সেই প্রথম অপেরা দেখা আমার। আমার বন্ধুটি শিল্পের রসগ্রাহী বোদ্ধা, সে অবকাশ পেলেই এখানে থিয়েটার দেখে, চলে যায় চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনে, যোগ দেয় সঙ্গীতের আসরে। তার জীবন শিল্পসম্মত, ঈর্ষা করার মতো নান্দনিক।
পরে মসয়ূদ একটি ট্যুর কোম্পানির সাথে আমাদের ট্যাগ করে দেয়। স্বয়ং রাষ্ট্রদূত ডেকে এনেছেন, ট্যুর কোম্পানির মালিক আমাদের সাথে গাইড হিসেবে যেতে রাজী হন। এর ফলে আমাদের ভ্রমণটি সহজ হয়ে যায়। কেবল যে অচেনা জায়গাগুলো ঠিকভাবে চেনা তাই নয়, উজবেকদের সাথে কথা বলাও সহজ হয়ে যায়। কোম্পানির মালিক দোভাষির ভূমিকাটি নেন। উজবেকরা ইংরেজি জানে না। উজবেক ভাষা ছাড়া, দীর্ঘদিন সোভিয়েত ব্লকে থাকার কারণে রাশান ভাষা জানে।
আমরা প্রথমে তাসখন্দ থেকে বিমানে উড়ে চলে যাই উজবেকিস্তানের পশ্চিমপ্রান্তের অতিপ্রাচীন নগরী খিভায়। যে বিমানবন্দরে প্লেন নেমেছিল সেই উরগেনচে বর্বর চেঙ্গিস খানের সৈন্যদের হাতে লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ উজবেক নিহত হয়েছিল। খিভায় গিয়ে মনে হয়েছিল সময় ও সভ্যতা বুঝি থেমে আছে মধ্যযুগে। আমাদের হোটেলটি ছিল খিভা দুর্গের ঠিক সমুখে। দীর্ঘকাল উজবেকিস্তান শাসন করা চেঙ্গিশ খানের বংশধরেরা এ দুর্গ র্নিমাণ করেছিল। দুর্গটি একটি মিনি শহরের মতো, যার ভেতরে যেমন মসজিদ ছিল কয়েকটি, ছিল কবরখানা ও মাদ্রাসা, তেমনি ছিল হারেম। খিভা থেকে আমরা মোটরগাড়িতে চড়ে ঐতিহাসিক নগরী বুখারায় আসি। একটি গোটা দিন লেগেছিল সে যাত্রায় পথে পড়েছিল মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত নদী আমু দরিয়া। আমরা এমন একটি শহর পার হয়েছিলাম যেখানে চেঙ্গিস খানের সৈন্যদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হয়েছিল উজবেক বীর জালালউদ্দিন মাঙ্গুবের্দী । আমাদের গাড়ি পাড়ি দিয়েছিল উজবেকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকা কিজিল কুম মরুভূমি।
বুখারায় আমাদের হোটেলটি ছিল নাসিরুদ্ধিন হোজ্জার কথিত জন্মস্থান সংলগ্ন ঐতিহাসিক চত্বর হোসে কাউসে। এর চারপাশেই দুর্গ আর মাদ্রাসা। আমরা খিভার আর্ক দুর্গ আর কল্যান মিনার দেখে মোহিত হয়েছিলাম। বুখারা থেকে ফের গাড়িতে আরেক ঐতিহাসিক নগরী সমরকন্দে গিয়েছিলাম। পথে পড়েছিল বিখ্যাত সুফিসাধক বাহাউদ্দিন নকসবন্দি এবং ইমাম বুখারির সমাধিস্থল। সমরকন্দের রেজিয়া চত্বরে তিন বিখ্যাত মাদ্রাসা, উজবেকিস্তানের জাতীয় নেতা তৈমুর লংয়ের সমাধি ও মধ্যযুগের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ উলুগ বেগের মানমন্দির দেখা ছিল বিস্ময়ের পর বিস্ময়। পরে আমরা সুপারফাস্ট ট্রেনে করে ফিরে এসেছিলাম তাসখন্দ।
সমরকন্দ থেকে ফিরেই খায়রুল বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিল। সেই রাতে ডিনারের পর মসয়ূদের সাথে দোতালার প্রকাণ্ড বসার ঘরটিতে বসে দীর্ঘ আলাপ হলো। নিচের প্রধান বৈঠকখানার ঠিক উপরে একই পরিমানের এটি দ্বিতীয় বৈঠকখানা। যদিও চারপাশে আরামপ্রদ ভেলভেট মোড়ানো সোফা ছিল আমরা আরাম করে লাল পুরু কার্পেটের মখমলে বসেছিলাম। আমাদের মাঝে ছিল বাহারি তৈজসে ভরা একটি অনুচ্চ কাঠের টেবিল, যেখানে নুজহাত ভাবী এসে মাঝে মাঝে চা ও বিভিন্ন ফলমূল রেখে গিয়েছিলেন। তাতে আলোচনার কোনো বিঘ্ন ঘটেনি, বরঞ্চ প্রণোদনা বেড়েছিল। তার পরদিন এ গৃহে একদল অতিথি আসবে আমারই সৌজন্যে, তাদের আপ্যায়নের বিস্তৃত ব্যবস্থা সামাল দিতে ভাবী ব্যস্ত, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাই তিনি আড্ডায় যোগ দিতে পারেননি।
মসয়ূদ নিজে খুব ক্যারিয়ার সচেতন যার প্রমাণ সে তার ঈর্ষাজনক ক্যারিয়ার সাফল্যে রেখেছে। ক্যারিয়ারে সাফল্যঅর্জন তার জীবনের একটি প্রধান প্রণোদনা। কেবল নিজের ক্যারিয়ার নয়, সে তার ব্যাচের সকল বন্ধুদের ক্যারিয়ারের খোঁজখবর রাখে, কে কোন শীর্ষ ছুঁয়েছে, সেসব নিয়ে রীতিমতো ভাবে। মসয়ূদকে বন্ধুদের ক্যারিয়ারের বিবিধ উত্থানপতনের ও বিচিত্র বাঁকবদলের খবরাখবরের এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যেতে পারে। সে সত্যি খুব বন্ধুবৎসল মানুষ, কৈশোর ও প্রাকযৌবনের সাথীদের ঘনিষ্ঠ মনে রেখেছে।
অনেক বিষয়েই খোলাখুলি সে তার অভিমত প্রকাশ করে যায়, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেই হয়তো সে আমাকে বলে। তার কাছেই জানতে পারি আমাদের ব্যাচের একজন আমেরিকার সিটি ব্যাংকে মাসে এক কোটি টাকা বেতন পেত, ব্যাচমেটদের মাঝে সেটাই ছিলো সর্বোচ্চ বেতন- যা কেউ পেয়েছে। ডাক্তার বন্ধুদের অনেককেই সে আর্থিকভাবে অত্যন্ত সফল মনে করে, তবে এও বলে তাদের প্রতিভা ছিলো চিকিৎসাবিজ্ঞানী হবার, নোবেল পুরস্কার অর্জনও বিচিত্র ছিল না। মসয়ূদের আক্ষেপ আমাদের ব্যাচের এখন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, কিন্তু আমরা সেটা পারিনি, অথচ জীবন ফুরিয়ে আসছে। সে জানাল আমাদের চেয়ে দশ বছর কম যাদের বয়স, তাদের যে সাফল্য ও অর্জন, আমাদের ব্যাচের তা হয়নি। এটা মসয়ূদকে বিমর্ষ রাখে। তার চেহারায় একটি বিষন্ন ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। আমি তাকে বলি আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মাঝে সে-ই সর্বোচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, খ্যাতি, সরকারি চাকুরির সুখ-অসুখ, দেশভ্রমণ, দাম্পত্যজীবনের সুখ, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র, আমেরিকা, উজবেকিস্তান, বাংলাদেশ- অনেক বিষয়ই আলোচনায় ঠাঁই পেতে থাকে। ভ্রমণক্লান্ত আমার চোখ, মসয়ূদের চোখে নতুন নতুন সমস্ত বিষয়ের আলো ঝিকমিক করে। সে কথা বলে আত্মবিশ্বাসের সাথে, আর বলেও চমৎকার।
সে তার জীবন নিয়ে খুব পরিতৃপ্ত। এক ছোট জীবনে সে এতকিছু দেখেছে যে নিজেকে মহাসৌভাগ্যবান মনে করে। কী করে তার এক খালুর পরামর্শে সে বিসিএস পরীক্ষার ফর্ম এনে তড়িঘড়ি পরীক্ষা দিয়েছিল সে বৃত্তান্ত জানাল। সে ছিলো তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তের ফসল আজকের মসয়ূদ মান্নান। গ্রহটির বহু কোন তার দেখা, বহু সংস্কৃতি তার চেনা। অনেক দর্শন আর ভ্রমণে পরিশ্রান্ত মসয়ূদ জানালো, এখন আর কোনো কিছুই তাকে আকৃষ্ট করে না। মসয়ূদ জানে আমার ক্যারিয়ার বলে কিছু হয়নি, তবে কবি হিসেবে সে আমাকে মূল্যবান মনে করে, মনে করে সময়ের প্রবাহে অন্য অনেক কিছুই হয়তো ভেসে যাবে, কবিতা টিঁকে থাকবে, সঙ্গে কবির নামটিও। থাকবে কি? মহাকাল বড় নির্দয় আর কালের প্রবাহে সবই খড়কুটো, সবই ভেসে যায়।
মসয়ূদ তার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রের ক্যারিয়ার সাফল্যে খুব খুশি, গর্বিত। গর্ব করার মতোই তাদের অর্জন। নুজহাত পিএইচডি করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন অনেক বছর। নভো ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টার্ডামে একটি আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থার সাথে কাজ করছে। মসয়ূদ মান্নান পৃথিবীর অনেক দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, তার আগে দূতাবাসের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিল। দেখেছে সারা পৃথিবীর মানুষ। তার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে উজবেকিস্তানের মানুষ। আশ্চর্য নয় নভো বিয়ে করেছে এক উজবেক স্থপতির সুন্দরী মেয়েকেই।
তাসখন্দে আসার পরদিন আমাকে ও খায়রুলকে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে গিয়েছিল মসয়ূদ। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দূতাবাসের সকলের সাথে। মসয়ূদের সময়েই উজবেবিস্তানে বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাস ভবন নির্মিত হয়। চলে আসার একদিন আগে সেখানে গিয়েছিলাম শেষবারের মতো। মসয়ূদ তার গাড়িতে চড়িয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এখানকার বিখ্যাত পিজা দোকানটির পিজা খাওয়াতে। দূতাবাসের তিন উজবেক সুন্দরী আজিজা, রানু ও দিনারা ছিল সাথে। আমার মনে আছে খুব বড় নয় রেস্তোরাঁটি, তবে অভিজাত। চমৎকার অভ্যন্তরভাগে সৌখিন আসবাব পাতা, ছিল বিম্বিত হবার দর্পণ, তৈজসপত্রেও বনেদীয়ানার ছাপ। কুলিন দোকানটি কিছুটা জনবিরল, অনুমান করি খাবারের উচ্চমূল্যই এর কারণ। আমার বন্ধুটি আমাকে একটি ভালো অভিজ্ঞতা উপহার দিতে চেয়েছিল, অন্য কারণ আমাদের উজবেক ভ্রমণে যে তিন নারী সহায়তা করেছে, বিশেষ করে রানু ও আজিজা- আমি যেন তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে পারি, নিতে পারি আড়ম্বরপূর্ণ বিদায়, যাতে কৃতজ্ঞতা ও ফর্মালিটি থাকবে, পিছুটান বা আবেগ থাকবে না।
সবচেয়ে বড়ো চমক ছিল সে আমার সম্মানার্থে তাসখন্দের একদল কবিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তার গৃহে। বাড়ি ফিরে দেখি এই অসম্ভব আলোকবাহী বাড়িটি তার সহস্র দীপ জ্বেলে অতিথিবরণে প্রস্তুত। সেদিন সন্ধ্যায় উজবেক লেখকসংঘ থেকে ছয়জন কবি এসেছিলেন রাষ্টদূতেরর আমন্ত্রণে। আমি যখন তাসখন্দে বেড়াবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মসয়ূদকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, তখন সে যে বিস্তৃত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভ্রমণপঞ্জি আমার জন্য প্রস্তুত করেছিল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিলো এই কবিসভা। আমন্ত্রিত কবিরা একে একে আলোকিত বৈঠকখানায় এসে আসন গ্রহণ করেছিলেন। দরোজার প্রবেশমুখে মসয়ূদ তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, আমিও তাদের সাথে হাত মিলিয়েছিলাম, সালাম বিনিময় করেছিলাম। প্রথা হলো আমন্ত্রিত অতিথিরা রাষ্ট্রদূতের বাসায় রাখা স্বাক্ষরবইয়ে যার যার নাম স্বাক্ষর করবেন, এতে একটি চমৎকার রেকর্ডও থেকে যায়। প্রথমেই পরিচয়ের পালা। আমন্ত্রিত কবিদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন সিরজদ্দিন সাঈদ, তিনি উজবেকিস্তানের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত। শুনে আমি কিছুটা চমকে উঠি। তাহলে বেশ উঁচুস্তরের কবিরাই এসেছেন রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে তার কবিবন্ধুর সাথে পরিচিত হতে। তিনিই নেতৃত্বের ভূমিকাটি নিলেন। অন্য দু’জন বয়েসী কবির নাম মাখমুদ তৈয়র ও ইকবাল মির্জা। যখন জানলাম তারা দু’জনও উজবেকিস্তানের জাতীয় কবি তখন বুঝলাম এখানে একাধিক জাতীয় কবি রয়েছেন। উপরন্তু শেষোক্ত দু’জন সিনেটর। অন্য চারজন কবি হলেন সিরজদ্দিন রউফ, গায়রাত মজিদ, নাদির জনুজক ও আধখামবেক আইমবেকভ। এই কবিসভাটি ছিল আমার জীবনের কবি হিসেবে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠসভা।
যেদিন ফিরে আসি সেদিন জরুরি কাজ থাকায় মসয়ূদ ভোরেই দূতাবাসে চলে গিয়েছিল। ইমিগ্রেশন ফরমালিটি শেষ করে ফিরতেই দেখি আমাকে বিদায় জানাতে সস্ত্রীক বিমানবন্দরে উপস্থিত দীর্ঘদেহী, জনারণ্যে নির্ভুলভাবে শনাক্তযোগ্য আমার অমলিন বন্ধুটি। লম্বা ওভারকোট ও হ্যাটপরা বিদেশী পোষাকের মসয়ূদের পাশে সিল্কের শাড়িপরিহিতা নুজহাত ভাবী খাটি বাঙালি। তাদের এই হার্দিক উষ্ণতায় অভিভূত হই। এই হলো আমার বন্ধু- উচ্চাসনে গিয়েও সে তার বন্ধুকে বিন্দুমাত্র ভুলে যায়নি। আমার উজবেকিস্তান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছি ‘আমির তিমুরের দেশে’। বইটি উৎসর্গ করেছি মসয়ূদ মান্নান, নুজহাত মান্নান ও আমার ছোটো ভাইকে।
২০১৩ থেকে ২০২০ এই সাত বছর সে ছিল মধ্য এশিয়ার চারটি দেশ উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, কাজাকিস্তান ও কিরঘিজস্তানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। উজবেকিস্তান থেকেই সে বাকি চারটি দেশের কাজ চালাত, প্রায়শই ভ্রমণ করতো সেসব দেশ। করোনাকালের মধ্যেই সে উজবেক ও ইংরেজি ভাষায় বাংলা কবিতার একটি সংকলন প্রকাশ করে। সংকলনটির নাম Poetry in New Normal। এটিই প্রথম নয়। এর আগেও বাংলা কবিতার একটি এনথোলজি সে প্রকাশ করেছিল, তাতে সংকলিত ছিল সিনিয়র কবিরা।
মসয়ূদ এখন তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। আমাকে অগ্রিম আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে! সে চায় মুসলিম ঐতিহ্য ও অটোমান সাম্রাজ্যের দেশ তুরস্ক নিয়ে আমি একটি বই লিখি। করোনাকাল কেটে গেলে আমার তীব্র ইচ্ছে আছে অর্ধেক এশিয়া আর অর্ধেক ইউরোপ তুরস্কে যাওয়ার। আর গেলে তো লেখা হবেই। আমার হৃদয়বান বন্ধুকে উষ্ণ ভালোবাসা জানাই।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31