মাতৃহন্তা

প্রকাশিত: ১১:৪০ অপরাহ্ণ, জুন ১৩, ২০২১

মাতৃহন্তা

জাকির তালুকদার
এই পরগণায় কোনো বটগাছ নেই। শুধু এই গাঁয়ের কথা ধরলে তো নেই-ই। গাঁয়ের পুরুষরা কোনোদিন বটগাছের কথা রমণীদের সামনে উচ্চারণ করেনি। আর নারীদের কয়েক প্রজন্ম যেহেতু বটগাছ চোখে দেখেনি, তাই তারা জানত না আদৌ বটগাছ নামের কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে কি না। যেহেতু পরগণার মেয়েদের বিবাহ-নাইয়র সবকিছু এই পরগণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তাই তাদের যাতায়াতের চৌহদ্দিও এই পরগণাই। তারা তাদের পতিদের চিনত। পতিগৃহে আসবার আগে তারা শিখত বালিশে ফুলতোলা, কাঁথায় নকশা তোলা, রন্ধনকলা আর সবজি বাগানের পরিচর্যা। বর্ষিয়সী পরিবার-নেত্রীর কাছে শিখত নামাজ-কালাম। এককথায় তাদেরকে প্রস্তুত করা হতো উপযুক্তরূপে পতিগৃহে যাত্রার জন্য। নারীরা যেহেতু কোনোভাবেই পরগণার বাইরে পা রাখত না, তাই তাদের চেনা বলতে ছিল আখক্ষেত, কলার বাগান, শস্যপূর্ণ ক্ষেত-খামার। কিন্তু এতদিনে এসে কোনো কোনো নারী পরগণার বাইরে পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে। পুরুষরা তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও, প্রায় মেনেই নিয়েছিল নারীদের এই পরগণাবৃত্তের বাহিরে সীমানা প্রসারিত করা। যদিও পুরোহিত এবং মৌলবীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, নারীদের এই বৃত্ত অতিক্রম সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনবে, তবুও পুরুষরা নারীদের এই একটুখানি আগলভাঙাকে নারীসুভল চপলতা বলে মেনেই নিয়েছিল। কিন্তু তারা সবাই তটস্থ হয়ে উঠল, যখন নারীরা অন্যত্র গিয়ে বটবৃক্ষ দেখে ফেলল। পুরুষরা ভাবতেও পারেনি এমনটা ঘটতে পারে। তাদের ধারণা ছিল, অন্য পরগণায় গিয়ে নারীরা শুধু বায়োস্কোপ কিংবা পুতুল নাচ দেখবে, গঞ্জে চুড়ি-বেলোয়াড়ির মোহন নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘরে ফিরবে আর পতিদের কাছে ব্রীড়াবনত আবদার করবে ঐসব বস্তু লভ্য হিসাবে পাবার জন্য। বলতে গেলে, পুরুষরা আগাম প্রস্তুত ছিল এসব ব্যাপারে। সত্যি বলতে, কেউ কেউ পয়সাও জমিয়ে রেখেছিল তাদের রমণীদের আবদার পূরণের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু নারীদের চোখে বটবৃক্ষ ঠিকই পড়ে গেল। আসলে বটবৃক্ষ তো কোনোমতেই চোখে না পড়ার জিনিস নয়। পুরুষরা মিথ্যেই নিজেদের সুরক্ষিত ভেবেছিল আর নারীদের ভেবেছিল বিলাসনিমগ্না।
হয়তো একজন রমণী কিংবা একাধিক রমণী প্রথমে দেখেছিল বটবৃক্ষ। কিন্তু এ কথা তারা উচ্চারণ করেনি তাদের পুরুষদের কাছে। প্রমাণ করেছে, নারীরা কথা গোপনে রাখতে সক্ষম নয়, এই জনশ্রুতি সর্বাংশে ভুল। শুধু গোপন রাখতেই নয় গোপনে সঞ্চারিত করতেও তারা সক্ষম। অন্য পরগণায় গিয়ে তারা একে একে দেখে এলো বটবৃক্ষের কাঠামো। তারপর মন্ত্রণা যখন কর্মোদ্যোগে পরিণত হবার সাবালকত্ব পেল, একদিন তারা সবাই একত্রিত হলো গ্রামের বারোয়ারিতলায়। পুরুষদের আহত, বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও রুদ্ধবাক করে দিয়ে রমণীগণ বলল– আমরা এখানে একটি বটবৃক্ষের চারা রোপণ করব।
পুরুষদের রুদ্ধবাক হবার মূল কারণ, নারীরা কিন্তু বটবৃক্ষ রোপণের অনুমতি চায়নি বরং রোপনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
পুরুষদের হতচকিতভাব রমণীদের কলকণ্ঠ হবার বর্ধিত সুযোগ এনে দিল। তারা শতকণ্ঠে বলতে লাগল– বটবৃক্ষের উপস্থিতির আশীর্বাদ থেকে এই গ্রাম দীর্ঘবঞ্চিত। ক্লান্ত পথিককুল পায় না ছায়া শীতলতা, পাখিরা বঞ্চিত হয় আশ্রয়স্থল থেকে। প্রকৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ শোভা থেকে বঞ্চিত গ্রামের মানুষ। অতএব অচিরেই আয়োজন করা দরকার বটবৃক্ষের চারা রোপণ উৎসব।
পুরুষরা বিপক্ষে অনেক কথাই বলতে পারত। বলতে পারত বটবৃক্ষ অনেক নিচ থেকে পানি টেনে আনে শিকড় ছড়িয়ে। কেড়ে নেয় অন্য উদ্ভিদের পুষ্টি ও প্রাণ। বলতে পারত, রাতে বটবৃক্ষে আশ্রয় নেয় বিদঘুটে এক প্রাণী, বাদুড়, যারা যে মুখে খায় সেই মুখ দিয়েই মলত্যাগ করে। কিন্তু সেই যে গোপাল ভাঁড় প্রমাণ করেছিলেন, ধাক্কা খেলে মানুষ সেই কথাটাই বলে ফেলে যে কথাটাকে অবচেতনে সে বিশ্বাস করে। তেমনি পুরুষরা প্রথমেই বলে– ভার্যাদের কাছে পতিপুরুষই তো বটবৃক্ষ। পুরুষই তো ছায়া দেয়, আশ্রয় দেয়, রমণীর শিকড়ে জল দেয়, তার পুষ্টি জোগায়। তাহলে স্থবির বটবৃক্ষের জন্য এই নিরর্থক আয়োজন কেন!
নারীরা অনমনীয় রইল। তারা দাবি করে বলল– বটবৃক্ষহীন কোনো পরগণা নেই, যেমন নেই নদীহীন কোনো জনপদ। কাজেই তাদের পরগণাকে পূর্ণাঙ্গতা দিতে এই গাঁয়ে বটবৃক্ষ রোপণ জরুরি।
পরবর্তী রাতে এক অবাক ঘটনা ঘটল। সারারাত জেগে বসেছিল রমণীরা। কিন্তু কারো পুরুষই ঘরে ছিল না। প্রত্যেক রমণীই ভেবেছিল, শুধু তার পুরুষই বোধহয় ঘরের বাহিরে। কিন্তু পরদিন পুকুরঘাটে পরস্পর আলোচনায় গ্রামের সকল নারী জানতে পারল যে, গাঁয়ের কোনো পুরুষই ঘরে ছিল না গতরাতে। ব্যাপারটাতে সবাই সন্দেহ আর ষড়যন্ত্রের আভাস পেল। নিশ্চয়ই বটবৃক্ষ সংক্রান্ত কোনো মন্ত্রণায় গ্রামের পুরুষকুল একত্রিত হয়ে রাত কাবার করেছে। সবাই সিদ্ধান্ত নিল, আজ তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ পুরুষকে জেরা করবে।
কিন্তু সন্ধ্যা থেকেই পুরুষরা উধাও। রমণীদের বেড়ে রাখা ভাত জুড়িয়ে যায়, তরকারি বিস্বাদ হয়ে যায়, পায়েশ জমে যায় আর রাত বাড়তে থাকে। তখন রমণীরা বুঝে ফেলে পুরুষরা আজো ফিরবে না। তাদের ইচ্ছা হয় খুঁজতে বেরোয়। কিন্তু অন্ধকারে একা বেরুবে কেমন করে! বিপদে ত্রাণ করতে আসে ঘুঁটেবুড়ি। এ গাঁয়ের সবচেয়ে বর্ষিয়সী মহিলা। পুরুষ তার দেহান্ত হয়েছে অনেক বছর আগে। বুড়ির চোখে অন্ধকার ছানির পর্দা। তবু বুড়ি প্রতি ইঞ্চি চেনা গাঁয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়ায়। আরো সুবিধা যেহেতু তার চলাফেরা চোখের চাইতে অন্য ইন্দ্রিয়তেই বেশি নির্ভর, তাই তার দিনে-রাতে তেমন ব্যবধান নেই। ঘুঁটেবুড়ি বাড়ি বাড়ি যায়– তোমরা এসো গো বউমনিরা, এর একটা বিহিত করতে হবে।
ঘুঁটেবুড়ির সুবাদে রমণীরা এই রাতেও একত্রিত হবার সুযোগ পায়। তারা খুঁজতে থাকে পুরুষদের। বেশি দূর যেতে হয় না। বারোয়ারিতলা, যেখানে তারা বটবৃক্ষের চারা রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানেই নেচে চলেছে অপূর্ব রূপসী এক নারী। নৃত্যরতার শরীর ঠিকরে বেরুচ্ছে অপার্থিব আলো। যেখানেই পা রাখছে সেখান থেকেই উঠছে তবলার বোল আর পুরুষরা তাকিয়ে আছে নিবিষ্ট চোখে। এমনই নিবিষ্ট তাদের দৃষ্টি, যেরকম দৃষ্টি নিয়ে বাধ্য বালকেরা পাঠ মুখস্থ করে তাদের শিক্ষকদের সামনে।
আক্রোশে ফেটে পড়ে গাঁয়ের রমণীকুল। তাদের ক্রুদ্ধস্বরে ঢাকা পড়ে তবলার বোল, নূপুরের নিক্কন। আর তাতেই ছন্দ হারায় নৃত্যরতা। আর পুরুষরা ঘোর ভেঙে সভয়ে তাকিয়ে দেখে তাদের ক্রোধান্বিত রমণীদের। কিন্তু রমণীদের ক্রোধ যতখানি তাদের পুরুষদের প্রতি, তারচেয়ে বেশি সম্মোহনী নর্তকীর প্রতি। তাদের ইচ্ছা হচ্ছিল, নর্তকীকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে। এক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা নেয় ঘুঁটেবুড়ি। গোবরের ঘুঁটে, কেন সে হাতে করে এনেছিল কে জানে, ছুঁড়ে মারল নর্তকীর গায়ে। কিন্তু আশ্চর্য, ঘুঁটে নর্তকীর শরীর স্পর্শ করার আগ-মুহূর্তে পরিণত হয়ে গেল টকটকে লাল গোলাপে। সেই লাল গোলাপ নর্তকীর শরীরে আলতো ছোঁয়া দিয়ে পড়ল তার পায়ের কাছে, পাদপদ্মে অর্ঘ্যের মতো।
অন্য নারীদের হাতের উদ্যত আঘাতকারী বস্তুগুলো থেমে গেল। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল, এ নিশ্চয়ই কোনো পিশাচিনী কিংবা দেবী।
এক্ষেত্রেও ঘুঁটেবুড়িই অগ্রগামী। জিজ্ঞেস করল– তুমি কে গা, গুচ্চের পুরুষের সামনে নাচনা করো! বৌমনিদের কাছ থেকে তাদের স্বামীদের কেড়ে নাও! তোমার কি নরকের ভয় নাই?
নর্তকীর চোখের বিলোল কটাক্ষ, যা একটু আগে পর্যন্ত পুরুষদের মাতাল করে রেখেছিল, ততক্ষণে উধাও হয়েছে। তার বদলে ফুটে উঠেছে অসহায় বেদনার আভা। সে করুণক্লান্ত স্বরে বলল– আমি বিরহিনী যক্ষী। বটবৃক্ষে বাস করে যক্ষের আরাধনা করি। যক্ষ এলেই আমার পরিত্রাণ।
তা এখানে তো কোনো বটবৃক্ষ নেই। তুমি এখানে কেন এলে?
আমি ইচ্ছাশক্তি পাঠ করতে পারি। তোমাদের ইচ্ছাশক্তি অধ্যয়ন করে জেনেছি, এখানে অচিরেই বটবৃক্ষ পাতালে শিকড় নামাবে আর নীলিমায় মেলবে শাখা। আমি তাই অধিষ্ঠান নিতে এখানে এসেছি। এখানে বসেই আমি যক্ষের আরাধনা করব।
ঘুঁটেবুড়ি এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। খনখনে গলায় বলল– অধিষ্ঠান নেবে ভালো কথা। তাই বলে গাঁয়ের সমস্ত পুরুষকে ঘর থেকে বের করে এনে ধিঙ্গিপনা করা কেন? গাঁয়ের বউদের ঘর অন্ধকার করা কেন?
যক্ষী কাতরকণ্ঠে বলল– আমি পুরুষদের ডাকিনি। ওরাই আমাকে দেখে ফেলেছে বিগতরাতে। পুরুষদের সামনে আমি অসহায়। আমার মায়াবল পুরুষদের ওপর কাজ করে না।
তাহলে তুমি অদৃশ্য থাকছ না কেন?
আমি সূর্যের আলোতে নিজের দেহকে মিশিয়ে নিতে পারি। কিন্তু রাতে আমাকে দেহধারণ করতেই হবে।
তা না হয় বুঝলাম। তাই বলে এইভাবে সারারাত নেচে মধুমাছির মতো আটকে রাখবে পুরুষদের এটা তো চলতে দেওয়া যায় না।
যক্ষীর কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি– একমাত্র নাচ দিয়েই আমি পুরুষদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি। আমি যতক্ষণ নাচব, আমার নাচের প্রভাবে ওদের দেহ-মন বিবশ হয়ে থাকবে। আমি নাচ থামালেই পুরুষদের লালসা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। তাই আমাকে সারারাত নেচে যেতে হবে। পা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকলেও আমাকে নাচতে হবে সূর্যোদয় পর্যন্ত।
যক্ষীর কথায় করুণার্দ্র হলো রমণীকুলের হৃদয়। তারা শতকণ্ঠে ধিক্কার জানাল বলাৎকারকামী পুরুষদের। তারপর সমস্বরে বলল যক্ষীকে– তোমার নিরাপত্তার ভার আমরা নিলাম। কোনো পুরুষ আর তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
যক্ষী ধন্যবাদ জানিয়ে বলল– শুধু আজকের রাতটুকু তোমরা আমাকে নিরাপত্তা দাও। আগামী রাতে বেঙ্গমা-বেঙ্গমি চলে আসবে। তারাও অধিষ্ঠান নেবে এখানে। তারাই আমার নিরাপত্তার ভার নিতে পারবে। তখন আমিও পারব নিবিষ্টচিত্তে যক্ষের আরাধনা করতে।
রোপণ করা হলো বটবৃক্ষের চারা। গাঁয়ে পানির বড় কষ্ট। তবু রমণীরা পানি আনে বটচারার জন্য। গৃহস্থালির কাজে কৃপণের মতো জল খরচ করে, সন্তানের জন্য বরাদ্দ জলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, গবাদি পশুদের জলপান করতে পাঠায় দূরের পরগণায়। এইভাবে জল জমিয়ে তারা পুষ্টিপানীয় ঢালে বটবৃক্ষের চারায়। কিন্তু কী আশ্চর্য! সারাদিন জল ঢেলে চারাটিকে সতেজ করলেও পরদিন প্রত্যূষে এসে দেখা যায় চারাটি ম্রিয়মাণ, বিবর্ণ। আবার রমণীকুল অবিশ্রাম জল ঢেলে তরতাজা করে চারাটিকে। কিন্তু পরবর্তী সকালে একই চিত্র। ম্রিয়মাণ বটচারা তাদের করুণ স্বাগত জানায়।
ঘুঁটেবুড়ি চেঁচিয়ে সারা গাঁ মাথায় তোলে– নিশ্চয়ই কেউ ষড়যন্ত্র করছে! বিষ ঢালছে রাত্রিকালে চারার গোড়ায়! কে সেই নিশিকুটুম্ব?
কোনো উত্তর মেলে না।
ঘুঁটেবুড়ি তেলের সলিতায় আগুন জ্বেলে রাত্রিকালে পাহারা বসায়। কিন্তু পরবর্তী সকালেও একই অবস্থা। এদিকে পাহারাদারগণ সমকণ্ঠে সাক্ষ্য দেয়– কেউ আসেনি বটবৃক্ষের কাছে।
তাহলে শুধু শুধু পাহারা দিয়ে লাভ কী! তবু মনের ধন্দ ঘোঁচে না রমণীকুলের– ঘুঁটেবুড়ির নেতৃত্বে নিশিপ্রহরা চলুক।
পরের রাতে ঘুঁটেবুড়ির প্রহর কাটে না। কথা না বলে থাকা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
প্রহরারত অন্য রমণীরা বুড়ির সাথে এত বকবকানিতে উৎসাহী নয়। কী আর করা! ঘুঁটেবুড়ির মাথায় বুদ্ধি খেলে। ঘর থেকে পোষা বিড়ালটাকে আনলে কেমন হয়! বিড়ালের সাথে গল্পে গল্পে দিব্যি রাত কেটে যাবে তার। অন্য রমণীদের সেকথা বলে বুড়ি গেল বেড়াল আনতে। মুখ টিপে হেসে রমণীরা তাকে বিদায় দিল। এই যাব আর আসব– আশ্বাস দিয়ে ঘরে গেল বুড়ি। ফিরলও তাড়াতাড়ি। কিন্তু বিড়াল কোলে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। বটচারা কাঁপতে থাকল থরথর করে। যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে। কিন্তু চারপাশে তো মৃদুমন্দ বাতাস ছাড়া ঝঞ্ঝার চিহ্নমাত্র নেই! এদিকে ঘুঁটেবুড়ির কোলের বিড়ালও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোলে থাকতে চাইছে না। ছেড়ে দিতেই বিড়াল ছুটে গেল বটচারার কাছে। দ্রুত আঁচড়ে খুড়তে লাগল মাটি। প্রহরারত রমণীরা তাজ্জব! ঘটছে কী এসব!
একটু পরেই থেমে গেল বটচারার কাঁপুনি। আর বিড়াল ফিরে এলো ঘুঁটেবুড়ির কাছে। তার মুখে চারটে ইঁদুর।
এই তাহলে ব্যাপার! পুরুষগুলো এত পাজি! মাটির নিচে ইঁদুর রেখে দিয়েছে। বটচারার শিকড় যেই পানি পেয়ে বাড়তে শুরু করে, অমনি ইঁদুর কুট করে কেটে দেয় সেটা। চারপাশের মাটি জলসিক্ত থাকলেও বটচারা গ্রহণ করতে পারে না সেই পুষ্টি। এবার আর কী ষড়যন্ত্র করবে ক্লীব পুরুষকুল!
বটচারা বেড়ে ওঠে তড়তড়িয়ে।
বেড়ে ওঠে পাতা ডাল নিয়ে। ঝুড়ি নামায়।
বটচারা বটবৃক্ষে পরিণত হয়।
গ্রামের নারীদের গার্হস্থ্য জীবনের অংশে পরিণত হয় বটবৃক্ষের কাছে যাওয়া। সারাদিন কাজ শেষে তারা বটবৃক্ষের কাছে যায়। নারীরা বিরহিনী যক্ষীকে দেখে নিবিষ্টচিত্তে যক্ষের আরাধনা করতে। কী প্রেম! যক্ষীকে দেখে নারীরাও প্রেমে আপ্লুত হয় তাদের পুরুষদের প্রতি। তারা আরো পতিব্রতা হয়।
কিন্তু পুরুষরা হয়ে ওঠে ওঠে ক্রমেই অধিক বিষণ্ন। প্লেগের মতো এড়িয়ে চলে বটবৃক্ষকে।
নারীরা অনুনয়-বিনয় করে। জানতে চায় বটবৃক্ষের প্রতি এত বিরূপতা কেন!
ঐ বৃক্ষ আমাদের অতীতের দিকে আঙুল উঁচিয়ে রাখে।
নারীরা জিজ্ঞাসা করে– কোন অতীত?
জানি না। মনে নেই সেই স্মৃতি। শুধু জানি মর্মন্তুদ এক অতীত। মনে হয় পূর্বজন্মের কোনো পাপ, যা আমাদের স্মৃতিতে নেই। কিন্তু ঐ বটবৃক্ষ আমাদের জাতিস্মর বানাতে চায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পুরুষরা, ঐ অতীত যতদিন চাপা থাকে ততদিনই আমাদের মঙ্গল।
তা কেন হবে? কোন দূর অতীতে কী ঘটেছে তা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কিসের?
দুশ্চিন্তা করতে চাই না। কিন্তু ঐ বটবৃক্ষ আমাদের যেন সবসময় বলছে প্রায়শ্চিত্ত করতে।
বেশ তো! আমরা সবাই একযোগে প্রায়শ্চিত্ত করব। তোমরা বরং মনে করার চেষ্টা করো কী ছিল সেই পাপ। একসঙ্গে প্রায়শ্চিত্ত করলেই তো আমরা সবাই মুক্তি পাব।
এই পাপে মুক্তি নেই। একমাত্র মুক্তি আমাদের বিনাশে। একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত আমাদের শেষ হয়ে যাওয়ায়।
এর বেশি পুরুষরা বলে না। এড়িয়ে চলে যায়।
পুরুষদের বিষণ্নতায় রমণীরাও দগ্ধ হয়।
তারা একদিন হত্যে দিয়ে পড়ে বেঙ্গমা-বেঙ্গমির সামনে– তোমরা তো সত্যদ্রষ্টা। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব জানো। বলো, আমাদের জানাও, কেন বটবৃক্ষ আমাদের পুরুষদের বিষণ্নতা বাড়ায়?
অতিবাচাল বেঙ্গমা-বেঙ্গমিও থেমে যায়। বলে– আমরা ভবিষ্যৎ বলতে পারি না। অতীতের সেটুকুই বলি যেটুকু নিষ্কলুষ।
তাহলে আমাদের পুরুষদের অতীত কি চরম পাপময় ছিল? নিষ্কলুষ নয়?
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি চুপ করে থাকে।
বলো! বলো!
সেই পাপ তাদের নয়। তবু তারা সর্বাংশে সেই পাপের দায়দায়িত্ব অবচেতনে নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। যেমন যীশু সকল মানুষের পাপ নিজে গ্রহণ করেছিলেন।
রমণীরা কিঞ্চিৎ উৎফুল্ল হয়– তাহলে তো আমাদের পুরুষরা সত্যিই মহৎ।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি বলে– তবু কেউ যখন নিজেকে কোনো কারণে দোষী ভাবে, আর সেই দোষ যখন জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়, তখন অন্যকে সে প্রায়শ্চিত্তে অংশ দিতে অস্বীকার করে। এটাই মানুষের রীতি।
আমরা তো আমাদের পুরুষদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের কোনো অভিলাষ তারা অপূর্ণ রাখে না। প্রায়শ্চিত্তে তারা আমাদের অংশ নিতে দেবে। তাহলে তো প্রায়শ্চিত্ত করাটাও সহজ হয়ে যাবে। তারাও মুক্ত হবে স্বকপোলকল্পিত পাপ থেকে। দোহাই লাগে বেঙ্গমা-বেঙ্গমি, তোমরা বলো।
বারংবার মিনতি। বারংবার প্রত্যাখ্যান।
শেষ পর্যন্ত রাজি হলো বেঙ্গমা-বেঙ্গমি।
তোমরা তৈরিও হও শুনতে। নিজেদের মনকে শক্ত করো। যা শুনবে, হয়তোবা তা শেল হয়ে বিঁধবে তোমাদের বুকে। বলতে গিয়ে কণ্ঠরোধ হয়ে যাবে আমাদেরও। চক্ষু হয়ে উঠবে বাষ্পাচ্ছন্ন। এতই কঠিন-করুণ সেই অতীত।
এই গ্রামে এক সময় রাজবাড়ি ছিল। এখন নেই। তোমরা কেউ দেখোনি। যেমন তোমরা এই গ্রামে বটবৃক্ষ দেখোনি। গ্রামের সবাই জানত রাজবাড়িতে রাজা থাকেন। তিনি তাদের রক্ষক এবং তিনি ঈশ্বরের মনোনীত। ধর্মবিদরা তখন সেকথাই শিখিয়েছিলেন গ্রামবাসীকে। গ্রামবাসীদের ফসলের অংশ, গবাদিপশু, জল থেকে ছেঁকে আনা মাছের অংশ উপঢৌকন দিতে হয় রাজাকে। প্রতিদানে তিনি প্রজাদের দেন সুরক্ষা। রাজাকে দেখেনি কেউ। দেখেছে তার প্রাসাদের সান্ত্রী-সেপাই আর কর্মচারিদের। তারা বলত, তারাও কেউ রাজাকে দেখেনি। তবে তারা আদেশ পায় রাজার কাছ থেকে, আর সেই আদেশ পৌঁছে দেয় প্রজাদের কাছে। তারা বলত, রাজবাড়ির ভেতরে আরো একটা রাজবাড়ি আছে, রাজা সেখানে থাকেন। সেখানে কেউ ঢুকতে পারে না। দরজার ঘণ্টা বাজালে দরজার কপাট আলগা হয়। তারা সেখানেই রেখে আসে প্রজাদের পাঠানো উপঢৌকন। কপাটের ওপার থেকে একটি অদৃশ্য কণ্ঠ তাদেরকে জানিয়ে দেয় রাজার আদেশ। তবে তারা এটুকু জানে যে, ঐ কপাট পেরিয়ে যে ঢোকে, সে আর ফিরে আসে না।
এক বছর সমস্ত পরগণা জুড়ে ভীষণ খরা আর আজন্ম। ক্ষেতের ফসল পুড়ে গেল রোদে, নদী-জলাশয় শুকিয়ে মাছ গেল নিশ্চিহ্ন হয়ে, গবাদি পশু মরে গেল সব। এখন যারা তোমাদের পুরুষ, তারা সবাই তখন শিশু। সব ঘরে হাহাকার। না খেতে পেয়ে বুকের ঝর্নাও শুকিয়ে গেছে মাতৃকুলের। তারা দিশেহারা; কীভাবে বাঁচবে বুকের শিশুরা! পুরুষরা খাদ্যবস্তুর খোঁজে যায় দূর-দূরান্তে, কিন্তু ফিরে আসে খালিহাতে। কেউ কেউ ফিরতেও পারে না। অপুষ্ট শরীর পথেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর মুখে। একদিন তারা সিদ্ধান্ত নিল, রাজার কাছে যাবে। প্রতিবছর এত ফসল-পশু-মাছ রাজাকে উপঢৌকন দেওয়া হয়, সেসব নিশ্চয়ই রাজভাণ্ডারে জমা থাকে। তাছাড়া বিপদে রাজা যদি প্রজাদের পাশে না দাড়ান তাহলে তিনি ঈশ্বর মনোনীত অন্নদাতা হলেন কীভাবে?
একদিন পুরুষরা গেল রাজবাড়িতে। সান্ত্রীরা খুলে দিল ফটক। কিন্তু ভেতরের লৌহকপাট খুলল না শত অনুনয়েও। ভেতর থেকে জলদগম্ভীর আদেশ এলো– এখানে কোনো পুরুষ ঢুকতে পারবে না। তোমরা ফিরে যাও। তোমাদের নারীদের পাঠাও।
নারীরা যেতে চায়নি। ভয় পাচ্ছিল ভীষণ। কিন্তু কোলের শিশুরাও যখন বলল, না গেলে খাদ্য জুটবে কোথায়, সবাই বাঁচবে কীভাবে, তখন তারা এগিয়ে গেল। সিংহদরজা পেরুল। ভেতরের লৌহকপাট পেরুনোর সময় মনে পড়ছিল, এই দরজা যে পেরোয় সে আর ফিরে আসে না। তবু তারা ভেতরে ঢুকল।
পরদিন বিশাল বিশাল ঢেকচি ভর্তি খাদ্যবস্তু এলো। সুঘ্রাণ ছুটল রান্নার। অমন সুস্বাদু মাংস কোনোদিন খায়নি গ্রামের মানুষ। সুস্বাদু এবং অফুরান। তারা আশ মিটিয়ে খেলো দিনের পর দিন।
তারপর তাদের মনে পড়ল নারীদের কথা। নারীরা তো ফিরছে না! তারা তখন গেল রাজবাড়িতে। সান্ত্রীরা জানাল হুকুম নেই, তারা ঢুকতে পারবে না। তবু তারা জেদ করে ঢুকল। লৌহদরজা নিরেট। কিন্তু পুরুষরা তখন খেতে পেয়ে পুরুষ্ট। তাদের শরীরে মত্ত হাতির বল। তারা নারীদের খোঁজে ভেঙে ফেলল লৌহকপাট।
কিন্তু এ কী! কোথায় রাজা! কোথায় লোকজন! শুধু দাঁড়িয়ে আছে একটা বনসাই। তারা সামনে যেতেই ডালপালা ছড়াতে শুরু করল বনসাই। বাড়তে শুরু করল দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এবং পরিণত হলো আকাশছোঁয়া মহীরুহ বটবৃক্ষে। আর সেই বটবৃক্ষের ডালে ডালে তালগাছে বাবুই পাখির বাসার মতো ঝুলছে অসংখ্য নরকঙ্কাল।
অট্টহাসি হেসে বটবৃক্ষ বলল– আমিই তোদের রাজা। আর এই যে কংকালগুলো, এরাই তোদের নারী। প্রথমে নির্যাস তারপরে কংকাল নিয়েছি আমি। আর মাংস পাঠিয়ে দিয়েছি তোদের জন্য।
বেঙ্গমা-বেঙ্গমি এই পর্যন্ত বলতেই হাহাকার উঠল চারপাশে। নারীরা নয়, হাহাকার করছে পুরুষরা। কখন যে তারা নারীদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল নিঃশব্দে, টের পায়নি রমণীকুল।
মনে পড়েছে, আমাদের পাপের কথা মনে পড়েছে। আমরা মাতৃমাংসভক্ষক। পাপ! হায় পাপ! মনে পড়েছে। এখন আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!
এক অমাবস্যা রাতের শেষ প্রহরে নারীরা জেগে উঠে দেখল, তাদের পুরুষরা শয্যায় নেই। কেউ বলেনি, তবু তারা অন্তরে নিশ্চিত অনুভব করল তাদের পুরুষরা প্রায়শ্চিত্ত করতে বটবৃক্ষের কাছেই গেছে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31