স্মার্ট ভূমি পরিষেবা

প্রকাশিত: ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৪

স্মার্ট ভূমি পরিষেবা

রাজিয়া সুলতানা

স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১ প্রতিষ্ঠা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ রোডম্যাপের ৪টি পিলার যথাক্রমে- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট গভর্নেন্স অন্তর্ভুক্ত করে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভূমিসেবাকে সাধারণ মানুষের নিকট আরও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমিসেবাসমূহকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অন্যতম উদ্যোগ হলো ভূমি পরিষেবা অটোমেশন সিস্টেম প্রবর্তন। ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমি সংক্রান্ত সকল কাজে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা ইতোমধ্যে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চালু হয়েছে ই-মিউটেশন, অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর আদায় সিস্টেম, ডিজিটাল রেকর্ড রুম, ডাকযোগে খতিয়ান ও পর্চা প্রাপ্তি, ডিজিটাল সার্ভেয়িং এবং ম্যাপিং, অনলাইন জলমহাল ইজারা, ল্যান্ড জোনিং, অনলাইন শুনানি সিস্টেম, হটলাইন সেবা (১৬১২২) ইত্যাদি। এছাড়া অনেকগুলো ডাটাবেইজ সংবলিত ভূমি তথ্য ব্যাংক তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে হলো অধিগ্রহণ কেসের ডাটাবেজ, সকল সায়রাত মহালের ডাটাবেজ এবং সিভিল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে রাজস্ব সংক্রান্ত সকল মামলার ডাটাবেজ। ফলে এ সকল ডাটা দেখে সহজেই যেমন নির্ভুল নামজারি করা যাবে, অধিগ্রহণ কিংবা বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে সহজেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যাবে। এছাড়াও ই-রেজিস্ট্রেশন ও ডিজিটাল ভূমিসেবা সিস্টেমের আন্তঃসংযোগ, ডিজিটাল মৌজা ম্যাপের মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েব ভার্সন, দ্বিতীয় প্রজন্মের খতিয়ানের ধারাবাহিক চেইন/ট্রি সিস্টেম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমি-পিডিয়া তৈরি করা হয়েছে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ভূমি সম্মেলনে উদ্বোধন করেছেন।

সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ন এবং সেবা সহজিকরণে নতুন নতুন পরিপত্র জারি করা হয়েছে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম (HRMS) প্রবর্তন করা হয়েছে। এই HRMS বাস্তবায়িত হলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কর্মচারীগণের চাকরি জীবনের সকল তথ্য উপাত্ত অনলাইনের মাধ্যমে জানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের জবাবদিহির আওতায় এনে ভূমিসেবা ডিজিটাইজেশনের কার্যক্রমকে মনিটরিং-এর আওতায় আনা হয়েছে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান ডিজিটাইজেশন কার্যক্রম ও ভূমি আইন সম্পর্কে পারদর্শী করতে যথাযথ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নাগরিক ও অংশীজনদের ভূমিসেবা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং ভূমি সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য ভূমি বিষয়ক অনলাইন প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ভূমি ব্যবস্থাপনা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্তকরণের কার্যক্রম অব্যাহত আছে ।

বর্তমানে সাধারণ নাগরিকগণ ভূমি অফিসে না এসে অনলাইনে (www.land.gov.bd) নামজারির আবেদন, অনলাইনে সার্টিফায়েড পর্চা ও মৌজা ম্যাপের জন্য আবেদন করতে পারছেন এবং ঘরে বসেই খতিয়ান বা ম্যাপ পেয়ে যাচ্ছেন ও খাজনা দিতে পারছেন। যে কোনো ভূমিসেবা সম্পর্কে জানতে বা অভিযোগ জানাতে হটলাইনে (১৬১২২) কল করতে পারছেন। এমনকি ই-নামজারির আবেদনও ১৬১২২-এর মাধ্যমে গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কর ও অন্যান্য ফি অনলাইনে পরিশোধ করা যাচ্ছে এবং এসএমএস/ই-মেইলের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা তা জানতে পারছেন। নামজারির ফি অনলাইন পেমেন্টের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং যেমন- বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ডেবিট কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে পেমেন্ট করা যাচ্ছে। নাম জারির আবেদন নামঞ্জুর হলে মোবাইলের মাধ্যমে কারণ জানতে পারছেন। www.land.gov.bd তে প্রবেশ করে ই-নামজারি আইকনে ক্লিক করে আবেদনটি কোন অবস্থায় আছে তা ট্র্যাক করে সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে যোগাযোগ অথবা কোন অভিযোগ থাকলে কল সেন্টারে (১৬১২২) কল করতে পারছেন। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট অফিসে না গিয়েই অনলাইনে (www.eporcha.gov. bd) আবেদনের ভিত্তিতে ৯০/- (নব্বই) টাকা অনলাইন পেমেন্টের পর নাগরিকের বর্তমান ঠিকানায় অথবা জেলা প্রশাসকের ফ্রন্ট ডেস্কে অথবা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে অথবা ডাকযোগে সার্টিফায়েড খতিয়ানের কপি/মৌজা ম্যাপ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ।

ই-রেজিস্ট্রেশন ও ডিজিটাল ভূমিসেবা সিস্টেমের আন্তঃসংযোগের ফলে সাব-রেজিস্ট্রারগণের জমি রেজিস্ট্রেশনের পূর্বে ডিজিটাল রেকর্ডরুম সিস্টেম হতে জমির রেকর্ড অনলাইনে যাচাই করার সুযোগ রয়েছে । যুগপৎভাবে সহকারী কমিশনার(ভূমি)গণও রেজিস্ট্রেশনের সাথে-সাথেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন দলিল ও বিক্রীত জমির তথ্য ই-মিউটেশন সিস্টেমের মধ্যে পেয়ে যান যার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি কার্যক্রম শুরু হয়। সারাদেশব্যাপী ই-রেজিস্ট্রেশন-এর সাথে ই-মিউটেশনের সংযোগ স্থাপিত হলে মানুষের ভোগান্তি কমবে, রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ হতে থাকবে । এর ফলে মামলা মোকদ্দমা ও জাল-জালিয়াতির সুযোগও কমে আসবে।

খতিয়ান ও ম্যাপ সেবা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সেবা। একক প্লাটফর্ম থেকে সেবাটি প্রদান করার লক্ষ্যে ২০২০ সালে ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ডস (ই-পর্চা) সিস্টেম কার্যক্রম শুরু হয়। এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নাগরিকগণ খুব সহজেই অনলাইনে নিজের মালিকানাধীন জমির খতিয়ান, দাগ এবং ম্যাপ সম্পর্কিত তথ্য অনুসন্ধান করতে পারেন। পাশাপাশি খতিয়ান/ ম্যাপের সার্টিফায়েড কপির জন্য ঘরে বসে অনলাইনে আবেদনসহ আবেদনের ফি প্রদান করতে পারেন এবং কুরিয়ারের মাধ্যমে ঘরে বসেই আবেদনকৃত কপি সংগ্রহ করতে পারেন ।

সকল জরিপের ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ, এক খতিয়ানে সকল জরিপের হিস্ট্রি সংযোজন, স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করে প্রকৃত মালিকানা নির্ধারণ, জমি ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ এবং সর্বোপরি নাগরিকগণকে খতিয়ান ও ম্যাপ সংশ্লিষ্ট উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্যেই পর্চা সিস্টেমে খতিয়ান ট্রি বা চেইন সংযোজন করা হয়েছে। বর্তমানে এই সিস্টেমে খতিয়ান সেবায় নির্দিষ্ট খতিয়ানে সর্বশেষ জরিপের তথ্য প্রদর্শন করা হয়। ই-পর্চা সিস্টেমে খতিয়ান ট্রি বা চেইন সংযোজনের ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির একটি খতিয়ানে পূর্বের সকল ভাগবাটোয়ারা বা বণ্টনের তথ্য প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি কতবার ভাগ হয়েছে, কত জন নতুন মালিক যুক্ত হয়েছে, বর্তমানে কত অংশ অবশিষ্ট আছে, সর্বশেষ জরিপে কত অংশ নতুনভাবে নামজারি হয়েছে ইত্যাদি নানাবিধ তথ্য খতিয়ান ট্রি বা চেইন মডিউলের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়।

নামজারি করার সঙ্গে ম্যাপ ও খতিয়ান সংশোধন করা না হলে মূল সমস্যাটি থেকেই যায় । এ সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৩৮হাজার মৌজা ম্যাপকে ডিজিটাইজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে । আর ক্রয় করা হয়েছে বছরের দুটি সময়- গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমের স্যাটেলাইট ইমেজ । এই ম্যাপের উপরে স্যাটেলাইট ইমেজ বসিয়ে প্লটভিত্তিক জমির শ্রেণির একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ হাজারের ও বেশি ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এর ফলে নামজারির সাথে সাথে এই ডিজিটাল ম্যাপ ও খতিয়ানও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ হতে থাকবে । ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ অ্যাপ থেকে নাগরিকগণ তাদের জমির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, স্থানাঙ্ক তথা প্রকৃত অবস্থানও তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও ই-নামজারির সাথে সাথে জমির ধরন অনুযায়ী হোল্ডিং নম্বরসহ তাদের ভূমি উন্নয়ন করও নির্ধারিত হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ।

নাগরিকদের ভূমি তথ্যজ্ঞানে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ভূমি-পিডিয়া চালু করেছে । এই একক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হতে নাগরিকগণ ভূমি সম্পর্কিত সকল ধরনের আইনি তথ্য ও পরামর্শ পেতে সক্ষম হবেন। ভূমিসেবা প্রদানকারী ও ভূমিসেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে জ্ঞানের ব্যবধান কমিয়ে একটি শক্তিশালী ‘নলেজ নেটওয়ার্ক” স্থাপন করাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমি পিডিয়ার মূল উদ্দেশ্য । এই প্লাটফর্ম থেকে নাগরিকগণ কী-ওয়ার্ড ভয়েজ টাইপিংয়ের মাধ্যমে ভূমি সম্পর্কিত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর ও পরামর্শ পাবেন। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স যুক্ত চ্যাটবট সুবিধাও রয়েছে এতে। বিভিন্ন মাধ্যম হতে প্রতিনিয়ত জ্ঞান আহরণ করে এ সিস্টেম ধীরে ধীরে একজন ভার্চুয়াল অ্যাডভাইজারে পরিণত হবে। ভূমি পিডিয়ায় থাকবে ব্লগ ও ফোরাম সুবিধা, ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে একজন অন্যজনের নিকট হতে সমাধান খুঁজে নিতে পারবেন।

নাগরিকগণ যাতে কোনো ভূমি অফিসে না গিয়েই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে বেসরকারি পেশাদার এজেন্সির প্রশিক্ষিত সেবাপ্রদানকারীর উন্নত ভূমিসেবা পেতে সক্ষম হন সেই লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ভবিষ্যতে ভূমিসেবার পলিসি ৬০-৩০-১০ নীতি দ্বারা পরিচালনা হবে অর্থাৎ ভূমিসেবার ৬০% নাগরিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিজে নিজেই সেবা গ্রহণ করতে পারবে। ভূমিসেবার ৩০%-এর জন্য নাগরিকগণ নির্দিষ্ট ফি পরিশোধের মাধ্যমে কোনো পেশাদার এজেন্টের সাহায্য নিবেন। আর ১০% ভূমিসেবার ক্ষেত্রেই কেবল নাগরিকগণ ভূমি অফিসে যাবেন । এই ধারণাকে বিবেচনায় নিয়ে ঢাকার তেজগাঁওস্থ ভূমি ভবনে পরীক্ষামূলকভাবে একটি নাগরিক ভূমিসেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমি সংক্রান্ত সকল কাজ সম্পাদনার মাধ্যমে সীমানা বিরোধ, ভূমিদস্যুতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনাসহ বাড়িতে বসেই ভূমির অধিকাংশ সেবা নিশ্চিত করা অর্থাৎ ভূমি অফিসে কারো আসার প্রয়োজন হবে না সে ব্যবস্থা করা বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য ।
#