শিশুদের হৃদয় ও অনুভূতির ক্রমঃবিকাশ

প্রকাশিত: ৪:২৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০২১

শিশুদের হৃদয় ও অনুভূতির ক্রমঃবিকাশ

জাকির আজাদ

দেশ জাতি ও সমাজের ভবিষ্যতে শিশুদের পরিচালনা ও পরিচর্যা করতে হলে শিশু এবং তাদের মনের ও অনুভূতির অবস্থা চাহিদাও প্রকৃতির সর্ম্পকে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রতিটি অভিভাবকের প্রয়োজন। শিশুদের জীবনের কয়েকটি স্তর এবং অবস্থায় বিভক্ত রয়েছে। যেমন-স্কুল পূর্ব শিশু-৩-৫বছরের শিশুরা হচ্ছে স্কুল পূর্ব শিশু এই সময়ে তারা ৫ থেকে ৬টির শব্দের বাক্যে এবং তঃপরবর্তীতে ৬ থেকে ৭টি শব্দের বাক্য বলতে পারে। এ-বয়সের শিশুরা সাধারণত অনুকরণ প্রিয় হয় মাঝেমধ্যে নিজেই কিছু করে ফেলতে চায় অর্থাৎ ঞৎধরষ ধহফ ঊৎৎড়ৎ গবঃযড়ফ এর অনুশীলন রপ্ত করে। স্কুল পুর্ব শিশুরা ছুটাছুটি করতে পছন্দ করে। কিছু একটা করার আগ্রহ প্রবল হয়। পক্ষান্তরে পিতা-মাতা শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করতে চায় যে সময়টা হচ্ছে ছঁবংঃরড়হ অমব। তারা কিছু একটা করতে চায় আর অভিভাবকরা বাধা প্রদান করে। কিন্তুু এ থেকে বিরত থাকতে হবে অভিভাবকদের। তাদেরকে আতœর্নির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে। সাধারণত ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সীমিত বয়সের শিশুদের সময়কে বলা হয়ে থাকে খবঃঃবৎ ঈযরষফযড়ড়ফ বা শেষ বাল্যকাল। এসময়ে শিশুরা মাতা-পিতা কম গুরুত্ব দেয়। বন্ধু প্রিয় হয় ওঠে এবং এই সময়টাকে বলা হয়ে থাকে ঞযব ঢ়বধপশ ড়ভ ঃযব মধহমব অমব পারিপার্শ্বিকতার সাথে পরিচিতি করানো ও সম্যক ধারণা প্রদান করা যেমন- ফল,ফুল, পাখি-পশু পতাকা ও জাতি।এই প্রসঙ্গে কুমিল্লা ৫০০শয্যাবির্শিষ্ট আধুনিক হাসপাতালের শিশুবিভাগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোসলেহউদ্দিন আহমেদ বলেন-“এই সময়ে শিশুর জানার আগ্রহের মূল্যায়ন করতে হবে এবং তার হৃদয় ধারনক্ষমতা ও অনুভূতির দিকগুলি বিবেচনা করতে হবে। তাকে বুঝতে দিতে হবে তার হৃদয় ও অনুভূতির প্রতি অভিভাবকের সন্মান আছে।” তবে এই বয়সে শিশুদের কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে-(১) শারিরীক ক্রুটি-বিচ্যুুতি (২) বুদ্ধি ক্ষীণতা (৩) মানসিক দাবীর অপূর্ণতা (৪) সংশয়ের প্রভাব (৫) হৃদয় ও অনুভূতির প্রতি অসন্মান (৬) অভিভাবকদের বাড়াবাড়ি (৭) স্কুলের অতিমাত্রায় আদর যতœ (৮)স্বাধীনতা (৯) খেলাধুলা ও সামাজিক প্রভাব।

বিশিষ্ট শিশু গবেষক ও মনোবিজ্ঞানী শিশু মানসিক বিকাশকে চারটি স্তরে ভাগ করছেন-(ক) সেনসরি মোটর পিরিয়ড বা শৈশবকাল-০-২বছর (খ) প্রি-অপারেশনাল পিরিয়ড বা বাল্যকাল-২-৭বছর (গ) কংকিট অপারেশনাল পিরিয়ড বা কৈশোরকাল-৭-১১বছর (ঘ) ফরমাল অপারেশনাল পিরিয়ড বা বয়ঃসন্ধিকাল-১১-১৬বছর।

সেনসরি মোটর স্তরে সংবেদন সঞ্চালন ও সমন্বয়ের মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ আরম্ভ হয় শিশু ভাষা ও প্রতীকের ব্যবহার শেখে। প্রি-অপারেশনাল স্তরে শিশু আতœকেন্দ্রিক ও অনুকরণ প্রবল থাকে। তার কল্পনা শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অতীতের ঘটনা মনে রাখতে পারে। ফরমাল অপারেশনাল স্তরে শিশুর বৃদ্ধি পূর্ণতা লাভ করে। সে বিমূর্ত চিন্তা করতে পারে, যুক্তি তর্ক পছন্দ করে।

শিশুদের জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মধ্যে নিরাপত্তা চাহিদার অভাব হলে শিশুদের মধ্যে অস্থিরতা, দ্বন্ধ ও দুঃচিন্তা জন্ম নেয়। স্নেহ ভালাবাসার চাহিদার অভাবে শিশুর মধ্যে ঘৃণা, উদ্বেগ ও ভয় সঞ্চার হয়। এবং চরম অস্থিরতা থেকে অপরাধ প্রবণতা ও মানসিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। স্বীকৃতির চাহিদার অপ্রাপ্ততায় হতাশা, দুঃচিন্তা ও হীনমন্যতা প্রকাশ পায়। স্বাধীনতার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে শিশুরা বিদ্রোহী ও আক্রমনধর্মী আচরণ করা শুরু করে। প্রধানতঃ চাহিদাগুলি পুরন না হলে শিশুরা হৃদয় ও অনুভূতির দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কোন কোন সময়ে দৈহিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে।

ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় ‘দ্য বেবি ল্যাবে’ বিজ্ঞানীরা খুজে বের করছেন শিশুর মস্তিস্ক ঠিক কেমন করে কাজ করে এবং তাকে অনুভূতিশীল করে তোলে। বিজ্ঞানীরা বলছেন-শিশুরা নতুন কোনো জিনিষ দেখলে আগ্রহের সাথে তা দেখতে থাকে। তবে যখন জিনিষটি পরিচিত হয়ে ওঠে তখন তারা সে জিনিষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সেই জিনিষ তাদের দেখাতে থাকলে তারা বিরক্ত হয়। গবেষকরা তাদের পরীক্ষায় শিশুদের এ বিরক্তি দেখে বুঝতে পেরেছেন তারা নতুন কিছু শিখেছে কি-না। দ্য বেবি ল্যাবের পরিচালক ড. সিলভাইন সিউয়া বলছেন বাচ্চারা কিছু শিখলো কি-না তা পরীক্ষা করা হয় তাদের কাছে কোনো কিছু বিরক্তিকরা হয়ে ওঠে কি-না সেটা বুঝে। বাচ্চারা যখন কোনো কিছুতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং বিরক্ত হয় তখন তারা চিৎকার চেচাঁমেচি আরম্ভ করে। পাচঁ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মস্তিস্কের দুটি অংশ ট্রাইপোক্যাম্পাস এবং কট্রেক্স পরস্পরের সঙ্গে সঠিকভাবে যুক্ত থাকে। হিপোক্যাম্পাসের কাজ হচেছ শিশুদের নতুন শব্দ, গন্ধ এবং রঙের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া আর কর্টেক্সের কাজ হচেছ শিশুর দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিশক্তির বিকাশ ঘটানো। এবং তার অনুভূতির প্রবনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি) বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, “যান্ত্রিক বিনোদননির্ভর শহরে শিশুরা হয়ে ওঠছে মানবিক অনুভূতিশূণ্য, এটা শিশুর মানসিক বিকাশকে যন্ত্রের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। মানুষের বড় হওয়ার পথের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি ভোঁতা করে ফেলে। ফলে তৈরি হয় প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন মানুষ।”

শিশুদের চাহিদা পূরণ পূর্বক তাদের প্রকৃত মানুৃষ হিসাবে গড়ে দায়িত্ব পিতা-মাতা ও শিক্ষকদের তাই তাদের সচেতনতা হতে হবে- ক্সগৃহে ও বিদ্যালয়ে উন্নত পরিবেশ বজায় রাখাক্সশিশুর চাহিদাগুলি যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা।ক্সবিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কাজের ব্যবস্থা রাখা।ক্সগৃহে যে কোন রকমের কলহ পরিহার করা।ক্সশিশুর চাহিদা ক্ষমতা অনুযায়ী আনন্দদায়ক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।ক্সবিদ্যালয়ে শিশুর সব রকম প্রতিভার বিকাশের ব্যবস্থা থাকা।

শিশুদের সামাজিক করে গড়ে তোলার জন্য বাড়ির পরিবেশ এবং মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পারিবারিক শিষ্টাচার শিশুদের হৃদয়, অনুভূতি ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক। তাই শিশুদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ হতে হবে অনুকূল ,বুঝতে হবে শিশু হৃদয়,অন্যুভূতির প্রবাহতা যাতে আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশের ভেতর নিজেদের বিকাশ করতে পারে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31