মা , নয়ন সমুখে তুমি নাই

প্রকাশিত: ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩১, ২০২১

মা , নয়ন সমুখে তুমি নাই

পূজা  সেনগুপ্ত 

মাকে সাথে নিয়ে বের হয়েছিলাম। আজকে ছাই ভস্ম, অস্হি আর একটা মৃত্যু সনদ নিয়ে ফিরলাম।

আমার মা, মিসেস নন্দিতা সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এর ৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন। ২০১৯ সালে অবসরে যাবার আগে তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়।
আমার মা ২০১০ সালে অভারিয়ান ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সেই সময় সফল অস্ত্রাপচারের পর ছয় সাইকেল কেমো নেন। এরপর থেকে শুরু হয় সুস্হ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার তার লড়াই। বিগত দশ বছর নিয়মিত যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন, সাঁতার, পার্কে হাঁটা ইত্যাদি চালিয়ে যাবার মাধ্যমে তিনি সম্পূর্ণ সুস্হ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছিলেন। এমনকি সিএমসি ভেল্লোরের ডাক্তাররাও অন্য রোগিদের কাছে তাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতেন। গত ৯ জানুয়ারি আমি আর মা ভেলোর গিয়েছিলাম তার নিয়মিত বার্ষিক চেক আপ এর জন্য। তবে এই বার গিয়ে জানতে পারি ১০ বছর বাদে আবার তার শরীরে ক্যান্সার ফিরে এসেছে। করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসলে ২১ জানুয়ারি আমরা ঢাকা ফিরে আসি। ডাক্তাররা আমাদের আবারও ফেব্রুয়ারি মাসে ভেলোর আসতে বলেন। আমার মা কিছুটা ঘাবড়ে গেলে ডাক্তার তাকে অভয় দিয়ে বলেন অপারেশন করলে আবার একটা দীর্ঘ সময় ভাল থাকতে পারবেন। আমরাও সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
আমার মা আমাকে বলল, করোনার জন্য এক বছর সাঁতার কাটা বন্ধ ছিল তাই রিপোর্ট খারাপ এসেছে। নিয়মিত সাঁতার কাটলে ঠিকই ই আবার ভাল হয়ে যাব। শুক্রবার ২২ জানুয়ারি আমি কোনোভাবেই তাকে সুইমিং পুলে যেতে দিতে রাজি হলাম না। পরদিন শনিবার আবার যাবার জন্য জেদ করলেন। আমি কেন জানি রাজি হলাম। আর সেটাই আমাদের কাল হল। আমার মা কোভিডে আক্রান্ত হলেন। শরীরে ইতোমধ্যেই ক্যান্সার ছিল। আমরা তাকে এবার আর ফেরাতে পারলাম না। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
পড়াশুনায় ছোটবেলা থেকেই মেধাবী আমার মা কেনো বড় সেলিব্রেটি ছিলেন না। কোথাও গেলেই দশ জন ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকে দেখত না, কিন্তু যারা তার সম্পর্কে জানত, তারা তাকে যে সম্মান দেখাত – সেটা দেখে মেয়ে হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে হত। একবার শুটিং করতে নারায়নগন্জ গেছি। কথায় কথায় বলে ফেললাম আমার ছোটবেলায় আমার মা এখানে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সাথে সাথে হই হই পড়ে গেল। আমার মার আমলে এস এস সি পরীক্ষায় নকল করা নাকি চরম দু:সাধ্য ব্যাপার ছিল। তাকে তার সততার জন্য এত বছর পরও মানুষ মনে রেখেছে। আরেকবার এ্যাপোলো হসপিটালস এ গেছি। আমি, মা, সাথে বাবাও ছিলেন। এক ভদ্রলোক আমার মার দিকে দৌড়ে এলেন। বললেন উনার বাবার একটা বহুমূল্য জমি বেদখল হয়ে গিয়েছিল। আমার মার কোর্টে উনার বাবা ন্যায় বিচার পেয়েছিলেন। কোনো রকম ঘুষ ছাড়াই এমন বিচার পাওয়া সম্ভব এটা উনার বাবা কল্পনাও করতে পারছিলেন না। সবসময় উনার বাবা এটা ছেলের কাছে গল্প করতেন। পরে আমার মা ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চাইলে উনি বললেন উনিই এই হাসপাতালের মালিক। মাকে নিয়ে এমন অসংখ্য গল্প আছে আমার স্মৃতির ঝুলিতে। আমার মার মত মানুষেরা আমাদের চারপাশেই আছেন – নীরবে নিভৃতে নিজের কাজ করে জোনাকির মত আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কেনো রকম প্রচার ছাড়াই। এমন মানুষদের উদ্দেশ্যেই হয়ত কবি বলেছেন,
“তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র,
তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে
আপন আলো জ্বেলেছ॥”
আমরা যেন এই গুনীদের কখনো অমর্যাদা না করি। এ কথা তো আমরা সবাই জানি, যে সমাজে গুনের কদর হয় না, সে সমাজে গুনীও আর জন্মায় না। আমার মার অকাল ও আকস্মিক প্রয়ানে যারা আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, মার আত্মার শান্তি কামনা করেছেন তাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আলাদাভাবে সব বার্তার উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি, তবে প্রতিটি বার্তাই আমার মনকে শান্তি দিয়েছে। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930