যারা বেদ এনেছিল

প্রকাশিত: ২:০৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২২

যারা বেদ এনেছিল

সুমন তুরহান

“কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্র বোচৎকুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।
অর্বাগ্‌দেবা অস্য বিসর্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব॥
ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন।
যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ত্সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ”

“কে জানে চূড়ান্ত সত্য? কে বলতে পারে কবে-কোথা হতে এলো এই বিবিধ সৃষ্টি?;
দেবতাদেরও আবির্ভাব হয়েছে সৃষ্টির পরে, আগে নয় ।
এই সকল সৃষ্টির মূলে আছেন কি কেউ? নাকি নেই?
সেই পরমসত্ত্বা নিশ্চয়ই জানেন — অথবা হয়তো জানেন না তিনি নিজেও”!

– (ঋগ্বেদ, নাসদীয় স্তোত্র, ১০: ১২৯ [1, 2, 3])

কখন-কোথায়, এমন অধরা-আলোআঁধারিপূর্ণ ভাষায়, সৃষ্টিরহস্য নিয়ে এই অসামান্য ভাবনাগুলোর প্রকাশ করেছিলেন ঋগ্বেদের ঋষি (এবং ঋষিকারা), তা আজ আর নিশ্চিত করে বলা সহজ নয়। হয়তো এ-কারণেই সহস্র বছর ধরে বেদানুরাগীরা বলে এসেছেন — এ-মহাগ্রন্থ অনাদি, অনন্ত, স্বতঃসিদ্ধ, অপৌরুষেয়, নৈর্বক্তিক ও রচয়িতা-শূন্য [4] — অর্থাৎ, বেদের ভেতরে যে ‘সত্য’ রয়েছে তা চিরন্তন, যার কোনো আদি বা অন্ত নেই, এবং কোনো ব্যক্তি বা মানুষ এটি রচনা করেননি। এ-জাতীয় দাবির ওপর অবশ্য কোনো কথা নেই; তবে অপ্রমেয় বক্তব্যের চেয়ে আমার কাছে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে — মানবমনের গভীর-গভীরতর স্তর থেকে পূর্বে-অনুন্মোচিত যে উপলব্ধিগুলো প্রথমবারের মতো প্রতিভাত হয়েছে বেদগুলোতে, সেই উপলব্ধিগুলো কাদের? অগস্ত্য-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র কিংবা অত্রি-লোপামুদ্রা-অদিতির মতো নামগুলো, যাঁরা আমাদের কাছে আজ রহস্যময় এবং সুদূর, তাঁরা ঠিক কোন মনুষ্য-ভাষাগোষ্ঠী এবং সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতেন? কারা ছিলেন তাঁরা? কোথা হতে এসেছিলেন? তাঁদের সংস্কৃতির উৎস্যভূমি কোথায় ছিলো? যখন ঋগ্বেদের প্রাচীনতম স্তোত্রগুলো রচিত হচ্ছিলো তখন তাঁরা কোথায় বাস করতেন? আজ অরণ্যে বা নগরে দেখা হলে, ঠিক কোন পরিচয়ে তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিতেন — আর্য, ব্রাহ্মণ্যবাদী, সনাতন, না কি ‘হিন্দু’? কী সম্পর্ক ছিলো এ-অঞ্চলের অন্যান্য ভাষিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে বৈদিক ঋষিদের? কোন প্রেরণায় তাঁদের কণ্ঠ হতে উৎসারিত হয়েছিলো সংহিতার স্তোত্রগুলো — এমন অজস্র প্রশ্ন জাগে মনে। প্রশ্নগুলো জটিল, এবং এদের উত্তর স্বল্প-পরিসরে উন্মোচন করা অসম্ভব, তবু কয়েকটি বিষয়ে সত্যের কিছুটা কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রয়াস আমরা করতে পারি।

 

 

পূর্ব-ঘোষণা
বঙ্গীয় ভূখণ্ডে বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপও নিরর্থক বিতর্কে রূপ নেয়, আর ধর্ম সম্পৃক্ত হলে তো কথাই নেই, তাই কয়েকটি পূর্ব-ঘোষণা দিয়ে রাখা জরুরি বোধ করছি:

১.
আমার জ্ঞান সীমিত; বেদের মতো মহাগ্রন্থ নিয়ে আমার ঝুলিতে নেই গভীর কোনো বোধ — যা প্রকাশ করে আমি মুগ্ধ করতে পারি আমার পাঠককে, তাই এই অন্বেষণে আমার গন্তব্য গ্রন্থ নয়, গ্রন্থের পেছনের মানুষ (অথবা তা-ও নয়, হয়তো ‘অন্বেষণ’ই আমার গন্তব্য)। যে স্তোত্রটি (সংস্কৃত ‘সুক্ত’ শব্দটির পরিবর্তে বাংলা ‘স্তোত্র’ শব্দটি আমার পছন্দ) উদ্ধৃত করা হয়েছে এই নিবন্ধের শুরুতে, তার ধাঁধাশীল, অনিশ্চিত সমাপ্তি (‘বেদ যদি বা ন বেদ’ ) আমাকে অনুপ্রাণিত করে প্রশ্ন করতে; সুনিশ্চিত উত্তরে পৌঁছানোর চেয়ে আমার কাছে প্রশ্ন করার অনুশীলন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

লেখাটির শিরোনাম ‘যারা বেদ এনেছিলো’ — যা বিভ্রান্তিকর, এবং আমি এই ধোঁয়াশা তৈরি করেছি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। শিরোনামটি হয়তো কিছু পাঠককে উৎসাহিত করবে ভাবতে, প্রাচীন ইজরায়েলীয়রা যেভাবে বিধাতার সাথে তাদের ‘চুক্তিমঞ্জুষা’ [আর্ক অফ দ্য কভেনেন্ট] কাঁধে নিয়ে প্রতিশ্রুত ভূমির খোঁজে ঘুরে বেড়াতো, অনেকটা সেভাবেই, আর্যভাষীরাও তাদের রচিত সম্পূর্ণ চতুর্বেদ মাথার ওপরে নিয়ে প্রবেশ করেছে ভারতবর্ষে। কিন্তু,আমরা যখন আমাদের বিশ্লেষণের পরিণতিতে পৌঁছাবো, তখন দেখবো যে এই চিত্রকল্পটি অর্ধসত্য, পুরোসত্য নয়। সম্পূর্ণ সত্য উদঘাটনে আমাদের যেতে হবে বেশ পেছনে।

২.
অবধারিতভাবেই, ‘হিন্দু’ ধর্মের কথা এই লেখায় আসবে, যা আমার জন্যে কিছুটা বিপদজনক। আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী নই, অর্থাৎ আমি যা-ই লিখি না কেনো তা হবে এক প্রকার এটিক বা ‘বাইরে থেকে দেখা’ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধতা থাকবে; অবশ্য, কার নেই? এমিক বা ‘ভেতর থেকে দেখা’ দৃষ্টিভঙ্গিরও অন্ধবিন্দু [ব্লাইন্ড স্পট] রয়েছে। আরেকটি ‘সমস্যা’ হচ্ছে হিন্দু ধর্মের বিশালতা। হিন্দু ধর্মকে অনেক সময় তুলনা করা হয় মহাসাগরের সাথে; তবে আমি মনে করি এ-তুলনা সত্যের কাছাকাছি হলেও, সম্পূর্ণ নয়। মহাসাগর বিশাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই; তবে মহাসাগরের তীর রয়েছে, রয়েছে ভৌগোলিক সীমানা, আর রয়েছে গভীরতা — যা পরিমেয়। কিন্তু হিন্দু ধর্মের বিশালত্ব তুলনারহিত, সীমানা অচিহ্নিত,এবং গভীরতা অসীম — সে সবারে নিতে জানে, সবারে করে আহবান। মুশকিল হচ্ছে, এই কারণে, হিন্দু ধর্ম নিয়ে, এটিক কিংবা এমিক দুই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই, কিছু বলা বা লিখা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। যার প্রাচীর নেই, তাকে কী করে আবদ্ধ করবো মুদ্রিত অক্ষরে? — যদিও সেই কাজটিই করার ব্যর্থ চেষ্টা করবো এইখানে।

৩.
এই নিবন্ধে ‘হিন্দু’ শব্দটি ব্যবহার করেছি অনেকটা বাধ্য হয়ে — এই শব্দটি আমার পছন্দ নয়। এ-অঞ্চলের অধিবাসীরা কিছুদিন আগেও নিজেদের এই নামে পরিচয় দেয়নি, এটি প্রাচীন পারসিকদের দেয়া নাম [5] (হপ্ত হিন্দু বা সপ্ত সিন্ধুর অধিবাসীদের বোঝাতে তারা, এবং অন্যান্যরা এই অভিধাটি ব্যবহার করতো)। তার চেয়ে বরং ব্যাপারটি এভাবে দেখা অধিকতর যৌক্তিকঃ

যাকে ‘হিন্দু ধর্ম’ বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে অজস্র, কখনো কখনো পরস্পরবিরোধী, বিশ্বাস-লোকাচার-উপাচারের মিলনমেলা, এবং এগুলো, ভারতের মহাসাগরে এসে মিশেছে বিভিন্ন সময়ে; এবং তারা, আপাতদৃষ্টিতে, ভিন্ন ভিন্ন পথ বা মার্গ নির্দেশ করে। ভিন্ন ভিন্ন মার্গ নির্দেশ কোনো দার্শনিক সমস্যা নয়, আমরা জানি যে হিন্দু ধর্ম ‘যতো মত, ততো পথ’কে উৎসাহিত করে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো করে? পরমসত্ত্বার (যিনি হিন্দু-জৈন-বৌদ্ধ-ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমান কিছুই নন, এবং সমস্ত নামের ঊর্ধ্বে) কাছে পৌঁছানোর একাধিক রাস্তা থাকতে পারে বলেই হিন্দুর বিশ্বাস — এবং এখানেই তার মাহাত্ম্য। একই গন্তব্যে আমরা পৌঁছাতে পারি ভিন্ন ভিন্ন পথে,এবং সরল, কিংবা জটিল থেকে জটিলতর মানচিত্র ব্যবহার করে। তাছাড়া আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন, আমাদের সবার বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা সমান নয়; যে পথ ‘যদু’র জন্যে যথার্থ, সে পথ ‘মধু’র জন্যে উপযুক্ত না-ও হতে পারে।
প্রশ্ন জাগতে পারে, হিন্দু ধর্মের এই সদাচলিষ্ণু উপত্যকায় একমাত্র ধ্রুবক কি? আমার দৃষ্টিতে হচ্ছে একমাত্র স্থিতবিন্দু হচ্ছে ‘বেদ’; বেদ হিন্দু ধর্মের ভিত্তি, আর সবই আনুষঙ্গিক। তাই এই বিশাল, জটিল, বহুস্তরীকৃত বিশ্বাস-লোকাচার-উপাচারসমষ্টিকে হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্ম না বলে ‘বৈদিক ধর্ম’- বলাই আমি বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করি। যাঁরা ‘বেদ’কে প্রামাণ্য মানেন, তাঁরা এই বৈদিক বা আস্তিক্যবাদী ধারার অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, যাঁরা বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেন না, যেমন জৈন বা বৌদ্ধদের মতো শ্রমনপন্থীরা, তাঁরা অবৈদিক বা নাস্তিক্যবাদী স্রোতের অন্তর্ভুক্ত। ‘নাস্তিক’ শব্দের আদি অর্থ ছিলো — ‘যারা বেদকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না’। (বাংলাদেশে অবশ্য ‘নাস্তিক’ এখন একটি নিরর্থক শব্দে পরিণত হয়েছে — যার কথাই আপনার অপছন্দ হবে, তাকেই আপনি এই অভিধা দিয়ে সম্মানিত করতে পারেন।)

বলে নেয়া ভালো যে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে এই জাতীয় বিভাজনও সমস্যাবিহীন নয়, কারণ বিভিন্ন বিপরীতমুখী দার্শনিক ধারা একে অন্যকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে শত শত বছর ধরে। যেমন ধরুন, মহাযান ধারার বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের ‘শূন্যবাদ’ ছাড়া গৌড়পাদের মান্ডুক্যকারিকা কল্পনা করা কঠিন; আর ‘পরমগুরু’ গৌড়পাদের মান্ডুক্যকারিকা ছাড়া শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত-বেদান্ত দর্শনের বর্তমান রূপও অনুমান করা কষ্টকর। কাজেই, বিশ্লেষণের সুবিধার্থে বৈদিক-অবৈদিক, আস্তিক-নাস্তিক, হিন্দু-বৌদ্ধ ইত্যাদি যে বিভাজনই আমরা করি না কেনো, তা পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরে না, এবং অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।

মূল আলাপে ফিরিঃ ‘যারা বেদ এনেছিলো’। হিন্দু ধর্মের এই ধ্রুবক বেদের উৎস সন্ধানে আমাদের যে ভ্রমণ, তার সূচনা হবে আফ্রিকায়। মানুষের গল্পের শুরু সেখানেই।

 

 

 

আদিপর্ব
বিবর্তনতত্ত্ব এখন বিজ্ঞানের একটি সন্দেহাতীত সত্য — কিন্তু এ-সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতা এবং বিভ্রান্তি প্রচুর, কারণ তত্ত্বটি ঠিক করে বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না, এবং যাঁদের পড়ানোর কথা তাঁদের অনেকেই বিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলো (প্রাকৃতিক নির্বাচন, গোত্র নির্বাচন, যৌন নির্বাচন ইত্যাদি) ঠিক করে বোঝেন কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে। তবে, নৃতাত্ত্বিক, জিনভিত্তিক পুরাবংশগতিবিদ্যা, ফসিল এবং পরিবেশগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আজ আমরা জানি, ‘মানুষ’ নামের মহাউপাখ্যানের সূচনা ঘটে আফ্রিকায় [6]। হোমো স্যাপিয়েন্স, অর্থাৎ, শারীরিকভাবে আমাদের সদৃশ ‘আধুনিক’ মানুষের বিকাশ ঘটে পূর্ব আফ্রিকার রিফট ভ্যালিতে, আজ থেকে কমপক্ষে ১৫০,০০০ বছর পূর্বে [7]। আমাদের পূর্বেও মানুষের বেশ কিছু প্রজাতি পৃথিবীতে ছিলো, এবং কেউ কেউ আমাদের সাথে সহাবস্থানও করেছে, তবে নিয়তি (কিংবা অভিযোজনের দক্ষতা) টিকিয়ে রেখেছে মানুষের একটি প্রজাতিকেই — এবং সেটি হোমো স্যাপিয়েন্স। এটি এখন একটি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব যে, আফ্রিকা থেকেই আমাদের প্রজাতির, অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্সের বিস্তৃতি ঘটেছে সারা পৃথিবীতে; এবং, এই ক্ষুদ্র গ্রহে, এখন এমন একটি অঞ্চল খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে আমাদের পায়ের ছাপ পড়েনি। যদিও মানুষের স্বভাব হচ্ছে নানা কল্পিত বিভাজনে নিজেদের বিভক্ত করে রেখে তৃপ্তি বোধ করা, তবু, সত্য হচ্ছে, চূড়ান্ত বিচারে আমরা প্রত্যেকেই ‘আফ্রিকান’ [8]। আফ্রিকা হতে আমাদের যে পূর্বপুরুষেরা ছড়িয়ে গিয়েছিলো সারা পৃথিবীতে, তারা ছিলো ভবঘুরে-যাযাবর, এবং আজ মঙ্গলে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন যারা দেখছে, তাদের চরিত্রও ভবঘুরে-যাযাবরেরই [9]। অর্থাৎ, দেড় লক্ষ বছর পূর্বে আমাদের প্রজাতির চরিত্র যা ছিলো, এখনো, মূলত, তা-ই আছে। মানুষের ইতিহাস, এক অর্থে,পরিব্রাজন-অভিবাসন-অভিপ্রয়াণের ইতিহাস এবং চূড়ান্ত বিচারে আমরা কেউ-ই নিজ অঞ্চলের আদি-আদিবাসী নই।

কেমন ছিলো আদিমানবের ধর্মীয় জীবন? প্রবৃত্তির তাড়নায় যে চালিত হয়েছে নিয়ত, সে প্রথম কখন নিজের এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ভাবা শুরু করে? ডঃ হুমায়ুন আজাদ মনে করেন যে ধর্মের ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের [10]। এই সময়কালটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ক্ষেত্রে সত্য হলেও, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে আমরা জানি যে আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ বছর পূর্বে, প্যালিওলিথিক বা পুরা-প্রস্তর যুগেও মানুষ সমাধিস্থ করতো মৃতদের। পরজীবন, সর্বপ্রাণবাদ, শমনবাদ, পূর্বপুরুষের পূজা, অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস ইত্যাদি হাজার হাজার বছরের প্রাচীন চর্চা। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা আজো বিশ্বাস করেন স্বপ্নপুরাণে [ড্রিমটাইম], এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বাস করে আসছেন অন্তত ৬৫,০০০ বছর ধরে। কাজেই ‘ধর্ম’ (পশ্চিমা অর্থে) বা ‘প্রত্ন-ধর্ম’ [প্রোটো-রিলিজিয়ন] মানুষের সাথে রয়েছে সেই আদি থেকেই — এটি সাম্প্রতিক কোনো উদ্ভাবন নয়।

আফ্রিকা থেকে আমরা এখন বেরিয়ে পড়বো পৃথিবীর পথে।

 

 

 

ভারতবর্ষে প্রথম মানুষ
আফ্রিকা থেকে বিশ্বের অন্যত্র মানুষের বিস্তার অল্প সময়ে হয় নি; তার এই মহাযাত্রা শুরু হয়েছে সহস্র বছর আগে, চলেছে সহস্র বছর ধরে — কখনো ধীরে ধীরে, কখনো ধারাবাহিক, উপর্যুপরি স্রোতে। প্রতিটি ঢেউ মানুষকে নিয়ে গেছে নতুন কোনো অঞ্চলে; সেখানে সে আশ্রয় খুঁজেছে, কখনো লিপ্ত হয়েছে সংঘাতে, কখনো অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণভাবে মিশে গেছে অন্য স্রোতের সাথে [11]। কিন্তু ঠিক কবে আমাদের প্রজাতির পা পড়ে এই ভারতীয় উপমহাদেশে? আফ্রিকা থেকে একটি বড়ো রকমের অভিবাসন ঘটে আজ থেকে প্রায় ৭৮,০০০ হাজার বছর পূর্বে এবং প্রথমবারের মতো মানুষ এসে উপস্থিত হয় এই ‘ভারতের সাগরতীরে’ [12]। সেই তখন থেকে, আমাদের এই উপমহাদেশে (যাকে ‘ভারতবর্ষ’ বলতে চাই), অসংখ্য ভাষা, জাতি এবং গোত্রের উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিলয় ঘটেছে — তাদের কারো কারো গল্প আমরা জানি, এবং অধিকাংশেরই জানি না, কিন্তু প্রতিটি অধ্যায়ই তাৎপর্যপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, মানুষের যে মহাযাত্রা — তার অংশ আমরা প্রত্যেকেই। একটি অবিচ্ছিন্ন, ধারাবাহিক সূত্র আমাদের গেঁথে রেখেছে, সম্পৃক্ত করে রেখেছে সেই গুটিকয়েক হোমো স্যাপিয়েন্সদের সাথে — যারা আফ্রিকা ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছিলো পৃথিবীর পথে, এবং যাদের একটি অংশ এসে পৌঁছেছিলো প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষে। আমরা তাদেরই উত্তরসূরী। মানুষের এই মহাযাত্রার সূত্র যদি কোথাও এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো, তাহলে আপনি-আমি এখানে থাকি না [13]।

যারা ভারতে এসেছিলো, তারা সবাই এখানে রয়ে যায়নি। জিনগত তথ্য থেকে আমরা জানি যে — প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে, আফ্রিকা থেকে ভারতে আসা জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ, প্রথমে দক্ষিণ ভারত, সিংহল, বঙ্গ, ব্রহ্মদেশ, সুবর্ণভূমির সমুদ্রতীর ঘেঁষে, এবং তার পরে মালয়, সুবর্ণদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রার দ্বীপপুঞ্জ হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ায় — পৃথিবীর দক্ষিণতম মহাদেশে। মানুষ যখন পরিব্রাজন করে, তখন তার ভাষা ও সংস্কৃতি সাথে করে নিয়ে যায়, এবং একটু খুঁজলেই, তার ছাপ আমরা আজো পাই। যেমন ধরা যাক এই বিস্ময়কর তথ্যটি — তামিল ভাষা, যা ভারতের দ্রাবিড় ভাষাবংশভুক্ত, তার সাথে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কিছু আদিবাসীদের ভাষার মিল, যদিও বর্তমানে এই দুই গোত্রের মধ্যেকার দূরত্ব প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার [14]। কী করে ব্যাখ্যা করা যায় ব্যাপারটি? ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, তামিল এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ভাষার মধ্যে, পরেরটি কাজ করছে ‘অধঃস্তর ভাষা’ [সাবস্ত্রেট ল্যাঙ্গুয়েজ] হিসেবে, অর্থাৎ মানুষের প্রাগৈতিহাসিক পরিব্রাজনের ছাপ রয়ে গেছে কম প্রভাবশালী ভাষার ওপর [15]। কিন্তু, কেনো এই তথ্যটি তাৎপর্যপূর্ণ? এটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আফ্রিকা থেকে ভারত হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অভিপ্রয়াণের এটি একটি প্রমাণ, এবং এভাবে ভাষাবিজ্ঞানকে ব্যবহার করে ভারতে মানুষের অভিপ্রয়াণের অতীত পুনর্গঠন করা সম্ভব।

ভারতবর্ষে যারা রয়ে গেলো তাদের ভাষিক ছাপ আমরা আজো পাই কিছু বিপন্ন, কিন্তু এখনো ব্যবহৃত, প্রাচীন ভাষায়, যেমন উত্তর পাকিস্তানের বুরুশাশকি, পশ্চিম নেপালের কুসুন্দা, শ্রীলঙ্কার ভেড্ডা, আন্দামানীয় ভাষাগুলো — তবে দুঃখজনক হচ্ছে যে এই ‘অনার্য’ ভাষাগুলো নিয়ে গবেষণার আগ্রহ ভারতবর্ষের গবেষকেরা দেখান না [16]। ভারতের এই ভুলে যাওয়া মানুষদের ইতিহাসের আদিপর্ব অর্থাৎপুরা-প্রস্তর যুগ এবং মধ্য-প্রস্তর যুগ নিয়ে আমিও এখানে আলোচনা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেবো, কেনোনা সেই পরিসর নেই; আর প্রসঙ্গটি আমার কাছে আগ্রহউদ্দীপক হলেও, আলোচ্য বিষয় থেকে সুদূর। পুরা এবং মধ্য-প্রস্তর, এই দু’টি পর্বের সম্মিলিত সময়কাল, অর্থাৎ প্রায় ৭০,০০০ বছর, পেরিয়ে আমরা এখন প্রবেশ করবো নব্যপ্রস্তর যুগে।

নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ যখন শিকারির জীবন ত্যাগ করে কৃষিজীবনে থিতু হল, তখন থেকেই তার অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসগুলো একটি সাংগঠনিক রূপ ধারণ করতে থাকে, যাকে আধুনিক অর্থে ‘ধর্ম’ বলে চিহ্নিত করতে পারি। সংঘবদ্ধ ধর্মের সাথে ‘সভ্যতা’ বলতে আমরা যা বুঝি তারও একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আজ থেকে ১০,০০০ বছর আগে, মানুষ যখন প্রথম কৃষিভিত্তিক সমাজের সূচনা ঘটায়, তখন থেকেই সভ্যতার সূচনা বলে আমরা অনুমান করে থাকি। কেনো এই নির্দিষ্ট কালকে সভ্যতার সূচনালগ্ন বলবো, এবং কেনো এর আগের সময়কে নয়? কেনোনা, যে জীবন শিকারির, সে জীবনে সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তার জন্ম দেওয়া কঠিন। সভ্যতার জন্মের জন্যে মানুষের স্থির হওয়া, থিতু হওয়া, এবং উৎপাদনের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম (যেমন কৃষি) খুঁজে বের করা জরুরি ছিলো। কোনটি ছিলো সর্বপ্রথম সভ্যতা? — এর উত্তর নিশ্চিত করে বলা কঠিন, তবে আমরা জানি যে সব সভ্যতাতেই ধর্মীয় বিশ্বাস পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যেমন, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে, সুমের, আক্কাদ, এসিরিয়া এবং ব্যাবিলনের মানুষেরা গড়ে তুলেছিলো প্রাচীন মেসোপটেমিয় সভ্যতা — তাদের জীবনে ছিল ধর্মবিশ্বাস, দেবতাদের পূজাঅর্চনা, সুবিশাল মন্দির, উৎসব এবং উৎসর্গের উপাচার। অর্থাৎ, মানুষের বিশ্বাসের ইতিহাস, আমাদের লিখিত ইতিহাসের চেয়েও, প্রাচীন।

 

 

 

 

প্রাক-বৈদিক সিন্ধু সভ্যতা
খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দের দিকে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাসরত শিকারী এবং যাযাবর শ্রেণীর মানুষেরা কৃষিকাজ এবং পশুপালনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে তারা বেছে নেয় ঐ অঞ্চলের নদী-সংলগ্ন উর্বর জমিকে। তাদের এমন স্থায়ী বসতির নিদর্শন পাই সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে, বোলান পাস উপত্যকার কাছে, মেহেরগড় এলাকায়। মেহেরগড়কে প্রাক-হরপ্পীয় কৃষিবসতি বলতে পারি। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত মেহেরগড়ে স্থায়ী মানববসতি ছিলো, এবং, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এরা সিন্ধু সভ্যতার পূর্বসূরী [17]। মেহেরগড়ের এই বাসিন্দারা কী ভাষা ব্যবহার করতো এবং তাদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ ছিলো কি না সে সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত বিস্তৃত এবং গভীর সমাধিস্থল থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে মৃতদের শেষকৃত্য-সংক্রান্ত আচারে তাদের আগ্রহ ছিলো — যা ধর্ম এবং পরজীবনে বিশ্বাসের লক্ষণ বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ, বৈদিক যুগের সূচনার প্রায় ৫৫০০ বছর পূর্বেও ভারতবর্ষের মানুষের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ছিলো, যদিও আমাদের দৃষ্টিতে এই বিশ্বাসগুলো মনে হতে পারে ‘আদিম’।

খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ অব্দের দিকে, সিন্ধু অববাহিকায় এক নগর-সভ্যতার উদয় হয়, যা ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামে খ্যাত। এই সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমরা পাই হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোতে — তবে এর বিস্তৃতি ছিলো উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে, দক্ষিণে আরব সাগর এবং পশ্চিমে ইন্দো-পারস্য সীমান্ত থেকে পুবে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত [18]। ভৌগোলিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে অধিকাংশ ইতিহাসবিদরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে সিন্ধু সভ্যতা ছিলো ‘প্রাক-বৈদিক’ — অর্থাৎ এটি ছিলো আর্যভাষাভাষীদের ভারতে আগমনের ‘পূর্বের’ সভ্যতা [19, 20, 21]। সিন্ধু সভ্যতার ভাষা, লিপি, ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনযাপন থেকে শুরু করে মৃতদেহ-সৎকারের রীতি — এগুলো কোনো কিছুর সাথেই পরবর্তী বৈদিক যুগের মিল নেই [22, 23]। মূলধারার প্রত্নতত্ত্বে এই সিদ্ধান্ত এতোটাই প্রতিষ্ঠিত, এবং অজস্র প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত, যে এই সত্যে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ আমি দেখি না।

সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দাদের সম্পর্কে আমরা কি জানি? আমরা জানি যে, এটি ছিলো নগর-কেন্দ্রিক সভ্যতা, এর বাসিন্দারা ছিলেন মূলত বণিক, কারিগর এবং শিল্পী। ব্যক্তিগতভাবে ‘নগর’ মানেই ‘সভ্যতা’ — এই জাতীয় সমীকরণে আমি বিশ্বাস করিনা, (এমনকি অনেক নগরকে বর্বর মনে করি), তবে সিন্ধুর নগরগুলো ছিলো সুপরিকল্পিত এবং জনবান্ধব। এখানকার ধ্বংসাবশেষে, যার খুব সামান্য অংশই খনন হয়েছে, পাই বিশাল প্রাচীর, স্নানাগার, জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, কেন্দ্রীয় স্তুপ, প্রশস্ত সড়ক, বিশ্রামাগার, নাগরিক মিলনায়তন এবং মৃতদের জন্যে সমাধিক্ষেত্র; পাই সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যে তামা, ব্রোঞ্জ এবং পোড়ামাটির তৈরি ভাস্কর্য [24, 25]। সিন্ধুবাসীদের বাণিজ্যবলয় বিস্তৃত ছিলো উত্তরে চিন, এবং পশ্চিমে গান্ধার,পারস্য, মেসোপটেমিয়া, উপসাগরীয় এলাকা, এমনকি মিশর পর্যন্ত। তারাই ছিলো প্রথম ‘ভারতীয়’ যারা পেরিয়ে গিয়েছিলো আঞ্চলিক সীমানা, এবং হয়ে উঠেছিলো ‘বৈশ্বিক’।

সিন্ধুবাসীরা ব্যবহার করতো নিজস্ব এক প্রকার লিপি, যার পাঠোদ্ধার আজো সম্ভব হয়নি, তবে দ্রাবিড়ীয় ভাষার প্রভাববলয়ের ভেতরে পড়ায় লিপিটি প্রাক-দ্রাবিড়ীয় হয়ে থাকতে পারে বলে অধিকাংশ ভাষাতাত্ত্বিকদের ধারণা। সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব না হওয়ায় তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং লোকাচার সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে উত্তর-পশ্চিম ভারত (ও বর্তমান পাকিস্তানে) প্রত্নখনন থেকে যেসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রাণদাত্রী, গর্ভধারণ, উর্বরতা, শস্যদাত্রী মাতার প্রতীকপুত্তলী রয়েছে বিপুল পরিমাণে – যা থেকে আমরা জানি যে এ-অঞ্চলে নারীরূপ বা মাতৃকাশক্তির উপাসনা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো [26]। (এটি একটি লক্ষণীয় বিষয়, কারণ সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তির সাথে সাথে দেবীরাও তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন, এবং পুরো বৈদিক যুগ জুড়েই দেবীদের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গৌণ। বেদে দেবতাদেরই প্রাধান্য, দেবীদের নয়। বৈদিক যুগ শেষ হওয়ার হাজার বছরেরও বেশি সময় পরে, ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে, কিছুটা পুরাণ, এবং মূলত তান্ত্রিক চর্চার প্রভাবে, দুর্গা, অম্বা, কালি বা চণ্ডীর মতো দেবীরা আবার পূজিত হতে শুরু করেন [27, 28, 29, 30], আবার ফিরে আসে দেবীদের যুগ। ভারতবর্ষে আজ আমরা ‘হিন্দু ধর্ম’ বলতে যা বুঝি — তা প্রাক-বৈদিক উপাদান, বৈদিক সংস্কৃতি, কিছু উত্তর-বৈদিক বৌদ্ধ উপাদান, পুরাণ এবং তান্ত্রিক ঐতিহ্যের সম্মিলন)।

ফিরে আসি প্রাক-বৈদিক সিন্ধু সভ্যতায়। এ-পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতাই ভারতের সর্বপ্রথম ‘সভ্যতা’ (প্রপঞ্চটির সংজ্ঞা নিয়ে এখন বিতর্কে যাচ্ছি না, কারণ মূল বিষয়ে থাকতে চাইছি)। উত্তর-পশ্চিম ভারতে আর্যদের আগমনের হাজার হাজার বছর আগে থেকেই এখানে মানববসতি ছিলো; ছিলো লিখিত ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি ধর্মও। শুধু তাই নয়, প্রাক-বৈদিক সিন্ধুবাসীরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো এমন একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা, যা উৎকর্ষ এবং বিস্তৃতির দিক থেকে বিচার করলে মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার সাথে তুলনীয়, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর বৃহৎ এবং বিকশিত ছিলো [31]। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর, সিন্ধু সভ্যতার মূল কেন্দ্রভূমি পড়ে যায় পাকিস্তানের সীমান্তের ভেতরে — যদিও আমি মনে করি সিন্ধু সভ্যতার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একটি ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক ‘দুর্ঘটনা’ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু দেশভাগের ফলে, ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা এই প্রাক-বৈদিক সভ্যতা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। যে অঞ্চল এখন আর ভারতের ভৌগোলিক সীমানার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাকে কী করে ‘ভারতীয় সভ্যতার সূতিকাগার’ বলি? — এই আন্তর-দ্বন্দ্ব থেকে আজো বের হতে পারেননি অনেক ভারতীয় চিন্তক। পাকিস্তানের মতো অসুস্থ রাষ্ট্রকে রাজনীতি দূষিত করবে, এটিই তো স্বাভাবিক; কিন্তু রাজনীতি দূষিত করেছে ভারতকেও — যার কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিলো অনেক বেশি (বিজেপিউত্তর ভারতে এখন জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় রাজনীতি যেভাবে ইতিহাস বা ছদ্ম-ইতিহাস চর্চাকে প্রভাবিত করছে — তা ভারতের জন্যে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি হিন্দু-ধর্মের বহুত্ববাদী ভাবমূর্তির জন্যেও বিনাশী বলে আমি মনে করি)।

কিছুই অবশ্য চিরস্থায়ী নয়; সিন্ধু সভ্যতাও বেশিদিন টেকেনি, এর ক্ষয়িষ্ণুকালের সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ অব্দের দিকে, এবং মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের মধ্যে এই সভ্যতার নগরগুলো পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ঠিক কী কারণে সিন্ধুবাসীরা এই সুপরিকল্পিত নগরগুলো ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলো তা নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে, তবে আজ অধিকাংশ পন্ডিতদের মতে মূল কারণটি সম্ভবত ভু-প্রাকৃতিক, এবং অর্থনৈতিক [32]। ঘাগর-হাকরা নদী, যার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সিন্ধু সভ্যতায়, শুকিয়ে গিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক মরুকরণ প্রক্রিয়ার সূচনা হয়, যার ফলেনগরগুলো ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়ে। মোটামুটি একই সময়ে, মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায় (যাদের সাথে সিন্ধু অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো গভীর) ঘটে বড়ো রকমের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন। এর ফলে সিন্ধু অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ভাটা আসে, এবং জীবিকার খোঁজে বাসিন্দারা অন্যত্র, বিশেষত অপেক্ষাকৃত উর্বর জমিতে, অভিপ্রয়াণ করতে বাধ্য হয়। এভাবেই, কালের স্রোতে, এই এলাকার সবচেয়ে উন্নত নগর-সভ্যতার অবসান ঘটে, এবং ভারত প্রস্তুত হয় এর পরের অধ্যায়ের জন্যে — যাকে আমরা বলবো বৈদিক যুগ — ভারতের ইতিহাস যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু তার আগে আমাদের যেতে হবে ভারতের বাইরে, উত্তরে।

 

 

 

প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উৎসভূমির খোঁজে
প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উৎসভূমির খোঁজে আমাদের সাহায্য নিতে হবে তুলনামূলক এবং ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের [কম্প্যারেটিভ এন্ড হিস্টোরিক্যাল লিঙ্গুইস্টিক্স]। এই শাস্ত্রের প্রকরণ ব্যবহার করে ইন্দো-ইউরোপীয়, দ্রাবিড়, পলিনেশীয় ইত্যাদি অনেকগুলো ভাষার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, এবং বেশ সার্থকতার সাথে। তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান আমাদের জানায় যে একটি অঞ্চলে ব্যবহৃত (বা লুপ্ত) ভাষাগুলোর ধ্বনি, শব্দরূপ এবং অর্থ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে তারা পরস্পরসম্পর্কিত, ভাষাগুলো উদ্ভূত হয়েছে একই আদিভাষা [কমন ল্যাঙ্গুয়েজ] থেকে, এবং কালের স্রোতে ক্রমবিবর্তিত হয়ে পরিণত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় [33, 34]। ভাষাগুলোর মধ্যে এই সম্পর্ক লক্ষ্য করে, এগুলোকে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে অনেকগুলো পরিবারে, বা ভাষাবংশে, এর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের ভৌগোলিক বিস্তার দেখলে দেখবো এক প্রান্তে ইউরোপ এবং আরেক প্রান্তে ভারত; অর্থাৎ, বর্তমান বিশ্বের ৪৬% মানুষ কোনো-না-কোনো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলে। সুদূর অতীতের দিকে যদি তাকাই, তাহলেও দেখবো যে: ঋগ্বেদের বৈদিক সংস্কৃত, আবেস্তার প্রাচীন ইরানীয় এবং ইউরোপের প্রাচীন লাতিন — এই ভাষাগুলো ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কিত, এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে এটি সুস্পষ্ট যে এদের ধ্বনি এবং শব্দরূপ একসময় অভিন্ন ছিলো [35]। পেছনে যেতে যেতে আমরা যদি সাড়ে ছয় হাজার বছর অতীতে যাই, তাহলে পাবো আজকের বিশ্বে প্রচলিত প্রায় ৫০০টি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর সর্বআদিরূপ, যাকে বলতে পারি প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় [প্রোটো ইন্দো-ইউরোপিয়ান] ভাষা [36]। এই প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ পর্যন্ত একটি একক ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়।[37]

প্রসঙ্গত বলে রাখি, তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান প্রকৃত অর্থেই একটি ‘বিজ্ঞান’ এবং এর রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি। এই বিজ্ঞান আমাদের জানায় যে, ভাষাগুলোর ধ্বনিপরিবর্তন একটি নিয়মানুবর্তী ব্যাপার, যা অনুসরণ করে লুপ্ত ভাষার পুনর্গঠন [রিকন্সট্রাজশন] করা সম্ভব। আজ থেকে ৬৫০০ বছর পূর্বে প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার ধ্বনি কেমন ছিলো, তার একটি সম্ভাব্য পুনর্গঠন করেছেন কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানী এন্ড্রু ব্যর্ড [38], আগ্রহীরা এর একটি রেকর্ডিং শুনতে পারেন এখানেঃ https://soundcloud.com/archaeologymag/king-and-god। বিলুপ্ত ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক পুনর্গঠন [ফোনোলজ্যিকাল রিকন্সট্রাজশন] নিয়ে এ-জাতীয় আরো অনেক কাজ হয়েছে; এবং আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে লুপ্ত ভাষার ধ্বনিপ্রকৃতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ধারণা পাওয়া সম্ভব।

আমরা দেখছি যে — ভাষার উৎপত্তি, ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং বিবর্তন একটি জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে আমাদের দিতে পারে কৌতুহূলউদ্দীপক তথ্য। এ-ব্যাপারে ভারতবর্ষে ব্যবহৃত ভাষাগুলোর দুইটি মানচিত্র দেখে নিতে পারি — প্রথমটি দ্রাবিড়, এবং পরবর্তীটি ইন্দো-আর্য ভাষাবংশের।

দ্রাবিড় ভাষাবংশের ভৌগোলিক বিস্তৃতি। উৎস: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত ইন্দো-ইরানীয় শাখা, এবং, তার অন্তর্ভুক্ত ইন্দো-আর্য উপশাখার বিস্তৃতির মানচিত্র। উৎস: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের অনেকগুলো শাখা-উপশাখা রয়েছে। এর একটি প্রধান শাখা হচ্ছে ‘ইন্দো-ইরানীয়’ শাখা — ভারত এবং ইরানের অনেকগুলো ভাষা অন্তর্ভুক্ত এর ভেতরে। ‘ইন্দো-ইরানীয়’ শাখার ভারতীয় উপশাখাটির নাম ‘ইন্দো-আর্য’, যার অধীনে পড়ে ঋগ্বেদের বৈদিক সংস্কৃত, পরবর্তীকালের ধ্রুপদী সংস্কৃত, এবং প্রাকৃত ভাষাগুলিঃ শৌরসেনী, মাগধী ইত্যাদি। আমাদের বাংলা হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের > ইন্দো-ইরানীয় শাখার > ইন্দো-আর্য উপশাখার > প্রাকৃত ভাষাগুলোর একটি। বাংলা ভাষার ওপর সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব অপরিসীম; কিন্তু বাংলা সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসেনি, এসেছে মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ রূপ থেকে [39]।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সুবিস্তৃত এবং জটিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের সর্বআদিভাষা যেটি, সেই প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার (প্রচলিত নাম ‘আর্যভাষা’) উৎপত্তিস্থল কোথায়? কাদের ভাষা ছিলো এটি?

মানচিত্রে ইউরেশিয় স্তেপ অঞ্চল । উৎস: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা

 

স্তেপ অঞ্চল, কাজাখস্তান। ছবিঃ শার্লট ভেনেমা (২০১৯)।

এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যবর্তী অঞ্চল, অর্থাৎ, আজকের ইউক্রেইন, পশ্চিম রাশিয়া, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া জুড়ে তৃণাচ্ছাদিত-সমভূমির যে দীর্ঘ বলয়, সেটি ইউরেশিয়ান স্তেপ্ বেল্ট নামে পরিচিত। স্তেপ্‌ বলতে আমরা বুঝি বিস্তীর্ণ সমভূমি; যেখানে আবহাওয়া শুষ্ক, বৃক্ষের সংখ্যা স্বল্প, কিন্তু যেখানে অবারিত প্রান্তর জুড়ে রয়েছে তৃণভূমি (এবং কোথাও কোথাও রয়েছে আংশিক মরুভূমি)।

এই বলয়েরই একটি অংশে, কৃষ্ণসাগরের উত্তরে,কাজাখস্তানের ইউরাল নদীর কাছে, বাস করতো ‘ইয়ামনায়া’ (Yamnaya) নামে এক জনগোষ্ঠী, যাদের সংস্কৃতির বিস্তৃতি ছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দ থেকে ২৬০০ অব্দ পর্যন্ত (অর্থাৎ, ব্রোঞ্জ যুগে)। স্থানীয় ভাষায়, ‘ইয়ামা’ (Yama) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘মৃতদের জন্যে তৈরি সমাধি’, এবং জনগোষ্ঠীটি ‘ইয়ামনায়া’ নামে পরিচিত ছিলো কারণ তারা মৃতদের গভীর গর্ত করে সমাধি দিতো (‘ইয়ামা’ শব্দটি হিন্দু মৃত্যুদেবতা ‘যম’-এর আদি রূপ হয়ে থাকতে পারে। যমের সংস্কৃত উচ্চারণ শুনতে ইয়ামার মতোই!)। প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের উৎসভূমি নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে ‘কুরগান প্রকল্প’ [কুরগান হাইপোথিসিস] আজকের ইতিহাসবিদরা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন [40]। এই প্রকল্পের আধুনিকতম রূপ অনুযায়ী, এই ইউরেশিয়ার স্তেপ্‌ অঞ্চল হতে আসা এই ইয়ামনায়া জনগোষ্ঠীই ইন্দো-ইউরোপীয় ‘আর্যভাষীদের’ পূর্বসূরি হওয়ার সবচেয়ে নিকটতম এবং সম্ভাব্য প্রতিনিধি [41]।

ভারতবর্ষে প্রথম ঘোড়া এবং ঘোড়ায় টানা রথের ব্যবহারের প্রচলন ঘটায় স্তেপ্ অঞ্চল হতে আসা ইয়ামনায়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা (এবং তাদের উত্তরপুরুষেরা)। ছবিঃ নায়ওবি থমসন (২০১৮)।

ইয়ামনায়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ছিলো মূলত যাযাবর প্রবৃত্তির; তারা পশুচারণ করতো, অশ্ব পালন করতো, জানতো চাকা এবং ঘোড়ায় টানা রথের ব্যবহার [42], এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কৃষিকাজও করতো। তৃণাচ্ছাদিত-সমভূমির যাযাবর পশুচারণকারীদের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পশুর জন্যে নিত্যনতুন প্রান্তরের খোঁজে তারা সারাক্ষণই চলিষ্ণু থাকে, অর্থাৎ একই স্থানে বেশিদিন থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। (কাজাখস্তান-মঙ্গোলিয়ার দিকে এখনো আমরা এমন জীবনযাত্রা দেখতে পাই)। এ-কারণেই হয়তো, পশ্চিম ইউরেশিয়ার তৃণাচ্ছাদিত-সমভূমি ত্যাগ করে, ইয়ামনায়া জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ উত্তরপুরুষেরা বিভিন্ন দিকে অভিপ্রয়াণ করা শুরু করে। তাদের একটি অংশ যায় উত্তর-পশ্চিমে, ইউরোপে — এবং আরেকটি অংশ যায় দক্ষিণ-পূর্বে ভারত-অভিমুখে। ভারতের দিকে যাত্রা করা জনগোষ্ঠী আমু দরিয়া নদীর দক্ষিণের ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল (যা হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত) হয়ে ইরানের কাছাকাছি এসে আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একদল চলে যায় ইরানের দিকে এবং জন্ম দেয় প্রাচীন পারসিক সভ্যতার (লক্ষণীয় যে ‘ইরান’ শব্দটি এসেছে ‘আরিয়ান’ থেকে, অর্থাৎ ‘আর্যদের বাসভূমি’); এবং আরেকটি গোষ্ঠী, খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দের দিকে, প্রবেশ করা শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারতে। আগেই বলেছি যে তারা যে ভাষায় কথা বলতো তা ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’ বা ‘বৈদিক সংস্কৃত’ নামে পরিচিত। বৈদিক সংস্কৃতের লেখ্য রূপ তখনো প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি।

একটি ভাষিক গোষ্ঠী যদি, দীর্ঘকাল ধরে, অন্য আরেকটি ভাষিক গোষ্ঠীর বাসভূমির ওপর দিয়ে পরিব্রাজন করে, তাহলে এর ছাপ পাওয়া সম্ভব দুই গোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা ওপর।

ইউরেশিয়ার স্তেপ্‌ অঞ্চল হতে, ভারত অভিমুখে, আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর যে অভিপ্রয়াণ ঘটেছিলো তার প্রমাণ আমরা পাই আমু দরিয়ার অক্সাস অঞ্চলের ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা থেকে আনা কৃতঋণ [লোন ওয়ার্ডস] শব্দগুলোতে (যেমনঃ ইস্ট্র > ইট, উস্ট্র > উট, ইত্যাদি)। তেমনি, উরালীয় ভাষাসমূহে আর্যভাষীদের রেখে যাওয়া শব্দগুলো-ও (যেমনঃ চেকরা > চক্র, রেশমা > রশি, শাতা > শত ইত্যাদি) আমাদের জানায় যে এক প্রকার ভাষিক বিনিময় ঘটেছিলো এই জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে [43]। আর্যভাষীদের ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতির অনুষঙ্গেও পাওয়া যায় তাদের এই দীর্ঘ যাত্রার ছাপ। ঋগ্বেদের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের আদিরূপ পাই ইন্দো-ইরানীয় দেবতা বৃত্রঘ্নে (শব্দটি ঋগ্বেদেও ব্যবহার করা হয়েছে ইন্দ্রের গুণবাচক নাম হিসেবে)। একইভাবে ঋগ্বেদে পাই সোম (ইন্দো-ইরানীয় —’হোম’) রসের ব্যবহার, যা আর্যভাষীরা সম্ভবত প্রথম শিখেছিলো ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা অঞ্চলের সংস্কৃতি থেকে, এবং যা সম্ভবত প্রস্তুত করা হতো এফিড্রা (‘সোমলতা’) নামের উদ্ভিদ থেকে [44, 45, 46]। আমরা দেখি যে, আর্যভাষীরা যেখানেই পরিযান করেছে, সেখানেই স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে ভাষা-সংস্কৃতির পারস্পরিক বিনিময়ের ছাপ রেখে গেছে।

আবারও স্মরণ করি যে, আর্যভাষীদের যে গোষ্ঠীগুলো, খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দের দিকে, উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করা শুরু করেছিলো, তাদের ভাষা ছিলো ‘প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা’ বা ‘বৈদিক সংস্কৃত’ — অথবা এর প্রাচীন কথ্য রূপ। অভিপ্রয়ানকারীরা অধিকাংশই ছিলো পুরুষ, এবং তারা সঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করেছিলো স্থানীয় নারীদের, যাদের ভাষা ছিলো তাদের চেয়ে ভিন্ন। কালক্রমে, এই দুই গোত্রের পরবর্তী প্রজন্মগুলো, বৈদিক সংস্কৃত এবং ভারতে বসবাসরত আদিবাসীদের কথ্য ভাষাগুলোর একটি সংমিশ্রিত রূপে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে — যার ফল হিসেবে আমরা পাই ‘প্রাকৃত ভাষা’ (অথবা, এর পরিবর্তিত রূপ) [47]। এ-প্রসঙ্গে আগ্রহ থাকলে দেখে নিতে পারেন ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ পেগি মোহনের এই সাক্ষাৎকারঃ https://youtu.be/qjsRqVHCetI।

 

ইতিহাসের অপরাজনীতিকরণ
তুলনামূলক এবং ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক স্যার উইলিয়াম জোন্স (যিনি খুব যত্নের সাথে শিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষা), এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর ১৭৮৬ সালে দেয়া বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেনঃ “সংস্কৃত ভাষা, এর প্রত্নপরিচয় যাই-হোক-না কেনো, এক বিস্ময়কর সংগঠনমণ্ডিত। এ-ভাষা গ্রিকের চেয়ে উৎকৃষ্ট, লাতিনের চেয়ে বিশদ, এবং উভয়ের থেকে সুচারুরূপে পরিশীলিত” [48]। ভাষাগুলোর ক্রিয়ামূল এবং শব্দরূপের কাঠামো বিশ্লেষণ করে তিনি অনুমান করেন যে এই তিনটি ভাষা উৎসারিত হয়েছে একটি অভিন্ন উৎস থেকে যা, সম্ভবত, আজ বিলুপ্ত।

একই ধারাবাহিকতায় ১৮৫০ সালে, জার্মান ভাষাবিদ, সংস্কৃতজ্ঞ এবং প্রাচ্য-বিষয়ক গবেষক ফ্রেডেরিক ম্যাক্স মুলার ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষাগুলো বিশ্লেষণ করে প্রস্তাব করেন যে আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর একটি ধারা মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিমে এবং আরেকটি ধারা পুবে ভারতের দিকে ঢুকেছে। ম্যাক্স মুলার (এবং তাঁর মতো অন্যেরা) মনে করতেন যে আর্যভাষাভাষীদের যে ধারাটি পশ্চিমে গিয়েছে তারা অপেক্ষাকৃত ‘সভ্যতর’ (এ-জাতীয় বর্ণবাদী চিন্তা তখনকার সময়ে একেবারে অস্বাভাবিক ছিলো না)। ম্যাক্স মুলার অবশ্য বেদ, এবং বিশেষত বেদের অন্তের উপনিষদ, সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং বেশ কিছু গ্রন্থের অনুবাদও করেছিলেন। তিনি আকাঙ্ক্ষা করতেন যে ষোড়শ শতকে খ্রিস্টানরা যেমন নিজেদের ধর্মকে ‘পরিচ্ছন্ন’ করেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই হিন্দুরা উপাচার-লোকাচারে তাঁদের ধর্মকে সীমাবদ্ধ না রেখে মূল উৎস বেদ-উপনিষদে ফিরে যাবেন [49]।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, ‘আর্য’ শব্দটি খুব গোলমেলে, কারণ একেক যুগে একেক গোত্র এই শব্দটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছে। ইতিহাসবিদরা (এমনকি ম্যাক্স মুলারের মতো ঔপনিবেশিক চিন্তকও) ‘ইন্দো-আর্য’ বা ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ শব্দবন্ধটি দিয়ে কোনো জাতিবিশেষ নির্দেশ করেননি, বরং তাঁরা নির্দেশ করেছেন একাধিক বৃহৎ ভাষিক গোষ্ঠীদের, যাদের ব্যবহৃত ভাষাগুলো ছিলো একই ভাষাবংশ বা ‘পরিবারবর্গে’র অন্তর্ভুক্ত। ‘জাতি’ [রেইস] এবং ‘ভাষিক গোষ্ঠীর’ [লিঙ্গুইস্টিক টার্ম ফর ফ্যামিলিজ অফ ল্যাঙ্গুয়েজেস] — এর মধ্যবর্তী এই পার্থক্যটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ [50]। আমরা দেখি যে, ভারতের ঋগ্বেদে ব্যবহৃত বৈদিক সংস্কৃত আর প্রাচীন পারস্যের জরাথুস্ত্রবাদ-অনুসারীদের ‘আবেস্তা’ গ্রন্থে ব্যবহৃত ইন্দো-ইরানীয় ভাষা — এ দু’টির মাঝে রয়েছে গভীর মিল। দু’টি ভাষা (এবং সংস্কৃতি) উৎসারিত হয়েছে ইউরেশিয়ার একই অঞ্চল থেকে, তারপর বিবর্তিত হতে হতে দুইটি ধারা দুই দিকে ছড়িয়ে গেছে — একটি অংশ গিয়েছে ইরানে, এবং অন্যটি ভারতে [51]। এর মানে এই নয় যে, আজকের ইরানীয়রা এবং ভারতীয়রা একই ‘জাতি’ — এভাবে ভাবলে ভুল হবে। তবে, ভাষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, তাদের ব্যবহৃত ভাষাগুলো একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, যে-কারণে সময় এবং ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও ভাষাগুলোর মধ্যে রয়ে গেছে কাঠামোগত আন্তর-মিল। ম্যাক্স মুলার একজন ঔপনিবেশিক চিন্তক হলেও, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবিবর্তন সম্পর্কিত তাঁর মূল ধারণাটি ভ্রান্ত নয়। সত্য যার কাছ থেকেই আসুক, তা সত্য-ই।

এখানে আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়ঃ ভাষাবিজ্ঞানীরা ‘আর্যভাষী’ শব্দটি ব্যবহার করেন ইন্দো-আর্য ভাষিক জনগোষ্ঠীগুলোকে বোঝাতে। অন্যদিকে, ভারতে যারা এসেছিলো, তারা নিজেদের শুধু ‘আর্য’ হিসেবেই পরিচয় দিতো, যদিও এই শব্দটি দিয়ে তারা কোনো বিশেষ জাতি [রেইস] বোঝাতো না। ‘আর্য’ বলতে তারা তাদেরকেই বোঝাতো যারা সংস্কৃত কথা বলেন, এবং যারা বৈদিক যাগযজ্ঞ, আহুতি ইত্যাদি পালন করেন। আরো বেশ পরে, বৌদ্ধযুগে ‘আর্য’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে গুণবাচক অর্থে [53]: ‘আর্য’ তিনিই যিনি ‘সম্মানিত ব্যক্তি, ‘উন্নত ভাষা ও চরিত্রের অধিকারী’, ‘নৈতিক’ এবং ‘শুদ্ধাচারী’। পাশাপাশি ‘মহান’ অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হতো, যেমন ‘চার আর্যসত্য’। ত্রিপিটকে আমরা পাই যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও একে অন্যকে সম্মানসূচকভাবে ‘আর্য’ বলে সম্বোধন করছেন। পরবর্তীতে, বিংশ শতাব্দীতে, নাৎসিরা ‘আর্য’ শব্দের অর্থ বিকৃত করে বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিবাদী ধারায় নিয়ে যায়, যার ভয়াবহ পরিণতি আমরা ইউরোপে প্রত্যক্ষ করেছি।

ভারতে যে আর্যভাষীরা এসেছিলো তাদের অভিপ্রয়াণের ধরণ কেমন ছিলো? — ম্যাক্স মুলারের সময় থেকেই এটি ভাবিয়েছে অনেক ইতিহাসবিদকে। নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতার অবসান, এবং যাযাবর পশুচারণকারী আর্যভাষীদের আগমন (যাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি ছিলো অভিনব) — ভারতের ইতিহাসে এই দুইটি বড়ো ঘটনা কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিলো, তাই ম্যাক্স মুলারের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে অন্যান্য পশ্চিমা নৃতত্ত্ববিদ এবং ভারততাত্ত্বিকরাও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে — সিন্ধু সভ্যতার বিনাশের জন্যে হয়তো বহিরাগত এই আর্যভাষীরাই দায়ী। ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ [আরিয়ান ইনভেইশন থিওরি] নামে এই তত্ত্বটি ঔপনিবেশিককালে পশ্চিমা চিন্তকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর রাজনৈতিক ব্যবহারও আমরা লক্ষ্য করি। ‘ভারতবাসীদের নিজস্ব কোনো ইতিহাস নেই, তারা চিরকাল শাসিত হয়েছে বহিরাগতদের দ্বারা — এবং এটিই তাঁদের ঐতিহাসিক নিয়তি’ — ইংরেজ উপনিবেশকে বৈধতা দিতে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের এ-জাতীয় অপব্যবহার এবং অপরাজনীতিকরণ হয়েছে [54]।

অলংকরণ: ‘আর্য’দের ভারত প্রবেশ। “They immigrated, rather than invaded”. উৎসঃ Hutchinson’s Story of the Nations (১৯১৫), (পৃষ্ঠা ১২৫)।

অলংকরণ: ভারতে ‘আর্য’দের বসতি স্থাপন। উৎসঃ Hutchinson’s Story of the Nations (১৯১৫), (পৃষ্ঠা ১২৬)।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ইতিহাসচর্চায় ‘মুক্তি’ আসে। কিন্তু আমরা দেখি যে, ঔপনিবেশিককালের গবেষণার সাথে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় মূলধারার ইতিহাসচর্চা প্রকরণগতভাবে ভিন্ন নয়। অর্থাৎ, এই দুই ধারার গবেষণাকর্মের মধ্যে ঘটনাপরম্পরার প্রামাণিক সত্যতা নিয়ে খুব বেশি বিরোধ নেই, যা আছে তা হচ্ছে ব্যাখ্যা-টীকা-ভাষ্যের। একই ঐতিহাসিক ঘটনা ঔপনিবেশিককালের গবেষকেরা ব্যাখ্যা করেছেন একভাবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় মূলধারার ইতিহাসবিদেরা ব্যাখ্যা করেছেন একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। একই ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা ইতিহাস এবং জ্ঞানচর্চার একটি স্বাভাবিক, সুস্থ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতাতেই ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ অর্থাৎ ‘আর্যভাষীরা মধ্য এশিয়া থেকে ভারত আক্রমণ করে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ঘটিয়ে এখানে রাতারাতি বসতি স্থাপন করেছে’ — এই ত্রুটিপূর্ণ ধারণাটি এখন বাতিল হয়ে গেছে; বেশ কিছু দশক ধরেই পশ্চিমে এবং পুবে মূলধারার কোনো ইতিহাসবিদই এ-তত্ত্বটি এখন আর গ্রহণ করেন না। তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে রাখা যে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বাতিল হয়েছে জাতীয়তাবাদীদের আপত্তির ফলে নয়, বরং ভাষাবিজ্ঞানী এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিজস্ব গবেষণার ফলে উদ্ভুত নতুন তথ্যের ভিত্তিতে [55]। বিজ্ঞানে অগ্রগতির এটি একটি স্বাভাবিক ধারা।

আমরা এখন জানি যে, স্তেপ্‌ আর্যভাষীরা বিদ্যুৎগতিতে খুনোখুনি করতে করতে ভারতে প্রবেশ করেনি (যেমনটি করেছিলো ভারতবর্ষে পরবর্তীতে-আসা অন্যান্য আক্রমণকারী গোত্রগুলো)। বরং, ভারতবর্ষে আর্যভাষী জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ছিলো মূলত অহিংস এবং ধীরগতির; তারা এসেছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে, ধারাবাহিকভবে, ধাপে ধাপে [56, 57]। তাই, ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ (আরিয়ান ইনভেইশন থিওরি) নয়, বরং ‘আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্ব’ (আরিয়ান মাইগ্রেশন থিওরি) এখন প্রকৃত ইতিহাসবিদের কাছে গৃহীত; আর পরের তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান, পুরাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, বংশগতিবিদ্যাসংক্রান্ত এবং সাহিত্যিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে [58]।

বর্তমানের ছাঁচে ফেলে অতীতকে নিরূপণ করা খুব বিভ্রান্তিকর, পিচ্ছিল, এবং বিপদজনক একটি ব্যাপার [59], তাই এ-প্রসঙ্গে আরো কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক আবর্জনা টেবিল থেকে সরানো জরুরি।

‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ নিয়ে এখনো অপরাজনীতি চলছে, তবে বিপরীত দিক থেকে। ভারতের একটি ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী গোত্র এখন এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে উচ্চকিত। স্বীকার করতেই হবে যে, এ-দাবিগুলো এসেছে পূর্বের ঔপনিবেশিক (এবং বর্ণবাদী) ধারণার প্রত্যুত্তরে, এবং পরবর্তীতে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারায়। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, যে তথাকথিত ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ এখন সর্বত্র বাতিল, তার বিরুদ্ধে উচ্চকিত প্রতিবাদের কারণ কি? যুক্তিবিদ্যার ভাষায়, এই ক্রিয়াটি কাকতাড়ুয়া যুক্তির [স্ট্র-ম্যান ফ্যালাসি] পর্যায়ে পড়ে; অর্থাৎ, খড়ের পুতুল বানিয়ে সেটির সাথে যুদ্ধ করার মতো নিরর্থক একটি ব্যাপার। আর্যদের ভারতে আগমন নিয়ে যে ‘বিতর্ক’ রয়েছে, সে বিতর্ক বিজেপিউত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ, ভারতের বাইরে খুব কম পণ্ডিতই এই বিতর্কে আগ্রহী; এবং বিতর্কটি যতোটা একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক, তার চেয়েও অনেক বেশি রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী। আমরা জানি যে, রাজনীতির বাইরে কিছু নেই, তবে বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ধারে ‘রাজনীতি’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ যতো দূরে ঠেলে দেয়া যায়, ততোই পৌঁছানো যায় নির্মোহ সত্যের কাছাকাছি। ভারতের বর্তমান ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী ধারায় আর্যদের নিয়ে প্রবর্তিত তত্ত্বগুলো অনেক নাম রয়েছে, যেমন ‘আর্য-স্বাদেশিকতাবাদ’ বা ‘স্বদেশীয় আর্যতত্ত্ব’ বা ‘ভারত থেকে অভিপ্রয়াণ তত্ত্ব’। মূলধারার গবেষকদের কাছে এই কষ্টকল্পিত প্রকল্পগুলো হাস্যকর — এবং এতোটাই অপ্রাসঙ্গিক যে এ দাবিগুলো অপ্রমাণ করার আগ্রহও তাঁদের নেই।

কিন্তু ভারতের একশ্রেণীর (এমনকি শিক্ষিত) মানুষদের ভেতরে এই অপ্রমাণিত, অবৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে — আর্যভাষীরা ভারতীয় উপমহাদেশের আদি বাসিন্দা, এবং বৈদিক সংস্কৃতের জন্ম ভারতেই। তাঁদের দাবি হচ্ছে ভারত হলো ‘সভ্যতার আঁতুড়ঘর’, সিন্ধু সভ্যতা আসলে বৈদিক সভ্যতাই, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো উৎসারিত হয়েছে ভারত থেকেই, এবং পরবর্তীতে পারস্য হয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে। এই প্রতিটি বিশ্বাস ভ্রান্ত, অবৈজ্ঞানিক এবং মূলধারার গবেষকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত। ভারতে বর্তমানে যে ধারার রাজনীতি চলছে তার জন্যে অবশ্য এই জাতীয় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা জরুরি যে ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠীর প্রাচীন এবং পবিত্র জন্মভূমি ভারত [60]। তবে, এ-জাতীয় দাবির সাথে হিন্দু ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, হিন্দু ধর্ম দাবি করে না যে এই ভ্রান্ত দাবিগুলো বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে। এ-দাবিগুলোর পেছনে নেই বৈজ্ঞানিক চিন্তা-যুক্তি-প্রমাণ-প্রক্রিয়া, যা আছে তা হচ্ছে ‘আগে থেকে উপসংহারে পৌঁছে’ তারপর কষ্টকল্পিত তথ্য-যুক্তি দিয়ে তত্ত্বটিকে ‘বিপরীত দিক থেকে’ প্রমাণ করার অপচেষ্টা। এই পদ্ধতিকে আমরা বলি ‘ছদ্মবিজ্ঞান’, এবং প্রকৃত বিজ্ঞান এই পদ্ধতিতে কাজ করেনা। ইন্টারনেট অবশ্য এখন ছদ্মবিজ্ঞানেই ডুবে আছে, যে যা খুশি লিখছে ও প্রকাশ করছে, ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও মেতে উঠেছে এই মহাউৎসবে, এবং তারা সম্মিলিতভাবে প্রতারিত করে চলেছে অসচেতন, বিহবল পাঠককে [61]। ইন্টারনেট-ব্যবহারকারীদের এখন ‘তথ্য সাক্ষরতা’র [ইনফরমেশন লিটারেসি] দক্ষতা অর্জন করা জরুরি হয়ে পড়েছে— এর অনুপস্থিতিতে ছদ্মবিজ্ঞান এবং অপবিশ্বাস আমাদের প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করে চলেছে। শিক্ষিত মাত্রই যে ইনফরমেশন লিটারেট, তা নয়; একরাশ তথ্যের ভেতর থেকে কীভাবে গ্রহণযোগ্য এবং অগ্রহণযোগ্য তথ্য আলাদা করতে হবে, সেই দক্ষতা আমাদের অধিকাংশেরই নেই।

জিনভিত্তিক পুরাবংশগতিবিদ্যা
আর্যভাষীরা যে বাইরে থেকে ভারতে অভিপ্রয়াণ করেছিলো তার পক্ষে তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞান থেকে কিছু তথ্য ইতোমধ্যেই তুলে ধরেছি, তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আমরা পাই জিনভিত্তিক পুরাবংশগতিবিদ্যায় (আর্কিওজেনেটিক্স) [62, 63]। আমরা জানি যে, ব্যক্তি মানুষ মারা যায়, এমনকি জনগোষ্ঠীও হারিয়ে যায়, কিন্তু জিন এক অর্থে ‘অমর’, সে রেখে যায় তার প্রত্ন-ইতিহাস, যা থেকে আমরা অতীতকে পুননির্মাণ করতে পারি। বিগত কয়েক দশকে জিনভিত্তিক পুরাবংশগতিবিদ্যাতে ঘটেছে অভাবনীয় অগ্রগতি, এখন জিন বিশ্লেষণ করা বলা সম্ভব একটি জনগোষ্ঠী কোথা থেকে এসেছে, এবং কালের স্রোতে ভেসে সে কোন কোন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছে। এই ধারায়, ২০০৯ সালে, ভারতবর্ষের ২৫ টি ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ওপর জিনভিত্তিক সমীক্ষা চালিয়ে বিশেষজ্ঞরা একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছান: হাজার হাজার বছর পূর্বে আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে থিতু হওয়া জনগোষ্ঠীগুলো থেকে শুরু করে, বর্তমান কাল অবধি যারা ভারতে বাস করছেন, তাদের মধ্যে, মোটাদাগে, দুইটি প্রধান জিনগত ধারা প্রবহমান। একটি হচ্ছে ‘উত্তর ভারতীয় জিন’, আরেকটি হচ্ছে ‘দক্ষিণ ভারতীয় জিন’ [64]। ২০১৩ সালে, এ-জাতীয় সমীক্ষা আবার করা হয় ভারতে বসবাসরত ৭৩ টি ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ওপর, এবং বিশেষজ্ঞরা মোটাদাগে একই উপসংহারে পৌঁছান [65]। এই দুই গবেষণা, এবং পরবর্তীতে আরো সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে — আজ আমরা যারা ভারতে বসবাস করছি, তারা মূলত এই দুইটি জিনধারার বিচিত্র মিশ্রন।

২০১৯ সালে, প্রখ্যাত সায়েন্স জার্নালে, জিনতত্ত্ববিদ ভাগিশ নরসিমহান (এবং তাঁর সাথের আরো ৮০ জন গবেষক) একটি সাড়া জাগানো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন [66, 67]। মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে, প্রায় ৮০০০ বছরের ব্যাপ্তিতে বসবাসকারী, ৫২৩ জন প্রাচীন মানুষের জিন বিশ্লেষণ করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তগুলোতে পৌঁছান:

• উত্তর ভারতীয় জিনের বাহকদের আদি উৎস ভারতে নয়, বরং ইউরেশিয়ার স্তেপ্‌ অঞ্চলে
• উত্তর ভারতীয় জিন ভারতের প্রাচীনতম স্রোত নয়, এটি দক্ষিণ ভারতীয় জিনের তুলনায় নতুনতর, অর্থাৎ এটি অনেক পরে এ-অঞ্চলে ঢুকেছে।
• ভাষার ভৌগোলিক বিস্তৃতি [জিওগ্রাফিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশন] থেকে এটি নিশ্চিত যে উত্তর ভারতীয় জিনের বাহকেরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী ছিলো। পক্ষান্তরে, দক্ষিণ ভারতীয় জিনের দেখা পাই প্রধানত ভারতের দ্রাবিড়-ভাষাভাষী অঞ্চলে।
• ভারতবর্ষের বাইরে দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের আদি-অস্তিত্ব পাওয়া যায় না — অর্থাৎ, এই ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্তন ভারতবর্ষেই।
• আজকের অধিকাংশ ভারতীয়রা আর্য, দ্রাবিড় এবং অন্যান্য ভাষিক গোষ্ঠীর মিশ্রণ।

 

 

ইউরেশিয়ার স্তেপ্‌ অঞ্চল থেকে আর্যভাষী ইয়ামনায়া জনগোষ্ঠীর অভিপ্রয়াণের গতিপ্রকৃতি এবং সময়কাল। মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে, প্রায় ৮০০০ বছরের ব্যাপ্তিতে বসবাসকারী, ৫২৩ জন প্রাচীন মানুষের জিন বিশ্লেষণ করে এই ম্যাপগুলো তৈরি করা হয়েছে। ভারতে প্রবেশের সময়কাল বৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত। উৎসঃ নরসিমহান ও অন্যান্য, ২০১৯ (66)।

নরসিমহান ও অন্যান্যরা আরো দেখান, ভারতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের ‘উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন (বিশেষত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ব্রাহ্মণেরা), তাঁদের মধ্যে স্তেপ্‌-উদ্ভুত উত্তর ভারতীয় জিনের অনুপাত তুলনামূলকভাবে বেশি — কেউ কেউ হয়তো এই তথ্যে তৃপ্তি বোধ করবেন। কিন্তু, যে তথ্য তাঁদের কাছে সুখকর না-ও মনে হতে পারে, সেটি হচ্ছে — এই স্তেপ্‌-উদ্ভুত উত্তর ভারতীয় জিন এসেছে প্রধানত পুরুষদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, যে আর্যভাষী গোত্রগুলো, ইউরেশিয়ার স্তেপ্‌ অঞ্চল থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিলো, তারা অধিকাংশই ছিলো পুরুষ (পশুচারণকারী সমাজে পুরুষই প্রধান), নারীদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম, ঋগ্বেদে তাই দেবতাদেরই প্রাধান্য। তবে এই নতুন অভিবাসীরা ভারতে থিতু হয়ে এখানকারই অনার্য-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর নারীদের সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছিলো। এমন উদাহরণ পাই স্বয়ং মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের জীবনে, যিনি বেদ সংকলিত করে আজকের রূপ দিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। বেদব্যাসের পিতা ছিলেন পরাশর মুনি — যিনি আর্যভাষী বলে অনুমান করছি; কিন্তু, কৌতূহলউদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, বেদব্যাসের মা ছিলেন মৎস্যগন্ধা সত্যবতী — একজন ধীবরকন্যা, এবং সকল বিচারে, অনার্য। আর্য-অনার্যের এই প্রতীকী (এবং ঐতিহাসিক) মিলন আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। ‘বিশুদ্ধ আর্য’ বলতে যেমন কিছু নেই [68], তেমনি বিশুদ্ধ ‘উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ’ বলতেও কোনো কিছু নেই [69, 70, 71, 72] — যাঁরা এখনো এ-জাতীয় দাবি করেন তাঁরা পেয়ালায় ঢেলে পরিবেশন করছেন অজ্ঞতা ও জাতিভেদের ক্ষতিকর মিশ্রণ।

আমরা কতোটুকু ‘মিশ্র’ তা এই উপাত্ত দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। এখানে, নীল — ইরানীয়, কমলা — স্তেপ্, হলুদ — আন্দামানীয়, গোলাপি — হান (চৈনিক) বংশপরম্পরা নির্দেশ করছে। এই উপাত্ত আরেকবার প্রমাণ করে যে ভারতবর্ষে বসবাসরত প্রায় প্রতিটি ইন্দো-ইউরোপীয় এবং দ্রাবিড় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে স্তেপ্‌-উদ্ভুত উত্তর ভারতীয় জিন, যার বাহকেরা খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দের দিকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করা শুরু করে। তবে, দ্রাবিড়দের তুলনায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্তেপ্‌-উদ্ভুত জিনের অনুপাত তুলনামুলকভাবে বেশি। উৎসঃ লাজারিডিস ও অন্যান্য, ২০১৬ [72]।
আমরা এখন নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, বর্তমানকালে ভারতবর্ষে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলো মূলত উত্তর ভারতীয় জিন, এবং দক্ষিণ ভারতীয় জিনের সংমিশ্রণ; কিন্তু এখানকার জাতিগুলোর মধ্যে এই দুইটি জিনের মিশ্রণের অনুপাত সুষম নয়। উত্তর ভারতীয় জিনের আধিপত্য দেখা গেছে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, কিন্তু যতোই আমরা ভারতের দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে এগোই, ততোই এর আধিপত্য কমতে থাকে, এবং তথাকথিত ‘অনার্যপ্রধান’ দক্ষিণ ভারতীয় জিনের অনুপাত বাড়তে থাকে। এই তথ্যটি আমাদের জানায় যে ধর্মশাস্ত্রগুলোতে ‘আর্যাবর্ত’ বলে যে ভৌগোলিক বলয়টির কথা বলা হয়েছে সেটি খুব সম্ভবত সত্যাশ্রিত। প্রাথমিকভাবে আর্যভাষী গোত্রগুলো আর্যাবর্তের ভেতরেই থাকার চেষ্টা করেছিলো, এবং পরবর্তীতে বলয়টি আরো সম্প্রসারিত করেছিলো। তবে বাংলা-অঞ্চল কোনো কালেই আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। কিন্তু আজ, অবাধ যোগাযোগের কালে, এই আর্য-অনার্য বিভাজনগুলো অর্থপূর্ণ কোনো কিছু নির্দেশ করে না। কালের স্রোতে, আমরা ভারতবর্ষের মানুষেরা, এখন প্রকৃত অর্থেই একটি ‘মিশ্র’ জাতি [73]। আমাদের মধ্যে জাত্যাভিমানের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, নেই বর্ণভিত্তিক বিবাহপ্রথার পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি। যা ইতোমধ্যেই মিশ্র হয়ে গেছে, তা ‘পরিশ্রুত’ রাখার প্রয়াস অর্থহীন (এবং কিছুটা বর্ণবাদী)।

একই বছর, নরসিমহান ও অন্যান্যরা আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল প্রকাশ করেন। হরিয়ানার রাখিগড়ি গ্রামে পাওয়া সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দাদের মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত জিন বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখান, সিন্ধুর বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো স্তেপ্‌ আদিপুরুষ নেই [74]; থাকার কথাও নয়, সিন্ধু সভ্যতার সাথে স্তেপ্‌ আর্যভাষীদের প্রায় কোনো সংযোগই ছিলো না। ইউরেশিয়ার স্তেপ্‌ অঞ্চল থেকে আর্যভাষীরা এসেছে সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পরে, অথবা একদম শেষের দিকে, এর আগে নয়। এই ফলাফলও আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্বের সত্যতা সমর্থন করে।

কেমন সময় লেগেছিলো স্তেপ্‌ অঞ্চল থেকে আসা আর্যভাষী গোত্রগুলোর উত্তর-পশ্চিম ভারতে থিতু হতে? জিনভিত্তিক পুরাবংশগতিবিদ্যা আমাদের তাও জানিয়ে দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ — মোটামুটি ৬০০ বছর ধরে আর্যভাষীদের এই প্রায়-অহিংস অভিপ্রয়াণ সম্পন্ন হয়েছিলো [75] (স্থানীয় অনার্য জনগোষ্ঠীর সাথে কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘাত ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু এটি উপেক্ষণীয়)। পূর্বে দেখেছি, স্তেপ্‌ অঞ্চল থেকে আর্যভাষী গোত্রগুলো যখন ভারতবর্ষে আসা শুরু করে, তখন সিন্ধু সভ্যতা প্রায়-অস্তমিত; বড়ো রকম সংঘাতের কোনো কারণ ছিলো না। ক্ষয়িষ্ণু সিন্ধু সভ্যতার যা-কিছু অবশিষ্ট ছিলো তা ‘সরিয়েই’ নবাগতরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। তবে এই সময়টি, এবং পরবর্তী হাজার বছর, ছিলো সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সময়; নিঃসন্দেহে আর্যভাষীরা নিয়ে এসেছিলো তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, কিন্তু তারা গ্রহণও করেছিলো ভারতের অনার্য সংস্কৃতির নানান উপাদান।

আজ হতে ৩৫০০ বছর পূর্বে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে, ভারতবর্ষে আসা আর্যভাষীদের হাতে সূচনা হয় যে যুগের, তাকে আমরা বলি বৈদিক যুগ — ইতিহাসে যার প্রভাব অসামান্য।

বৈদিক যুগঃ অভিনব আলো
হিন্দু শ্রুতিশাস্ত্রগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে বেদ (বেদ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘বিদ্’ ধাতু থেকে যার অর্থ হচ্ছে ‘বিদ্যা’ বা ‘জ্ঞান’)। ঋগ্বেদ, সামবেদ,যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ — এই চারটি বেদ হচ্ছে হিন্দু ধর্মের আদি উৎস। যেহেতু বেদের স্তোত্রগুলো আজো উচ্চারিত হয়, তাই ধরে নিতে পারি বেদ হচ্ছে প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ যা এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। বেদগুলোর কাঠামো ও বিন্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় এখন যাচ্ছি না, বরং আমরা আগ্রহী এই প্রশ্নগুলোতেঃ

• কারা বেদ রচনা করেছিলেন?
• ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতাগুলো কবে রচিত হয়েছিলো?
• ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতাগুলো কোথায় রচিত হয়েছিলো?
• চারটি বেদ সংকলন করা কবে নাগাদ সম্পন্ন হয়েছিলো?

প্রথম প্রশ্নের একটি সুস্পষ্ট উত্তরে আমরা ইতোমধ্যে পৌঁছেছি। খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের ভেতরে, ইউরেশীয় স্তেপ্‌ অঞ্চল হতে আর্যভাষীদের যে গোত্রগুলো ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অভিপ্রয়াণ করে বসতি স্থাপন করেন, তাঁরা এবং তাঁদের উত্তরপুরুষেরাই বেদের ‘রচয়িতা’। আরেকভাবে বলতে গেলে, এই আর্যভাষী জনগোষ্ঠীগুলোর ধ্যান, ভাবনা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির নাম বেদ।

আমাদের পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতাগুলো কবে রচিত হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে এখানে ‘রচিত হওয়া’ বলতে আমরা লিখিত রূপের কথা বলছি না, বলছি মুখে-মুখে রচনার কথা, কেনোনা, ঋগ্বেদের লিখিত রূপের দেখা আমরা পাই আরো বহু পরে [76] (এমনকি বুদ্ধেরও পরে)। আমরা জানতে চাই ঋগ্বেদ মৌখিকভাবে কবে নাগাদ রচিত হয়েছিলো।

আমরা জানি যে চারটি বেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রধান হচ্ছে ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদ সুবিশাল; যাঁরা এই ‘গ্রন্থের’ ভাষাতাত্ত্বিক, সামাজিক এবং সাহিত্যিক বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁরা দেখিয়েছেন যে পুরো ঋগ্বেদ একসাথে রচিত হয়নি, হওয়া সম্ভব নয় [77]। ঋগ্বেদের কিছু কিছু সংহিতা, অন্য সংহিতাগুলোর চেয়ে প্রাচীনতর; এবং অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতে, যে সংহিতাগুলো সর্বাধিক প্রাচীন সেগুলো রচিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দকে ঋগ্বেদের রচনার সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কয়েকটি কারণে:

• প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে আমরা জানি যে উত্তরপশ্চিম ভারতে লোহার ব্যবহার শুরু হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের ভেতরে। ঋগ্বেদে স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র সহ নানা ধাতুর উল্লেখ রয়েছে, লক্ষণীয়ভাবে যে ধাতুটির উল্লেখ নেই সেটি হচ্ছে লোহা। তাহলে ধরে নিতে হবে যে, ঋগ্বেদ রচিত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের পূর্বে। ঋগ্বেদ ব্রোঞ্জ যুগের রচনা, লৌহ যুগের নয় [78]।
• অথর্ববেদে আমরা লোহার উল্লেখ পাই। অধিকাংশ গবেষকদের মতে, অথর্ববেদ রচিত হয়েছে হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের ভেতরে।
• অথর্ববেদের সূচনা খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দে হলে, ঋগ্বেদের সূচনালগ্নের জন্যে আমাদের যেতে হবে আরেকটু পেছনে। ঋগ্বেদ অথর্ববেদের চেয়ে প্রাচীন, কিন্তু এটি মনে করার কোনো ভিত্তি নেই যে ঋগ্বেদের নতুনতম অংশ এবং অথর্ববেদের প্রাচীনতম অংশ রচনার মধ্যে সুদীর্ঘ কাল কেটে গেছে।
• অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে ঋগ্বেদের ‘রচনাকালের’ ব্যাপ্তি ‘কয়েকশো শতাব্দী’ — এর খুব বেশি বা কম নয়।
• ঋগ্বেদের অনুক্রমণিকা এবং স্তোত্রগুলোতে যে কবি এবং রাজাদের উল্লেখ রয়েছে তাদের ব্যাপ্তি হবে ৫ থেকে ৬ প্রজন্মের।
• একটি আর্যভাষী গোত্র ভারতে প্রবেশ করেনি, করেছিলো অনেকগুলো [79, 80] – এবং ঋগ্বেদ আমাদের জানায় যে তাদের মধ্যে সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিলো না। এই গোত্রগুলোর মধ্যে প্রথমে ভরত এবং পরে কুরুবংশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে [81, 82], এবং ধারণা করা হয় যে বেদ রচনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে এই দুই গোত্রের ভূমিকা ছিলো মুখ্য। তাঁদের ইতিহাসও আমাদের কালপঞ্জি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়।
• ঋগ্বেদে রচিত হয়েছে একটি বিশেষ প্রকার সংস্কৃতে, যাকে বৈদিক সংস্কৃত বা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বলা হয়। ককেশাস-অঞ্চলে উদ্ভুত মিত্তানি ভাষায় রেখে যাওয়া ইন্দো-আর্য কৃতঋণ শব্দগুলো বিশ্লেষণ করে ভাষাবিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে ঋগ্বেদের রচনাকালের সূচনা খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের পূর্বে নয়।
• ঋগ্বেদে রয়েছে বেশ কিছু অনার্য [83] (দ্রাবিড়, মুন্ডা ইত্যাদি) শব্দ, সেগুলোর উৎস বিশ্লেষণ করলেও খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকেই নির্দেশ করে।

উপরের তথ্যগুলো ব্যবহার করে ঋগ্বেদের যে সম্ভাব্য রচনাকালে আমরা এসে উপস্থিত হই তার ব্যাপ্তি হচ্ছে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ — অর্থাৎ, এই ৪০০ বছরের মধ্যে ঋগ্বেদ বর্তমান আকৃতি পেয়েছে। তবে, কেউ কেউ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ, এই ৫০০ বছরকে ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল হিসেবে ধরেন [84, 85]।

ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতাগুলো খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের দিকেই মৌখিকভাবে রচনা করা শুরু হয়েছিলো, এতে আমার সন্দেহ স্বল্প; এর সপক্ষে বেশ কিছু প্রমাণ আমরা দেখলাম। কিন্তু ঋগ্বেদে যে বোধ-বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, কামনা-বাসনা, এবং প্রার্থনা-উদ্বেগের দেখা আমরা পাই, তার জন্যে ৪০০ বছরও যথেষ্ট সময় নয়। বোধের উদ্ভবকাল এবং রচনাকাল এক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আর বাচনিক ঐতিহ্যের (অর‍্যাল ট্র্যাডশিন) অনুসারীরা ভবিষ্যতের গবেষকের জন্যে প্রেরণা আসার সাথে সাথে লিখিতরূপ রেখে দিয়ে যাবে, তা আশা করি না। স্মরণে রাখতে হবে যে বেদের স্তোত্রগুলো মুখে-মুখেই রচিত হতো এবং গুরুশিষ্য-পরম্পরায় উচ্চারিত হতো এবং বেদ, এখনো, এক প্রকার বাচনিক ঐতিহ্যই। বেদের স্তোত্রপাঠ শোনা অনেকটা কয়েক হাজার বছর আগের অডিও রেকর্ডিং শোনার মতোই একটি ব্যাপার [86] — কেনোনা এর বর্ণ, স্বর, ছন্দ, মাত্রা, ধ্বনি, ইত্যাদি ষড়বেদাঙ্গে বর্ণিত প্রকরণ অনুযায়ী অত্যন্ত যত্নের সাথে গুরু-শিষ‍্য পরম্পরায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে (এই কৃতিত্ব ব্রাহ্মণদেরই; তাঁরাই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থাগারিক এবং লেখ্যাগারিক — লাইব্রেরিয়ান এবং আর্কিভিস্ট)। বেদের স্তুতিকাব্যগুলো পাঠের যে সাহিত্যিক ঐতিহ্য, ছন্দের নিয়মকানুন,উচ্চারণের বিশেষ রীতি রয়েছে — এগুলো একদিনে বিকশিত হয়নি, এর উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে আর্যভাষীদের ইন্দো-ইরানীয়, অথবা হয়তো আরো আগে, ইন্দো-ইউরোপীয় পর্বে।

এক্ষেত্রে একটি সমান্তরাল উদাহরণ হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সর্বআদিনিদর্শন চর্যাপদকে নিয়ে আসতে চাই। চর্যাপদ রচিত হয়েছে মোটামুটি ১১০০ বছর আগে, এতে কোনো বিতর্ক নেই; কিন্তু চর্যাপদে প্রকাশিত বোধ-জ্ঞান-প্রজ্ঞা (যা বৌদ্ধ বজ্রযান-তন্ত্রযান-সহজযান পরম্পরার বিকশিত রূপ) আরো অন্তত কয়েকশো বছর আগে থেকে মৌখিকভাবে গুরুশিষ্য-পরম্পরায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। একই কারণে, বেদে প্রতিভাত বোধ-বিশ্বাসের বীজ [আইডিয়েশন] খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দের চেয়েও আরো বহু আগের বলে আমি মনে করি (বিশ্বাসীরা বলবেন অনাদি, চিরন্তন — তবে আমি সেই পথে যাচ্ছি না)।

সূচনাতেই স্বীকার করেছি, এই লেখার শিরোনাম (‘যারা বেদ এনেছিলো’) উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিকর; আমি এই শিরোনাম দিয়ে আমার পাঠককে কিছুটা প্রতারিত করেছি। কেউ গ্রন্থিত বেদ ভারতে সাথে করে ‘নিয়ে আসেনি’। সবগুলো বেদ মৌখিকভাবে রচিত হয়েছে ভারতের মাটিতেই — জাতীয়তাবাদীদের বেশি একটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু তাঁদের এটিও মেনে নিতে হবে যে বৈদিক সংস্কৃত একটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা, এই ভাষার উদ্ভব ভারতবর্ষে নয়, কিন্তু এটি এখন আমাদের সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত মূল্যবান অংশ, এবং অনেক অর্থে, উৎস-ও। যে আর্যভাষীরা বেদ রচনার কয়েকশো বছর পূর্বে ভারতে অভিপ্রয়াণ করেছিলেন, ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতায় আমরা পাই সেই আর্য সংস্কৃতির বোধ-উপলব্ধি-ভাবনা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ; কিন্তু পাশাপাশি, পরবর্তীকালের রচনায়, আমরা পাই বেশ কিছু অনার্য অনুষঙ্গ। মানুষের ইতিহাস এমন অভিপ্রয়াণ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়েরই ইতিহাস।

কোথায় রচিত হয়েছিলো ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতাগুলো? এর উত্তর পাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। স্তোত্রগুলোর মধ্যেই আমরা পাই ভৌগোলিক এলাকার বিবরণ এবং বিভিন্ন নদীর নাম। পশ্চিমে গান্ধার, অর্থাৎ, বর্তমান আফগানিস্তানের কুররাম নদী থেকে পূর্বে গঙ্গা নদী — এর বলয়ের ভেতরেই ঋগ্বেদের ক্ষেত্র। ভাষা এবং ধ্বনিপরিবর্তনের রূপ বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে যে ঋগ্বেদের প্রাচীনতম সংহিতাগুলো রচিত হয়েছে
আর্যভাষীরা যখন আফগানিস্তান অঞ্চল থেকে বৃহত্তর পাঞ্জাবে প্রবেশ করছিলো, তখন। তাছাড়া, ঋগ্বেদে পাওয়া কৃতঋণ শব্দগুলোর মধ্যে প্রায় ৩০০ টির উৎস বৃহত্তর পাঞ্জাব অঞ্চল [87, 88] (ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা থেকে নেয়া শব্দগুলো বাদ দিয়ে)। তাই দেখি, প্রাথমিকভাবে বৃহত্তর পাঞ্জাবই ছিলো বেদের কেন্দ্রভুমি, পরবর্তীতে অবশ্য তা কুরুক্ষেত্রে (বর্তমান হরিয়ানায়) সরে আসে।

চতুর্বেদ সংকলন করা কবে নাগাদ সম্পন্ন হয়েছিলো? অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে চারটি বেদ বর্তমান এবং সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করে খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের মাঝে [89], তাই মধ্যবর্তী প্রায়-১০০০ বছরকে আমরা বৈদিক যুগ বলি। চারটি বেদের প্রতিটির অন্তে (বা সর্বশেষ অংশে) রয়েছে বিভিন্ন উপনিষদ্‌; প্রথমদিকের সংহিতাগুলোতে যে ভাবনাগুলো অস্ফুট, এবং কিছুটা অবিকশিত অবস্থায় ছিলো, তারই পরিণত এবং দার্শনিক রূপ পাই এখানে। উপনিষদগুলো রচিত হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ, অর্থাৎ মোটামুটি ২০০ বছরের মধ্যে। বেদের ঋষিরা উপনিষদে যে নৈর্ব্যক্তিক, মহাজাগতিক, অতীন্দ্রিয় পরমসত্তার কথা বলেছেন তা দার্শনিক বিচারে উৎকৃষ্ট, এবং এগুলো শুধু হিন্দুধর্মেরই নয়, বিশ্বের জন্যে মূল্যবান সম্পদ।
উপনিষদগুলোর রচনা যখন প্রায় সমাপ্তির দিকে, মোটামুটি সেই সময়ে, খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দে, উত্তর ভারতের শাক্য গণরাজ্যের কপিলাবস্তু নগরীতে জন্মালেন সিদ্ধার্থ গৌতম — পরবর্তীতে যিনি হয়ে উঠবেন বেদের সবচেয়ে শাণিত সমালোচক। কিন্তু, সে আরেকদিনের গল্প!

Ollantaytambo

লেখক পরিচিতি
সুমন তুরহানঃ অন্বেষক। কাগুজে নামঃ হোসেন সালাহউদ্দিন। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলোজি সিডনিতে জ্যেষ্ঠ গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত। বইপত্র নিয়েই কেটে যায় জীবন। যোগাযোগঃ https://bit.ly/SumanTurhan

রচনাপঞ্জি

1.
দত্ত, রমেশচন্দ্র। (১৮৮৭)। ঋগ্বেদ সংহিতাঃ অষ্টম অষ্টক। বেঙ্গল গভর্নমেন্ট (পৃষ্ঠা ১৩২৬-২৭)। https://ia601608.us.archive.org/6/items/in.ernet.dli.2015.316210/2015.316210.Ashtam-Ashtak.pdf

2.
Vivekananda, Swami. (2019). The complete works of Swami Vivekananda (Vol 6). Discovery Publisher (p. 79). https://estudantedavedanta.net/Complete%20Works%20of%20Swami%20Vivekananda.pdf.

3.
Jamison, S. W. & Brereton, J. P. (2014). The Rigveda: The earliest religious poetry of India. Oxford University Press (pp. 1608-09). https://www.amazon.com/Rigveda-3-South-Asia-Research/dp/0199370184/

4.
লাহিড়ী, দুর্গাদাস। (১৯২০)। ঋগ্বেদ-সংহিতা। অক্ষয় লাইব্রেরি। https://ia801608.us.archive.org/8/items/in.ernet.dli.2015.337100/2015.337100.Pratham-Ashtak.pdf

5.
Kosambi, D. D. (1966). Ancient India: A history of its culture and civilization. Pantheon. https://archive.org/details/ancientindiahist0000kosa

6.
আহমেদ, বন্যা। (২০০৭)। বিবর্তনের পথ ধরে। অবসর। https://mm-cdn.azureedge.net/bnblog/wp-content/uploads/2017/04/বিবর্তনের%20পথ%20ধরে%20-%20বন্যা%20আহমেদ.pdf

7.
Harari, Y. N. (2015). Sapiens: A brief history of mankind. Vintage. https://www.amazon.com/Sapiens-Humankind-Yuval-Noah-Harari/dp/0062316095

8.
Dawkins, R. (2009). The greatest show on Earth: The evidence for evolution. Black Swan. https://www.amazon.com/Greatest-Show-Earth-Evidence-Evolution/dp/1416594795

9.
Sagan, C. (1980). Cosmos: A personal voyage. Random House. https://ia800401.us.archive.org/32/items/Cosmos-CarlSagan/cosmos-sagan.pdf

10.
আজাদ, হুমায়ুন। (১৯৯৭)। আমার অবিশ্বাস। আগামী প্রকাশনী।
11.
Bellwood, P. (Ed.). (2013). The global prehistory of human migration. Wiley Blackwell. https://www.amazon.com/Global-Prehistory-Human-Migration/dp/1118970594

12.
Petraglia, M. D., Haslam, M., Fuller, D. Q., Boivin, N., & Clarkson, C. (2010). Out of Africa: New hypotheses and evidence for the dispersal of Homo sapiens along the Indian Ocean rim. Annals of Human Biology, 37(3), 288–311. https://www.tandfonline.com/doi/pdf/10.3109/03014461003639249

13.
Dawkins, R. (1976). The selfish gene. Oxford University Press. https://ia902708.us.archive.org/11/items/pdfy-RHEZa8riPwBuUyrV/The%20Selfish%20Gene.pdf

14.
Blažek, V. (2006). Was there an Australian substratum in Dravidian?. Mother Tongue, 11(1), 275–294. https://www.academia.edu/44051940/Australian_Substratum_in_Dravidian_Mother_Tongue_XI_2006

15.
আজাদ, হুমায়ুন। (১৯৮৮)। তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান। আগামী প্রকাশনী।

16.
Thapar, R., Witzel, M. Menon, J. Friese, K. & Khan, R. (2019). Which of us are Aryans?: Rethinking the concept of our origins. Aleph Books. https://www.amazon.com/Which-are-Aryans-Romila-Thapar/dp/9388292383

17.
Singh, U. (2009). A history of ancient and early medieval India: From the Stone Age to the 12th century. Pearson. https://www.amazon.com/History-Ancient-Early-Medeival-India/dp/8131716775/

18.
Ratnagar, S. (2015). Understanding Harappa: Civilization in the greater Indus Valley. Columbia University Press. https://www.amazon.com/Understanding-Harappa-Civilization-Greater-Valley/dp/8185229600/

19.
Chakrabarti, D. K. (2006). The Oxford companion to Indian archaeology: The archaeological foundations of ancient India. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Oxford-Companion-Indian-Archaeology-Archaeological/dp/0195673425

20.
Parpola, A. (2015). The roots of Hinduism: The early Aryans and the Indus civilization. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Roots-Hinduism-Early-Aryans-Civilization/dp/0190226927/

21.
Avari, B. (2016). India: The ancient past: A history of the Indian subcontinent from c. 1700 BCE to CE 1200. Routledge. https://www.amazon.com/India-Ancient-Past-Burjor-Avari-dp-1138828211/dp/1138828211/

22.
Lal, B. B. (1974). The Indus civilization. In A. L. Basham (Ed.), A cultural history of India (pp. 11–19). Oxford University Press. https://archive.org/details/ACulturalHistoryOfIndiaA.LBasham

23.
Bryant, E. F. & Patton, L. L. (2005). The Indo-Aryan controversy: Evidence and inference in Indian history. Routledge. https://ia802909.us.archive.org/6/items/EdwinBryantLauriePattonIndoAryanControversyEvidenceAndInferenceInIndianHistoryRoutledge2005/Edwin%20Bryant%2C%20Laurie%20Patton-Indo-Aryan%20Controversy_%20Evidence%20and%20Inference%20in%20Indian%20History-Routledge%20%282005%29.pdf

24.
Maisels, C. K. (2001). Early civilizations of the old world: the formative histories of Egypt, the Levant, Mesopotamia, India and China. Routledge. https://www.amazon.com/Early-Civilizations-Old-World-Mesopotamia/dp/0415109760

25.
Possehl, G. L. (2002). The Indus civilization: A contemporary perspective. AltaMira Press. https://www.amazon.com/Indus-Civilization-Gregory-L-Possehl-dp-0759101728/dp/0759101728/

26.
Arvidsson, S. (2006). Aryan idols: Indo-European mythology as ideology and science. University of Chicago Press. https://www.amazon.com/Aryan-Idols-Indo-European-Mythology-Ideology/dp/0226028607/

27.
Sharma, R. S. (2007). India’s ancient past. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Indias-Ancient-Past-R-S-Sharma-dp-019568785X/dp/019568785X/

28.
Jha, D. N. (2009). Ancient India in historical outline: Revised and enlarged edition. Manohar. https://ia801209.us.archive.org/2/items/AncientIndiaInHistoricalOutlineByD.N.Jha/Ancient%20India%20in%20Historical%20Outline%20by%20D.N.Jha.pdf

29.
সেন, সুকুমার (১৯৯২)। ভারতীয়-আর্য সাহিত্যের ইতিহাস। ভারবি। https://ia801601.us.archive.org/11/items/in.ernet.dli.2015.266557/2015.266557.Bharatiya-arjya-Sahityer.pdf

30.
রায়, অশোক। (২০১৮)। মাতৃকাশক্তি। আনন্দ পাবলিশার্স।

31.
Kenoyer, J. M. (1998). Ancient cities of the Indus Valley civilization. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Ancient-Cities-Indus-Valley-Civilization/dp/0195779401

32.
Possehl, G. L. (1996). Mehrgarh. In Brian M. Fagan (Ed.), The Oxford Companion to Archaeology (pp. 436–438). Oxford University Press. https://archive.org/details/oxfordcompaniont0000unse_x4u7

33.
আজাদ, হুমায়ুন। (১৯৮৭)। কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী। আগামী প্রকাশনী।

34.
Pollock, S., Elman, B. A. & Chang, K. K. (2015). (Eds.). World philology. Harvard University Press. https://www.amazon.com/World-Philology-Sheldon-Pollock/dp/0674052862/

35.
আজাদ, হুমায়ুন। (১৯৮৮)। তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান। আগামী প্রকাশনী।

36.
Fortson, B. W. (2004). Indo-European language and culture: An introduction (2nd ed.). Blackwell. https://www.amazon.com/Indo-European-Language-Culture-Benjamin-Fortson/dp/1405188960

37.
Mallory, J. P. (1991). In search of the Indo-Europeans: Language, archaeology and myth. Thames and Hudson. https://www.amazon.com/Search-Indo-Europeans-J-P-Mallory/dp/0500276161

38.
Byrd, A. (2013). King and God. Archaeology. https://soundcloud.com/archaeologymag/king-and-god

39.
আজাদ, হুমায়ুন। (১৯৮৭)। কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী। আগামী প্রকাশনী।

40.
Bryant, E. F. & Patton, L. L. (2005). The Indo-Aryan controversy: Evidence and inference in Indian history. Routledge. https://ia802909.us.archive.org/6/items/EdwinBryantLauriePattonIndoAryanControversyEvidenceAndInferenceInIndianHistoryRoutledge2005/Edwin%20Bryant%2C%20Laurie%20Patton-Indo-Aryan%20Controversy_%20Evidence%20and%20Inference%20in%20Indian%20History-Routledge%20%282005%29.pdf

41.
Anthony, D. W. (2007). The horse, the wheel and language: How bronze-age riders from the Eurasian Steppes shaped the modern world. Princeton University Press. https://www.amazon.com/Horse-Wheel-Language-Bronze-Age-Eurasian/dp/069114818X

42.
de Barros Damgaard, P. et al. (2018). The first horse herders and the impact of early Bronze Age steppe expansions into Asia. Science, 360(6396), eaar7711. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6748862/pdf/EMS84309.pdf

43.
Witzel, Michael (2019). Beyond the flight of the falcon. In Thapar, Romila (ed.). Which of us are Aryans?: Rethinking the concept of our origins (pp. 1–29). Aleph Books. https://www.amazon.com/Which-are-Aryans-Romila-Thapar/dp/9388292383

44.
Parpola, A. (1995). The problem of the Aryans and the Soma: Textual-linguistic and archaeological evidence. In George Erdosy (Ed.) The Indo-Aryans of ancient South Asia: Language, material culture and ethnicity (pp. 353–381). Walter de Gruyter. https://www.amazon.com/Indo-Aryans-Ancient-Indian-Philology-Studies/dp/3110144476/

45.
Nyberg, H. (1995). The problem of the Aryans and the Soma: The botanical evidence. In George Erdosy (Ed.) The Indo-Aryans of ancient South Asia: Language, material culture and ethnicity (pp. 382–406). Walter de Gruyter. https://www.amazon.com/Indo-Aryans-Ancient-Indian-Philology-Studies/dp/3110144476/

46.
Mallory, J. P. & Adams, D. Q. (Eds.) (1997). Encyclopedia of Indo-European Culture. Fitzroy Dearborn. https://archive.org/details/EncyclopediaOfIndoEuropeanCulture/page/n351/mode/2up

47.
Mohan, P. (2021). Wanderers, Kings, Merchants: The Story of India Through Its Languages. Viking. https://www.amazon.com/Wanderers-Kings-Merchants-Peggy-Mohan/dp/0670093688/

48.
আজাদ, হুমায়ুন। (১৯৮৮)। তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান। আগামী প্রকাশনী।

49.
Figueira, D. M. (2002). Aryans, Jews, Brahmins: Theorizing authority through myths of identity. State University of New York Press. https://www.amazon.com/Aryans-Jews-Brahmins-Theorizing-Literature/dp/0791455327/

50.
Thapar, R. (2003). The Penguin history of early India: From the origins of AD 1300. Penguin. https://archive.org/details/HistoryOfEarlyIndiaFromTheOriginsToAD1300Thapar

51.
Burrow, T. (1974). The early Aryans. In A. L. Basham (Ed.), A cultural history of India (pp. 20–29). Oxford University Press. https://archive.org/details/ACulturalHistoryOfIndiaA.LBasham

52.
Witzel, M. (2001). Autochthonous Aryans? The evidence from Old Indian and Iranian texts. Electronic Journal of Vedic Studies, 7(3). 1–93. https://crossasia-journals.ub.uni-heidelberg.de/index.php/ejvs/article/viewFile/830/808

53.
Bryant, E. F. & Patton, L. L. (2005). The Indo-Aryan controversy: Evidence and inference in Indian history. Routledge. https://ia802909.us.archive.org/6/items/EdwinBryantLauriePattonIndoAryanControversyEvidenceAndInferenceInIndianHistoryRoutledge2005/Edwin%20Bryant%2C%20Laurie%20Patton-Indo-Aryan%20Controversy_%20Evidence%20and%20Inference%20in%20Indian%20History-Routledge%20%282005%29.pdf

54.
Trautmann, T. R. (1997). Aryans and British India. University of California Press. https://www.amazon.com/Aryans-British-India-Thomas-Trautmann/dp/0520205464/

55.
Witzel, M. (2001). Autochthonous Aryans? The evidence from Old Indian and Iranian texts. Electronic Journal of Vedic Studies, 7(3). 1–93. https://crossasia-journals.ub.uni-heidelberg.de/index.php/ejvs/article/viewFile/830/808

56.
Thapar, R. (2013). The past before us: Historical traditions of early north India. Harvard University Press. https://www.amazon.com/Past-Before-Us-Historical-Traditions/dp/0674725239

57.
Pllalamarri, A. (2019). Where Indians Come From, Part 2: Dravidians and Aryans: Who were the people who made up ancient India and where did they come from? The Diplomat. https://thediplomat.com/2019/01/where-indians-come-from-part-2-dravidians-and-aryans/

58.
Bryant, E. F. (2001). The quest for the origins of Vedic culture: The Indo-Aryan migration debate. Oxford University Press. https://archive.org/details/wg785

59.
Thapar, R. (2014). The past as present: Forging contemporary identities through history. Aleph Books. https://www.amazon.com/Past-Present-Forging-Contemporary-Identities/dp/9383064013

60.
Sen, A. (2005). The argumentative Indian: Writings on Indian history, culture and identity. Farrar, Straus and Giroux. https://archive.org/details/TheArgumentativeIndian_201805

61.
Daniyal, S. (2019). Two new genetic studies upheld Indo-Aryan migration. So why did Indian media report the opposite? The Scroll. https://scroll.in/article/936872/two-new-genetic-studies-upheld-aryan-migration-theory-so-why-did-indian-media-report-the-opposite

62.
Reich, D. (2018). Who we are and how we got here: Ancient DNA and the new science of the human past. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Who-Are-How-Got-Here-ebook/dp/B073NP8WT3/

63.
Joseph, T. (2017). How genetics is settling the Aryan migration debate. The Hindu. https://www.thehindu.com/sci-tech/science/how-genetics-is-settling-the-aryan-migration-debate/article19090301.ece

64.
Reich, D., Thangaraj, K., Patterson, N., Price, A.L., Singh, L., (2009). Reconstructing Indian population history. Nature, 461, 489–494. https://www.nature.com/articles/nature08365

65.
Moorjani, P., Thangaraj, K., Patterson, N., Lipson, M., Loh, P.-R., Govindaraj, P., Berger, B., Reich, D., & Singh, L. (2013). Genetic Evidence for Recent Population Mixture in India. The American Journal of Human Genetics, 93(3), 422–438. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3769933/pdf/main.pdf

66.
Narasimhan, et al. (2019a). The formation of human populations in South and Central Asia. Science, 365(6457), eaat7487. https://www.science.org/doi/10.1126/science.aat7487

67.
Joseph, T. (2019). New reports clearly confirm ‘Arya’ migration into India. The Hindu. https://www.thehindu.com/society/history-and-culture/theres-no-confusion-the-new-reports-clearly-confirm-arya-migration-into-india/article61986135.ece

68.
Figueira, D. M. (2002). Aryans, Jews, Brahmins: Theorizing authority through myths of identity. State University of New York Press. https://www.amazon.com/Aryans-Jews-Brahmins-Theorizing-Literature/dp/0791455327/

69.
Joseph, T. (2018). Early Indians: The story of our ancestors and where we came from. Juggernaut Books. https://www.amazon.com/Early-Indians-Story-Ancestors-Where/dp/938622898X

70.
Venkataramakrishnan, R. (2018). Who was here first? A new study explains the origins of ancient Indians. The Scroll. https://scroll.in/article/874102/aryan-migration-everything-you-need-to-know-about-the-new-study-on-indian-genetics

71.
Thapar, R., Witzel, M. Menon, J. Friese, K. & Khan, R. (2019). Which of us are Aryans?: Rethinking the concept of our origins. Aleph Books. https://www.amazon.com/Which-are-Aryans-Romila-Thapar/dp/9388292383

72.
Lazaridis, I. et. al. (2016). Genomic insights into the origin of farming in the ancient Near East. Nature, 536(7617), 419-424. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5003663/pdf/nihms-804247.pdf

73.
Doniger, W. (2009). The Hindus: An alternative history. Penguin. https://ia803001.us.archive.org/13/items/TheHindusAnAlternativeHistoryWendyDoniger_201402/The-Hindus-An-Alternative-History—Wendy-Doniger.pdf

74.
Narasimhan, et al. (2019b). An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers. Cell, 179(3), 729–735. https://doi.org/10.1016/j.cell.2019.08.048

75.
Reich, D. (2018). Who we are and how we got here: Ancient DNA and the new science of the human past. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Who-Are-How-Got-Here-ebook/dp/B073NP8WT3/

76.
Mallory, J. P. & Adams, D. Q. (2006). The Oxford Introduction to Proto-Indo-European and the Proto-Indo-European World. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Oxford-Introduction-Proto-Indo-European-World-Linguistics-dp-0199296685/dp/0199296685/

77.
Brereton, J. P. & Jamison, S. W. (2020). The Rigveda: A guide. Oxford University Press. https://www.amazon.com/Rigveda-Guides-Sacred-Texts/dp/0190633379

78.
Ibid.

79.
Thapar, R. (2013). The past before us: Historical traditions of early north India. Harvard University Press. https://www.amazon.com/Past-Before-Us-Historical-Traditions/dp/0674725239

80.
ঘোষাল, সৌরভ। (২০২১)। ঋগ্বেদের সময়কার ভারত। ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক । https://www.itihasadda.in/india-at-the-time-of-rigveda/

81.
Witzel, M. (1995). Early Sanskritization: Origin and development of the Kuru state. Electronic Journal of Vedic Studies, 1(4). 1–26. https://crossasia-journals.ub.uni-heidelberg.de/index.php/ejvs/article/viewFile/823/913

82.
Witzel, M. (1997). The development of the Vedic canon and its schools: The social and political milieu. In Michael Witzel (ed.), Inside the texts, beyond the texts: New approaches to the study of the Vedas (Harvard Oriental Series, Opera Minora, vol. 2, pp. 257–348). Harvard University Press. https://fid4sa-repository.ub.uni-heidelberg.de/110/1/VedicCanon_1997.pdf

83.
Southworth, F. C. (1979). Lexical evidence for early contacts between Indo-Aryan and Dravidian. In Madhab M. Deshpande & Peter E. Hook (Eds.), Aryan and non-Aryan in India (pp. 191–234). University of Michigan Press. https://library.oapen.org/bitstream/20.500.12657/41853/1/9780472901685.pdf

84.
Bryant, E. F. (2001). The quest for the origins of Vedic culture: The Indo-Aryan migration debate. Oxford University Press. https://archive.org/details/wg785

85.
Thapar, R. (2013). The past before us: Historical traditions of early north India. Harvard University Press. https://www.amazon.com/Past-Before-Us-Historical-Traditions/dp/0674725239

86.
Thapar, R., Witzel, M. Menon, J. Friese, K. & Khan, R. (2019). Which of us are Aryans?: Rethinking the concept of our origins. Aleph Books. https://www.amazon.com/Which-are-Aryans-Romila-Thapar/dp/9388292383

87.
Southworth, F. C. (1979). Lexical evidence for early contacts between Indo-Aryan and Dravidian. In Madhab M. Deshpande & Peter E. Hook (Eds.), Aryan and non-Aryan in India (pp. 191–234). University of Michigan Press. https://library.oapen.org/bitstream/20.500.12657/41853/1/9780472901685.pdf

88.
Witzel, Michael (2019). Beyond the flight of the falcon. In Thapar, Romila (ed.). Which of us are Aryans?: Rethinking the concept of our origins (pp. 1–29). Aleph Books. https://www.amazon.com/Which-are-Aryans-Romila-Thapar/dp/9388292383

89.
Ibid.

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31