সেলিনা হোসেনের হীরক জন্মজয়ন্তী

প্রকাশিত: ২:৩৭ অপরাহ্ণ, জুন ১৭, ২০২২

সেলিনা হোসেনের হীরক জন্মজয়ন্তী

কামরুল  হাসান

ছিয়াত্তর বছর বয়সে পা দিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, পূর্ণ হলো তাঁর জীবনের পঁচাত্তর বছর।

নিরন্তর লেখালেখি করে যে কয়েকজন কথাসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছেন সেলিনা হোসেন তাদের একজন। প্রিয় কন্যার আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক তাকে গভীর ব্যাথাতুর করেছে কিন্তু তাঁর কলমকে থামিয়ে দিতে পারেনি। সন্তানশোককে জয় করে তিনি এগিয়ে গেছেন পরবর্তী লেখার দিকে। গতকাল সারাদিন ধরেই তাঁর জন্মোৎসব পালিত হয়েছে। সকাল নয়টায় এসেছেন তাঁর প্রিয় কর্মস্থল বাংলা একাডেমিতে। সকাল দশটায় বাংলা একাডেমি তাঁর ৭৫তম জন্মবছর পেরিয়ে এসে ৭৬তম জন্মদিন পালন করেছে শুধু এইজন্য নয় যে সেলিনা হোসেন তাঁর কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই বাংলা একাডেমিতে কাটিয়েছেন, এ জন্যও শুধু নয় যে তিনি এখন বাংলা একাডেমির সভাপতি, বরং এজন্য যে তিনি আমাদের সাহিত্যের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব! হয়তো সবগুলো মিলিয়েই তাঁর প্রতি ওই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।

সেলিনা হোসেনের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫, ছোটোগল্পের বইয়ের সংখ্যা ১৩, শিশুকিশোর গ্রন্থ ২২টি, প্রবন্ধের বই ১০টি, সম্পাদনা করেছেন ১৩টি গ্রন্থ যার ভেতর শব্দকোষ, বিশ্বকোষও রয়েছে। সবমিলিয়ে তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ১০০ ছুঁই। ঔপন্যাসিক হিসেবে বেশি আলোচিত সেলিনা হোসেনের প্রথম গ্রন্থ উপন্যাস নয়, ছোটোগল্প। ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। এর দুবছর পরে প্রথম উপন্যাস ‘উত্তর সারথী’। ১৯৭৬ সালে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ প্রকাশিত হবার পর তিনি সমালোচকদের মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘মগ্ন চৈতন্যে শীস’, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ‘যাপিত জীবন’, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ সেলিনা হোসেনকে প্রতিষ্ঠিত করে কথাসাহিত্যের একেবারে সামনের কাতারে। তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর ভেতর ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৮৬), ‘কালকেতু ও ফুল্লরা (১৯৯২), ‘টানাপোড়েন’ (১৯৯৪)। তিনখণ্ডে প্রকাশিত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি বিশ্বসাহিত্যের বা রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত বাংলাভাষার প্রধান লেখকদের মতো স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেননি বরং দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখকদের মতো প্রচুর লিখেছেন। তিনি একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী লেখক। ‘বর্ণমালার গল্প’ ব্যতীত তাঁর কোনো কাব্য নেই, কিন্তু তার গ্রন্থসমূহের নামগুলো খুবই কাব্যিক।
১৪ই জুন সন্ধ্যা ছয়টায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে সেলিনা হোসেনের এক জমকালো জন্মোৎসব পালন করল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। ভাগ্যিস একটু আগেভাগেই পৌঁছেছিলাম, নইলে কানায় কানায় পূর্ণ হওয়া মিলনায়তনে আমাকে বসতে হতো এমন কোনো জায়গায় যেখান থেকে আমি ভালো করে ছবি তুলতে পারতাম না। মিলনায়তনের প্রবেশপথে চোখ আঁটকে যায় গাদা ফুলের পাপড়ি দিয়ে লেখা ৭৬, তাতে প্রজ্বলিত ৭৬টি মোমবাতি আর ৭৬ বছর বয়স হতে অনন্তকাল দেরী কিছু তন্বী রূপবতীর রূপ-লাবণ্যে। এমনিতেই তারা হলুদাভ ত্বকাভার, মোমের আলো সে ত্বকে, বিশেষ করে অবয়বে, সোনালী আলোর আভা ছড়িয়েছিল, তারা হয়ে উঠেছিল মর্ত্যের অপ্সরী। এমনি অনুষ্ঠানে আসা মানেই না-দেখা বা বিরলদর্শন কিছু মুখের দেখা পাওয়া আর এই মুখগুলো হলো কবি-সাহিত্যিকের। সেলিনা আপাকে দেখলাম সামনের সারিতে, তার সাথে ছবি তোলার একটা হিড়িক পড়েছে। মাটির মানুষ তিনি, কাউকেই ‘না’ বলেন না, প্রতিজন উৎসাহী ভক্তের সঙ্গে স্নিগ্ধমুখে পোজ দেন, মুখে লেগে তার সেই চিরপরিচিত মায়াভরা হাসি।
আমি ভাগ্যগুণে সমুখের সারির একেবারে
মধ্যিখানে একটা সিট পেয়ে গেলাম। এগুলো হলো হট সিট, ভিআইপি বা বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ এলে সিট ছেড়ে দিতে হয়। যারা মঞ্চে গিয়ে বসেন তারা ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে এসব সিট ব্যবহার করেন। আমার দুপাশে দুই বয়োজ্যেষ্ঠ বসেছেন। একপাশে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, অন্যপাশে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমান আজিজ। তাকিয়ে দেখি মঞ্চের নিচে সার বেঁধে রাখা হয়েছে অনেকগুলো পুষ্পস্তবক। বুঝলাম আজ শাহবাগের ফুলবাগান লুট হয়ে গেছে।
অনুষ্ঠান শুরু হলো মঞ্চের নিচে, পুষ্পস্তবকগুলো যেখানে রাখা হয়েছে, তার সমুখে রাখা চারকোণা নিচু টেবিলে রাখা মোটাসোটা এক মোমবাতি জ্বালিয়ে। বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি কামরুল ইসলাম ভীড় এড়াতে মোমবাতি জ্বালানোর জায়গায় তার আহবান করা অতিথিরাই কেবল যাবেন বলে বারকয়েক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, কিন্তু সেলিনা হোসেনকে মধ্যমণি করে যে ফটোসেশন হলো তার দুপাশের ডানা কেবল বিস্তৃত হলো, ফটোগ্রাফাররা যে পিছুবেন তারও জো রইল না। এরপর মঞ্চে আসনগ্রহণ। কামরুল ইসলাম যত বিশেষ অতিথি ডাকেন, মঞ্চের লম্বা টেবিলের ওপাশে তত চেয়ার নেই। ফলে চেয়ারসারিও টেবিল ছাড়িয়ে দুপাশে প্রজাপতির ডানা মেলে দিল। পর্যাপ্ত সংখ্যক চেয়ার আছে কি না – একজন দর্শকের এমনি উটকো প্রশ্নে বিরক্ত হলেন কামরুল ইসলাম, যাকে সবাই বঙ্গীয় কামরুল বলেই চেনেন। অসংখ্য অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সঞ্চালনা করা মানুষটি অত্যন্ত মঞ্চস্বচ্ছন্দ। ভরাট কণ্ঠস্বরে হলঘরটি ভরে তুললেন। মিলনায়তন উপচে পরা দেখে তিনি দেরিতে আসা শ্রোতৃবর্গকে অনুরোধ করলেন দোতলার ব্যালকনিতে গিয়ে বসতে। সিনেমা হলে ব্যালকনি প্রিয় হলেও মিলনায়তনের ব্যালকনি অজনপ্রিয়, ফলে ঠাসাঠাসি, ভিড়াভিড়ি ওই নিচতলাতেই।
অনুষ্ঠান শুরু হলো মাটির প্রদীপ হাতে শিল্পী রায়হানের নেতৃত্বে একদল শিল্পীর ঘূর্ণমান নাচ দিয়ে। ‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ রবীন্দ্র সংগীতের অনুপম সুরে তাদের নাচটি ছিল প্রাণভরানো। এরপরে ত্রিপুরা থেকে আগত শিল্পী পাঞ্চালী দেববর্মা গাইলেন একটি আদিবাসী গান। গাঢ় লাল ও হলুদ পোষাকে তাকে লাগছিল চাকমা মেয়েদের মতো উজ্জ্বল। মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের সময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তার কথামালা দিয়েই শুরু হলো অনুষ্ঠান। সেলিনা হোসেনের ব্যক্তিত্বের নানা দিক সংক্ষেপে উল্লেখ করে তিনি গান গাইলেন খানিকটা। বাদ্যযন্ত্র ছাড়া খালি গলায় সে গান অনুপম ফুটল শিল্পীর কণ্ঠের মাধুর্যে। গোলাম কুদ্দুছ মঞ্চে চলে যাবার পরে খালি সিটটিতে এসে বসেছেন প্রতিমার মতো সুন্দর কণ্ঠশিল্পী শামা রহমান। তাকিয়ে দেখি মঞ্চে কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, তাকে ঘিরে এই মহোৎসব দেখে অভিভূত, বিনয়ী মানুষটি হয়তো কিছুটা কুণ্ঠিতও, কিন্ত দীর্ঘ জীবনে এমন সন্ধ্যা আগে আর আসেনি ভেবে আনন্দিত ।
বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের হীরক জন্মজয়ন্তী পালনের উৎসবে। একে আমি মহোৎসবই বলব। একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য এ এক বিরাট প্রাপ্তি। আমাদের দেশের যে সংস্কৃতি জীবদ্দশায় ‘টু’ শব্দটি কেউ করবে না, মরে গেলে প্রশংসাবানে ভাসিয়ে দিবে- এই জন্মজয়ন্তীর বিপুল আয়োজন তার বিপরীত এবং আশার। মরোণত্তর সকল পুুরস্কার, স্বীকৃতি, অভিবাদন এক অর্থে ব্যর্থ কারণ যিনি এসবের লক্ষ্য তিনি এর কিছুই টের পান না। জীবদ্দশায় তিনি জেনে যান তিনি অবহেলিত, অপাঙক্তেয়, অস্বীকৃত। যেমন জেনেছিলেন শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, যেমন জেনেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাদের জীবনের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিলেন তারা নিজেরাই ওই অপরিমেয়, অসহনীয়, অবর্ণনীয় অবহেলাউদ্ভুত শোকে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রে অবশ্য এসব খাটে না। এদেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির পুুরস্কারগুলো তিনি পেয়েছেন। ১৯৮০ সালে, তাঁর লেখালেখির এক যুগ না পেরুতেই পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুুরস্কার; ২০০৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে, ২০১৮ সালে পান এদেশের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার। কেবল লেখালেখি নয়, সামাজিক আন্দোলনে তাঁর প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক ভূমিকা প্রশংসনীয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড- আমাদের জাতীয় জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই তাঁর লেখায় বিধৃত। বস্তুত মাটি ও মানুষের অত্যন্ত কাছাকাছি এই কথাসাহিত্যিক যিনি জীবনের শৈল্পিক রূপায়ন করেছেন চরিত্রগুলোকে ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে। তাঁর উপন্যাস ও ছোটোগল্প বাংলাদেশের জনজীবনের জীবন্ত দলিল।
অতিথিদের মাথার উপর দিয়ে দেয়ালে যে বৃহৎ পোস্টারটি শোভা পাচ্ছিল তাতে সেলিনা হোসেনের চিরপরিচিত স্নিগ্ধহাসিমাখা মুখের ছবিটি একটু ঝাপসা, বুঝি ছোটো ছবি থেকে বড়ো ছবি করতে গিয়ে ওই কাণ্ড ঘটেছে। সেলিনা হোসেন গঠনে গড়নে ছোটোখাটো একজন মানুষ, কিন্তু তাঁর প্রতিভা ও কর্ম বিপুল। দৈহিক গড়ন যে প্রতিভার কোনো পরিমাপক নয়- তিনি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিরন্তর গবেষণা ও লেখালেখি করে তিনি অনেক উঁচু মাথাকে ছাড়িয়ে গেছেন, হয়ে উঠেছেন আমাদের কালের এক মহীরুহ। তার কাজের পরিধি ও গভীরতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এত যে বিপুল সৃষ্টিশীল তাঁর কাজ, বিন্দুমাত্র অহঙ্কার নেই। দিল্লীতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে আমার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার। অত যার কীর্তি, তার কোনো অহঙ্কার নেই। যেসকল তরুণ কবি বা লেখক একটি বা দুটি গ্রন্থ প্রকাশ করেই হাওয়ায় চলাচল করেন, দর্পে যাদের পা মাটিতে পড়ে না, তাদের বলি সেলিনা হোসেনের পা ছুঁয়ে বিনয়ের শিক্ষা নিন। আজ, তিনি মঞ্চে ওঠার আগে, দেখছিলাম অনেক অনুজ কবি-লেখক-ভক্ত সেলিনা হোসেনের পা ছু্ঁয়ে সালাম করছেন। দেখে প্রসন্নবোধ করেছিলাম।
ব্যানারে সেলিনা হোসেনের নামের আগে লেখা ‘সাহিত্যমনীষী’। আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজক
বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ এই উপাধি অর্পণ করেছে। এই উপাধি যথার্থ। জন্মদিন পালন উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ প্রকাশ করেছে সেলিনা হোসেনকে উৎসর্গ করা কবিতা, প্রবন্ধ, আলোকচিত্র সম্বলিত একটি সংকলন যার নাম ‘সাহিত্যমনীষী সেলিনা হোসেন : উৎসর্গ অঞ্জলি।’ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করছিলেন রূপা চক্রবর্তী। তাকে তো এক নামেই সবাই চেনে, যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। এদের উপাধি লাগে না। কিন্তু বারংবার যখন বলা হয় অধ্যাপক ডক্টর, তখন কানে লাগে। অনুষ্ঠানেের একপর্যায়ে শামা রহমান গান গাইতে উঠে গেলে সে শূন্যস্থানে এসে বসেন ভাষাসৈনিক বিমল বসু স্বপন, অনুমান করি তাঁর বয়স আশি ছাড়িয়েছে। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন, পাশে তাঁর কন্যা। তাকে মঞ্চে আহবান করে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মানিত করা হলো।
মঞ্চের একপাশে সঙ্গীতশিল্পীর বসার অনুচ্চ আসন, সেখানে তবলাবাদক ও গিটারবাদকের স্থান ও মাইক্রোফোন নির্দিষ্ট। মঞ্চের উপর আরেক মঞ্চে বসে রবীন্দ্র সংগীতের সুরধারায় শ্রোতৃকূলকে ভেজালেন শামা রহমান- বিধাতা যাকে দুহাত মেলে কণ্ঠসুধা ও রূপপ্রভা দান করেছেন। গান যখন শুনি তখন ভাবি বক্তৃতার কী প্রয়োজন, বেশিরভাগ বক্তাই যখন সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকৃতি নিয়ে অভিজ্ঞানপ্রসূত নতুন কিছু বলতে পারছেন না। বেশিরভাগ আলো পড়ছে ব্যক্তি মানুষটির উপর, তাঁর সাথে বক্তার ব্যক্তিগত জানাশোনার উপর। সেলিনা হোসেনের জনপ্রিয়তার পেছনে, সর্বজনগৃহীত হবার পেছনে তাঁর অমায়িক ব্যবহার, সৌজন্যবোধ একটি ভূমিকা রেখেছে অনুমান করা কঠিন নয়। নারী ও প্রগতিশীল আন্দোলনে যারা সেলিনা হোসেনের ভূমিকা জানেন তারা নিঃসন্দেহে বলবেন মানুষটি কঠিনেকোমল। প্রগতির প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, মৌলবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে তিনি ইস্পাতকঠিন।
বক্তৃতা চল্ল, মাঝে ভক্তকূলের নৈবেদ্য প্রদান। ফুলের স্তবক নিয়ে একটি মিছিল যেন চলেছে মঞ্চে। মিছিলটি এত দীর্ঘ যে অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে যিনি রয়েছেন সেই বঙ্গীয় কামরুলকে এসে ভারসাম্য আনতে হলো। একটি-দুটি বক্তৃতা, অনেক পুষ্পার্ঘ অর্পণ- এই চল্ল অনেকক্ষণ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুল এনেছে, তাদের সদস্যরা ক্ষণিকের মঞ্চবিজয় আর কিংবদন্তির সাথে ছবি তোলার সৌভাগ্যলোভে সার বেঁধেছে মঞ্চে। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনের মঞ্চটি যে উপকরণ দিয়ে তৈরি তাতে তা ভাঙার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে আজ ভক্তকূলের পদভারে তা কম্পিত। অনেক সংগঠনের মাঝে কানে বাজল দুটি সংগঠনের নাম- ‘পরণকথা’ ও ‘বৃহস্পতির আড্ডা’। কবি ও কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমানের নেতৃত্বে ‘পরণকথা’ এবং কবি ও কথাসাহিত্যিক রোকেয়া ইসলামের নেতৃত্বে ‘বৃহস্পতির আড্ডা’ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে এলো। আমি যেতে পারতাম দুটো খণ্ড মিছিলের সাথেই, কেননা আমি দুটো সংগঠনের সাথে যুক্ত, কিন্তু আমি তো অপরের ছবি তুলেই ব্যস্ত, আমার সময় কোথায় মঞ্চে গিয়ে ছবি তোলার? তাও কি আর তুলতে পারি, সমুখে এসে দাঁড়ায় পেশাদার, অপেশাদার, সৌখিন ও খণ্ডকালীন চিত্রগ্রাহকরা, মাঝে মাঝে চেয়ার হারানোর আশঙ্কা সত্ত্বেও সমুখে গিয়ে ছবি তুলেছি; এক পর্যায়ে বঙ্গীয় কামরুলের অনুশাসন যখন ভেঙে পড়েছে, তখন সিংহাসনের মায়া পরিত্যাগ করে মঞ্চে উঠে ছবি তুলি। প্রায় তিনশ শিশু কিশোর সেলিনা হোসেনের অবয়ব এঁকেছে, আঁকা ছবি নিয়ে তারাও আসছে, মঞ্চে এক হুলস্থুল সমাবেশ। শৃঙ্খলা ফেরাতে বঙ্গীয় কামরুলের প্রচেষ্টা ছিল প্রাণান্তকর। ‘ফুল দিয়েই বিদায় হউন, কথা বলবেন না’ এই ছিল তার বারংবার বলা সতর্কীকরণ। তামা কথা রূপামুখে ফুটবে না বলে এ অংশে রূপা চক্রবর্তী নীরব রইলেন।
আলোচকদের মাঝে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার বক্তব্যেই সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের তত্ত্বীয় কাঠামোর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। তিনি একে বললেন মেটাফিকশন। মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজম পেরিয়ে এই শিল্পধারা এগিয়ে গেছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তৃতা শুনে মনে হলো তিনি হোমওয়ার্ক করে আসেননি, সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকর্ম নিয়ে তার জ্ঞান নেই। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, আজকের প্রধান অতিথি কে এম খালিদ কিন্তু হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। যেই লিখুক তিনি সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকর্ম নিয়ে যা কিছু বললেন তা ছিল প্রাসঙ্গিক। ‘সেলিনা হোসেন দেশ পেরিয়ে পুরো বিশ্বে সাহিত্য- সংস্কৃতি অঙ্গনে দেশের সম্পদ’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বললেন মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে তিনি যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তা অসামান্য। সেলিনা হোসেনের প্রগতিশীল ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মন্ত্রী বললেন, সেলিনা হোসেন আপোষহীন, অসাম্প্রদায়িক।
সেলিনা হোসেন, বিপুল সম্বর্ধনায় স্বভাবতই অভিভূত, মঞ্চের মাইকের সমুখে এসে বললেন তিনি কৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতা প্রথমত বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের কাছে যারা আয়োজনের বর্ণচ্ছটায় রাঙিয়েছেন; দ্বিতীয়ত আজ যারা এখানে এসেছেন তাকে সম্বর্ধনা দিতে সেই লেখক-কবি-পাঠককে। বয়স বেড়ে যাওয়া কোনো বিষয় নয়, পাঠকের ভালোবাসাই মূখ্য। তাঁর বক্তৃতায় মূখ্য হয়ে উঠল দেশভাবনা, শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতির হাত ধরে সৃজনশীলতার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক- এটা তার প্রত্যাশা। তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কথা বললেন, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পৌঁছে দেবার কথা বললেন। ইউনেস্কো যে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বমাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণকে বিশ্বনেতাদের মূল্যবান ভাষণ হিসেবে সংরক্ষিত করেছে তার উল্লেখ করে তিনি বললেন আমাদের অর্জন করতে হবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা।
বঙ্গীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের শাখা রয়েছে পৃথিবীর ১৪০টি দেশে- এমন কথা জানালেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক কবি কামরুল ইসলাম। ১৪০ দেশের ভেতর কেবল পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন অনুষ্ঠানে। মঞ্চে ছিলেন ত্রিপুরা শাখার সাধারণ সম্পাদক মনীষা পালচৌধুরী। আর এসেছিলেন নৃত্যশিল্পী অনন্তিকা চৌধুরী। অনন্তিকার একক নৃত্য ছিল শিল্পসুষমামণ্ডিত, নয়নাভিরাম। আমি ক্রমাগত ছবি তুলে যাই মর্ত্যের মঞ্চে এসে নাচা ওই স্বর্গলোকের মেনকার।
আজকের সভাপতি বর্ষিয়ান নাট্যনির্দেশক আতাউর রহমানের উপাধি ‘মঞ্চসারথী’। এ উপাধিও যথার্থ। তিনি বললেন, সেলিনা হোসেন তাঁর অনুজা, বয়সে ছোটো হলেও যিনি আশি পেরিয়ে একাশিতে পা দেওয়া আতাউর রহমানকে ছাড়িয়ে গেছেন প্রতিভা ও কর্মে। একাশিতেও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, সুন্দর নাট্যজগতের এই অন্যতম পুরোধাপুরুষ। তাঁর কথা থেকে জানলাম পৈতৃকসূত্রে সেলিনা হোসেনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার যে গ্রামে আতাউর রহমানের পৈতৃকভিটে সে গ্রাম থেকে দূরে নয়। পিতার কর্মসূত্রে সেলিনা হোসেনের জন্ম দেশবিভাগের বছরটিতে রাজশাহীতে, তাঁর শিক্ষাজীবন কাটে রাজশাহীতেই। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলা একাডেমিতে চাকরিসূত্রে বাকি জীবনটা তিনি ঢাকাতেই কাটাচ্ছেন।
সভাপতির বক্তৃতা শেষ মানে তো অনুষ্ঠান শেষ। কিন্তু না, ততক্ষণে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় অনুষ্ঠান। ওই যে তিনশত শিশু-কিশোর সেলিনা হোসেনের ছবি এঁকেছে তাদের পুুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠান। সৌখিন পাপারাজ্জিদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে ততক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছেন উৎসবের মধ্যমণি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31