মানবতার জননী ও তাঁর শৈশবের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ৩:৩৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১

মানবতার জননী ও তাঁর শৈশবের স্বপ্ন

শেলী সেনগুপ্তা
মধুমতী নদীর অনেক শাখা। তেমন এক শাখার নাম বাইগার নদী। বাইগার নদীর কোমর ঘেষে দাঁড়ানো একটি সবুজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়া, নামেই যার পরিচয়। মধুমতির ঢেউ এর ওপর রোদ খেলা করে, চাঁদনি রাতে জ্যোৎস্না উঁকি দেয় কিশোরীর কৌতূহলে। নদীর পাড় ঘেষে কাশবন, ধান-পাট- আখ ক্ষেত, সারিবদ্ধ খেজুর গাছ। নানান জাতের পাখির কলকাকলি, ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘুর অলস ডাক, বসন্তে কোকিলের কুহুতান যেন মন ভালো করে দেয়ার আবেশ।

 

 

এই গ্রামে বসতি শুরু হয়েছিলো সিপাহী বিপ্লবেরও আগে। নীলকর সাহেবদের সাথে বিরোধ করেই টিকে ছিলো এখানকার মানুষ। সে গ্রামে একসময় শুধু নদী পথেই যাওয়া আসা করা হতো। রাজধানী ঢাকা থেকে সে গ্রামে যেতে কমপক্ষে সতের ঘন্টা সময় লাগতো। এখন তা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে।

 

 

এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এক কন্যা, কালের পরিক্রমায় তিনি এখন জননী, মানবতার মা, নাম যাঁর শেখ হাসিনা। তাঁর শৈশব খুব আনন্দে কেটেছে। বাঁশের সাঁকো বেয়ে স্কুলে যাওয়া, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নদীর পাড়ে বেড়ানো, শীতের দিনে নদীর উষ্ণ পানিতে পা ভেজানো তারঁ কাছে খুব লোভনীয় ছিলো। এখনও মনে পড়ে জোড়া নারকেল ভাসিয়ে অথবা কলাগাছ ফেলে সাঁতার কাটা, গামছা বিছিয়ে টেংরা মাছ, পুটি মাছ ধরা। খালে ভেসে যেতো কচুরিপানা, টেনে তুললে শেকড় থেকে বের হয়ে আসতো কই মাছ, বাইন মাছ। কখনো সাপও উঠে আসতো।

 

 

কন্যাটির শৈশব কেটেছে কাঁচাআম কেটে কাঁচামরিচ দিয়ে কলা পাতায় রেখে ভর্তা করে খাওয়ার আনন্দে। এখনও মনে পড়ে কলাপাতা কোনাকুনি করে আম ভর্তার রস টেনে খাওয়ার স্বাদ। ডাল ঝাঁকিয়ে বরই পেড়ে কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার স্মৃতি ভোলা যায়! গাছ থেকে পাড়তে গিয়ে দু’একটা বরুই পুকুরের জলে ভেসে গেলে আফসোসের শেষ থাকতো না।
ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে পাটক্ষেতে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি এখনও খুব বেশি পেছনে নিয়ে যায়। শৈশবের ফেলে আসা গ্রাম যেন তাঁর কাছে এক সুভাষিত ছবি।

 

 

গ্রাম তাঁকে উদ্বেলিত করে, ফিরিয়ে নিয়ে যায় সুখের শৈশবে। তাই শত ব্যস্ততা থাকলেও এবং একটু সময় পেলেই তিনি গ্রামে চলে যান। খুব ইচ্ছে করে গ্রামের মেঠো পথে হেঁটে গলা ছেড়ে গাইতে, ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙ্গামাটির পথ, আমার মন ভোলায় রে…’
সেই তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারেন, ‘গ্রামই আমাদের জীবন’। তিনিই দিনবদলের স্বপ্ন দেখেছেন গ্রামীণ জীবনে একটি বাড়ি, একটি খামার দিয়ে।

 

 

 

কৃষকই কৃষিভিত্তিক বাংলার প্রাণ। যে কৃষক ফসল ফলান, সুযোগ পেলে তিনিই আবার মাছ চাষ করেন। তারই উঠোনে বাড়ে হাঁসমুরগি, গোয়ালে গরু। সাথে আঙ্গিনায় শাকসব্জির চাষ তো আছেই। এমন স্বপ্ন সবারই থাকতে পারে, কিন্তু সামর্থ্য থাকে ক’জনার।
আবার এটাও ঠিক যে গ্রামের উন্নয়ন বলতে ছিটেফোঁটা বা সাময়িক ব্যবস্থা নয়, যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা পশ্চাৎপদ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত প্রাচীন কৃষি-ব্যবস্থার প্রচলিত ধ্যান ধারণার সামগ্রিক সংস্কার করে আধুনিক গ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এতে অনুদানমূলক বা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ উন্নয়ন নয়, সামগ্রিক উন্নয়ন দরকার।
প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতে মানবতার জননী প্রকল্প গ্রহণ করলেন ‘একটি বাড়ি একটি খামার’। এমন ভাবে ব্যবস্থা করা হয়েছে যেন প্রতিটি মানুষ নিজের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারে এবং সাথে অন্যের পুষ্টির চাহিদাও মেটে।

 

 

প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি গ্রামে ৬০ জন দরিদ্র মানুষকে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে ৪০ জন নারী এবং ২০ জন পুরুষ থাকে। প্রত্যেক সমিতির নামে অনলাইনে একটি ব্যাংক একাউন্ট বা হিসেব খোলা হয়। প্রত্যেক সদস্য মাসে ২০০ টাকা করে একাউন্টে জমা করেন, একই পরিমাণ টাকা সদস্যের নামে সরকারও জমা দেন। ২০ বছর পর যে টাকা জমে তার সাথে আরো কিছু টাকা সরকারের কাছ থেকে ঋণ নেয়া যায়, এবং তা কোন আয়মূলক কাজে ব্যবহার করা যায়। তা থেকে যা লাভ হয় তা থেকে সদস্যরা ঋণ নিতে পারে, আবারও বিনিয়োগ করা যায়।

 

 

এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হলো দারিদ্র নির্মূল ও টেকসই উন্নয়ন। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিকসম্পদ ও মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। এর মাধ্যমে আয়বর্ধক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার গড়ে তোলা যায় এবং পারিবারিক আয় বৃদ্ধি সম্ভব। মানবতার জননী একই সাথে নারী ক্ষমতায়নকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, নারীই সংসারের লক্ষ্মী, তাই নারীকে বাদ দিয়ে সংসার কিংবা সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। এজন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীকে বিশেষ মর্যাদায় যুক্ত করেছেন। যুক্ত করে সুফলও পেয়েছেন। অর্থনীতি অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। উন্নত হয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনার জগতও।

 

 

 

তিনি বুঝেছেন এটি শুরু করতে হবে গ্রাম থেকে। কারণ তাঁর শৈশব তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে গ্রাম নিয়ে ভাবতে, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে। এ প্রকল্প পারে দেশের হতদরিদ্র মানুষের জীবন গল্পের মতো বদলে দিতে। নিজের জমানো টাকার সাথে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজের আয় বর্ধন করতে পারে, বর্ধিত আয়ের টাকা আবারও বিনিয়োগ করা সম্ভব। পৃথিবীর জন্য এটি একটি বিশেষ উদাহরণ। আজ পর্যন্ত কোন দেশের সরকার দরিদ্র মানুষের কল্যাণে তাদের নিজস্ব স্থায়ী তহবিলের মালিকানা দিয়ে স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে দারিদ্রদূরীকরণে এ রকম কোন পদক্ষেপ নিতে পারে নি। একমাত্র শেখ হাসিনা পেরেছেন। এটা সম্ভব হয় শুধু গ্রামকে ভালোবাসলে।
গ্রামকে ভালোবাসেন এই মানবতার মা। গ্রামীণ স্বভাব, চালচলন, জীবনযাত্রা ও মানসিকতার সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক। রাতের তারাভরা আকাশ অনেক বড়। নিম, কদম, তাল-নারিকেল গাছের পাতা ছুঁয়ে ছন্দময় শব্দ তুলে ছুটে আসে মুক্ত আকাশে।

 

 

 

জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’তাঁর অন্তরের গভীরে শানবাঁধানো ঘাট যেন। এই ঘাট বেয়ে শ্যামল কন্যাটি প্রতিনিয়ত জল ছোঁয়, ঘাটে পা ভিজিয়ে সুখের নাও ভাসায়। চাঁদ সওদাগরের বজরা করে দেশের মানুষের জন্য সুখ বয়ে এনেছেন তিনি। কারণ এ বাংলা তাঁর সংসার, এদেশের মানুষ তাঁর পরিবার। আপনজনকে সুখি করতে সবাই চায়। তিনিও চেয়েছেন, শুধু চেয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি, সানন্দে কাজ করে গেছেন। প্রতিটি কাজ সফল হয়েছে। সফল করতে পেরেছেন তিনি, কারণ মানবতার জননী ভালোবাসেন মা, মাটি এবং মানুষকে।