শিকার

প্রকাশিত: ১২:৫৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৪, ২০২১

শিকার

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

অলংকরণ ঃ নার্গিস সোমা জাফর 

ক্যাম্পাসিংয়েই চাকরি নিশ্চিত হল অনুভবের।নামী বহুজাতিক সংস্থা।মাইনে শুরুতেই লাখ ছুঁইছুঁই। ম্যানেজমেন্টের শানিত বুদ্ধির ছেলে হিসাবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল সকলের কাছে।অনুভব খুশি।ওর মা ও বোন খুশি। বাড়িতে যেন বিসমিল্লার সুর।মা দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে এলো এক সকালে।বোন শপিং মলে কেনাকাটা করবে বলে লাফাচ্ছে।সব সময় দাদার কাছে আবদার।মা শুনে বকাবকি করলেও অনুভব বেশ মজাই পায়। বিয়ে হলে তো চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি।তাই ও সব সময় চেষ্টাই করে বোনের আবদার মেটাতে।আর একজনও খুব খুশি।হাতের উষ্ণ স্পর্শে সেকথা জানিয়েছে রিয়া।রিয়ার সাথে সম্পর্কটা অনেক বছরেরই। সেই কলেজ লাইফ থেকে।এখন রিয়াই ওর মুক্তি,ওর প্রশ্বাস যেন ! মেয়েটা বড়ো ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে অনুভবকে।দু বাড়ির সকলেই জানে। অনুভবের মা চান ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে। কিন্তু বোনের বিয়ে না দিয়ে অনুভব কিছুতেই বিয়ে করবে না।রিয়াকে বলেছে অনুভব। নিশ্চিন্তে সায় দিয়েছে রিয়া ওর কাঁধে মাথা রেখে। কানের কাছে ওর আবেগের ফিসফিস:”মনের মিলনই হলো আসল বিয়ে। সেটা তো আমাদের হয়ে গেছে কবেই”! ভরসা পেয়েছে অনুভব ওর কথা শুনে।কাছে টেনে নিয়েছে নিবিড় করে।
অফিসে কাজ পাগল ও।মেধা ও অনুমান ক্ষমতার মিলনে সাফল্যের এক নিশ্চিত প্যাকেজ যেন ও।তাই অফিস ওর ওপর নির্ভর করে খুব।যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরে ওর ডাক পড়বেই।ওর যুক্তি ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনে সকলে মন্ত্রমুগ্ধ তখন।ও আসার পর কোম্পানির সাফল্যের গ্রাফটা বেশ উর্দ্ধমুখী।তাই গ্রহণযোগ্যতায় ও কোম্পানির দু নম্বর ব্যক্তি। অনুভবের প্রোমোশন ছিল সময়ের অপেক্ষা।এক সকালে ওর হাতে প্রোমোশনের চিঠিও এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদের। ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পাশের সুসজ্জিত কেবিন হল ওর। কর্মীরা পার্টি দিল এক সন্ধ্যায়। এতো অল্প বয়সে এই সাফল্য তুলনাহীন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর খুব খুশি। প্রচন্ড সুন্দরী মহিলা ও অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী মোনা সিং। ডিভোর্সি।একাই থাকেন টালিগঞ্জের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। একমাত্র মেয়ে পড়াশোনা করছে বিদেশে ।খুব স্মার্ট।নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিস আসেন। অফিসের পুরুষ কর্মীরা ওনার রূপে পাগল । আড়ালে ডাকে ‘ মোনা ডার্লিং ‘বলে।
মোনাজীর প্রিয়মুখ অনুভব,অফিসের সকলের মতো অনুভবও জানে এটা। কিন্তু একটা বিষয়ে ইদানিং ওর খটকা লাগে খুব। কাজের চাপে ফাইল থেকে মুখ তুললেই প্রায়ই দেখে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন মোনাজী। তখন ওর চোখ ঠিক স্বাভাবিক লাগে না। অন্য কোন কথা যেন লুকিয়ে থাকে ও চোখে।অনুভব অতো পাত্তা দেয় না। নিজের কাজ নিয়েই সদা ব্যস্ত।মা,বোন ও রিয়াকে নিয়ে খুব সুখী ওর মনন,শীলন ও যাপন।
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই প্রাপ্তি জল থইথই কলকাতা। রাস্তাঘাট যেন আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে।ওর সাঁতরাগাছির বাড়িতে ফেরা মুশকিল। অন্যদিনের মতো আজ অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফেরা যাবে না। গাড়ি অনেক জায়গায় জলের তলায় চলে গেছে। চিন্তায় অনুভব। সমাধান বাতলে দিলেন মোনাজী নিজেই। অফিসের পাশেই বিদেশী অতিথিদের জন্য কোম্পানীর গেষ্ট হাউসে থেকে যেতে বললেন আজ রাতটা।কাল আবার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। বিদেশী কোম্পানির কাছে ওদের উৎপাদিত পণ্যের উপস্থাপন আছে।ভার অনুভবের ওপর।তাই কাল ফেরাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়লে চিন্তার।বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে অনুভব রাজী হয়ে গেল। বাড়িতে উদ্বিগ্ন মাকে ফোনে সব জানালো। মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল শুনে।
সেদিন প্রোজেক্টের কাজ করতে করতে অনেকটাই দেরী হয়ে গেল ওর। ফেরার তাড়া নেই।তাই মন দিয়ে কাজ করে চললো। কাজের ব্যাপারে ও সব সময় ‘পারফেকশানিষ্ট’।এটা অফিসও জানে।তাই ওকে দায়িত্ব দিয়ে কোম্পানি নিশ্চিন্ত। দেখলো পাশের কেবিনে মোনাজী বসে।কাজে ব্যস্ত।কালকে ওনারও কিছু কাজ আছে।বেয়ারার মুখে শুনলো, উনিও নাকি আজ গেষ্ট হাউসেই থাকবেন। টালিগঞ্জে আজ উনিও ফিরতে পারেন নি।কাজ মিটলে মোনাজী আর ও গেস্টহাউসে গেল। গেস্ট হাউস দেখে অনুভবের চোখ ছানাবড়া। একটা ছোটখাটো ফাইভ ষ্টার হোটেল যেন ।ডিনার সেরে অনুভব ওর ঘরে গেল। পাশের ঘরে রইলেন মোনাজী।
সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই অনুভবের। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। ঘড়িতে দেখল রাত একটা।এতোরাতে কে আবার? দরজা খুলেই চমকে গেল ও।লাল পাতলা নাইটিতে আগুন জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে মোনাজী। অনুভবের খটকা লাগলো। ওনার গায়ের পারফিউমের গন্ধ যেন ওর শরীরে আবেশ তৈরি করে চলেছে।অন্য জায়গায় একা ঘরে নাকি ওনার ঘুম আসছে না!অনুভব দেখল ওনার চোখ দুটো জ্বলছে কামনার আগুনে। শরীর যেন ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে পোষাকের অতি স্বচ্ছ জাল ভেদ করে। হঠাৎ অনুভবকে জড়িয়ে ধরলেন উনি।অনুভব সর্বশক্তি দিয়ে ছাড়াতে চাইছে। কিছুতেই পারছে না। একটা অজগর যেন শরীরের পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে ওকে গিলে খাবে বলে। বিছানায় অবশ হয়ে পড়ে অনুভব।শিকারী শিকারকে নিয়ে খেলা করে চলেছে।শুষে নিচ্ছে অনুভবের সব প্রাণ শক্তি। নিকষ কালো অন্ধকার ওকে গিলে গিলে খেল সারা রাত !
ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গলে দেখলো মোনাজীর নগ্ন শরীর ওকে জড়িয়ে। অনুভবের ভেতর থেকে একটা কান্নার দলা যেন বমির মতো বেড়িয়ে এলো। ছুটে গেল বাথরুমে।শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও।এই মুখ নিয়ে কি করে দাঁড়াবে রিয়ার সামনে? ওর মা ও বোনের সামনে? কান্নার নোনা জলে ঘষে ঘষে সারা শরীরের পাপের দাগ ধোয়ার চেষ্টা করতে লাগলো ও ।

dmukherjee557@gmail.com

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31