মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে নাস্তিকতা বাড়ছে কেন?

প্রকাশিত: ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২১

মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে নাস্তিকতা বাড়ছে  কেন?

 

সানজিদা তমা 

মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতেও নাস্তিকতা বাড়ছে– একটি আন্তর্জাতিক সংস্তার গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে৷

বিশেষ করে তুরস্কে প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ানের চাপিয়ে দেওয়া কঠোর রীতিনীতির কারণেই নাস্তিকের সংখ্যা বাড়ছেবলে মনে করা হচ্ছে৷

বাংলাদেশী স্বঘোষিত নাস্তিক আসিফ মহিউদ্দীন বলেন, নাস্তিক হবার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আমি প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো সবগুলোই পড়েছি৷ পালনের জন্য নয়, জানার আগ্রহে৷ যতই পড়েছি এবং বোঝার চেষ্টা করেছি, ততই নাস্তিক হয়েছি৷ এখনো আমি সব সময় বলি, কোরান, বাইবেল, তোরাহ মাতৃভাষাতে সবাই পড়ুক৷ যত বেশি পড়বে এবং বুঝবে, নাস্তিকদের সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাবে৷ তাছাড়া ঈশ্বরের কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি৷ যেদিন কেউ ঈশ্বরের প্রমাণ দিতে পারবে, আমার আস্তিক হয়ে যেতে আপত্তি থাকবে না৷

 

কোন্ডা নামের একটি প্রতিষ্ঠান নানা বিষয়ে জরিপ পরিচালনার জন্য বিখ্যাত৷ তাদের এক জরিপে দাবি করা হয়, গত ১০ বছরে তুরস্কে ‘অবিশ্বাসীদের’ সংখ্যা বেড়েছে৷ দেশটিতে ইসলাম পালন করা বা কট্টর ইসলামপন্থি লোকের সংখ্যা ৫৫ শতাংশ থেকে ৫১ শতাংশে নেমেছে৷

৩৬ বছর বয়সি কম্পিউটার বিজ্ঞানী আহমেত বালেইমেজ ১০ বছর ধরে নাস্তিক৷ তিনি বলেন, ‘‘তুরস্কে ইসলাম পালন করতে বাধ্য করা হয়৷ আমাদের প্রশাসন আমাদের ওপর তা চাপিয়ে দিচ্ছে৷ ফলে আমরা ভাবতে বাধ্য হই– এই কী আসল ইসলাম?” তিনি মনে করেন, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেকে রক্ষায় নাস্তিকতা উত্তম বিকল্প৷

তুরস্কের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে ঘোষণা দিয়েছিল যে, দেশটির ৯৯ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী৷ কিন্তু কোন্ডার এই গবেষণা প্রকাশের পর ধর্মমন্ত্রণালয়ের এ দাবি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে৷

 

ধর্মতত্ত্ববিদ কেমিল কেলিক বলেন, ‘‘কোন্ডার জরিপ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জরিপ দুটোই সঠিক৷ কারণ, তুরস্ক একটি মুসলিম প্রধান দেশ৷ এই দেশে জন্মসূত্রে সবাই মুসলমান৷ এখানে ৯৯ শতাংশ মুসলমানের একটি অংশ শুধুমাত্র সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে ইসলাম পালন করে৷ তাঁরা আত্মিকভাবে মুসলমান নয়৷ তাঁরা নিয়মিত নামাজ আদায় করে, হজে যায়, হিজাব পরে, কিন্তু মানসিকভাবে ধর্মকে সামাজিক অনুশাসনের পদ্ধতি ছাড়া কিছুই ভাবে না৷ তাঁদের পরিচয়ও কিন্তু মুসলমান।অন্যদিকে আরেকটি গ্রুপ ইসলাম ধর্মকেই নিশ্চিত নিয়ম বলে এর সব কঠোর অনুশাসন মেনে চলে৷ এদের সংখ্যা ৬০ শতাংশের মতো৷ এরা সত্যিকার অর্থে ধার্মিক৷”

কেমিল তুরস্কের জনগণকে ১৭ শতাব্দীর উমাইয়াদ গোত্রের সঙ্গে তুলনা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সেই সময় উমাইয়াদ জনগোষ্ঠী নিজ দেশের শাসককে খুশি রাখতে প্রার্থনা করতো৷ তুরস্কের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী প্রশাসনকে সন্তুষ্ট রাখতে নিয়মিত নামাজ পড়ে৷ অথচ কোরানে ন্যায়ের শাসনের কথা উল্লেখ রয়েছে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘তুরস্কে মসজিদ আর প্রশাসন একে অপরের সহযোগী৷ কারণ, এখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হচ্ছে প্রশাসনের প্রতি আনুগত্যের লক্ষণ৷ আর নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়া সেই আনুগত্যকে আরো সুস্পষ্ট করে৷ মসজিদ হিসাব রাখে নামাজের৷”

তুরস্কের নাস্তিকদের অন্যতম প্রধান সংগঠন অ্যাটিজম ডেরনেগির প্রধান সেলিম ওজকোহেন বলেন, ‘‘এর্দোয়ান প্রশাসন চেষ্টা করছে ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রজন্ম তৈরি করতে, যাঁদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে৷ অথচ ভেতরে ভেতরে এই প্রজন্মের মধ্যে বিশ্বাসগত বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে৷”

এ প্রসঙ্গে সেলিম ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ওই অভ্যুত্থানের দায় দেওয়া হয়েছিল ধর্মীয় চিন্তাবিদ ফেতুল্লাহ গুলেনকে৷ তাঁর অনুসারীরা প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যুক্ত হয়৷ এতেই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদ স্পষ্ট৷ একই ধর্মের অনুসারী একই কাতারে নামাজ পড়ে ধর্মীয় ভাবধারায় আলাদা আচরণ করছে৷ জনগণ নিজেদের বিশ্বাসগত এই পার্থক‌্য লক্ষ্য করছে৷ এদের মধ্যে যৌক্তিক আচরণের ব‌্যক্তিরা নাস্তিকতায় ঝুঁকছে৷”

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এমন মানুষকেই আমরা নাস্তিক বলে থাকি। নাস্তিকতাবাদ দর্শনে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে বিশ্বে ধার্মিক বেশি, নাকি নাস্তিক? সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এমন মানুষ কোন কোন দেশে সবচেয়ে বেশি? সবচেয়ে বেশি ‘নাস্তিক’ বাস করেন কোন দেশে? তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর।

চীন:

গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনালের ৬৫টি দেশ নিয়ে করা এক জরিপ বেরিয়ে আসা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নাস্তিক বাস করেন। সে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। চীনের শতকরা ৬১ ভাগ মানুষ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সরাসরি অস্বীকার করেন, বাকি ২৯ ভাগ নিজেদের ধর্মে বিশ্বাসী নন বলে দাবি করেছেন।

সুইডেন:

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেনে মাত্র ৮ ভাগ মানুষ উপাসনালয়ে গিয়ে ধর্ম চর্চা করেন। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এই তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে গ্যালাপের জরিপ অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৬ ভাগই সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে মনে করেন না।

চেক প্রজাতন্ত্র:

চেক প্রজাতন্ত্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ ভাগ মানুষ নিজেদের সরাসরিই ‘নাস্তিক’ বলে দাবি করেন। তবে বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের ধর্মবিশ্বাস আছে কিনা, তা জানাতেই রাজি নন। মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করেন। গ্যালাপের জরিপ জানাচ্ছে, সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশটিতে এক হিসেবে শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষই নাস্তিক, কেননা তারা ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার গুরুত্ব স্বীকার করেন না।

ব্রিটেন:

জরিপে অংশ নেয়া ব্রিটেনের শতকরা ৫৩ জন মানুষ বলেছেন যে, তাদের কোনো ধর্মবিশ্বাস নেই। আর ১৩ ভাগ সরাসরিই বলেছেন, আমি নাস্তিক।

হংকং:

বিশ্বের ৬৫টি দেশের ৬৪ হাজার মানুষের মাঝে এই জরিপ চালিয়েছে গ্যালাপ। হংকংয়ের মানুষদের সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া গেছে এই জরিপ থেকে৷ দেখা গেছে, হংকংয়ের শতকরা ৪৩ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে নাস্তিক। বাকি ৫৭ ভাগের মধ্যে ১৯ ভাগকেও আস্তিক অন্তত মনে হয়নি।

জাপান:

জাপানে প্রত্যক্ষ নাস্তিক শতকরা ৩১ ভাগ হলেও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের গুরুত্ব নিয়ে ভাবেন না এমন মানুষও আছে অনেক

জার্মানি:

গ্যালাপ জরিপে দেখা যায়, জার্মানির ৫৯ ভাগ মানুষকেই নাস্তিক। ইউরোপের অন্যান্য দেশ, যেমন স্পেন, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের নাগরিকদেরও বড় একটা অংশই নাস্তিক। ইউরোপের বেশ কিছু দেশেই এখনো নাস্তিকরাই সংখ্যাগুরু। তবে সংখ্যালঘু আস্তিকদের ধর্ম চর্চায় তাতে কোনো সমস্যা হয় না।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31