মহাকালে রেখাপাত

প্রকাশিত: ২:৪৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৩, ২০২২

মহাকালে রেখাপাত

স্বকৃত নোমান

 

চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাওসেতুং চড়ুই পাখিকে মানুষের শত্রু জ্ঞান করেছিলেন।

 

বলেছিলেন, মশা-মাছি-ইঁদুর ও চড়ুই মানুষের শত্রু, এদেরকে দমন করতে হবে। কুকুর পালনও নিষিদ্ধ ছিল তখন। মাও সরকার মনে করত, কুকুর পালা বুর্জোয়া বিলাসিতা; একে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রশ্রয় দিতে পারে না। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চীনে কুকুর ছিল সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত।
ইঁদুর, মশা আর মাছি মারায় উপকার হয়েছিল হয়তো। কুকুরকে বঞ্চিত রেখে কী উপকার হয়েছিল জানি না। কিন্তু চড়ুই পাখি কী দোষ করেছিল? কেন তাদের নিধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল? মাওসেতুং মনে করতেন, চড়ুই পাখি খেতের শস্য খেয়ে ফেলে। তাই চড়ুই পাখিও মেরে ফেলতে হবে। নির্দেশ তামিল হলো। মারা হলো লাখ লাখ চড়ুই। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও অংশ নিয়েছিল চড়ুই নিধনে।
অর্থাৎ মাওসেতুং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের উল্লঙ্ঘন করেছিলেন। সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সর্বপ্রাণবাদকে অস্বীকার করে বসেছিলেন। ভেবেছিলেন এই পৃথিবী কেবল মানুষের, প্রকৃতির গৌণ সন্তানরা এই পৃথিবীতে থাকতে পারবে না। ফলাফল হলো উল্টো। ফল পাওয়া গেল পরের বছরই। চড়ুই কমে যাওয়ায় বেড়ে গেল শস্য ধ্বংসকারী কীটের উপদ্রব। দেখা গেল, চড়ুই যতটা শস্য খেত, তার চেয়ে কীটের কারণে কয়েক গুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে।
আমি ভাবি ভারতবর্ষের কথা। কৃষিপ্রধান ভারতে দেখতে পাই সর্বপ্রাণের জয়জয়কার। ভারতীয় পুরাণে কোনো প্রাণকেই গৌণ করে দেখা হয়নি, প্রত্যেক প্রাণকে ভাবা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ, দেখা হয়েছে মানুষের পরিপূরক হিসেবে। হিন্দু দেব-দেবীরা তো নিজেদের বাহন হিসেবে বিভিন্ন প্রাণীকে নিয়েছেন। শিবের বাহন নন্দী বা ষাঁড়, দুর্গার বাহন সিংহ, বিষ্ণুর গরুড় বা ঈগল, ব্রহ্মার রাজহাঁস, গণেষের ইঁদুর, কার্তিকের ময়ূর এবং ইন্দ্রের হাতি। এভাবে প্রত্যেক দেবতার বাহন বিভিন্ন প্রাণী। কোনো দেবতার বাহন মানুষ নয়। একেক প্রাণীকে নিজেদের বাহন করে সম্মানের আসনে অধিষ্টিত করা হয়েছে। অর্থাৎ কৃষির সঙ্গে পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
বাল্মিকীর ‘রামায়ণে’ দেখতে পাই পবনপুত্র হনুমানকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদা, বলা হয়েছে মহাবীর। হনুমান প্রাণীটি এই মহাকাব্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মহাভারতেও কি সর্বপ্রাণকে উপেক্ষা করা হয়েছে? মোটেই না। অঙ্গরাজ্যে জরাসন্ধকে পরাজিত করলেন মহাবীর কর্ণ। প্রতিশ্রুতি দিলেন কোনো একদিন তিনি জরাসন্ধের পক্ষে লড়বেন। জরাসন্ধ একদিন ডেকে পাঠালেন কর্ণকে। দ্বারকা অধিপতি শ্রীকৃষ্ণের বিরুদ্ধে লড়বে জরাসন্ধ, লাগবে কর্ণের সহায়তা।
জরাসন্ধের দূতের ছদ্মবেশে কর্ণের কাছে এলেন কৃষ্ণ। রথে চড়িয়ে কর্ণকে নিয়ে চললেন যুদ্ধের মাঠে। পথে একটি নদী পড়ল। কৃষ্ণ বললেন, ‘রথ নিয়ে তো নদী পার হওয়া যাবে না। অঙ্গরাজ, আপনি আপনার শক্তিশালী বাণ নিক্ষেপ করে এই নদী শুকিয়ে দিন।’ কর্ণ বললেন, ‘না, এই নদীতে রয়েছে অসংখ্য মাছ। নদী শুকিয়ে দিলে তারা মারা পড়বে। আমি তা করতে পারি না।’ অর্থাৎ নিরপরাধ প্রাণীহত্যাকে নিরুৎসাহিত করা হলো। এখানেই সর্বপ্রাণবাদের গুরুত্ব।
কুরুক্ষেত্রের অদূরে কর্ণের অসহায় মৃত্যুর কারণ কী? কারণ একটি গরু। একটি গরুই ছিল তার মৃত্যুর কারণ। একদিন তিনি নিরপরাধ এক গোবাছুরকে একটি কর্দমাক্ত ডোবায় ভুলবশত বাণ মেরে হত্যা করেছিলেন। গরুর মালিক অভিশাপ দিয়েছিল, যেভাবে এই বাছুর অসহায় অবস্থায় মরেছে, ঠিক একইভাবে কর্ণও একদিন এমনই অসহায় অবস্থায় মারা পড়বে। কেউ তার সাহায্যকারী থাকবে না।
মহাভারতের মহাপ্রস্থান অধ্যায়ে দেখি কুকুরের গুরুত্ব। পাণ্ডবরা যখন মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করলেন তখন তাদের পিছু নিল একটি কুকুর। দেবরাজ ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে বললেন স্বর্গে প্রবেশ করতে। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘এই কুকুর আমার ভক্ত। আমার ইচ্ছা কুকুরিটও আমার সঙ্গে স্বর্গে যাবে।’ ইন্দ্র বললেন, ‘মহারাজ, আপনি স্বর্গসুখের মালিক হয়েছেন। এই কুকুর এবার ছাড়ুন। যার কুকুর থাকে সে স্বর্গে যেতে পারে না।’ যুধিষ্ঠির বললেন, ‘এই কুকুর ছাড়া আমি স্বর্গ চাই না।’
আর সাপ? নাগরাজ বাসুকি তো শিবের গলায় নেকলেস হয়ে শোভা বৃদ্ধি করছে। বিষ্ণু শুয়ে আছেন শীষনাগের ওপর ভর করে। সমুদ্র মন্থনের সময় কূর্ম তথা কাছিমের রূপ ধরে মান্দার পর্বতকে নিজের পীঠে তুলে নিতে সংকোচ করেননি বিষ্ণু। হীরণ্যাক্ষের হাত থেকে ভূদেবী তথা পৃথিবীকে উদ্ধার করতে তিনি বরাহের রূপ ধারণ করতেও সংকোচ করেননি। হিরণকশ্যপকে বধ করতে তিনি সিংহের রূপ ধারতেও দ্বিধা করেননি।
মধ্যযুগের ‘পদ্মপুরাণ’ বা ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যেও দেখতে পাই সাপের উচ্চ আসন। চাঁদ সওদাগর কিছুতেই সর্পদেবী মনসার পূজা দেবেন না। মনসা সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলেন চাঁদের নৌবহর। চাঁদপুত্র লক্ষীন্দরের বাসরঘরে ঢুকে লক্ষীন্দরকে করলেন দংশন। এক পর্যায়ে চাঁদ সওদাগর মনসাকে পূজা দিতে বাধ্য হলেন। যে সাপকে তিনি নিকৃষ্ট মনে করলেন তার কাছেই তাকে হার মানতে হলো। এখানেই সাপের মাহাত্ম্য। এখানেই সর্বপ্রাণের গুরুত্ব।

 

শুধু প্রাণী কেন, ভারতবর্ষে গাছপালা-তৃণলতাকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বট, তুলসি, বেল, অর্জুন, অশোক, কলাসহ প্রত্যেক গাছ-বৃক্ষকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। সে কারণেই দেখবেন, হিন্দুরা বড় কোনো বৃক্ষ দেখলে তাকে প্রণাম করছে, তার বেদীতে ফুল-ফল দিচ্ছে। নদী-নদী-সমুদ্রও ভারতীয় পুরাণে গুরুত্বপূর্ণ। শিব তার জটায় ধারণ করে আছেন নদী গঙ্গাকে। মরুভূমি ও যন্ত্রসভ্যতার সুবিধাভোগী মানুষদের পক্ষে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের এসব মিথলজি বুঝে ওঠা কঠিন।

ভারতবর্ষ সর্বভূতের মধ্যে মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল। সে কারণেই উপনিষদে উল্লেখ, ‘যে মানুষ আপনাকে সর্বভূতের মধ্যে ও সর্বভূতকে আপনার মধ্যে এক করিয়া দেখিয়াছে সেই সত্যকে  দেখিয়াছে ।

 

১২.০৮.২০২২